বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৮

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৮
সাদিয়া জাহান উম্মি

ধুমসে শপিং করা হচ্ছে।পরশুদিন আরাবী আর জায়ানের বাগদানের অনুষ্ঠান হবে।তার ঠিক তিনদিন পর থেকেই বিয়ের সকল অনুষ্ঠান শুরু হবে।তাই ওরা প্লান করেছে দুদিনের মাঝেই বিয়ের সকল প্রকার কেনা কাটা সেরে ফেলবে।পুরো পরিবার হাজির শপিং করার জন্যে।প্রায় সবারই শপিং শেষ এখন শুধু আরাবীর শপিংগুলোই বাকি। এতো এতো শাড়ি, গাউন, লেহেংগা বের করে রাখা হয়েছে।কিন্তু একটাও পছন্দ হচ্ছে না কারো।নূর কতোক্ষন বলছে এটা ট্রায় করো আবার সাথি বলছে এটা ট্রায় করে আসো।

এগুলো করতে করতেই আরাবীর দম ফুরিয়ে আসার উপক্রম।অসহায় দৃষ্টিতে সাথি আর নূরের কার্যকালাপ দেখছে ও। আরাবী ক্লান্ত চোখে আশেপাশে নজর ঘুরালো।কিন্তু কাঙ্খিত মানুষটাকে না দেখতে পেয়ে খানিক চিন্তিত হলো ও।লোকটা গেলো কোথায়?কতোক্ষন যাবত দেখছে না।হঠাৎ এইভাবে সবার মাঝ থেকে উধাও হয়ে যাবার মানে কি? আরাবী নূরের কানে কানে ধীর আওয়াজে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ নূর! তোমার ভাই কোথায় গিয়েছে বলতে পারো?অনেকক্ষন হলো দেখছি না।’
আরাবীর কথায় নূর দুষ্টু হাসি দিলো।ভ্রু নাচিঁয়ে বলে,
-‘ কি ব্যাপার আমার ভাইকে এতো খোজাখুজি কেন হ্যা?’
-‘ তো আমাকে খুঁজবে না তো কাকে খুজবে? ডাফার একটা!’
হঠাৎ এমন গম্ভীর কন্ঠে চমকে উঠে নূর আর আরাবী।পিছনে ফিরে দেখে জায়ান পকেটে দুহাত গুজে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।তার শীতল দৃষ্টি সর্বদার মতো আরাবীর উপর। আরাবী ওই দৃষ্টির তেজ সহ্য করতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিলো।জায়ান সাথিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-‘ মা বাড়ি যাবে নাহ?অনেক রাত তো হলো।চলো বাড়িতে যাই।’
নূর চেচিঁয়ে উঠলো তৎক্ষনাৎ,
-‘ কি বলছো ভাইয়া?বাড়ি যাবো মানে?কিসের বাড়ি যাবো?ভাবির জন্যে এখনো বাকি আছে শপিং করা।’
জায়ান শান্ত কন্ঠে বলে,
-‘ জাস্ট কিপ কুয়াইট।ওর জন্যে তোদের শপিং করা লাগবে নাহ।’
নূর সাথে সাথে রেগেমেগে সাথিকে বলে,
-‘ আম্মু তোমার ছেলেকে বলবে? ও সবসময় এমন করে কেন?’
জায়ান নূরের এমন চিল্লাপাল্লা শুনে বিরক্ত চোখে সাথির দিক তাকালো।চোখের ইশারায় কিছু একটা বুঝাতেই সাথি সাথে সাথে হাসেন।নূরকে বলে উঠেন,

-‘ আরাবীর শপিংয়ের জন্যে তোর চিন্তা করা লাগবে না।তুই চুপ থাক।’
নূর কাঁদো কাঁদো মুখ করে রাখলো সাথির কথা শুনে।পরক্ষনে কিছু একটা মনে পরতেই হাসি ফুটে উঠলো ওর ঠোঁটের কোণে। জায়ানের দিকে হাসি মুখে তাকাতেই জায়ান নিজেও হালকা হাসলো।তারপর সবাই যার যার শপিং নিয়ে পেমেন্ট করে গাড়িতে উঠে বসলো।আরাবীও গাড়িতে উঠতে নিতেই জায়ান ওর হাত ধরে থামিয়ে দেয়।আরাবী এতে প্রশ্ন করলো,
-‘ কি হলো?হাত ধরে আছেন কেন?গাড়িতে উঠবো না?’
জায়ানের তৎক্ষনাৎ জবাব,
-‘ নাহ! ওরা যাবে।তুমি আমার সাথে যাবে।’
আরাবী বুঝতে না পেরে বলে,

