বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৯

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৯
সাদিয়া জাহান উম্মি

প্রবল বেগে বাতাস বইছে।আকাশে এখন আর চাঁদের দেখা নেই।কালো মেঘে ডেকে গিয়েছে আকাশ।হালকা বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে।একটু পরেই বুঝি এই নামলো বারিধারা।আরাবী সেদিকে তাকিয়ে খানিক চিন্তিত হলো।ঘুমন্ত জায়ানকে উঠাতে ইচ্ছে করছে না আরাবীর।কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে লোকটা।তবুও এখন না জাগালে বাড়ি যেতে পারবে না।এই বৃষ্টির মাঝে ড্রাইভ করাটাও কষ্টসাধ্য হবে জায়ানের জন্যে।আরাবী আলতো স্বরে ডাকলো, ‘ শুনছেন?উঠবেন নাহ?বৃষ্টি নামবে তো!’
জবাব নেই জায়ানের।আরাবী তপ্ত শ্বাস ফেললো।হালকাভাবে জায়ানকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘ উঠুন।উঠুন।বৃষ্টি নামবে।শুনছেন?’

এবার যেন একটু নড়েচড়ে উঠলো জায়ান।হালকাভাবে চোখ মেলে তাকায় জায়ান।জিজ্ঞেস করলো,’ কয়টা বাজে?’
আরাবী চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো।লোকটার ঘুম ঘুম কন্ঠ এতোটা ভয়ানক যে আরাবীর শরীরের প্রতিটা লোমকূপ শুদ্ধ দাঁড়িয়ে গিয়েছে।জায়ান উঠে বসেছে।আরাবীর দিকে একপলক তাকিয়ে ফের একই প্রশ্ন করলে।এইবার আরাবী ধীরে বলে, ‘ দশটা বাজে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জায়ান উঠে দাড়ালো।আরাবীর হাত ধরে ওকেই দাড় করালো।কয়েকপলক এদিক ওদিক তাকিয়ে চারপাশ দেখে নিলো। গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘ ওড়নাটা ভালোভাবে মাথায় স্কার্ফের মতো পেচিয়ে নেও আরাবী!’
আরাবী পিটপিট চোখে তাকিয়ে জায়ানের দিক।জায়ান হালকা উচ্চস্বরে বলে, ‘দ্রুত করো।’

আরাবী তাড়াতাড়ি উড়নাটা সেইভাবেই পরে নিলো যেভাবে জায়ান বলেছে।এইভাবে ওড়নাটা নেওয়ায় বেশ ঠান্ডা লাগছে আরাবীর।কারন ওড়নাটা মাথা ঢেকে ওড়নার দুপ্রান্ত সরুভাবে কাধের দুপাশ দিয়ে রাখা।এতে হাতগুলোতে বেশ ঠান্ডা লাগছে।জায়ান আরাবীর দিকে কয়েকপলক তাকিয়ে গায়ের কোটটা খুলে যত্নশীলতার সাথে আরাবীর গায়ে মেলে দেয়।তারপর আরাবীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।আরাবী ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে।লোকটা এতো কেন বুঝে ওকে?কিভাবে এতোটা সুন্দরভাবে ভালোবাসতে পারে?আরাবী ওর আর জায়ানের মুষ্টিবদ্ধকরা হাতজোড়ার দিকে তাকায়।তৃপ্তিকর চাহনী নিক্ষেপ করে ও নিজেও জায়ানের হাতটা শক্ত করে ধরলো।মনে মনে বললো, ‘ এইযে ধরলাম আপনার হাত আর কখনো ছাড়বোনা।ওয়াদা করলাম আমি।’

জায়ান আরাবীর দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো।তারপর আরাবীকে নিয়ে সেই নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে হাটতে শুরু করলো।এখন বাড়ি যাবে।অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।জায়ানের ফোন বাজছে।জায়ান সেটা রিসিভ করে কানে লাগালো।বলছে, ‘ হু! আসছি।এইতো কাছেই ছিলাম।ডোন্ট বি পেনিক আম্মু।আমি থাকতে তোমার বউমার কিছু হবে ভাবলে কিভাবে?আচ্ছা।ওকে।’

