বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩০

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩০
সাদিয়া জাহান উম্মি

আজ জায়ান আর আরাবীর বাগদান।সকাল থেকে বেশ তোড়জোড় সব কাজের জন্যে।কিন্তু যাদের জন্যে এতো এতো আয়োজন। তারাই যেন মনমরা হয়ে আছে। কাল সারাদিনে আরাবী আর জায়ান একে-অপরের সাথে কথা বলেনি।না দেখা করেছে। বাড়ি থেকে একপাও বাহিরে দেয়নি দুজনে। বিছানায় স্বয়নরত আরাবী কেমন ছটফট করছে।অস্থির হচ্ছে।ভালো লাগছে না কিছু। প্রচন্ড কান্নায় দম আটকে আসছে।

কান্না না করতে পারায় কন্ঠচালিতে চাপ প্রয়োগ হচ্ছে।যার ফলে ব্যাথা হচ্ছে সেখানটায়। আরাবীর চোখের কার্ণিশ হতে গড়িয়ে পরে তপ্ত অশ্রুকোনা। দ্রুত চোখ মুছে ফেললো আরাবী।বিছানায় পরে আছে ওর বাগদানের অনুষ্ঠানের জন্যে জামা,গহনা,সাজগোজের সামগ্রী।তবে আরাবী তা এখনো খুলেও দেখিনি। আয়নার সামনে বসলো আরাবী।আয়ানায় নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হলো আরাবী।মাত্র একদিনের ব্যাবধানে কি অবস্থা হলো ওর।চোখের নিচে কালি পরেছে দুটো নির্ঘুম রাতের কারনে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দুহাতে মুখটাকে ঘষে নিলো আরাবী। এর মধ্যে রুমে আসে নূর।এসে আরাবীকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে নূরের রাগ লাগলো।এভাবে বসে থাকার মানে কি? বাগদানের অনুষ্ঠান শুরু হতে আর মাত্র কিছুক্ষন।আরাবী এখনো রেডি হয়নি।আরাবী পার্লারের মেয়েদের হাতে সাজবে না।তাই তাদের আনা হয়নি।নূর ক্ষেপানো গলায় বলে, ‘ তুমি এখনো তৈরি হচ্ছো না কেন? আর মাত্র কিছুক্ষন বাকি ভাবি।জলদি রেডি হও।’
আরাবী পিছন ফিরে নূরকে দেখে উঠে দাড়ালো।নূরের কাছাকাছি এসে বলে,’ তুমি নিজেও তো তৈরি হওনি।তুমি যাও তৈরি হও।আমিও তৈরি হচ্ছি।’

নূরের আরাবীর মুখ থেকে কেমন যেন ভালো লাগলো না।জায়ানের চেহারাও কাল থেকে থমথমে হয়ে আছে।ঠিকঠাক কথা বলছে না কারো সাথে।অহেতুক রাগিরাগি করছে। নূর চিন্তিত কন্ঠে বললো, ‘ ভাবি? সব ঠিক আছে তো তোমার আর ভাইয়ার মাঝে?’
আরাবী জোড়পূর্বক হাসলো।বললো, ‘ হু! সব ঠিক আছে।আমাদের মাঝে আবার কি হবে?’

‘ না মানে।ভাইয়া কাল থেকে কেমন যেন আগের মতো সেই রুক্ষ বিহেইব করছে।অহেতুক রাগারাগি করছে সবার সাথে।’
নূরের কথায় বেশ চিন্তিত দেখালো আরাবীকে।পরক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়ে আরাবী বললো, ‘ হয়তো কাজের চাপ বেশি।এমনিতেও তো দেখছো কয়েকদিন যাবত বিয়ের আয়োজনের কারনে উনি ঠিকঠাক অফিসে যেতে পারছেন না।তুমি চিন্তা করো না।ঠিক হয়ে যাবে।যাও তৈরি হয়ে নেও।কেমন?’

নূরের কেমন যেন আরাবীর কথাটা বিশ্বাস হলো না।তাও আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো নূর।এদিকে নূর যেতেই আরাবী দরজা আটকে দিলো।দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলালো আরাবী। লোকটা এতো নির্দয় কেন? একটাবার আরাবীর কাছে আসলো না। শুধু ছোট্ট আওয়াজে যদি একবার আরাবীকে ডাক দিতো।আরাবী ছুটে চলে যেতো।কিন্তু লোকটা এলো না।এ কেমন পাষাণ লোককে ভালোবেসে ফেললো আরাবী। আরাবী লম্বা শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ফ্রেস হতে চলে গেলো।এখনই তৈরি হতে হবে।নয়তো দেরি হয়ে যাবে।

পুরো বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে।সে এক বিশাল আয়োজন। ইফতি আরাবীকে ধরে নিয়ে আসছে।আরাবী গাউনটা বেশ লম্বা।তাই হাটতে একটু সমস্যা হচ্ছে।ইফতি তো আরাবীকে বার বার বলছে, ‘ তোকে অনেক সুন্দর লাগছে আরাবী।জায়ান ভাই তো আজ তোকে দেখলে নিশ্চিত অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে যাবে।’
আরাবী এতে বেশ বিরক্ত।এই কথাটা প্রথম শুনে বেশ লজ্জা লাগছিলো আরাবীর।কিন্তু ইফতি একই কথা বার বার রিপিট করছে।যাতে প্রচুর বিরক্ত আরাবী।নিহাদ সাহেব আরাবীকে দেখেই দূর হতেই দ্রুত পায়ে ছুটে আসলো।সাথে আসলেন সাথি।নিহাদ বলেন, ‘ মাশা-আল্লাহ! আম্মুকে বেশ সুন্দর লাগছে।’

সাথিও প্রসংশা করলেন।সাথে মিহান আর মিলি তো আছেনই।আর আরাবীর মা তো এই নিয়ে শ’খানেক চুমু খেয়ে নিয়েছে মেয়ের কপালে।নূর আরাবীর কাছে এসে চিৎকার করে উঠলো, ‘ ওয়াও ভাবি।তোমাকে যা লাগছে না।ভাইয়ার চয়েজ আছে বলতে হবে।কি সুন্দর।’

আরাবী রয়াল ব্লু কালারের গাউন পরেছে যার মাঝে সাদা স্টোন বসানো। গলায়,কানে,হাতে ম্যাচিং করে সাদা আর রয়েল ব্লু এর কম্বিনেশনে স্টোন ওয়ার্ক করা জুয়েলারি,চুলগুলো নিচের দিক রিয়ে কার্লি করা,কিছু চুল সামনে এনে রাখা।চুলেও সুন্দরভাবে স্টোন ক্লিপ লাগানো।আর সাথে সাদা মাটা হালকা মেক-আপ।এতেই যেন অপ্সরা লাগছে আরাবীকে।সবাই সাখাওয়াত বাড়ির বড় পুত্রবধুকে দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।কিন্তু যার মুখ থেকে নিজের জন্যে একটু প্রশংসা শুনতে চায় আরাবী।তাকেই দেখতে পাচ্ছে না সে। দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরালো আরাবী।

পরক্ষনেই দূর হতে কাঙ্খিত মানুষটাকে দেখতে পেলো আরাবী।জায়ান সুইমিংপুলের ওইপাশটায় দু একজন মানুষদের সাথে কথা বলছে।কি সুন্দরই না লাগছে লোকটাকে।আরাবীর হার্ট দ্রুত গতিতে ছুটতে লাগলো জায়ানকে দেখে।জায়ানও আরাবীর সাথে ম্যাচিং করে রয়াল ব্লু ব্লেজার পরেছে।ব্লেজারের ভীতরের শার্টটা সাদা।রয়াল ব্লু কালারের ডেনিম প্যান্ট।হাতে দামি ঘড়ি। চকচকে কালো জুতো।চুলগুলো জেল দিয়ে সেটা করা।আরাবী যেন নিজের চোখজোড়া সরাতে পারছে না কিছুতেই জায়ানের উপর থেকে।মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে জায়ানের দিক।ইফতি হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারলো।তাই আরাবীর হাত ধরে ওকে টেনে জায়ানের দিক নিয়ে যেতে লাগলো।আরাবী বুঝতে পেরে সাথে সাথে নারাজ জানালো, ‘ ইফতি ভাইয়া। আমি যাবো না।তিনি এখন কথা বলছেন।ব্যস্ত আছেন।থামো ভাইয়া।’

ইফতি আরাবীর কথা শুনে বললো, ‘ আজাইরা কথা বাদ দে।তুই ছাড়া এখন ভাইয়ার কাছে আর কি বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট হবে?’
ইফতি আর একটা কথা আরাবীকে বলতে না দিয়ে ওকে জায়ানের সামনে নিয়ে গেলো। আকস্মিক এভাবে আসায় জায়ান বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকাতেই দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে জায়ানের।একরাশ মুগ্ধতা এসে ভর করে ওর চোখে।সেই মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি দেখে শুকনো ঢোক গিললো আরাবী।দৃষ্টি নত হলো ওর। এদিকে ইফতি হেসে দিয়ে বলে,’ ভাই মুখের হা বন্ধ করো।’

জায়ান দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়।ইফতির দিকে দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে দাঁতেদাঁত চিপে বলে, ‘ এখানে হুট করে আসার কারন কি? দেখছিস না কথা বলছি?’
জায়ানের এমন রুক্ষ ব্যবহারে বেশ কষ্ট পেলো আরাবী।উজ্জ্বল মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।এতোটা পরিবর্তন? যে এখন আরাবী কাছে আসলেও লোকটা বিরক্ত হয়?আরাবী ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলে নিলো।চোখ বুঝে বড় এক শ্বাস ফেলে বললো, ‘ ইফতি ভাইয়া।আমি ওদিকে যাচ্ছি।নূর ডাকছে।’

আরাবী চলে আসতে নিলো।তবে একবার ঘুরে তাকালো।এই বুঝি লোকটা ওকে ডাকবে।এখানে থাকতে বলবে।কিন্তু না এমন কিছুই হলো না।আরাবী চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেলো।পুরো অনুষ্ঠানে না আরাবী জায়ানের কাছে গেলো।আর না জায়ান আরাবীর কাছে গেলো। নিহাদ সাহেব সকলের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।এখনই বাগদানটা সেরে ফেলা হবে। ইফতিকে স্টেজে উঠে মাইক হাতে নিয়ে জায়ান আর আরাবীকে নিয়ে স্টেজে আসতে বললো।নূর আরাবীকে নিয়ে আসলো।আর জায়ান একা একা আসলো।পুরো ফ্যামিলি চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো আরাবী আর জায়ানকে।

সাথি জায়ানের হাতে আংটির বক্সটা দিলেন।ইশারা করলেন আরাবীকে পরিয়ে দিতে। জায়ান বক্সটা হাতে নিয়ে খুলে সেটা হতে আংটিটা বের করে নিলো। তারপর অন্যহাত বাড়িয়ে দিলো আরাবীর দিকে।আরাবী তাকালো জায়ানের দিকে।লোকটা এখনো তাকাচ্ছে না ওর দিকে।এভাবে জায়ানকে দেখে কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে আরাবীর।তাও চুপচাপ জায়ানের হাতে নিজের হাতটা তুলে দিলো।জায়ান আরাবীর হাতটি আলতো করে ধরে ওর আঙ্গুলে আংটিটা পরিয়ে দিলো।সাথে সাথে আরাবী কেঁপে উঠলো। হৃদয়টা জানান দিচ্ছে বার বার আজ থেকে তুই কারো বাগদত্তা।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৯

ভালোবাসার মানুষটিকে পুরোপুরি নিজের করার জন্যে অর্ধেক ধাপ এগিয়ে গেলো।টুপ করে একফোটা জল গড়িয়ে পরলো।সেটা একেবারে জায়ানের হাতের উপর পরলো।জায়ান সেটা লক্ষ্য করে চোখ বুঝে ফেললো।দ্রুত সরে আসলো।এইবার আরাবীর মা আরাবীকে আংটিটা দিতেই জায়ান নিজেই হাত বাড়িয়ে দেয়।আরাবী এখনো চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে জায়ানের দিকে।এই বুঝি লোকটা তাকালো ওর দিকে।কিন্তু নাহ তাকালো না জায়ান একবারো।আরাবী জায়ানের আঙ্গুলেও আংটিটা পড়িয়ে দেয়।ওদের বাগদান সম্পূর্ণ হয়।সবাই করতালি দিয়ে উঠে।হইহুল্লোড় শুরু হয়ে যায় চারদিক থেকে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩১