বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৯

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৯
শারমিন আক্তার বর্ষা

‘আমার সাজানো গোছানো প্লান টাকে নষ্ট করে দিলো এই মেয়েটা কে বলছিল ও-কে আবার ফিরে আসতে। ননসেন্স। এত কষ্ট করে মামুর থেকে দূরে সরিয়ে ছিলাম। চাইনি মামু জানতে পারুক রুহানির আসল পরিচয় তবুও সে জেনেই গেলো। ইয়াক।’

আলোহীন ঘরে কাঠের টেবিলের ওপরে শব্দ করে হাত রাখে আরিশ। তার হাতের শব্দে ভয়ত কেঁপে ওঠে তেজ, প্রবীর ও ওয়াসিফ। আরিশের কথাটি তাদের মাথায় ওপর দিয়ে উবে গেছে। ভ্রু কুঁচকে একে অপরের দিকে চাহনি ফেলল। ভ্রু কুটি একত্র করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল প্রবীর। শানিতকণ্ঠে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘এসবের মানে কি আরিশ? তুই আগে থেকে চিনতি রুহানি কে আর ও যে তোর মামুর মেয়ে সেটাও জানতিস?’
রাগে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নেয় আরিশ। শক্ত হাতে আরিশের হাত ধরে ফেলল তাজ। প্রবীরের উক্ত প্রশ্ন টি তাজ নিজেও করল। কেননা ওদের তিন জনের মনে একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। রুহানিকে বাড়িতে দেখে আরিশ এটা বুঝতে পারে ও’কে ইনফর্ম করেছে একমাত্র আমান। সে জন্য এখন এখানে আমান উপস্থিত নেই।

আরিশ রাগী গলায় বলল, ‘উঁহু না। তোদের মতো আমিও রুহানি কে ওইদিন প্রথম দেখি। নেহার জায়গায় যেদিন রুহানি কে ওরা তুলে এনেছিল। প্রথম বার মেয়ে টাকে দেখে মায়া লাগল। ইচ্ছে করল না মে-রে ফেলতে কিন্তু কি করার আমাদের সবার চেহারা দেখেছে বলে ও-কে যে মরতে হতই। তারপর তোরা ওর লাগেজ চেক করলি। কিছু কাগজপত্র সহ পাসপোর্ট আমার হাতে দিলি। পাসপোর্ট দেখে রুহানি কে চিনতে আমার বেশি সময় লাগেনি। পাসপোর্টে বাবা ও মা’র নাম উল্লেখ্য দেখে আমি বুঝে যাই। রুহানি আমার মামুর মেয়ে। তারপর আর কি ও-কে ওর গন্তব্যে পৌছে দিলাম। তারপর শিওর হওয়ার জন্য ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও শ্যামা মেয়েটার বিয়ে এটেন্ট করি। তখন ওর বান্ধবী কি জেনো নাম ওহ, হ্যাঁ রাইসার কাছে শুনলাম। রুহানি এদেশে ওর বাবাকে খুঁজতে আসছে।

তারপর প্লানিং করে, দুইয়ে দুইয়ে চার করি। এখন তীরে এসে তুরি ডুবার মতো অবস্থা হয়েছে। সব আমানের জন্য ও কল দিয়ে বলেছে বলেই রুহানি দেশে চলে আসছে। আল্লাহ জানে এবার মামু কিরকম রিয়াকশন করবে।’
হতবুদ্ধি চোখে তাকাই ওয়াসিফ। সে সন্দিহান কণ্ঠে বলল, ‘মানে তুই ইচ্ছে করে ইয়াসির আঙ্কেলের সাথে রুহানির দূরত্ব বাড়ানোর জন্য মিথ্যা বলেছিলি?’

আরিশ ফুস করে একটা শ্বাস ফেলল। টেবিলের ওপরে চড়ে বসে। আঁড়চোখে এক নজর ওদের দিকে তাকায়। শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলল, ‘হুম। ওইদিন রুহানি কে মামুর সাথে লেকে বসে থাকতে দেখেছিল জাফর। ও তখনই সাথে সাথে আমায় খবর দেয়। তখন আমি ও-কে বলেছিলাম দূর থেকে ছবি তুলে দিতে।’

বলতে বলতে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করল। গ্যালারি থেকে সেদিনের রুহানি ও ইয়াসিরের পাশাপাশি বসে থাকার ছবি বের করে ফোনটা ওদের দিকে বাড়িয়ে দেয়। অবাক চোখে ফোনের ছবিটা দেখছে। একে অপরের সাথে কথা বলে তাদের মধ্যে জেনো সতেজ ফিরে আসছে। মুখো প্রস্ফুটিত দুজনের হাসি বলে দিচ্ছে ওরাই পৃথিবীর সব থেকে খুশি মানুষ।

