আমি মায়াবতী পর্ব ৩১

আমি মায়াবতী পর্ব ৩১
তাহমিনা মিনা

“তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। আমাকে কিভাবে চিনো?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে কাব্য।
“ভাইয়া, আমি সোহাগ। আপনার জুনিয়র ছিলাম। হলে আপনিই আমাকে একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ”
“অহ, আচ্ছা। কোন ডিপার্টমেন্টে তুমি?”
“পদার্থবিদ্যা। ভাইয়া।”

“এইবার কোন ইয়ারে? ফাইনাল?”
“জ্বি, ভাইয়া। আমি আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। সেইরাতে আপনি না থাকলে আমি হয়তো শেষই হয়ে যেতাম।”
“বাদ দাও পুরোনো কথা। এখানে কি করছো?”
সোহাগ উত্তর দেওয়ার আগে মায়া বলে,”স্যার, উনি আমার কাজিন। আমাকে প্রাইভেট পড়াতে এসেছিল। ”
“অহ, আচ্ছা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“স্যার, আমাদের বাসায় চলুন না। ”
“নাহ, আজ না মায়া। অন্য কোনোদিন। কবিতা, মায়া তো নিচেই এসেছে। তুই চলে যা ওর সাথে। ”
“আচ্ছা, ভাইয়া।”
সোহাগ মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”আসি, মায়া।”
কাব্য সহসাই সোহাগের দিকে তাকায়। ওর চোখে মায়ার জন্য মুগ্ধতা খুঁজে পাচ্ছে সে। বিরক্ত লাগছে তার সোহাগকে। ইচ্ছে করছে ওর নাক ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু চাইলেও সেটা পারছে না।

“শোনো কবিতা, আল্লাহ যতোদিন যার হায়াত রেখেছে, সে ততোদিনই বাঁচবে এই দুনিয়ায়। আল্লাহ জান কবচ করার জন্য আজরাইলকেই পাঠায়। কোনো মানুষকে না। তোমার মায়ের মৃত্যুতে তোমার কোনো কিছুই করার ছিল না। তুমি নিজেকে কেন দোষী ভাবছো?”
“আন্টি, বাবা আমাকেই দায়ী মনে করেছে মায়ের মৃত্যুর জন্য। আমাকে কোলেও নেয়নি। আদরও করেনি। জন্মের পর আমাকে দেখেও নি। আম্মুই আমাকে নিয়ে এসেছিল।” কাঁদতে কাঁদতে বলে কবিতা।

“তোমার বাবা ভুল ছিল কবিতা। আমরা কেউই কারো মৃত্যুর জন্য দায়ী নই। আমরা দুনিয়ায় আসি নিজেদের হক নিয়েই। আল্লাহ জন্মের আগেই আমাদের রিজিক লিখে রেখেছে। যেমন ধরো, তুমি এই যে খাবারটা খাচ্ছো, সেটা আমি রিজার জন্য প্লেট এ তুলে রেখেছিলাম। রিজা বলেছিল পরে খাবে।

কিন্তু মায়া তোমাকে এই খাবারটা দিয়েছে। তুমি যে খাবারটা খাচ্ছো, এইটা তোমার রিজিকে লিখা ছিল। রিজার জন্য হলে, রিজা দুদিন পরেও এই খাবারটাই খেতো। আবার খাবার সময় তুমি মায়াকে যে মাঝেমধ্যে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছো, খাবারের সেই অংশগুলোও মায়ার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে কবিতা।

তুমি কক্সবাজার থেকে যে জিনিসগুলো মায়ার জন্য এনেছো, পাশের বাসার ছোট্ট মেয়েটার ভাগ্যেও সেগুলোর কিছু অংশ ছিল। তাই সে আজই আমাদের বাসায় এসেছিল। তুমি এই দুনিয়ায় আসবে, এইটা আল্লাহ চেয়েছিলেন কবিতা। তাই তুমি এসেছো। তুমি যা যা ভোগ করছো, সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছে। তুমি কারো মৃত্যুর জন্য দায়ী নও। না তোমার মায়ের জন্য, না তোমার ভাই-বোনের জন্য। তুমি কোনো কিছুর জন্যই দায়ী নও।” কবিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে সাগরিকা।

“কিন্তু আন্টি, আমার জন্যই নতুন মায়ের জীবনটা এমন হয়ে গিয়েছে। আমার জন্যই দাদী এমন করেছে।”
“সেটা তোমার দাদীর দোষ।তুমি কি তোমার দাদী কে বলেছিলে এইসব করতে?বলোনি। সে ভুল ছিলো। তার অতিরিক্ত ভালোবাসা তোমাদের সবার জীবনকে এইভাবে গুড়িয়ে দিয়েছে। সে শুধু ভুলই করেনি, সে পাপও করেছে। একটা মাসুম বাচ্চাকে এই দুনিয়ার আলো দেখা থেকে বঞ্চিত করেছে। একটা মায়ের মন ভেঙেছে। আল্লাহ তাকে কখনোই ক্ষমা করবে না।”

মায়া বলে,”এইসব ভেবে মন খারাপ করিস না কবিতা। জীবনে এইরকম অনেক সময় আসবে যখন কোনোকিছুই হাতের নাগালের মধ্যে থাকবে না। কিন্তু আমাদেরকেই আমাদের যত্ম নিতে হবে।”
“খেয়ে নাও মা। খাবার সামনে রেখে কান্না করতে হয় না। আল্লাহ নারাজ হন।”
“আম্মা, ফুপি কোথায় গিয়েছে? ”

“তোমার বাবার সাথে কোথায় যেন গিয়েছে। আসতে সময় লাগবে বলেছে।”
“মামী, সাবিহা সাব্বির কখন আসবে?”
“ওদেরও আসতে সময় লাগবে। ওদের স্কুলে অনুষ্ঠান আছে।”
“অহ।”
কবিতা আফসোসের সুরে বলে,”ইশশ! তোর ভাইকে আজ দুটো ভালোবাসার কথা বলতে পারলাম না। কি জ্বালা, কি জ্বালা।”
কবিতার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে সবাই।

“ভাইয়া, তুই মায়ার কাজিনকে চিনিস নি তাইনা?”
কাব্য মুচকি হেসে বলে, “না, চিনি না আমি। কত ছেলেকেই তো সাহায্য করেছি। র‍্যাগিং এর হাত থেকে বাঁচিয়েছি। হবে হয়তো ওদের মধ্যে থেকে কেউ একজন। ”
কবিতা হাহা করে হাসতে থাকে।
“হাসবি না মূর্খ।”

“হাসবো না তো কি করবো? যখন তুমি চিনোই না, তাহলে শুধু শুধু কেন নাটক করতে গেলে? নাকি আমার বান্ধবীর সামনে নিজের স্মরণশক্তির পরীক্ষা দিলে?” ব্যঙ্গ করে বলে কবিতা।
“আরেহ, বাজে কথা বলিস না। এইরকম কোনো বিষয় না। একজন মানুষ যেখানে আমাকে সালাম দিয়ে এতোটা সম্মান দেখাচ্ছে, তাহলে আমারও তো উচিত তাকে সম্মান দেওয়া। তাইনা?”

“হুমম। তা অবশ্য ঠিক। কাজটা তুই অবশ্য ভালোই করেছিস।”
“হুমম। আমি তো আর বাকিদের মতো মূর্খ না। আমার তো জ্ঞান আছে।”
কবিতা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,”অপমান করবি না বলে দিচ্ছি কিন্তু। ”
“কি আশ্চর্য, আমি কি তোকে বলেছি নাকি? তোর এতো জ্বলছে কেন?
” আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি? আমার দিব্বি? ”

“তুই আর কি এমন জিজ্ঞেস করবি যে দিব্বি লাগবেই?”
“আগে বল সে সত্য বলবি?”
“আচ্ছা, বলবো। প্রশ্নটা তো কর আগে।”
“তুই কি মায়াকে ভালোবাসিস?”
কাব্য থ হয়ে যায় কবিতার কথা শুনে। কি বলবে এইবার সে? এই মেয়েকে একবার বলে দিলে তো আর সিক্রেট থাকবে না কোনোকিছুই। মায়াকে জানিয়েই দিবে।

“ভাইয়া বল না প্লিজ?”
“বাজে কথা বলিস না তো।”
“তুই কিন্তু আমার দিব্বি দিয়েছিস। আর দিব্বি দিলে কি হয় জানিস তো? যার নামে দিব্বি দিবি, সে মরে যাবে।”
“এইসব ছেলেমানুষী চিন্তা ভাবনা বাদ দে।”
“তাহলে তুইও বল।”

কাব্য আর কোনো উপায় না পেয়ে বলে দেয়,”হ্যাঁ, তোর বান্ধবীকে আমি ভালোবাসি। ”
কবিতা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠে বলে,”সত্যিই? আমি জানতাম এমনটাই হবে। সত্যি করে বল তো, ওর কিডন্যাপ এর দিন তুই কোনো স্টুডেন্ট পড়াতে যাস নি তাইনা? ওর পিছু নিয়েছিলি?”
কাব্য মাথা চুলকে বলে,”হ্যাঁ। ”

“তুই ওকে ফলো করেছিলি, তাই ওর বাড়ির এড্রেস তুই জানতি। তাইনা? ওকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে আসার দিন ওর কাছে জানতেও চাসনি ওর বাসা কোথায়। তাইনা?”
“হুমম। তুই কি এখন ওকে বলে দিবি? বলিস না প্লিজ। আমি বলবো ওকে।”

কবিতা আর কিছু বলতেই যাবে কিন্তু তার আগেই ওদের মা এসে বলে,”কবিতা, বাবা এসেছে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে।”
কবিতা কাব্যকে একটা চিমটি দিয়ে ছুটে আসে ড্রয়িংরুমের দিকে। বাবা, বাবা চেঁচাতে চেঁচাতে এসে দেখে ড্রয়িংরুমে তার নিজের জন্মদাতা বাবা বসে আছে। তাকে দেখেই তার মুখটা কালো হয়ে যায়। কবিতাকে দেখে তার বাবা উঠে তার কাছে এসে বলে,”কেমন আছিস মা?”

কবিতা পিছনে ফিরে দেখে ইতোমধ্যে কাব্য আর মা এসে দাঁড়িয়েছে। কবিতা আর কিছু না বলেই ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। আর এইদিকে তার নিজের বাবা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এইটাই কি তবে তার প্রাপ্য?

“এই করিডোরে কি করছো মায়া?”
মায়া পিছনে ফিরে দেখে সেখানে কাব্য স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। মায়া তাড়াতাড়ি সালাম দিয়ে বলে,”এমনিই স্যার একটু কাজ ছিল।”
“তোমার সাথেরটা কই?”

“ও একটু ওয়াশরুমে গিয়েছে।ঐ তো আমাকে এইখানে এনেছে।”
“অহহ, তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“এইতো, চলছে ভালোই।”
“ফিজিক্সে অনেক দূর্বল নাকি?”

“আসলে হ্যাঁ, অনেকটাই। স্কুলেই ঘাটতি ছিল ফিজিক্স এ। এখন তাই কভার করতে প্রবলেম হচ্ছে।”
“জীববিজ্ঞানের কি খবর? আমার সাব্জেক্ট? তোমরা ভালো রেজাল্ট না করলে তো এর দায় আমাকেই নিতে হবে।”
“জীববিজ্ঞানের অবস্থা ভালোই স্যার। আপনি ক্লাসে তো ভালোভাবেই বুঝাচ্ছেন। সেটুকুই যথেষ্ট। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টই করেছি এই বিষয়ে।”

“অহ, হ্যাঁ। তারপরও যদি সমস্যা হয়, আমাকে বলো। আমি সাহায্য করে দিবো। আর না হলে আমার কিছু ফ্রেন্ড কোচিং সেন্টার চালাচ্ছে, সেখানে কথা বলে দেখতে পারো।”

মায়া হেসে বলে,”এখন না স্যার। ফিজিক্স একটু আয়ত্তে আসুক। তারপর। বাকি সাবজেক্টগুলো মোটামুটি ভালোই পারি।”
কাব্য আরো কিছু জিজ্ঞেস করতো হয়তো কিন্তু তার আগেই কবিতা এসে পড়ে। কবিতা মায়াকে নিয়ে যাওয়ার সময় পিছন ফিরে ইশারায় কাব্যকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে কাব্য দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দেয়। কবিতা রেগে গিয়ে মায়াকে বলে,”জানিস মায়া, আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা হচ্ছে মানুষরুপী গরু। তাদের দিয়ে কোনো কাজই হয় না।”
মায়া কবিতার কথা না বুঝেই হাহা করে হাসে। আর কাব্য অপমানিত হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।

“আমাকে কি তোর পিয়ন মনে হয়? আর আমি কি মাগনা কাজ করমু?” রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কাব্যকে বলে কবিতা।
“আরেহ, বইন। বোঝার চেষ্টা কর। তুই পিয়ন কেন হবি? তুই শুধু দেখবি ঐ সোহাগ বেডায় যেন কোনো সুযোগ না নিতে পারে। আর তোরে মাগনা কাজ করাবো কেন আমি? তোরে প্রাইভেট পড়ার টাকা আমি দিব। আর তোরে রোজ আনা নেওয়ার দায়িত্বও আমার।”

“তোমার ধান্দা বুঝি না আমি, তাইনা? এইগুলো তো তুই তোর জন্য করবি। আমার জন্য কি করবি? মানে বিনিময়ে আমি কি পাবো?”
“তোরে প্রতিদিন একটা করে ডেইরি মিল্ক খাওয়াবো। ”
“শুকনো কথায় চিড়ে ভিজে না রে কাব্য। দামী কিছু বল।”
কাব্য শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে,”তুইই বল কি চাস তুই?”

কবিতা একটা বিটকেলে হাসি দিয়ে বলে, “বেশি কিছু না ভাই আমার। শুধু সপ্তাহে দুদিন চাইনিজ খাওয়াবি।”
“দুদিন বেশি হয়ে যায় না? একদিন ভালো হবে না?”
“তুই কি চাস আমি মায়াকে সবকিছু বলে দিই?”
কাব্য মুখ গোমড়া করে বলে, “আচ্ছা, দুইদিন।”

আমি মায়াবতী পর্ব ৩০

“এইতো, আমার ভালো ভাই।”
“এতো পাম্প দিতে হবে না। তুই এখন মায়াকে কল দিয়ে বল যে তুই ওর সাথে ফিজিক্স পড়তে চাস।”
“এখনই দিতে হবে?”
“হ্যাঁ, এখনই দিতে হবে।”

আমি মায়াবতী পর্ব ৩২