বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৭

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৭
সাদিয়া জাহান উম্মি

‘কাঠগোলাপের যে কাঁদা বারণ আছে।সে কাঁদলে যে অন্যজনের বুকে পীড়া হয় তা কি সে জানে?’
এমন বাক্যগুলো আরাবীর কানে এসে পৌছাতেই আরাবী মাথা নিচু করে রাখে।সে জানে লোকটা কে।তবে তার দিকে তাকাতে কেমন যেন ইতস্ততবোধ করছে আরাবী।আরাবীর কান্না করা বিধ্বস্ত মুশ্রীটা ও জায়ানকে দেখাতে চাচ্ছে না।তাই মাথা নিচু করে রাখলো।জায়ান তপ্ত শ্বাস ফেলে আরাবীর চিবুক ধরে ওকে নিজের দিক ফিরালো।

এর কারনে আরাবী করুন দৃষ্টিতে জায়ানের দিকে তাকায়।না চাইতেও চোখের জলগুলো আবারও গাল গড়িয়ে পরছে।জায়ান আলতো হাতে সেই চোখের জলগুলো মুছে দিলো।তারপর মুখশ্রীটা এগিয়ে নিয়ে আরাবীর কপালে আদুরে স্পর্শ দিলো।আরাবী চোখ বন্ধ করে জায়ানের হাত খামছে ধরলো।জায়ান সরে আসতেই আরাবী পিটপিট চোখে জায়ানের দিকে তাকালো।খানিক তাকিয়েই রইলো।তারপর হুট করে একেবারে জায়ানের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে।দুহাতে জায়ানের পিঠ খামছে ধরে মুখ লুকায় জায়ানের বুকে।জায়ান খানিকটা পিছনে দিক এলিয়ে গেলেও।নিজেকে সামলে নেয়।তারপর আরাবী ভালোভাবে আকড়ে নেয় নিজের সাথে।আরাবী মুখ লুকিয়ে ফোপানো আওয়াজে কাঁদছে।কান্নার ফলে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর পিঠ।জায়ান আরাবীর পিটে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ কাঁদলে কোন কিছু ঠিক হবে না আরাবী।কান্না না করে এটা ভাবো কিভাবে তোমার সব সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়।নিজেকে শক্ত করো আরাবী।এভাবে ভেঙ্গে পরলে চলবে নাহ!’
আরাবী জায়ানের কথায় চুপটি করেই রইলো।প্রায় অনেকক্ষন বাদে আরাবী মুখ খুললো,

-‘ মায়ের কারনে আজ আমার এই হাল।তিনি যদি সেদিন নিজের অধিকারটুকু বুঝে নিতেন।আমার বাবার প্রতিটা জিনিসে উনার হক আছে আমার হক আছে।সেখানে উনি সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে এলেন।তার এই ছোট্ট দোষের কারনে আজ আমার এই হাল।সেদিনের পর থেকে আমি রাস্তার কুকুরদের মতো মানুষের জঘন্য ব্যবহার সহ্য করে বড় হয়েছি।যেগুলো আমি ভোগ করবো আজ তা দিয়ে অন্যেরা বিলাসিতা করছে।

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আমি লোভি।কিন্তু এমনটা না।আপনি বলুন আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান।তার সবকিছুতে আমার অধিকার।আর আমি কেন আমার অধিকার ছেড়ে দিবো?আমার মা ছেড়ে দিয়ে এসেছে বলে কি আমি ছেড়ে দিবো? কখনই নাহ।একবার যখন শহরে এসেছি।আমার জন্মভূমিতে এসেছি।তখন সব সুধে আসলে আদায় করবো।কিন্তু আমাত মা নিজেই আমাকে আগাতে দিচ্ছে না।তিনি ঠিক সেই আগের মতোই সবটা করে যাচ্ছে।তিনি কেন বুঝেন না।দুনিয়াতে তার মতো সরল মানুষদের জন্যে বড্ড কঠিন।আমি হানিফ আহমেদকে নিয়েও প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম।

সেখানেও তিনি আমায় বাধা দিলেন।গ্রামের মানুষদের ভয় দেখালেন।আমি প্রতিবাদ করলে নাকি হানিফ আহমেদ গ্রামের মানুষদের সাহায্যে আমাদের মেরে ফেলবেন।বিশ্বাস করুন সেদিন আমি নিজেকে নিয়ে একটুও ভয় পায়নি।ভয় পেয়েছি শুধু আমার মায়ের জন্যে।তার কিছু হলে আমি কিভাবে বাঁচবো?পুরো পৃথিবীতে তো সেই আমার একমাত্র মানুষ।আমার একমাত্র ভরসা স্থল ছিলো।মায়ের কারনেই ঠিক প্রতিবার আমি নিজেকে দমিয়ে ফেলি।কিন্তু আর কতো?বলতে পারবেন আর কতো?’
জায়ান আরাবীকে টেনে বুক থেকে উঠালো।আরাবীর গালে ধীরে স্পর্শ করলো।আরাবী চোখ বুজে নিতেই জায়ান আরাবীর সিক্ত চোখজোড়ায় নিজের অধর স্পর্শ করালো।দীর্ঘক্ষণ সেভাবেই থেকে সরে আসলো জায়ান।আরাবীর দুগালে হাত রেখে ধীর কন্ঠে বলে,

-‘ তুমি যথেষ্ট স্ট্রোং একটা মেয়ে আরাবী।এইভাবে আর কাঁদবে না।শুধু একটু ধৈর্য ধরো।আমি আছি তো। তোমার পাশে সর্বদা আমি আছি আরাবী।সব ঠিক হয়ে যাবে।সব ঠিক করে দিবো আমি।যা তোমার তা সব তোমার কাছেই ফিরি আসবে। আমি তোমাকে প্রমিস করলাম।’

জায়ানের প্রতিটা কথায় আরাবীর মনটা প্রশান্তিতে ভর উঠলো।এই মানুষটার প্রতিটা কথায় আরাবী ভরসা খুঁজে পায়।নতুন করে সবটা শুরু করার মতো শক্তি খুজে পায়। আরাবী সিক্ত চোখেই হালকা হাসলো।জায়ানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই আরাবীর শ্বাস আটকে আসার উপক্রম।ও লোকটার এতোটা কাছে তা তো টেরই পায়নি আরাবী।লজ্জায় মাথা নত করে ফেললো।একটু আগে জায়ান কি কি করেছে ভাবতেই শরীর কেমন শিরশিরিয়ে উঠছে আরাবী।নিজেকে জায়ানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালো।কোনরকমে বললো,

-‘ আ..আমি নিচে যাচ্ছি।আপনিও আসুন।দ্রুত!’
আরাবী চলে যেতে নিতেই হঠাৎ ওড়নায় টান খেলো।চমকে উঠে আরাবী।গলার কাছের ওড়নাটা শক্ত হাতে ধরে ফেললো।শরীর কাপছে আরাবীর।জায়ান এইভাবে ওর ওড়না টেনে ধরবে ভাবতেও পারিনি ও।আরাবী কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে,
-‘ কি করছেন?এই..এইভাবে ওড়না টেনে ধরেছেন কেন?ছা..ছাড়ুন না।কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?ছাড়ুন না প্লিজ!’
জায়ানের কোন সারাশব্দ পাওয়া গেলো না।আরাবী ওড়না টেনে নিজের কাছে আনার জন্যে আবারও চেষ্টা করলো আবারও ব্যর্থ হলো আরাবী।অসহায় কন্ঠে বলে,

-‘ কি কর..করছেন?ছেড়ে দিন প্লিজ।’
জায়ান এইবারও চুপ।আরাবী সহ্য করতে না পেরে এইবার পিছনে ঘুরে জায়ানের দিকে তাকালো।তাকাতেই বিশাল বড় একটা ঝাটকা খেলো।বিষ্ময়ে আরাবীর মুখটা হা হয়ে গেলো। এমনটা যে হবে কাশ্মিনকালেও ভাবেনি আরাবী।ওর ওড়নাটা জায়ান টেনে ধরে নি।বরংচ ওর ওড়নাটা ছাদের রেলিংয়ের রডের সাথে আটকে গিয়েছে।জায়ান পকেটে দু হাত গুজে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তাকিয়ে আরাবীর দিক।এখনো ওর বিষ্ময় কাটছে না।জায়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে,

-‘ আশেপাশে একবার ভালোভাবে তাকিয়ে থেকে তারপর কিছু বলবে ঠিক আছে?নাহলে মানুষ তোমাকে পাগল ভাববে।’
আরাবীর মুখটা এখনো হা হয়ে আছে।অবাকতার রেশ এখনো কাটাতে পারেনি একবার ও নিজের ওড়নার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার জায়ানের দিকে তাকাচ্ছে।জায়ান আবারও বললো,
-‘ মুখটা বন্ধ করো নয়তো মশা ঢুকবে।’

আরাবী থতমত খেয়ে দ্রুত মুখের হা টা বন্ধ করে নিলো।ও আরো ভেবেছিলো আরাবী চলে যাচ্ছিলো এই জন্যে বুঝি জায়ান ওর ওড়না টেনে ধরেছে।যেমনটা আরাবী ফিল্মে দেখে হিরোরা করে হিরোইনদের সাথে।কিন্তু ওর কপালে যে এমনটা হবে না এটা ভাবেনি আরাবী।মনে মনে নিজেকে একশো একটা গালি দিলো আরাবী।পরক্ষনে আবার জায়ানকেও দোষারোপ করলো।অসভ্য লোকটা এতোক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর কথা শুনে গেছে।একবার বলেও নি।আরাবী মুখ ফুলিউএ নিলো।

কথা বলবে না বজ্জাত লোকটার সাথে।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছিলো খারুশ লোকটা।জায়ান হালকা হাসলো আরাবীর মুখ ফুলানো দেখে।মেয়েটার দুয়েক সময় এমন বাচ্চামো করে জায়ান না চাইতেও হেসে ফেলে আরাবীর কর্মকান্ড দেখে। জায়ান এইবার এগিয়ে গিয়ে যত্নশীল প্রেমিকের মতো আরাবীর ওড়নাটা ছাড়িয়ে নিলো।তারপর সেটা নিয়ে আরাবীর মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলো।আরাবী মাথা নিচু করে হাত কচলাতে লাগলো।লজ্জা লাগছে ওর একটু আগের কর্মকান্ডের জন্যে।জায়ান আরাবীর কানের কাছে মুখ নিয়ে মাদকতা ভরপুর কন্ঠে বললো,

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৬

-‘ আজ ওড়না আমি টেনে ধরেনি।তবে ধরবো না এমনটাও গ্যারান্টি দিবো না।শুধু বিয়েটা হতে দেও।তোমার সাথে এমন সব কান্ড ঘটবে তুমি নিজেকে স্বাভাবিক করে ঠিকবাবে শ্বাস নেওয়ারও সময় পাবেনা।আমার কথাটা মিলিয়ে নিও।’
কথাগুলো বলা শেষ হতেই জায়ান পকেটে দু হাত গুজে নির্বিকাত ভঙ্গিতে চলে গেলো ছাদ থেকে।কিন্তু এদিকে যে লোকটা জানলোই না ও আরাবীর মনে ঠিক কতো ডিগ্রি পরিমান ঝড় উঠিয়ে দিয়েছে।অনুভূতির প্রবল ঝড়ে আরাবীর শ্বাস প্রায় আটকে।শরীরের কাঁপা কাঁপি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে।আরাবী তো বুঝতেই পারছে না যে ও আরাবী নিজে কাঁপছে না জমিন কাঁপছে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৮