ফোন রাখতেই আরাবীর প্রশ্ন, ‘ আন্টি ছিলো?’
জায়ান সরু চোখে তাকায় আরাবীর দিকে।হালকা রাগি গলায় বলে, ‘ আন্টি কি? আম্মু বলবে।’
আরাবী এমন প্রশ্নে কি বলবে ভেবে পেলো না।বিয়েটা এখনো হয়নি।এখনি ‘ আম্মু ‘ বলতে কেমন যেন লজ্জা লাগে।আরাবী কথা ঘুরানোর জন্যে বললো,’ আপনি এখানে আগে এসেছেন?’
জায়ান সামনের দিক দৃষ্টি রেখেই জবাব দেয়, ‘ হু! প্রায় আসি।আমি যখন অতিরিক্ত কষ্ট পাই অথবা খুশি হই। তখন এসে চলে আসি।’

আরাবী খুব আবেগ নিয়ে তাকালো জায়ানের দিকে।হালকা আওয়াজে বলে, ‘ তো আজ এসেছেন কি করনে?কষ্টে না সুখে?’
জায়ান থেমে গেলো।আরাবীর চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো।কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে, ‘ তুমি বলো কেন এসেছি?’
আরাবী জায়ানের ওই চোখে দেখতে পেলো তৃপ্তির ছোঁয়া। চোখে মুখে সুখের আভাস।খুশির ঝিলিক।আরাবী চোখ নামিয়ে হাসলো।বললো, ‘ বুঝে নিয়েছি আমি।’
জায়ান আর কথা বাড়ালো না।বাতাসের বেগ বারছে।দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে আরাবীকে নিয়ে।তারপর গাড়ি ছুটালো গন্তব্যের দিকে।

ফ্রেস হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরুলো আরাবী।একটু আগেই ওরা বাড়ি এসে পৌছিয়েছে।বাহিরে হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। এসেই গোসল নিয়েছে আরাবী।বাহিরে এতো বাতাস ছিলো যে শরীর পুরো ধুলোবালিতে ভরে গিয়েছে।আরাবী তোয়ালে নিয়ে মাথাটা ভালোভাবে মুছে নিলো।তারপর বারান্দার দিকে আগালো।তোয়ালেটা ভালোভাবে নেড়ে দিয়ে।যেই ঘুরে আসতে নিবে ওমনেই জায়ানের বারান্দার দিকে তাকাতেই চোখ বড় হয়ে যায় আরাবীর।

জায়ান শুধু মাত্র একটা শর্ট প্যান্ট পরে৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।দেখে বুঝাই যাচ্ছে জায়ান নিজেও গোসল নিয়েছে।জায়ানের হাতের দিকে তাকাতেই আরাবীর কপাল কুচঁকে আসলো।হাতে ওটা কিসের বোতল দেখা যাচ্ছে?আরাবী আরেকটু মনোযোগ দিয়ে দেখলো।জিনিসটা কি বুঝতে পেরে আরাবী বিষ্ময়ে কি করবে ভেবে পেলো না। প্রায় চেঁচানো সুরে বলে, ‘ আপকি কি ড্রিংস করছেন?’

হঠাৎ আরাবীর কন্ঠ শুনতে পেয়ে জায়ান বোধহয় একটু চমকালো।আরাবীর দিকে তাকাতেই কপাল কুচকে ফেলে জায়ান।ভ্রু-কুচকে বলে, ‘ তুমি এতো রাতে শাওয়ার নিয়েছো?’
আরাবী কেমন মুহূর্তেই পাথর দৃষ্টিতে তাকালো জায়ানের দিকে।শক্ত কন্ঠে বলে, ‘ আমি একটা কুয়েশ্চন করেছি।সেটা আন্সার দিন!’
জায়ান বেশ অবাক হলো আরাবীর শক্ত আচড়ণ দেখে।পরক্ষনে বাঁকা হেসে বলে, ‘ যদি বলি হ্যা?তবে?’
আরাবী রাগি গলায় বললো, ‘ ছেড়ে দিতে বলবো এক্ষুনি।ছেড়ে দিন!’
জায়ানের ত্যাড়া জবাব, ‘ যদি না ছাড়ি?’

আরাবীর ভীতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসছে।এই মদের নেশা কতোটা ভয়ানক হয় আরাবী তা খুব ভালোভাবে জানে।এই মদের নেশার কারনেই তো ওই জানোয়ার লোকটা ওকে যার তার কাছে বিক্রি করে দিতে নিয়েছিলো।এই মদের নেশাই ওর আর ওর মা’কে প্রতিনিয়ত মার খেতে হতো।আরাবীর চোখে পানি টলমল করছে।এই বুঝি এক্ষুনি গড়িয়ে পরবে।আরাবী ধরা গলায় বলে, ‘ মদ না ছাড়তে পারলে আমায় ছেড়ে দিন।’

কথাটা বলে আর একমুহূর্ত দাড়ালো না আরাবী।দ্রুত পায়ে রুমে গিয়ে বারান্দার দরজা আটকে দিলো।এদিকে আরাবী যে এমন একটা কথা বলবে ভাবেনি জায়ান।চোখ বুঝে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেললো জায়ান।চোখগুলো লাল হয়ে গিয়েছে।হাতের বোতলটা সজোড়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে তৎক্ষনাৎ ও নিজেও রুমে প্রবেশ কর ঠাস করে বারান্দার দরজা আটকে দিলো।সেই আওয়াজের এতোটাই তীব্র আওয়াজ ছিলো যে আরাবীর শরীর সেই শব্দে ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠলো।চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো দুফোটা জল।আরাবী দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠলো। জায়ানকে ওইভাবে কথাগুলো বলে ওর নিজের মনটাই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে সহস্রবার।তবে কি বা করবে আরাবী? লোকটাকে মদের বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর নিজের হিতাহিত জ্ঞান শক্তিই হারিয়ে ফেলেছিলো।ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে জায়ান নেশা করে।এটা কখনই মানতে পারবে না আরাবী।কখনই না।উপুর হয়ে বিছানায় সুয়ে সেইভাবেই কাঁদতে লাগলো আরাবী।একসময় ঘুমিয়ে পরলো।

কি হয়ে গেলো। এইতো কয়েকমুহূর্ত আগেই ও আর জায়ান কতোটা কাছাকাছি ছিলো,পাশা পাশি ছিলো।দুজনের হাত পরস্পরের হাতের মাঝে ছিলো।আর এখন একজনের মনে তীব্র অভিমান।তো আরেকজনের মনে তীব্র রাগ পোষন করা।
তবে মনে রাখবেন।মেয়েরা অভিমান করে আরো বেশী ভালবাসার জন্য, আর ছেলেরা অভিমান করে ভালোবাসা ভালোভাবে বোঝানোর জন্য। মানুষ তার সাথেই রাগ অভিমান বেশি করে, যাকে সে ভালোবাসে।
তবে মনে রাখবেন অভিমানের মাত্রাটা যেন ওতোটা বেশি না হয়।যতোটা বেশি হলে সেই অভিমান গুলো জমতে জমতে একসময় পাথরের রূপ ধারন করে। অভিমান গাঢ় হওয়ার আগেই প্রিয় মানুষটির অভিমান ভেঙ্গে দিবেন জলদি।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৮

আরাবী ঘুমিয়ে পরেছে।বাহির হতে আরাবীর মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে।তিনি বেশ কয়েকবার ডাকলেন আরাবীকে।তবে আরাবীর কোন সারাশব্দ পাওয়া গেলো না। আরাবীর মা চুপচাপ চলে গেলেন।তার মনটাও ভার হয়ে আছে।মেয়েটা সেদিন কি কান্নাকাটিই না করলো।তারপর থেকে ঠিকভাবে কথা বলছে না।মেয়ে তার একরোখা জিদ নিয়ে আছে।তাকে বারবার বলছে আরাবীর কথায় রাজি হয়ে যেতে।কিন্তু মেয়েকে তিনি কিভাবে বুঝাবেন।সবকিছু তো আর সব জায়গায় জোড় খাটালে হয় না তাইনাহ?ভীষন ভয় হয় আরাবীর মায়ের।নিজের স্বামিকে হারিয়ে এখন তার একমাত্র বেচে থাকার উৎস তার মেয়ে।তার আরাবী।আর ওর কিছু হলে তিনি নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেন না।আরাবীর মা চোখের জলটুকু মুছে নিলেন।তারপর চলে গেলেন নিজ রুমে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩০