বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ২৬

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ২৬
নিশাত জাহান নিশি

সেদিনের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা সামান্তা প্রথম থেকে শেষ অবধি তার বাবাকে খুলে বলল। বৃত্তান্ত শোনার পর মিজানুর রহমান স্তব্ধ হয়ে গেলেন। হয়রান না হয়ে পারলেননা তিনি। সাহিলের জেলে যাওয়া সম্পর্কে বিন্দু পরিমাণ অবগত ছিলেননা তিনি। সাহিলের পরিবার থেকেও এই সম্বন্ধে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি।

সামান্তা ও মিশালও এই ব্যাপারে মুখ খুলেনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই বিশাল ঘটনাটি তারা সবাই অবলীলায় চেপে গেছে। গম্ভীর দৃষ্টিতে মিজানুর রহমান বার কয়েক ভীত সামান্তার পানে তাকালেন তো কিছুক্ষণ ক্ষুব্ধ সাহিলের পানে। অতঃপর তিনি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তাদের তিনজনকে একসাথে বসিয়ে বিষয়টি এখানেই শেষ করতে চাইলেন। সকলের মধ্যকার মনোমালিন্য দূর করতে চাইলেন। রোজ রোজ দুই ভাইয়ের মধ্যে একই ঝামেলা দেখতে দেখতে তিনি বিরক্ত হয়ে গেছেন। তাৎক্ষণিক তিনি রুমকিকে পাঠিয়ে মিশাল ও জেসমিন বেগমকে ডেকে আনলেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিশাল এলো। তার মামার সামনে মাথা নুইয়ে দাড়ালো। আপাতদৃষ্টিতে সাহিলকে জেলে দিয়ে সে সবার চোখে অন্যায় করলেও ঘটনাক্রমে সে সঠিক কাজটিই করেছিল! সাহিল তাকে কম জ্বালায়নি। তাকে কম অপমান, অপদস্ত করেনি। ছোটো বড়ো কথা কম শুনায়নি। এর ফলস্বরূপ সাহিলের এটি প্রাপ্য ছিল। এইক্ষেত্রে তার কোনো অপরাধবোধ কিংবা আফসোস নেই। মিশালের দিকে প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিজানুর রহমান গলা ঝাঁকালেন। ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

“এসব কী শুনছি আমি মিশাল? সত্যিই কী তোর কারসাজিতে সাহিলকে জেলে যেতে হয়েছিল?”
মুখ খুলল মিশাল। তার মামার দিকে নির্ভীক দৃষ্টিতে তাকালো। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে অস্বীকার করলনা। নমনীয়তা ভুলে শক্তপোক্ত গলায় বলল,

“হ্যাঁ চাচা। আর এটাই তার প্রাপ্য ছিল! কারো মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে ফলো করাটা নিশ্চয়ই অন্যায়। এতে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। তবুও এই বিষয়টা আমি না হয় বাদই দিলাম। কাজিন, ফলো করতেই পারে। এতে আমার কোনো প্রবলেম থাকার কথাও নয়। কিন্তু রাগের বশে একটা অপরিচিত মেয়ের গাঁয়ে হাত তোলাটা তোমার কাছে কতোটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়?

যেখানে ঠান্ডা মাথায় বসে কথা বলে অসম্ভব কোনো বিষয়ও ইজিলি সম্ভব করা যায় সেখানে গাঁয়ে হাত তুলার প্রয়োজন হবে কেন? জায়গা বুঝে রাগ দেখাতে হয় এই বিষয়গুলো তার বুঝা উচিত। সেদিন তো কিছু ক্লিয়ার করার সামান্য সময়টুকুও দিলোনা সে আমাদের! বসে যে তার সাথে দু’দন্ড কথা বলব, কেন সামান্তা তাকে আমাদের মধ্যে জড়িয়েছিল বলব সেই সময়টিও দেয়নি আমাদের।

শুধু এইবার নয় প্রতিবারই সে তার কাজ দ্বারা বুঝিয়ে দেয় আমরা কাজিন হলেও আমাদের মধ্যে কোনো মিল নেই! কোনো বন্ডিং নেই আমাদের মধ্যে। আমরা সবাই একে অপরের শত্রু। একজন অন্যজনকে নখে তোলে মেরে ফেলার মতো শত্রু। আমাদের মধ্যে কখনও কিছু ঠিক হতে পারেনা। রেষারেষির সম্পর্ক আমাদের মধ্যে লেগেই থাকবে। সে যা জোর করে পেতে চায় তা আমার কাছে অনায়াসেই এসে ধরা দেয় বলে এতেই তার সমস্যা!