ছবির ওপর থেকে চোখ সরিয়ে আরিশের দিকে তাকাল। আরিশ ওষ্ঠদ্বয় জোড়া উল্টিয়ে চোখ বন্ধ করল। বাম হাতের শাহাদাত আঙুল দিয়ে কপাল খানিক কুঁচকে ফের বলল, ‘ওইদিন রাতেই বাড়ি ফিরে রুহানি কে আমাদের শত্রু বলে জানাই। এবং বলি কোনো ভাবেই জেনো ওর সাথে যোগাযোগ না করে। রাস্তা ঘাটে হঠাৎ দেখা হলেও জেনো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে চলে যায়।’

‘তাহলে রাজেশের লোকজন যখন ও-কে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তখন তুই ওমন বিচলিত হয়ে পরে ছিলিস কেন?’
‘তার কারণ হচ্ছে রুহানি ছিল আমার একমাত্র উত্তরাধিকারী। সেজন্য ও-কে বাঁচানো ছিল আমার মূল লক্ষ্য। ভেবেছিলাম ও-কে কোনো রকম এনিয়ে বিনিয়ে আবার কানাডা ব্যাক পাঠিয়ে দিবো। পরে ভাবলাম প্রেমের নাটক করি, বিয়ে করি তারপর সম্পত্তি মামু উনার মেয়ের নামে করে দিলে আমি রুহানির থেকে পেয়ে যাবো। কিন্তু কিছুদিন পর, হঠাৎ মামুর দরজার আড়াল থেকে শুনি, উনি উকিলের সাথে বলছেন, সকল সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিবেন। তো এমনি যখন সম্পত্তি আসছে যেখানে ও-কে বিয়ে করে ফায়দা নাই। তাই ও-কে চলে যাওয়ার জন্য তাগিদে দেই। এরমধ্যে মামু কিছু জানতে পারল না তার মেয়ে এসে উনার সামনে থেকে চলে গেছে।

তা বাদে কিছুদিন পর মামু জানালো তার প্রিয় বন্ধুর মেয়ের সাথে আমার বিয়ের কথা উনি পাকাপোক্ত করেছেন। আমি প্রথমত রাজি হইনি। বিয়ে, বউ এসব আমার কাছে নিতান্তই প্যাড়া। তবে খোঁজ নিয়ে দেখি বন্ধুর ও সম্পত্তির অভাব। তাই শুধু লাভে লাভে বিয়ে তে রাজি হলাম। কেননা বিয়ের পরই মামু সব সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিবে বলেছিল। আর বিয়ের পূর্বে ঝামেলা পাকালো রুহানি ফিরে এসে। এত কষ্ট মেহমত জলে গেলো। সেই মামু জেনেই গেলো ওই মেয়ে টাই উনার একমাত্র মেয়ে।

আমার বোকা মামু আসলে উনার কোনো দোষ নাই। দোষ তো সব ওই গার্ডদের যারা ও-কে ওমন নিষ্ঠুর ভাবে মারছে। আর গার্ডদের ও কোনো দোষ নেই। সব চাল তো আমার ছিল। আমি সন্দেহ করে ছিলাম এমন কিছু হতে পারে। আমানের ঘন্টার পর ঘন্টা নাজিনের প্রতি আসক্ততা দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল বৈকি ও দু’তিন জন গার্ডদের আমি আগে থেকে রুহানির ছবি দেখিয়ে জানিয়ে রাখি। যদি মেয়ে টা কে গেইটের বাহিরে দেখতে পাও তাহলে সে জেনো কোনো ভাবেই ভেতরে না আসে। আটকানোর জন্য যা করা দরকার করবা। রুহানি গেইটের সামনে আসার পরপরই একজন গার্ড কল দিয়ে বলেছিল, ও আসছে। তারপর ও-কে বাঁধা দেওয়ার জন্যই ও-র ওপরে আঘাত করা হয়েছিল৷ কিন্তু মেয়েটা এত দূরতর যে গার্ড দের চোখে ধুলো ছুঁড়ে বাড়ির ভেতর চলে আসে। আর রইলো আমার মামু উনি তো মেয়ে টাকে দেখলেই ইমোশনাল হয়ে পরেন।

বাড়ির ড্রয়িংরুমে রুহানির কণ্ঠস্বর শুনে আমি আমার হবু শশুর মশাইয়ের ফোনে মেসেজ পাঠাই। যেভাবেই হোক মেয়ে টা কে ভেতর থেকে বের করার ব্যবস্থা নেন। উনি ব্যর্থ হলেন। পারলেন না রুহানি কে বের করতে। কিন্তু আমার কথা মামুর বুকে তীরের মতো বেঁধে ছিল। যেটা মৈথির বাবা করতে পারে নাই। ওইটা মামু করল, গার্ডদের বলল, রুহানি কে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য। ভুল বশত মামু রুহানি কে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর রুহানি পা ফসকে ফ্লোরে পরে যায়। ফটো ক্যাপ্চারের মতো এই দৃশ্য মামির চোখে পরে যায়।