-‘ হ্যা যাবো আপনার সাথে।কিন্তু আপনি গাড়িতে উঠছেন না আর আমাকেও কেন উঠতে দিচ্ছেন নাহ?’
জায়ান এইবার প্রচুর বিরক্ত হলো।প্রায় একপ্রকার ধমকে বলে,
-‘ এতো কথা বলো কেন?চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো আমার সাথে।’
আরাবী হালকা কেঁপে উঠলো জায়ানের কথায়।এইভাবে বলার কি হলো?ভালোভাবে বললেই হতো? তাই নাহ? খারুশদের মতো ব্যবহার করে।আর কথাই বলবে না আরাবী।জায়ান হয়তো বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা।তাই এইবার শান্ত ভাবে বলে,

-‘ আমি আর তুমি পরে যাবো।তোমার সাথে আলাদা একটু টাইম স্পেন্ড করবো বুঝেছো?’
জায়ানের শান্ত কন্ঠের এই কথাগুলো শুনে আরাবীর মন ভালো হয়ে গেলো সাথে সাথে।এইযে লোকটার উপর অভিমান করেছিলো আরাবী।কিন্তু কোথায় গেলো সেই অভিমান?লোকটার একটুখানি ভালো কথা শুনলেই আরাবীর মন বরফের মতো গলে যায়।একটুও অভিমান ধরে রাখতে পারেনাহ।কেন পারে নাহ?এই মনকে নিয়ে কি করবে আরাবী?

সবাই চলে যেতেই জায়ান আরাবীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিতেই আরাবী বাহিরে দৃষ্টি ফেলে রাতের পরিবেশ উপভোগ করতে লাগলো।কিন্তু এইভাবে ভালো লাগছে না ওর।আরাবী ছোট্ট আওয়াজে বলে,
-‘ কাঁচটা নামিয়ে দিন না!’
জায়ান কোন কথা বললো না।তবে ধীরে একটুখানি কাঁচ নামিয়ে দিলো।নিমিষেই শো শো আওয়াজে বাতাস প্রবেশ করলো গাড়ির ভীতর।আরাবী আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।হঠাৎ জায়ানের ধীর আওয়াজ শোনা গেলো,
-‘ হিজাবটা খুলে ফেলো আরাবী।’

আরাবী জিজ্ঞাসাসূচক চাহনী তাকালো জায়ানের দিকে।তবে কোন প্রশব করলো না।বিনা বাক্যে আস্তে ধীরে হিজাবটা খুলে ফেললো।হিজাবটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে রেখে আবারও বাহিরের দিকে নজর দিলো আরাবী।আচমকা চুলে টান লাগায় ভড়কে যায় আরাবী।প্রবল বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যায় ওর।আরাবী চুলে হাত দিয়ে জায়ানের দিকে তাকালো।দেখে জায়ানের হাতে ওর চুলের ক্লিপ।যেটা জায়ান খুলে নিয়েছে মাত্র ওর চুল থেকে।আরাবী বিরক্ত হলো। এইভাবে চুলগুলো খুলে দেওয়ার মানে কি? আরাবী জায়ানের হাত থেকে ক্লিপটা নিয়ে নিলো।যেইনা আবার চুল বাধতে যাবে।সাথে সাথে জায়ান ধমকে উঠে,

-‘ ডোন্ট ডু দিছ। চুলগুলো খোলা রাখো।’
আরাবী চোখ মুখ কুচকে ফেললো।প্রশ্ন করলো,
-‘ আরে এইভাবে খোলা চুলে কিভাবে কি?বাতাসে দেখেন না চুলগুলো উড়াউড়ি করছে।আপনিই একটু পর বিরক্ত হবেন।’
জায়ানের সরল কন্ঠ,
-‘ হবো না।শুধু যেটা বলেছি আমি তাই করো।’
আরাবী আর অহেতুক কথা বাড়ালো না।চুপচাপ বাহিরে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষন বাদে গাড়ি থেমে যেতেই জায়ান গাড়ি থেকে বের হয়ে।ঘুরে এসে আরাবীকেও নামালো। আরাবী বললো,
-‘ কোথায় আমরা?’

জায়ান কোন জবাব দিলো না। তবে খুব দায়িত্বশীল ব্যাক্তির মতো আরাবী নরম ছোট্ট হাতটি নিজের শক্তপোক্ত হাতটি দিয়ে আঁকড়ে ধরলো।তা দেখে মুচঁকি হাসলো আরাবী।জায়ান আরাবীকে নিয়ে হাটতে লাগলো।নির্জন নিরিবিলি রাস্তা।রাস্তার দুধারে অসংখ্য ঘাস হয়ে আছে।আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে।মৃদ্যু মন্দ বাতাস।নানান পোকাদের আওয়াজ ভেসে আসছে কানে।এমন মধুময় আবহাওয়া।আর সাথে যদি প্রিয় মানুষটি থাকে তাহলে আর কি লাগে?

আরাবী আর কোন টু শব্দ করলো না।চুপচাপ জায়ানের হাতে হাত রেখে হাটতে লাগলো নির্বিকারে।সে জানে তার পাশের মানুষটিই একমাত্র পুরুষ মানুষ। যাকে আরাবী চোখ বুজে বিশ্বাস করতে পারবে। হাটতে হাটতে একটা ঘাসে ভরা মাঠ দেখতে পেলো আরাবী।সেখানে বড় একটা গাছ যার চারধারে ইট সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে দেওয়া।জায়ান আরাবীকে নিয়ে সেখানে বসালো।তারপর জায়ান হুট করে আরাবীর কোলে মাথা দিয়ে টানটান হয়ে সুয়ে পরলো।কেঁপে উঠলো আরাবী।সর্বাঙ্গ শিরশিরিয়ে উঠলো। জায়ান চোখ বুজে আছে।হঠাৎ সেইভাবেই বললো,

-‘ কিছুই তো করলাম না।তাও এমন কাঁপাকাঁপি করছো কেন?’
আরাবী থেমে থেমে বলে,
-‘ আ..আপনি এই..ভাবে…..!’
-‘ হ্যা আমি এইভাবে তারপর?’
আরাবী কি বলবে ভেবে পেলো না।ওর গলা আটকে আসছে।জায়ান আরাবীর হাতটা নিয়ে ওর মাথায় রাখলো। ধীর আওয়াজে বলে,
-‘ মাথায় হাত বুলিয়ে দেও আরাবী।মাথাটা ব্যাথা করছে।’

আরাবী জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো।আলতো হাতে জায়ানের চুলগুলো টেনে দিতে লাগলো।চুলগুলো কি সফ্ট জায়ানের।ধরলেই আরাবীর হাত ফসকে বেড়িয়ে আসছে।আরাবী হেসে দিলো।পরক্ষনে আবারও জায়ানের চুল টেনে দিতে লাগলো।কপালে স্লাইডও করে দিচ্ছে।জায়ান ততোক্ষনে ঘুম। আরাবী জায়ানের গালে হাত বুলিয়ে দিলো।চোখের পাতায় ছুঁয়ে দিতেই জায়ান ঘুমের ঘোরেই হালকা কেঁপে উঠলো।আরাবী হেসে দিলো।আবারও গালে,নাকে, সর্বশেষে ঠোঁটে হাত দিতে গিয়েও থেমে গেলো।ইস, কি করতে যাচ্ছিলো ও।

জায়ান যদি টের পেয়ে যেতো।কিন্তু কিভাবে বুঝবে জায়ান তো ঘুমাচ্ছে।আচ্ছা আরাবী যদি একটা চুমু খায় জায়ানের কপালে তবে কি জায়ান উঠে যাবে? লোকটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে টের পাবে না।আরাবী ধীরে ওর মুখটা নামিয়ে অতি সাবধানে নিজের নরম ওষ্ঠজোড়া পরম ভালোবাসা নিয়ে স্পর্শ করলো জায়ানের কপালে।সেকেন্ড গড়াতেই দ্রুত সরে আসলো।কারন জায়ান হাললা নড়ে উঠেছে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৭

লজ্জায় আরাবী লাল নীল হয়ে গেলো।মনে মনে নিজেকে একশো একবার বাহবা দিচ্ছে।কি একটা ভয়ানক কাজই না করে ফেললো ও।অবশ্য জায়ান জেগে থাকলে এমনটা কাশ্মিনকালেও করতে পারতো না আরাবী।দেখা যেতো এমন চিন্তাভাবনা মাথায় আনতে গেলেও লজ্জা ও জ্ঞান হারিয়ে পরে যেতো।লোকটা ঘুমানোর কারনেই আজ এটা করতে সক্ষম হয়েছে আরাবী।লাজুক হেসে আরাবী আবারও জায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৯