আমি এই সাহিলকে চিনতে পারিনা। জোরজবরদস্তি যার একসময় পছন্দ ছিলনা সে এখন জোর করেই সবকিছু পেতে চায়! তুমি জানো? তার সেদিনের একটু ভুলের জন্য আমরা সবাই আজ জেলের ভেতরে থাকতাম? মেয়েটাকে মানানোই যাচ্ছিলনা। পরিস্থিতি পুরোপুরি বিগড়ে যাওয়ার পর আমি বাধ্য হয়েছিলাম ঐ সিদ্ধান্ত নিতে! তাকে বুঝিয়ে দিতে সবসময় নিজের রাগ, জেদ, অহংকার ও দাম্ভিকতাকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে সত্যিকার অর্থে নিজের কতোটা ক্ষতি হয়ে যায়।

যদি তার শিক্ষা হয়ে থাকে তো নেক্সট টাইম সে বুঝে শুনে চলবে। যদি এতেও সে সংশোধন না হয় যদি আমার চিন্তাধারা তার ভুলে মনে হয় তবে সে এখন যে কাজটা করতে এসেছে তাই করুক! বাড়ি ঘর ভেঙে ফেলুক আমার। সিরিয়াসলি এতে কোনো অসুবিধে নেই আমার। তবুও যদি তার ইগু সেটিসফাইড হয়। অন্যজনকে শান্তি দেওয়ার মাঝেও নিজের মঙ্গল নিহিত থাকে।”

থামলো মিশাল। কয়েকদফা রুদ্ধশ্বাস ফেলল। চুপ হয়ে গেল সাহিল! বাকরুদ্ধ প্রায়। মিশালের প্রতিটি কথা তার মস্তিষ্কে বেশ তোরজোরে কাজ করতে লাগল। প্রতিটি কথার তাৎপর্য সে উপলব্ধি করতে লাগল। এবার সাহিলের উদ্দেশ্যে সামান্তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন মিজানুর রহমান! সাহিলের মুখোমুখি দাঁড়ালো সামান্তা। এই প্রথম সাহিলের দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো সে। ক্ষীণ হেসে বলল,

“নিজেকে আর কতো খারাপ প্রমাণ করার চেষ্টা করবে সাহিল ভাই? সেদিন সত্যিই আমাদের কথা তোমার শোনার উচৎ ছিল। আমরা তো কাজিন ভাইবোন তাইনা? অথচ আট পাঁচটা কাজিন ভাইবোনদের মতো আমাদের মধ্যে কোনো মিল নেই। যদি আদোতেই আমাদের মধ্যে কোনো মিল থাকত তবে সেদিন এতো বড়ো ঘটনাটি ঘটে যেতো না। আমি জানি, মিশাল ভাইয়ার সাথে তোমার কীসের এতো শত্রুতা।

কারণ প্রায়োরিটি লিস্টে মিশাল ভাই আমার কাছে সবার প্রথমে। আর থাকবেই বা না কেন? একজন ছেলেকে মনে ধরার মতো সমস্ত গুনই তো মিশাল ভাইয়ার মধ্যে ভরপুর রয়েছে! যা তোমার মধ্যে নেই! কাউকে হিংসা না করে বরং তার থেকে কিছু শিক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করো। এমন কিছু করো যেনো মানুষ তোমারও প্রশংসা করে। জোর করে যেমন সবকিছু হয়না তেমনি জোর করে তুমি নিজেকে পাল্টাতেও পারবেনা।

পরিবর্তনটা আসতে হবে তোমার মন থেকে। মিশাল ভাইয়ার শত্রু না হয়ে তুমি বরং তার শক্তি হওয়ার চেষ্টা করো। চাচা যেহেতু এখন আমাদের মাঝে নেই তাই অন্তত চাচার কথা ভেবে তুমি মিশাল ভাইকে আপন করে নাও। ছোটো বেলায় তো চাচাও তোমার জন্য কম কিছু করেনি। সেসব অস্বীকার করলে তো চলবেনা। শুধু আমি নই বরং আমরা সবাই চাই তোমরা এক হও।

যেনো আমরা সবাই তোমাদের দুই ভাইকে নিয়ে প্রাউড ফিল করতে পারি। তোমার কাছে আমার এই শেষ একটি অনুরোধ সাহিল ভাই, যা হয়েছে সব ভুলে যাও। বাড়ি ভাঙার বিষয়টি মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দাও। এক হয়ে যাও তোমরা। এই মুহূর্তে মিশাল ভাইয়ার তোমাকে খুবই প্রয়োজন! প্লিজ নিজের অহংকার গরিমাকে আর প্রশ্রয় দিওনা।”

মাথা নুইয়ে এলো সাহিলের। কেনো যেনো এই মুহূর্তে তার মধ্যে কোনো রাগ, জেদ, অহংকার কিংবা কোনো মন্দ লাগাও কাজ করছিলনা! বরং একধরণের সহানুভূতি কাজ করছিল। খুবই স্বস্তিকর এই অনুভূতি। সামান্তার অনুরোধ তার মনকে গলিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেনো বরফ গলছিল। চোখে ভাসা ভাসা জল নিয়ে মিশাল আচমকা শুকনো হেসে বলল,
“আমার এখনও মনে পরে সাহিল ভাই, আমাদের ছোটোবেলাটা কতো মধুর ছিল।

কতোটা দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে যতোই মারামারি বা মনোমালিন্য হোক না কেন যখন স্কুলের কোনো ছেলে আমার গাঁয়ে হাত তুলতো তুমি সবার আগে রুখে যেতে! একপ্রকার তুলোধুনো করতে। পরে বাবা বা ফুফু গিয়ে ঝামেলা মিমাংসা করত। তোমার ভয়ে স্কুলের ছেলেরা আমার গাঁয়ে হাত তুলতে দু’বার ভাবত।

তোমার স্যাল্টারে তখন স্কুলে রাজ করতাম আমি! এতো বছর পর আমার কী মনে হলো জানো? মনে হলো আবারও বাইরের কেউ আমার গাঁয়ে এসে হাত তুলুক, তোমার চোখের সামনে আমায় মারধর করুক তবেই হয়তো ছোটোবেলার মতো সব মনোমালিন্য ভুলে তুমি আমাকে আবারও প্রটেক্ট করতে ছুটে আসবে! আমি জানি তুমি আসবে। কী আসবে না?”

আচমকা সাহিল মাথা তুলে নিশ্চল মিশালের পানে তাকালো। মায়া জন্মালো তার মধ্যে। দায়িত্ব ও দুঃশ্চিন্তার ভারে মিশালের চোখমুখের এ কী অবনতি হয়েছে। মসৃণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সাহিল মিশালের দিকে। ছোটোবেলার স্মৃতিগুলো তাকে ব্যথা দিতে লাগল! মিশালের প্রতি দুর্বলতা কাজ করতে লাগল। নির্ভেজাল চাহনি তার। চোখের কোণেও যেনো টলমল জল! সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাহিল ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ফুটিয়ে বলল,

“আমাকে আর দুর্বল করার প্রয়োজন নেই! ক্লাস এইটে পড়ুয়া তুই যখন আমার টেনে পড়ুয়া ক্রাশকে লাইন মারতিস, তখনও কিন্তু তোর জন্য আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম! যদিও আমাদের দুজনের জন্য এটা ফ্যান্টাসি ছিল। এখনও ঠিক তাই হবে! আমি তোর শত্রু নই বরং শক্তি হয়ে থাকব! এন্ড ইট’স ট্রু। আমি করে দেখাব! ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস যেহেতু আমাদের দুজনের মধ্যেই নেই, তাই কেউ কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই!”

ড্রইংরুমের পরিবেশ এখন শান্ত, নিবিড় ও উচ্ছ্বল। সবার মধ্যে আবেগ কাজ করতে লাগল। খুবই মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। খুশিতে সবার চোখমুখ চিকচিক করছিল। যে কেউ অভিভূত হতে বাধ্য। জেসমিন বেগমের খুশি যেনো ধরছেনা। বাড়ি ভাঙার ফাড়া কাটল। আল্লাহ্ যেনো আজ তাদের হাতে ধরে বাঁচালো। মিশাল ও সামান্তার সাথে তৈরি হওয়া কিছু মিষ্টি মধুর আবেগ নিয়ে সাহিল জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো।

তবে মিশাল তার আবেগকে ধরে রাখতে পারলনা। সাহিলের প্রতি ভাতৃত্ববোধ উদয় হলো। দৌড়ে গিয়ে সে পেছন থেকে সাহিলের কাঁধে হাত দুটো ঝুলিয়ে সাহিলের শরীরে তার সমস্ত ভর ছেড়ে দিলো! সাহিলের পিঠে একপ্রকার চড়ে বসল। ছোটোবেলাকার মতো সাহিলের গলায় আচমকা কামড় বসিয়ে দিলো মিশাল! হাসতে হাসতে ত্যাড়া বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল সাহিল। মিশালকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে বলল,