নিজের আদরের সন্তানের ওপর এই অমানবিক নির্যাতন তিনি সইতে পারেনি। শেষে মামুকে শাসিয়ে গেলো। যা একটু ভয় পেয়ে ছিলাম, মামি চলে আসছে। মামুর জীবন পরিপূর্ণ হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এগুলোর কিছুই হবে না। মামু মামির পায়ে ধরে মিনতি করলেও মামি মামুকে মাফ করবেন না। কেননা প্রসঙ্গ উনার আদরের মেয়ের। রুহানির মুখে আমি আগেও শুনেছি ও-কে ওর মা অর্থাৎ মামুনি অসম্ভব ভালোবাসে।

নিজের চতুর বুদ্ধির জন্য নিজের সব অপরাধের অপরাধী বানালাম রাজেশ কে। আমার সব দুই নাম্বারি কাজের অপরাধী ও-কে বানালাম। আমি জানতাম রাজেশ আমাকে মার*তে চায়৷ কারণ ওইদিন ক্লিয়ার হল। সা-লা ষ্টুপিড একটা। আমি আরিশ শাহ সাথে পাঙ্গা নিতে আসছিল। আমার জালে ও-কে ফাঁসিয়ে দিলাম। এখন আমার করা অপরাধের জন্য সে জেলে বসে শাস্তি পাবে। আমি ফ্রি আকাশে উড়বো। সব কিছুই ঠিক ছিল। এখন কি করি? মনে হচ্ছে নতুন কোনো প্লানিং করতে হবে। মামি ভুলেও জেনো মামুর প্রতি দূর্বল না হয়৷ এমন কিছু করতে হবে।’
‘এজন্যই তুই রুহানি কে তোর দাবার গুটি বলে অট্টহাসি তে মেতে উঠেছিলি?’
‘আর নয়তো কি? রুহানি মেহেক সারা ‘ও’ তো আমার ট্রাম্প কার্ড।’

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে রুহানি। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ইয়ানা। উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে রুহানির বন্ধু ওরা। কাঁদতে কাঁদতে গলা শুকিয়ে আসছে মাথা ঝিমঝিম করছে। ইমার্জেন্সি ডাক্তার এখনও ভালো মন্দ কিছু জানায়নি।
দ্রুত ওয়ার্ড রুম থেকে বের হল ইমার্জেন্সি ডাক্তার। ছুটে যেতে নিলে তাকে বাঁধা দেয় নিশান ও আদনান। ভেতরে রুহানির কথা জিজ্ঞেস করে, ডাক্তার কম্পিত কণ্ঠে বলল,

‘পেসেন্ট অবস্থা বেশি ভালো না। আমি এখানে কিছু করতে পারবো না। নার্স মাহফুজা বলল, উনি নাকি আমাদের অধ্যাপক ‘ডাক্তার শাফায়াত শীষ’ স্যার এইমাত্র হাসপাতালে আসছেন। আমি এখন উনাকেই নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুক। আল্লাহ জেনো শীষ স্যারের হাতে জয় দেন। আল্লাহর রহমত থাকলে ডাক্তার শীষ স্যার উনিই পারবেন আপনাদের পেসেন্ট কে সুস্থ করিতে।’

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ২৮

‘বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। কিছু কথা না বললেই নয়৷ অনেকে আছেন। ইয়াসির কে ভুল বুঝছেন। গল্পটা ভালো করে পড়লে আপনাদের বুঝতে ভুল হত না। গত পর্বে রুহানি কে যখন মা-রা হয়েছিল। তখন রুহানি গেইটের সামনে ছিল। গেইটের সামনে কাউকে মার-লে ইয়াসিরের বাড়ির ভেতর থেকে জানার কথা নয়। এবং বাড়ির ভেতরে যখন রুহানি প্রবেশ করে তখন রুহানি কে মা-রার আদেশ ইয়াসির দেয়নি। শুধু গার্ডদের বলেছিল, রুহানি কে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য। একটা অচেনা মেয়ে বিয়ের সময় এমন হড্ডগোল করলে তাকে অন্য রাও বের করে দিতো। এমনটা ইয়াসির বলেছিল। আমি ইয়াসিরের কোনো ভুল দেখছি না। রুহানি কে মারার জন্য আরিশের যার সাথে বিয়ে ঠিক হচ্ছিল তার বাবা মারতে এগিয়ে এসেছিল। ইয়াসির নয়। সে শুধু বলেছিল রুহানি কে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য। রুহানি পা ধরেছিল বলে, তার হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। দূর্বলতার কারণে, রুহানি ফ্লোরে পরে যায়। আশা করি এরপর ইয়াসির কে নিয়ে কেউ এমন মন্তব্য করবেন না। কালকের সকলের কমেন্ট আমি নোটিশ করেছি। এজন্যই এত গুলো কথা বলা। ধন্যবাদ। ভুলক্রটি ক্ষমাসূলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।’

বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব ৩০