বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৬

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৬
সাদিয়া জাহান উম্মি

আজ সকাল থেকেই আরাবী পালাই পালাই করছে জায়ানের কাছ থেকে।কাল রাতে জায়ানের করা কর্মকান্ডে লজ্জায় ও জায়ানের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না একটুও।জায়ানের সাথে প্রতিদিন ভোরে কথা বলে আরাবী।আজ তাও করলো না।চুপচাপ নাস্তা সেরে নূরকে নিয়ে ভার্সিটিতে চলে গিয়েছে।লজ্জায় তার গাল দুটো ফুলোফুলো হয়ে আছে।ক্লাসে বসেও স্যারের পড়ানোতে ধ্যান দিতে পারিনি আরাবী।বারবার কাল রাতের কথা ভেবে গিয়েছে অন্যমনস্কভাবে।আরাবীকে এমন আনমোনা দেখে নূর বার কয়েক জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে। কিন্তু আরাবী কিছুই বলেনি।ভার্সিটি মাঠ দিয়ে হাটছে আরাবী আর নূর।আরাবীকে কৃষ্ণচূড়ার গাছটার কাছে বসবে জানালো নূরকে।তাই তারা গিয়ে ওখানে বসলো।আরাবী সেখানে বসে আবারো জায়ানের ভাবনায় মশগুল হয়ে গেলো।বসে বসে লজ্জা ভঙ্গিমায় মিটিমিটি হাসছে।নূর আরাবীকে এমন করতে দেখে এইবার বিরক্ত হয়ে বললো,

-‘ তুমি কি বলবা কি কারনে তুমি আজ এমন করছো?’
আরাবীর নূরের প্রশ্ন শুনে থকমত খেয়ে গেলো।দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলে,
-‘ আরে কিছু হয়নি তো!তাহলে কি বলবো তোমায়?’
নূর এইবার বেশ তেজ নিয়ে বলে,
-‘ কিছু হয়নি তো এমন করছো কেন? ক্লাসের পড়াতেও ভালোভাবে মন দেওনি!’
-‘ আহ! রাগ করছো কেন?আজ এমনিই মনটা অতিরিক্ত ভালো তাই এই অতিরিক্ত ভালোলাগার কারনে আমি ক্লাসেও মনোযোগ দিতে পারিনি।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আরাবীর এমন যুক্তিছাড়া কথা শুনে নূর কি বলবে ভেবে পেলো না।তাই অগত্যা হার মেনে নিলো আর কথা না বাড়ানোর।প্রায় মিনিট পাঁচেক পরেই গাড়ি আসলো ওদের।আরাবী তা দেখে বলে,
-‘ নূর চলো।গাড়ি এসে পরেছে।’
নূর মাথা দোলালো।তারপর দুজনে বাড়ি যাওয়ার জন্যে রওনা হলো।

ভার্সিটি থেকে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে মায়ের কাছে এসে এক লম্বা ঘুম দিয়েছে আরাবী।এখনো মায়ের কোলে মাথা দিয়ে সুয়ে আছে আরাবী।আর ওর মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আরাবী মায়ের কোলে মাথা দিয়ে নানান কিছু চিন্তা করছে।একটা কথা তাকে বার বার ভাবাচ্ছে।কিছুতেই সাহস পাচ্ছে না মা’কে এই কথাটা বলার।আরাবীর মা হয়তো মেয়ের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন।স্বস্নেহে বললেন,

-‘ কিছু বলবি মা?বলার থাকলে বলে ফেল।’
আরাবী হাসলো।সে জানে তার মা ওর মুখ দেখেই মনের চাওয়া পাওয়াটা বুঝে ফেলে নিমিষেই।আরাবী ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
-‘ মা শহরে আসলে।একবার বাবার কবরটা জিয়ারত করবে না?আর আমারতো মনে নেই বাবাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে তাই যেতে পারিনি।এখন তুমি এসেছো। তুমিতো জানো বাবাকে কোথায় রাখা হয়েছে।চলো না মা।একবার বাবাকে দেখে আসি।আর তার কবরটা জিয়ারত করে আসি।’

মেয়ের কথায় বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে উনার।আসলেই তো কতোটা বছর পেরিয়ে গেলো মানুষটা আর নেই আর ওর কাছে।ওর ভালোবাসার মানুষটা উনাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। চোখ ভরে উঠলো জলে।প্রিয় মানুষটাকে দেখতে কেইবা না চায়।কিন্তু আরাবীর মা অসহায়।তার হাতে কিছু নেই।কিছু করার নেই।মেয়ের কথায় যে তার ভীতরটা ফেটে যাচ্ছে।কিভাবে মেয়েকে বুঝাবে যে এই শহরে পা দেওয়া মাত্রই উনি নিজের স্বামির কবরটা দেখার জন্যে দিনরাত ছটফট করে কাটাচ্ছেন।তার অন্তরে যে অসহনীয় দহন হচ্ছে তা কি করে বোঝাবে?তারও তো খুব করে মন চাইছে ছুটে গিয়ে প্রিয় মানুষটার কবরের বুকে লেপ্টে থেকে হাউমাউ করে কাঁদতে।এতো বছরের জমানো সকল কথা ওই নিশ্চিন্তে ঘুমানো মানুষদের কাছে পৌছে দিতে।তার কবরটা জিয়ারত করতে।কিন্তু তিনি পারছেন না।পরিস্থিতি তাকে এতোটা অসহায় বানিয়ে দিয়েছে যে উনি চাইলেও পারছেন না। আরাবী ওর মাকে এমন চুপ থাকতে দেখে আবারও বললো,

-‘ কি হলো মা? নিয়ে যাবে না আমায়?’
আরাবীর মা ধুকরে কেঁদে উঠলেন।হঠাৎ উনাকে এমন কাঁদতে দেখে ভড়কে গেলো আরাবী।তৎক্ষনাৎ মায়ের কোল থেকে উঠে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
-‘ কি হয়েছে মা?কাঁদছো কেন?কেঁদোনা প্লিজ?আমার কোন কথায় কি তুমি কষ্ট পেয়েছো?’

আরাবীর মা মেয়ের কথায় চোখ মুছে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কান্না খানিকটা কমে আসলে তিনি বলেন,
-‘ তুই কি ভাবিস?আমি কি পাষাণ?আমার কি মন চায় না তোর বাবার কবরটা দেখতে?এই শহরে পা রাখার সাথে সাথে মন চাইছিলো তার কাছে ছুটে যাই।এইযে এখনো পারলে আমি চলে যাই।কিন্তু আমি অসহায়।আমার কোন ক্ষমতা নেই তার কবরটা একপলক দেখার।আমি তার স্ত্রী হয়েও তার কবরটা দেখতে যেতে পারবো না।সেই অধিকারটুকুও আমার নেই।’
আরাবী মায়ের এমন কথায় রাগে দুঃখে প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠে,

-‘ কেন মা?কেন?কেন পারবে না তুমি?কি কারনে পারবে না? তুমি আজও আমায় আমার বাবার বাড়ির ঠিকানা বললে না।শহর এখন আরো উন্নত হয়েছে আগের মতো কিছু নেই।যদি আগের মতোই সব থাকতো আমি অপেক্ষা করতাম না।সেই ছোট্ট সময়ের কথা মস্তিষ্ক ঠিকঠাক ধারন করে রাখতে পারিনি।নাহলে আমি কি এখানে এসেও বসে থাকতাম? উহু! কোনদিন না।আমি সেই কবেই চলে যেতাম।কিন্তু এখন যখন তুমি এসেছো তাও তুমি আমায় বলছো না কিছু।কেন এমন সবকিছু গোপন করো মা? আমাকে আমার বাবার কবরটা এই ইহজীবনে শুধু একবার দেখতে দেও।

আমি একবার তার কবরটা হাত দিয়ে স্পর্শ করতে চাই।তার কবরের মাঝে সুয়ে থাকতে চাই।বাবাকে অনুভব করতে চাই।কিন্তু তুমি এইভাবে চুপ করে থাকলে কিভাবে হবে মা?কেন এমন করছো আমার সাথে?তোমার এই সরলতাই আমার থেকে সব ছিনিয়ে নিয়েছে মা।সেদিন যদি তুমি আইনের ব্যবস্থা নিতে।রুখে দাড়াতে।তাহলে আজ আমাদের এইভাবে ভিখাড়িদের মতো পরে থাকতে হতো না।না মানুষের লাথি উষ্ঠা খেয়ে বড় হতে হতো।

তুমি নিজের কারনে আজ নিজেই এমন নিঃস্ব।আমায় মিহান আংকেল বলেছেন বাবা আমাদের নামে তার সব সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন।মিহান আংকেলকে নিয়েই সেই দলিল বানিয়েছেন তিনি।যে তিনি যদি মারা যান তাহলে তার সকল সম্পত্তি আমাদের হবে।কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না।সেদিন নিজেকে সবার সামনে দূর্বল প্রমান করে। নিজের অধিকার নিজের হক ছেড়েছুড়ে চলে গেলে।কেন মা?তুমি কেন করলে এমনটা?কেন করলে?’

আরাবী কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।আর আরাবীর মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন মেয়ের কথা শুনে।তার মেয়ে তো ভুল কিছু বলেনি।সত্যিই তো তিনি কেন পারলেন না সেদিন কিছু কর‍তে।নিজের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েও কেন পারলেন না সেদিন রুখে দাড়াতে।আরাবীর মা আচঁলে মুখ চেপে ধুকরে কেঁদে উঠলেন।

ছাদের রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে বসে আরাবী।’দ’ আকৃতিতে বসে ও।হাটুতে মুখ গুজে অনরবত কাঁদছে আরাবী।চিৎকার করে কাঁদতে পারলে বুঝি বুকের এই অসহনীয় পীড়াটা একটু কম হতো।কিন্তু আরাবী পারছে না কাঁদতে।এই ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্নাগুলোও যেন ওর কষ্টগুলো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত।নিজেকে পাগল পাগল লাগছে আরাবীর। কষ্টগুলো কেন কমে না?

কেন বুকের মাঝে এতো পীড়া হয়? আরাবী কি করবে ভেবে পেলো না।রাগে,দুঃখে নিজের চুল টেনে ধরলো আরাবী।আকাশের দিক তাকিয়ে রইলো একধ্যানে।অবাধ্য নোনাজলগুলো ক্রমান্বয়ে গাল গড়িয়ে পড়ে গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে আরাবীর।ঠিক তখনি কানের কাছে ভরাট কন্ঠের আওয়াজ শোনা গেলো,
-‘ কাঠগোলাপের যে কাঁদা বারণ আছে।সে কাঁদলে যে অন্যজনের বুকে পীড়া হয় তা কি সে জানে?’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৫

আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনারা? অনেকেই প্রশ্ন করেছেন আমার আম্মু কেমন আছে।আলহামদুলিল্লাহ! আম্মু এখন ভালো।হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে।বাড়িতে এনে ফেলেছি আম্মুকে। তবে সে প্রোপার রেস্টে আছে।সকলের দোয়ায় আর আল্লাহ্’র রহমতে।আমার আম্মু খুব দ্রুত রিকোভার করতে সক্ষম হয়েছে। অনেক ধন্যবাদ সবাইকে। আর হ্যা গল্পটা কেমন হয়েছে জানাবেন।ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।গল্পটা কি আপনাদের একগেয়ামি লাগছে?আমি কি দ্রুত কাহিনি টেনে শেষ করে দিবো?রেস্পন্স এতো কমে গেলো কেন? সুন্দর সুন্দর মন্তব্য চাই সবার।পরিশেষে সবাইকে ভালোবাসা।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৭