“আরে কী করছিস? ছোটোবেলার মতো পাগলামি শুরু করেছিস?”
“হা। লাভ বাইট দিলাম! আজ থেকে আমাদের দোস্তী হয়ে গেল। আমরা আর লড়াই ঝগড়া করবনা। সবসময় মিলেমিশে থাকব। আমাদের মধ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নিয়ে ঝামেলা হবেনা।”
বেশ ভেবেচিন্তে সাহিল বলল,

“ওকে ফাইন। বাট আগে তো আমার উপর থেকে তোকে নামতে হবে। তোর মতো পালোয়ানকে পিঠে চড়ানোর শক্তি আমার নেই।”
ব্যগ্র হাসেল মিশাল। সাহিলের কানে বিড়বিড় করে বলল,
“ভাবি হলে তো ঠিকই তার ভার বইতে পারতে! ভাই বলে নামিয়ে দিচ্ছ। ইট’স নট ফেয়ার।”

সাহিলের পিঠ থেকে নেমে গেল মিশাল। পিছু ঘুরে সাহিল আবেগাপ্লুত হয়ে মিশালকে জড়িয়ে ধরল। মিশালকে মন থেকে আপন করে নিতে তার একটুও সংকোচবোধ হচ্ছিলনা! বরং ভেতরটায় সুখ সুখ অনুভব হচ্ছিল। রাগ, জেদ, দম্ভ পুষিয়ে রাখার মধ্যে যে অশান্তি সেই অশান্তি আর বয়ে বেড়াতে চায়না সাহিল! দুই ভাইয়ের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক হলেও সামান্তাকে আদোতেই সাহিল মিশালের হতে দিবে কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ! যদিও সাহিল এই মুহূর্তে তা ভাবতে চাইছেনা। এই অমূল্য মুহূর্তটি চোখ ভরে দেখছিলেন মিজানুর রহমান। বহু বছর পর এই দৃশ্যটি দেখার সৌভাগ্য হলো তাঁর। খুশিতে ম্লান হাসলেন তিনি। পাশে থাকা সামান্তাকে মিনমিন করে বললেন,

“কখনও ভেবেছিস সাপে নেউলে একসাথে হবে?”
“না বাবা। সত্যিই এটি অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর ছিল। আমার এখনও মনে হচ্ছে আমি একটি স্বপ্নের মধ্যে রয়েছি।”
“শেষ অবধি এই বন্ডিংটা টিকে থাকলেই হয়।”
“আই থিংক থাকবে। আজ আমি অন্য এক সাহিল ভাইকে দেখলাম। আমি সত্যিই অভিভূত। আই হোপ তারা এভাবেই একে অপরের সাথে জুড়ে থাকবে। আমার জন্য তাদের সম্পর্কটা নষ্ট হবেনা।”

বাড়ি ফিরে যাওয়ার বদলে সাহিল আজ মিশালদের বাড়িতে থেকে গেল! মিশাল ও সামান্তা একবার বলাতেই সাহিল থাকতে রাজি হয়ে গেল। জেসমিন বেগম ও রুমকি মিলে রান্নাঘরে চলে গেল। আটঘাট বেঁধে রাঁধতে হবে আজ। সাইফা ও সায়মাও আজ মিশালদের বাড়িতে চলে এলো। কাজিনরা মিলে একসাথে সময় কাটাবে আজ।

দুপুর প্রায় একটার কাছাকাছি। ছাদ জুড়ে কড়া রোদ। তীব্র রোদের ঝলকানিতে এদিক ওদিক তাকানো যাচ্ছেনা। ফ্লোরে পা রাখতেই পা সুদ্ধ ঝলসে যাচ্ছে। মই বেয়ে মিশাল ও সাহিল তাদের ছাদে এলো। যেহেতু মিশালদের ফাউন্ডেশন ওয়ালা বাড়িটি একতলা অবধি কমপ্লিট হয়েছে তাই সিঁড়ির কোনো ব্যবস্থা নেই। মই বেয়েই তাদের ওপরে ওঠতে হয়। সিগারেট খাওয়ার জন্য একটি ফাঁকা জায়গা খুঁজছিল সাহিল৷ বাসার মুরুব্বি ও ভাইবোনদের জন্য সম্ভব হচ্ছিলনা তা।

তাই এই রোদের মধ্যে কসরত করে সিগারেট খাওয়ার উপযুক্ত জায়গাটি খুঁজে বের করতে হলো তাকে। মিশালও তার পকেট থেকে সিগারেট বের করল। দুইভাই মিলে এঞ্জয় করে সিগারেট খাবে। সাহিল যেইনা সিগারেট বের করে তা ধরাতে গেল অমনি যেনো ভূমিকম্পের ন্যায় সামান্তা কোথা থেকে ছুটে এলো! মিশালের মুখে তখন সিগারেট! সাহিল তার হাত থেকে সিগারেটটি ফেলে দিতে পারলেও মিশাল তা পারলনা। মিশালের সিগারেট খাওয়া দেখে ফেলল সামান্তা! স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে রইল মিশাল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামান্তার। পাশ থেকে সাহিল বিব্রতকর গলায় সামান্তাকে বলল,

“তুই এখানে কী করছিস?”
“তোমরা দুই ভাই মিলে সিগারেট খাচ্ছিলে?”
“আমি খাচ্ছিলাম না! মিশাল খাচ্ছিল!”
“ওকে, দাড়াও একবার চেক করে দেখি।”

সামান্তা ঘুরে গিয়ে যেইনা সাহিলের পেছনে গিয়ে দাড়ালো অমনি দেখল একটি সিগারেট সাহিলের পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে! শুকনো ঢোঁক গিলল সাহিল। ধরা পরে যাওয়ার আর কিছু বাকী রইল না। দুই ভাই ফ্যাসাদে পরে গেল। মুখে থাকা সিগারেটটি নষ্ট করতে চাইলনা মিশাল। দুই/তিন টানে শেষ করে ফেলল সিগারেটটি! সাহিল ও সামান্তার মধ্যে তর্ক লেগে যাওয়ার পূর্বেই মিশাল জায়গা থেকে পালানোর চেষ্টা করল। তৎক্ষনাৎ সামান্তা গলা উঁচিয়ে মিশালকে ডেকে বলল,
“এই চো’র থামো। কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
“তোরা থাক আমি আসছি!”

মিশাল দৌড়ে পালানোর পূর্বেই সামান্তা ছুটে গিয়ে মিশালের মুখোমুখি দাড়িয়ে গেল। কোমড়ে হাত গুজে সে ভ্রু উঁচিয়ে মিশালের দিকে তাকালো। সাত পাঁচ না ভেবে মিশাল আচমকা সামান্তাকে হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরল! অনুনয়ভরা গলায় বলল,

“মা বা চাচাকে কিছু বলিসনা প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
“আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে কিছু বলবনা!”
সঙ্গে সঙ্গেই সামান্তাকে ছেড়ে দাড়ালো মিশাল। ভ্রু কুঁচকে খরতর গলায় বলল,
“চাল হাট। যা বলে দে আমি সিগারেট খাচ্ছিলাম। প্রয়োজনে মসজিদের মাইক দিয়ে বল। তবুও তোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার মতো বোকামি আমি করবনা।”

সামান্তা রেগে গিয়ে মিশালের হাত মোচড়ে দিলো। রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল,
“কেন? আমার গাঁয়ে কী পাপ লেগে আছে?”
“না। কারেন্ট লেগে আছে! শক লেগে মরে যাওয়ার মতো কারেন্ট।”

দুজনের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগে গেল। দূর হতে দাড়িয়ে তাদের দুজনের মধ্যকার খুনশুটি দেখছিল সাহিল! তার ভেতরটা অসম্ভব রকম পুড়ে যাচ্ছিল। এই প্রথম মিশাল ও সামান্তার মধুর সম্পর্ক চোখের সামনে দেখেও চুপ করে দাড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা তার কাছে। রাগ হলেও তা প্রকাশ করার কোনো অবকাশ খুঁজে পাচ্ছিল না।

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ২৫

কতক্ষণ সে তার এরূপ নমনীয়তা ধরে রাখতে পারবে তারও কোনো নির্দিষ্টতা নেই। সামান্তাকে মিশালের সাথে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছেনা সে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো তার। তৎক্ষনাৎ বুকে ব্যথা নিয়ে পিছু ঘুরে গেল সাহিল। বাড়ির মেইন গেইটের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই সে স্থির হয়ে এলো! তার মনমর্জি অন্যদিকে ঘুরে গেল।
জেনিয়া সবে পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। সাহিলের দৃষ্টি কোনোভাবে ঐদিকেই আটকে গেল!

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ২৭