বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৬

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৬
তাসফিয়া হাসান তুরফা

সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে চারপাশ। বিকেলের কোলাহল ভুলে যেন নীড়ে ফেরা পাখির মতো সকলের ছুটতে লাগলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। গ্রামের সরু রাস্তায় একমনে চলছে আমাদের গাড়ি। যা ড্রাইভ করছেন প্রান্ত ভাইয়া, তার পাশের সিটে ক্লান্তভাবে হেলান দিয়ে আছে রাইসা।

পেছনের সিটে জানালার এক ধারে বসে আছেন তাসিন ভাইয়া, অপরপাশে বসে আছি আমি আর আমাদের দুজনের মধ্যিখানে বসে আছেন পূর্ণ! কাশবন ছেড়ে দাদুবাড়ি যাওয়ার পথে প্রথমদিকে গাড়িতে তাসিন ভাইয়ার কল্যাণে গল্পগুজব হলেও এখন তিনি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন বন্ধ জানালার সাথে মাথা রেখে। তাই এখন গাড়িজুড়েও বিরাজ করছে অদ্ভুত নীরবতা! বাহিরে বেশ খানিকটা আধার ঘনিয়ে আসায় একনাগাড়ে জ্বলতে আছে গাড়ির ভিতরের লাইট। যার আলোয় সবার চেহারার ক্লান্তি স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। শুধু পূর্ণই মনোযোগ দিয়ে ফোন টিপছেন, কি এত করেন ফোনে আল্লাহই জানে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে আমার নিজেরও ঘুম ধরেছে বিধায় ঘুমু ঘুমু চোখে হেলান দিয়ে আছি আমার পাশের আধখোলা জানালার সাথে। গাড়িতে উঠেই এতক্ষণ খোপা করে বেধে রাখা চুলগুলো খুলে দিয়েছিলাম, এখন একটু হালকা লাগছে মাথা! চুলগুলোও এখন বাতাসের ছোয়া পেয়ে মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে!

গাড়ি কিছুটা গর্তযুক্ত খাদের পাশ দিয়ে যাওয়ায় খানিকটা কেপে উঠলাম সবাই, জানালার কাচের সাথে মাথায় সজোরে আঘাত পাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই নরম কিছুর উপর গিয়ে ঠেকলো আমার মাথাটা। গাড়ির গতি স্বাভাবিক হতেই পাশ ফিরে দেখি পূর্ণ রাগী চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। উনার হাত আমার পিঠের পেছন দিয়ে জানালার সাথে ঠেকানো। তার হাতের তালুতে মাথা ঠেকেছে আমার। উনি খানিকটা সরে গিয়ে হাত আমায় তার কাধে মাথা দিতে ইশারা করলেন। উনার ইশারায় আমার চক্ষুচড়ক গাছ!

সামনের সিটে প্রান্ত ভাইয়া ড্রাইভ করছেন যেকোন সময় লুকিং গ্লাস এ আমাদের দেখতে পারবেন আর আমি তার কাধে মাথা দিয়ে ঘুমাবো? আমার কি লজ্জা নেই নাকি! চোখ পাকিয়ে উনাকে মানা করলাম। পূর্ণ এক ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলেন “কি হয়েছে?” আমি কিছু না বলে ইতস্ততভাবে প্রান্ত ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। পূর্ণ হয়তো বুঝলেন আমার কথা, তাইতো চুপ হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ বাদে কিঞ্চিৎ কেশে প্রান্ত ভাইয়াকে বললেন,

—বলছিলাম তোর কি অসুবিধা হবে কি লাইট অফ করে ড্রাইভ করতে? হেডলাইট তো অন-ই আছে সামনের। সমস্যা হওয়ার কথা না। রাইসার খুব ঘুম পেয়েছে দেখ, কেমন হেলান দিয়ে আছে। গাড়ির আলোতে ঘুমাতে পাচ্ছেনা বেচারি।
পূর্ণর কথায় প্রান্ত ভাইয়া রাইসার দিকে তাকালেন। ওর চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো ওর ঘুম ধরেছে, তাই প্রান্ত ওকে ধমকে বললেন,

—তোমার সমস্যা হচ্ছে আগে বলোনি কেন? তাহলেই তো আমি লাইট অফ করে দিতাম।
রাইসা বেচারি দুই ভাইয়ের কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। হ্যাঁ না কি বলবে কিছুই বুঝতে পারলোনা। ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই গাড়ির ভেতরের লাইট অফ করে দিলেন প্রান্ত ভাইয়া। ভরাসন্ধ্যার নিকষ আধার এসে গ্রাস করলো গাড়ির মাঝেও।

এখন আবছা আলোয় কাউকেই তেমন বুঝা যাচ্ছেনা। রাইসারও সাড়া শব্দ নেই ঘুমিয়ে গেলো হয়তো, এদিকে আমার ঘুম উড়ে এলো পূর্ণর কর্মকাণ্ড দেখে! কি ভীষণ ধুরন্ধর লোকটা! আমি জাস্ট ভাবতে পারলাম নাহ। কেমন চালাকি করে গাড়ির লাইট অফ করে নিলেন। আমার ভাবনার মাঝেই পূর্ণর স্পর্শ পেয়ে ধ্যান কেটে গেল আমার! উনি আমার পিঠের পেছন দিয়ে হাত এলিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বললেন,

—এসো।
আবছা অন্ধকারে তার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেলাম নাহ আমি। তবে আমি মুখ খুলে কিছু বলার আগেই উনি নিজেই টেনে নিলেন আমার মাথাটা, সযত্নে চেপে রাখলেন তার বুকে। স্তব্ধতায় কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম আমি! উনি আমার খোলা চুলের মাঝে হাত এলিয়ে দিয়ে শান্তকণ্ঠে বললেন,

—আর একটাও কথা নয়। চুপচাপ ঘুমাও।
আবেশে, আশ্চর্যতায় চোখ আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে গেলো আমার। উনার বুকে মাথা দিয়ে কেন যেন খুব প্রশান্তি লাগছে, মনে হচ্ছে এই স্থানে মাথা দিয়ে যেকোন সময় মহাআয়েশে ঘুমাতে পারবো আমি!
এসব ভাবতে ভাবতে আচমকা ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করলাম আমি…

“বিদায়” শব্দটা বরাবরই বেশ কস্টকর। আমার জন্যও ব্যতিক্রম নয়। বিয়ের সময় আন্টির বাড়ি ছেড়ে আসতে যেমন কস্ট লেগেছিলো তেমনি কস্ট দাদুবাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসার সময় লেগেছে। এত বছর পর দাদুবাড়ি এসেছিলাম যেন মনেই হয়নি একবারও!

সবাই একয়দিনে এমনভাবে আপন করে নিয়েছেন আমায় যেন এতবছর বিচ্ছিন্ন ছিলামই না আমি তাদের থেকে! সেই প্রিয় পরিবারের মায়া কাটিয়ে পুনরায় ঢাকায় ফিরতে বড্ড খারাপ লেগেছে মনে। দাদি তো কেদেই দিয়েছেন বেচারি। বারবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো দিয়ে আদর করেছেন। পূর্ণকে কড়াভাবে বলে দিয়েছেন কখনো আমাকে কস্ট না দিতে। পূর্ণও বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়েছেন।
উল্টো দাদিকে বলেছেন,

—তুমি তুরফার জন্য চিন্তা করোনা, দাদি। আমি কোন অযত্ন হতে দিবোনা তোমার নাতনির। তবে ওকেও বলো আমার মনের খেয়াল রাখতে। সে যে এ বিষয়ে বড্ড কাচা!
দাদির সামনে এমনটা বলায় বেশ রাগ হয়েছে আমার। আমি আবার উনার মনের কি করেছি? আমি কি তার খেয়াল রাখিনা? খারাপ লোক।

অযথাই একটা কথা বলে। তারপর থেকে ঢাকা আসার রাস্তায় আমার আর পূর্ণর কোন কথা হয়নি। সকাল সকাল বাসায় ফিরেই পূর্ণ ও প্রান্ত ছুটেছেন অফিসে। আমার দিন কেটেছে বড়াম্মু আর রাইসার সাথে কখনো কাজ করে, কখনো গল্প করে। গত কয়েকদিন আনন্দে কাটিয়ে এখন আবার গতানুগতিক নিয়মে ফিরে এসেছি সবাই। এভাবেই চলছে জীবন।

দেখতে দেখতেই সময় চলে যায়। আজ আমার এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট। সকাল থেকেই বেশ নার্ভাস হয়ে, টেনশনে অস্থির হয়ে বসে আছি আমি। তার মধ্যে কালরাতে পূর্ণর সাথে ঝগড়া হওয়ায় রাগ ও ভয় আরো বেড়ে গেছে মনে। কাল রাতে যখন উনাকে জানাই আজ রেজাল্ট দিবে। উনি স্বাভাবিকভাবেই নিলেন। তার মতে রেজাল্ট একদিন দিবেই, এটা জানা কথা অতএব এই বিষয়ে টেনশন করার কোন যুক্তি হয়না। আমি রেগে বলেছিলাম “আপনার মতো টপার কি বুঝবে আমার মতো এভারেজ স্টুডেন্ট এর দুঃখ”

