বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৫০

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৫০
তাসফিয়া হাসান তুরফা

সকাল সকাল ঘুমের রেশ কাটতেই নিজের পাশে পূর্ণকে না দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই উনাকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে রেডি হতে দেখলাম। ফর্মাল লুকে সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট পড়ে চুল সেট করছেন একমনে। পেছন ঘুরে আমায় উঠতে দেখেই হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বললেন,

—গুড মর্নিং। অবশেষে মহারানীর ঘুম ভাঙলো!
—কয়টা বাজে? আপনি এখনি রেডি হচ্ছেন যে? খাবেন না? না খেয়ে যাবেন অফিসে?
আমার কথায় পূর্ণ খানিকটা হাসলেন যেন। এতক্ষণে আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি তার সামনে। উনি ফোন চার্জ থেকে খুলতে খুলতেই জবাব দিলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—খাওয়া-দাওয়ার সময় নেই আজ। একটু আগেই বের হতে হবে। অফিসে খেয়ে নিবো চিন্তা করোনা। আর তুমি কিন্তু পড়াশুনা করো ঠিকমতো৷ রেজাল্ট ভালো হতে হবে কিন্তু। যা বলেছিলাম মনে আছে তো?
যদিও আমি বুঝলাম উনি ঢাকায় চান্স পাওয়ার ব্যাপারে বলছেন তবুও রসিকতা করে বললাম,

—কি বলেছিলেন? খারাপ রেজাল্ট করলে আমাকেও রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিবেন?
পূর্ণ বিরক্তির সহিত চোখ পাকিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম, তা দেখে উনি এক্সপ্রেশন বদলে হঠাৎ খুব ভাব নিয়ে শার্টের কলার ঠিক করে বললেন,

—তোমাকে কেন বিয়ে দিবো? তুমি যে ফাকিবাজ, তোমাকে রিকশাওয়ালাও বিয়ে করবে বলে আমার মনে হয়না। তার চেয়ে বরং আমিই আরেকটা বিয়ে করবো। তোমার জন্য একটা সতীন নিয়ে আসবো। ভালো না আইডিয়াটা, কি বলো?
উনার কথায় ও জ্বা/লাময়ী হাসি দেখে রাগে আমার গা জ্বলে গেলো। আরেকটা বিয়ে করবে বলছে আমার সামনে! কত্ত সাহস! উনাকে চোখ দিয়ে ভস্ম করার মতো একটা লুক দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে আসছিলাম আমি। সেই সাথে পেছন থেকে ভেসে আসছে উনার উচ্চ হাসির ঝংকার। ওয়াশরুমের কাছে পৌঁছানোর আগেই আমার হাত ধরে ফেললেন পূর্ণ। আমি রাগী চোখে ঘুরে তাকাতেই হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

—এই যে রাগী কন্যা, এটা তোমার জন্য। কাল ফিরে এসে এত টায়ার্ড ছিলাম যে দিতেই ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আমার সময় নেই। তুমি দেখে নিও।
ব্যাগটা দেখে বুঝলাম এটা কালকে নিয়েছেন উনি। কিন্তু কখন? যখন আমায় ফুচকা খেতে দিয়ে চলে গেলেন তখন? হতাশ দৃষ্টিতে উনার দিক চেয়ে বললাম,

—এটা কাল ফুচকা খাওয়ার সময় আপনি কিনতে গিয়েছিলেন তাইনা? মানিব্যাগ তো পড়ে গিয়েছিলো তাহলে টাকা কোথায় পেলেন?
—পকেটে কার্ড ছিলো আমার। তোমার বরের বুদ্ধির অভাব নেই। তোমার এত চিন্তা করতে হবে না।
—কিন্তু কি দরকার ছিলো এটা কিনার বলুন তো? সবার জন্য তো নিয়েছেনই। আর আমি তো বলেছিলাম আমার কিছু লাগবেনা। আপনি শুনেন না কেন আমার কথা?

—আমি সবার জন্য কিছু নিবো আর আমার বউয়ের জন্য নিবোনা এটা তো হতে পারেনা, তুরফা। তুমি চাও আর না চাও আমার সমস্ত দায়িত্ববোধের উর্ধে তুমি থাকবে সবসময়। তোমাকে বাদ রেখে আমি কিছুই করবোনা। করতে পারবোই নাহ!
উনার শান্ত অথচ দৃঢ় গলার কথার বিপরীতে কোন যুক্তি খুজে পেলাম নাহ আমি। হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম শুধু আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই পাগল লোকটার দিকে! উনাকে বুঝা বড্ড দায়!

আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি সোফা হতে অফিসের ব্যাগ হাতে নিয়ে চলে গেলেন রুমের বাহিরে। আমিও ব্যাগটা খুলে দেখতে লাগলাম কি আছে ভেতরে। নীল রঙের কাজ করা শিফনের একটি শাড়ি। ইশ কি যে সুন্দর! আয়নায় শাড়িটি নিজের উপর ধরতেই মুচকি হাসি খেলে গেলো ঠোঁটের কোণে! উনার চয়েসের প্রশংসা করতেই হবে বটে। ঠিক তখনি হঠাৎ করে পূর্ণকে আমার পিছনে দাড়াতে দেখে চমকে গেলাম। পেছনে ফিরতেই উনি আমার দু’গালে হাত রেখে মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন,

—তোমার উপর শাড়িটা কেমন লাগবে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম নাহ তাই ফিরে এলাম! যদি কখনো ইচ্ছে হয় তবে আমার জন্য সাজবে এই শাড়িটা পড়ে। শুধুই আমার জন্য! আমি কিন্তু দেখার অপেক্ষায় থাকবো।
কথাটা বলেই টুপ করে আমার কপালে চুমু খেয়ে হনহন করে বেরিয়ে পড়লেন রুম থেকে। পুলকিত অন্তরে উনার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলাম আমি! এত সুন্দর করে বললে কি সে আবেদন ফেলা যায়? অন্তত আমার তো উনার আবেদন উপেক্ষা করার সাধ্যে নেই! একেবারেই নেই!

মধ্যাহ্ন দুপুরে প্রিয়ার রুমের বিছানায় পা দুলিয়ে বসে আছি। ও সদ্য গ্রহণ করা গিফট নামক পারসেল খুলতে ব্যস্ত। রায়হান ভাইয়ার সাথে দেখা করে এসেছে কলেজ থেকে, উনিই নাকি এটা দিয়েছেন ওকে। বাসায় এসেই আমায় ডেকে নিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে এটা খুলছে সে।

পারসেল খুলতেই ভেতরে এক ডালায় শাড়ি, চুড়িসহ চোখে পড়লো ছোট্ট একটি চিরকুট। এটা নাকি একদিন সে ফেসবুকে দেখে রায়হান ভাইকে বলেছিলো ওর খুব ভালো লেগেছে তাই উনি আবার সেটা মনে রেখে ওকে গিফট দিয়েছেন! চিরকুটের ভেতর গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা “হ্যাপি বার্থডে টু দ্যা মোস্ট সুইট গার্ল”। বুঝায় যাচ্ছে এটা রায়হান ভাইয়ের লেখা আর প্রিয়ার লাজুক হাসি দেখে ওদের সম্পর্কের উন্নতি আমার চোখে স্পষ্ট তবুও ওকে ক্ষেপানোর লোভ সামলাতে পারলাম নাহ। দুষ্টু হেসে বললাম,

—সুইট গার্ল এন্ড অল, না? জল গড়িয়ে এতদূর আর আমাকে কিছুই জানানো হয়নি! এক্ষুণি তোমার ভাইকে বলে দিবো দাড়াও।
—এই না না, ভাবী প্লিজ। উনি বুঝেন আমি তাকে ভালোবাসি এবং সে নিজেও আমায় পছন্দ করেন এটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু তিনি এখনো সেটা পুরোপুরি প্রকাশ করতে পাচ্ছেন নাহ। এর পেছনেও অবশ্য এক কারণ আছে। তোমাকে সব বলছি দাঁড়াও।

—কি কারণ আছে?
ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলাম আমি। প্রিয়া খানিকটা উদাস স্বরে বললো,
—আসলে আমি আসার আগে তার জীবনে অন্য কেউ ছিলো।
প্রিয়ার কথায় শুকনো ঢোক গিললাম আমি। এটা কি সে নিজেই বুঝেছে নাকি রায়হান ভাইয়া বলে দিয়েছেন? আমার কথা আবার বলেন নি তো? তাহলে খুবই অসস্তিকর লাগবে আমার কাছে ব্যাপারটা। ইতস্তত মুখে জিজ্ঞেস করলাম,

—ওহ। তুমি সেটা কিভাবে জানলে? রায়হান ভাই বলেছেন?
—হ্যাঁ, মানে একদিন আমি কি যেন কথায় তাকে বলেছিলাম যে আপনার গার্লফ্রেন্ড নেই বা আগে ছিলোনা? তখন উনি বলেছিলেন গার্লফ্রেন্ড ছিলোনা তবে একজনকে নাকি তিনি খুব ভালোবাসতেন, যে তার হতে পারেনি। তাই উনি এখন মুভ অন করার চেস্টায় আছেন। আর আমায় এটাও বলেছেন যে তার সময় লাগবে নতুন করে কারও সাথে সম্পর্কে জড়াতে কারণ উনি এসব নিয়ে বেশ সিরিয়াস। হুট করেই কোন ডিসিশন নিতে চান নাহ।

প্রিয়ার কথায় হাফ ছেড়ে বাচলাম যেন! সে জানেনা রায়হান ভাই কাকে ভালোবাসতেন শুনে একটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম! যাক অন্তত অতটা অসস্তিতে পড়তে হলোনা! একিসাথে রায়হান ভাইয়ের প্রতি সম্মান বেড়ে গেলো আমার। প্রিয়ার সাথে কোনরুপ সম্পর্কে জড়ানোর আগেই তার অতীত সম্পর্কে বলে দিয়েছেন ওকে, যিনি কোনকিছু লুকিয়ে নতুন সম্পর্ক শুরু কর‍তে চান না। তার মানে উনার মনে যে কোন খারাপ কিছু নেই এটা পুরোপুরি স্পষ্ট। এমন ভালো মনের ছেলেকে পূর্ণ নিজের বোনের জন্য কেন মানবেন নাহ? মানতেই হবে। আমি মানাবো উনাকে!

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রিয়াকে বললাম,
—তারপর তুমি কি বললে? উনার জীবনে তোমার আগে কেউ ছিলো এটা নিয়ে তোমার সমস্যা নেই তো?
—উম, আমি এ ব্যাপারে ভেবে দেখেছি ভাবী। কাল থেকেই ভাবছি। প্রথমে একটু খারাপ লেগেছিলো যে কে সেই মেয়ে যাকে উনি এতটা ভালোবাসতেন? হিংসেও হচ্ছিলো একটু। পরে মনে হলো উনার ভালোবাসাটা হয়তো আমার জন্যই বরাদ্ধ ছিলো এজন্যই সেই মেয়েকে উনি এতটা ভালোবাসার পরেও সে তার হয়নি!

অতীত মানুষের থাকতেই পারে এটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু উনি যে সেটাকে ভুলে জীবনে মুভ অন করতে চাইছেন এটাই বড় বিষয় তাই আমি অত মাথা ঘামাইনি। মেয়েটা কে ছিলো আমি জানতেও চাইনা। আমি শুধু উনার আর আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে চাই!

প্রিয়ার কথায় একিসাথে বিস্ময় ও ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো অন্তর। ছোট্ট-সরল মেয়েটা কিরকম ম্যাচিউরড কথাবার্তা বলছে! একদম বড়দের মতো বুঝতে শিখেছে সে জীবনটাকে। মনে মনে বেশ খুশি হলাম প্রিয়া আর রায়হান ভাইয়ের জন্য, তারা দুজন সত্যিই একে-অপরের জন্য পারফেক্ট। প্রিয়ার সাথে বিকাল পর্যন্ত গল্পগুজব করে সন্ধ্যায় আমাদের রুমে ফিরে এলাম। শাড়িটার দিকে একবার চোখ বুলাতেই পূর্ণর কথা মনে পড়লো।

উনি বাসায় চলে আসবেন ঘণ্টা খানেকের মধ্যে!
হঠাৎ তার সকালে বলা কথাগুলো মাথায় আসতেই মনের মাঝে ইচ্ছে জাগলো উনার জন্য রেডি হলে কেমন হয়! তাকে চমকে দেওয়া যাবে! আর এ সুযোগে তখনি উনাকে প্রিয়া-রায়হান ভাইয়ার কথাটাও বলে দিবো! এমন সেজেগুজে রেডি হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই অত রাগ দেখাবেনা। মনে মনে নিজের বুদ্ধির প্রশংসা নিজেই করলাম!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৪৯

যা ভাবা সেই কাজ! দ্রুত পায়ে শাড়ি নিয়ে চলে গেলাম রেডি হতে। ভালোভাবে শাড়ি পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে চুল আচড়িয়ে চুড়ির বক্স থেকে নীল রঙা চুড়িতে ভরিয়ে ফেললাম হাতজোড়া। চোখে কাজল লাগিয়ে হালকা গোলাপি লিপস্টিক আর ছোট্ট একটা স্টোনের টিপ দিয়ে সাজ কমপ্লিট করলাম! ব্যস আমি রেডি! আয়নায় তাকিয়ে দেখি বেশ ভালোই লাগছে আমায়! সব তো হলো, এখন শুধু পূর্ণ আসার অপেক্ষা! মুচকি হেসে সোফায় বসে দরজার পানে চেয়ে উনার আসার অপেক্ষায় রইলাম…

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৫১