ব্যস! তাতেই উনার ইগোতে লেগে গেছে! আমায় স্পষ্ট ও কড়াভাবে বলে দিয়েছেন আমি টপ করতে পারিনা এটা আমার ব্যর্থতা। উনি টপার হতে পারলে আমি কেন টপার হতে পারলাম নাহ? তাই এ বিষয়ে তাকে যেন খোটা না দিই। আরও অনেককিছুই বলেছেন রাগের বশে যেটা মনে হতেই টেনশনে আমার হাত-পা হিম হয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ রাগ দেখিয়ে কণ্ঠে ব্যাপক গাম্ভীর্য মিশিয়ে বলেছেন,

—দেখো তুরফা, রেজাল্টের পর থেকেই অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে এডমিশনের জন্য পড়া শুরু করো। ঢাকার মধ্যেই চান্স পাওয়ার টার্গেট থাকতে হবে তোমার।
কিছুটা থেমে বললেন,

“অবশ্য ঢাকার বাহিরে চান্স পেলেও আমার সমস্যা নেই। তবে সেক্ষেত্রে তোমাকে হোস্টেলে একাই থাকতে হবে।”
হঠাৎ একা থাকার কথা শুনে পিলে চমকে গেলো আমার! এসব কি বলছেন উনি? কোথায় সাহস দেখাবেন তা নয়, উলটো ভয় দেখাচ্ছেন আমায়। জিহবা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,

—আপনি সত্যিই আমাকে হোস্টেলে রেখে আসবেন?
আমার চোখে স্পষ্ট ভয়, তবে এটা কিসের ভয় আমি জানিনা! উনার চোখের ভাষা অস্পষ্ট।
নেহাৎ-ই ঠান্ডা গলায় বললেন,

—অবশ্যই। কেন রেখে আসতে পারবোনা? পড়ালেখার ব্যাপারে কোন ছাড় নেই আমার কাছে। আর তাছাড়াও আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি এখানে খুব। তুমি তো জানোই। অতএব ঢাকার বাইরে চান্স পেলে তোমাকে একাই থাকতে হবে। তাই চেস্টা করবে ঢাকার ভেতরে চান্স পাওয়ার।

উনার কাঠ কাঠ গলার গাম্ভীর্যে চিন্তায়-ভয়ে আমার ঘাম ছুটে গিয়েছে। এখন তো এইচএসসির ফলাফলের চেয়ে এডমিশনের টেনশন বেশি হচ্ছে। রাইসার হাত ধরে বসে আছি এসএমএস আসার অপেক্ষায়। টিভিতে দেখাচ্ছে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। যথারীতি এসএমএস এলো। পেয়ে গেলাম কাংক্ষিত রেজাল্ট। “এ প্লাস” পেয়েছি আমি। এই খুশিতে রাইসাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি।

তারপর বড়াম্মুকে জানালাম দুজন। বড়াম্মু ফোন করে বড়াব্বুকে জানিয়ে দিলেন অফিসে। আসার সময় মিস্টি নিয়ে আসবে জানালেন বড়াব্বু। তার সাথে কথা বললাম আমি। প্রান্ত ভাইয়াও কংগ্রেটস জানালেন। কি গিফট নিয়ে আসবেন আমার জন্য সেটাও শুনলেন। সবার সাথেই কথা হলো, শুধু হলোনা পূর্ণর সাথে। তাই এত খুশির মাঝেও মনটা যেন শান্তি পেলোনা আমার।

উনি ঢাকায় আসার পর থেকেই এমন করছেন! মনে হচ্ছে যেন ইচ্ছে করেই এভোয়েড করছেন আমায়। অথচ দাদুবাসায় কি সুন্দর ব্যবহার করছিলেন সে কয়দিন আমার সাথে! একবারের জন্য তো রাইসার সেদিনের বলা কথাটা মেনে নিতে ধরেছিলাম আমি, কিন্তু ফিরে আসার পর থেকে উনার ব্যবহার দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে আমায়। এত গোলকধাঁধাঁর মাঝে রেখেছেন কেন আমায় কে জানে?

যদি সত্যিই ভালোবাসেন তবে প্রকাশ করলে কি হয় আমি বুঝিনা! আর আমাকে এভোয়েড-ই বা কেন করছেন বিগত কয়দিন ধরে?? আচমকাই উনার এহেন বদলে যাওয়া আচরণ বড্ড ভাবাচ্ছে আমায়।
এইচএসসির চিন্তা তো গেলো, এখন সামনে এডমিশন নামক আরেকটি বড় চিন্তার পাহাড় অপেক্ষা করছে আমার জন্য! সেখানেও আদৌ এবারের মতো সফল হতে পারবো তো?

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৫

আল্লাহ-ই ভালো জানেন!
পূর্ণটারও হঠাৎ কি হয়েছে উনার কে জানে? কি চলছে উনার মনে?
গম্ভীরমুখে ভাবতে লাগলাম আমি…

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩৭