বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩২

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩২
সাদিয়া জাহান উম্মি

দমবন্ধকর পরিবেশ। কিভাবে এখান থেকে নিজেকে বাচাতে পারবে আরাবী তা ক্ষনে ক্ষনে ভেবে চলেছে।গলা শুকিয়ে আসছে।ভয়ে হৃৎপিন্ডটা জোড়ে জোড়ে লাফাচ্ছে।আরাবী নিজের ভয়টাকে দেখাতে চাচ্ছে না।তাই নিজেকে শক্ত করে।তেজি কন্ঠ বলে উঠে,’ কি সমস্যা আপনার?আর আপনি এখানে কি করছেন? পার্টি নিচে হচ্ছে।আপনি আমার রুমে কেনো এসেছেন?জায়ান জানতে পারলে আপনাকে আজ আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না।নেহাতই আপনি তার কাজিন হোন।তাই পার্টিতে আসতে পেরেছেন।নাহলে সে তো আপনাকে আমার ত্রি-সীমানায়ও আসতে বারণ করেছে।ভুলে গিয়েছেন?বেড়িয়ে যান এখান থেকে।’

আদি যেন আরাবীর কথায় বেশ মজা পেলো।পৈচাশিক হাসি দিয়ে বলে, ‘ খুকি তুমি? বুঝো না কিছু?কেন এসেছি একটুও বুঝোনি? সেদিনের রাস্তায় করা অপমানের কথা এতো সহজে ভুলে যাবো কিভাবে আমি?শোধ তুলতে হবে না?আর রইলো জায়ানের কথা? ও জানতে পারলে তো আমাকে কিছু করবে?তার আগে তুই শেষ।সেদিন পাবলিক প্লেস ছিলো বিধায় কিছু বলিনি।কিন্তু আজ কিভাবে তুই বাচঁবি বল?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মুহূর্তেই রাগে ফুসতে ফুসতে আরাবীর কাছে চলে এলো।আরাবী দৌড়ে বারান্দার দিক যেতে নিতেই।আদি ওর হাত ধরে টেনে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দেয়।আরাবীর চোখ থেকে পানি পরছে।কিভাবে নিজেকে সামলাবে আরাবী?কিভাবে রক্ষা করবে এখান থেকে নিজেকে।একবার দরজার দিকে বা বারান্দায় যেতে পারলেও হতো।বারান্দায় গেলে সেখান থেকে জায়ানকে ডাকতে পারবে।বা কিছু একটা তো করতে পারবে।কিন্তু যাবে টা কিভাবে?

আরাবী দুহাতে চোখ মুছে নিলো।যেই না বিছানা থেকে উঠতে যাবে।তার আগেই আদি এসে আরাবীর উপরে ঝাপিয়ে পরে।আরাবী চিৎকার করে উঠে।কিন্তু আফসোস কেউ তার চিৎকার শুনছে না। আরাবী দুহাতে ঠেলে সরাতে চাইছে আদিকে।কিন্তু একটা পুরুষের সাথে কি একটা মেয়ে কখনো পারে শক্তিতে।আরাবী নিজেকে শান্ত করলো। আরাবীকে হঠাৎ শান্ত হয়ে যেতে দেখে আদি বাঁকা হেসে তাকালো আরাবীর দিকে।বললো,’ কি সব তেজ শেষ? আমি বললাম তো পারবে না আমার সাথে।এর থেকে ভালো এঞ্জয় করো আমার সাথে।কেউ জানতে পারবে না।আমি সবটা সিক্রেট রাখবো প্রমিস।’

আরাবী হিংস্র চোখে তাকালো আদির দিকে।পারলে এক্ষুনি এই আদিকে আরাবী টুকরে টুকরে কেটে ফেলবে এমনভাবে রাগে ফুসছে ও।আরাবী নিজের গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজের হাটু দ্বারা আদির পেইন পয়েন্টে আঘাত করে দিলো।আদি চিৎকার করে সরে গেলো।ব্যাথা গোঙ্গাতে লাগলো আদি।এই সুযোগে আরাবী দ্রুত উঠে দাড়ালো বিছানা থেকে।রাগি গলায় বলে, ‘ আমাকে অবলা ভাবিস না।তোদের মতো জা*নোয়ারদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমি ভালো করে জানি।’

আরাবী কথাগুলো বলে যতোদ্রুত পারে রুমের লাইট ওন করলো।তারপর দরজা খুলতে গিয়ে ভীষন অবাক হলো আরাবী।দরজায় পেছন থেকে লক করা।কিভাবে কি করবে আরবী? এখন এখান থেকে বের হবে কিভাবে।আরাবী উপায় না পেয়ে দরজায় জোড়ে জোড়ে আঘাত করতে লাগলো।আর চিল্লাতে লাগলো, ‘ প্লিজ হেল্প।কেউ আছেন? প্লিজ দরজাটা খুলে দিন।জায়ান আপনি কোথায়?ইফতি ভাইয়া?নূর।’

কিন্তু না কারো আওয়াজ পাওয়া গেলো না।আরাবী না পারতে কেঁদে দিলো।এতোক্ষন নিজেকে শক্ত করে রাখলেও এখন আর পারলো না।ততোক্ষনে আদি ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসেছে। হাসঁতে হাসঁতে বললো, ‘ এতো কাচা খেলা আমি খেলি না।তোকে তো যে করেই হোক।আমার বেড পার্টনার বানাবোই।’

এমন কথায় চমকে উঠলো আরাবী।তাকিয়ে দেখে আদি উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করছে।ভয় পেলে আরাবী।চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিজেকে রক্ষা করার উপায় খুজতে লাগলো।বারান্দার দিকে নজর যেতেই একটু আশার আলো পেলো আরাবী।দ্রুত সেদিকে দৌড়ে নিতেই ততোক্ষনে আদি দাঁড়িয়ে গিয়ে।ওর চুল টেনে ধরে।ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে আরাবী।ঘারেও প্রচুর জ্বলছে।তারপরেও নিজের ব্যাথাটাকে তোয়াক্কা করলো না।পিছনে ঘুরে আদির নাক বরাবর ঘুশি মেরে দিলো।

এক হাতে নাক ধরে চিৎকার করলো আদি।তাও আরাবীর চুল একহাতে ধরে রেখেছে।ছাড়ছে না।আরাবী দুহাতে আদির হাতে খামছাতে লাগলো নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে।অবশেষে আদি হাত ছেড়ে দিতেই দৌড়ে বারান্দায় চলে গেলো।দরজা আটকে দিলো আরাবী।রেলিং ধরে হাপাতে লাগলো। উপর থেকে চিল্লাতে লাগলো।সাহায্যের জন্যে।কিন্তু মিউজিকের আওয়াজে কেউ শুনছে না ওর আওয়াজ।এদিকে আদি এতো এতো ব্যাথা পেয়েও থেমে নেই।নিজেকে সামলে নিয়ে দরজায় জোড়েজোড়ে লাত্থি দিতে লাগলো।মূল পরিকল্পনা দরজা ভেঙ্গে ফেলা।এদিকে আরাবী কাঁদতে কাঁদতে জায়ানকে ডেকে চলেছে।পরক্ষনে দরজা ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে যায় আরাবী।কাদঁতে কাঁদতে বলতে লাগলো,’ আরে কেউ তো এদিকটায় তাকাও প্লিজ।’

জায়ানের মনটা বড্ড অস্থির লাগছে।কেমন যেন লাগছে ওর।চারদিকে নজর ঘুরালো।নাহ মেয়েটার দেখা নেই।কোথায় গেলো?অনেকক্ষন যাবত দেখছে না আরাবীকে। জায়ান নূরের কাছে এগিয়ে গেলো জিজ্ঞেস করলো, ‘ আরাবী কোথায় নূর?’
জায়ান প্রশ্নে পাশে দাঁড়ানো ইফতি বললো, ‘ ও রুমে গিয়েছে ভাই।কিন্তু বুঝলাম না বললো একটু পরেই এসে যাবে।কিন্তু এখনো আসছে না কেন? অনেকক্ষন হয়ে গিয়েছে।’

জায়ানের মনটা কেমন ধ্বক করে উঠলো।ইফতির কথায় কপালে চিন্তার ভাজ পরলো।কি মনে করে যেন আরাবীর রুমের বারান্দার দিকে তাকালো।তাকাতেই যেন জায়ানের দুনিয়া ঘুরে উঠলো।এ কি অবস্থা তার আরাবীর। তার আরাবী কাঁদছে কেন?
এদিকে জায়ানকে তাকাতে দেখে যেন আরাবীর কলিজায় পানি আসলো।দ্রুত কাঁদতে কাঁদতে চেচাঁলো,’ আমাকে বাঁচান জায়ান।হেল্প মি। আদি আমার সাথে………!’

বাকিটা বলার আগেই ধরাম করে আওয়াজ হলো।হ্যা আদি দরজা ভেঙ্গে ফেলেছে। আরাবী চেঁচিয়ে উঠলো।কি করবে ও?এখান থেকে লাফ দিবে? সেটাই এখন একমাত্র রাস্তা বাকি। আরাবীর যেই না সেটা করতে যাবে তার আগেই আদি এসে আরাবীর চুল মুঠি ধরে লাগাতার চার পাঁচটা থাপ্পড় মেরে বসলো।আরাবী ছিটকে রেলিংয়ের উপর পড়ে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো।
জায়ান সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো, ‘ আরাবী!!”

জায়ান সর্বোচ্চ গতিতে দৌড় লাগালো আরাবীর কাছে যাওয়ার জন্যে।এদিকে ইফতি আর নূর এসব দেখে হতবাক।ইফতি জলদি নূরকে বললো,’ মিউজিন বন্ধ করতে বল। আর সবাইকে জানা আব্বু আর বড়বাবাকে পুলিশে ইনফোর্ম করতে বল।আমি যাচ্ছি।’
নূর কথা মতো চলে গেলো।ইফতিও জায়ানের পিছন পিছন দৌড়।

আদি আরাবীকে টেনে হিচড়ে রুমে এনে ধাক্কা দিলো আরাবীকে।যেই না আরাবীর কাছে আসবে তার আগেই প্রচন্ড শব্দে দরজা খুলে ভীতরে ঢুকে জায়ান।ঢুকেই স্তব্ধ চোখে আরাবীর দিকে তাকিয়ে আছে ও? এ কি হাল হলো ওর কাঠগোলাপের।এদিকে আরাবী কাতর নয়নে তাকিয়ে জায়ানের দিকে।উঠে যে দাঁড়াবে সেই শক্তিটুকুও বিন্দু পরিমান নেই ওর মাঝে।মাথায় আঘাত লাগার কারনে চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসছে আরাবীর। জায়ান চোখ বন্ধ করে নিলো।সে সহ্য করতে পারছে না ওর কাঠগোলাপের এই অবস্থা।

জায়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে।হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে ধপ করে তাকালো জায়ান।আদি সাথে সাথে ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে গেলো জায়ানের ওই রাগে লাল হয়ে আসা হিংস্র চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে।জায়ান হুংকার দিয়ে দিয়ে আদির কাছে গেলো।তারপর এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো আদিকে। বড় লম্বা একটা লোহার ফুলদানি সেটা হাতে তুলে নিয়ে পিটাতে লাগলো আদিকে। চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘ কুত্তা*র বাচ্চা।তোর সাহস কিভাবে হলো?ওর দিকে হাত বাড়ানোর।আজ তোকে আমি মেরে ফেলবো।তোকে জ্যান্ত মাটিতে পুতে দিবো আমি।আমার আরাবীকে যেই হাত দিয়ে ছুঁয়েছিস যেই হাত আমি ভেঙ্গে দিবো।’

বলতে বলতে জায়ান আদির ডানহাতে একেরপর এক আঘাত করতে লাগলো।মার খেয়ে আদি ফ্লোরে লুটিয়ে পরলো।তাও থেমে নেই জায়ান। একেরপর এক লাথি দিয়ে চলেছে আদিকে।মুখ দিয়ে, নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত পরছে আদির।জায়ান মারতেই আছে মারতেই আছে।

ইফতি এসেই হতবাক।জায়ানের এমন ভয়ানক হিংস্রতা ইফতি আজ প্রথম দেখলো।তবে থামালোনা জায়ানকে।ফ্লোরে নিস্তেজ শরীরে পরে থাকা আরাবীর কাছে গেলো নিজের গায়ের কোট খুলে আরাবীর গায়ে জড়িয়ে দিলো।কারন আরাবীর গাউনের অনেক জায়গাতেই ছিড়ে গিয়েছে।বোনের থেকে বেশি স্নেহ করা আরাবীকে এই অবস্থায় দেখে ইফতি ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।আরাবীকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত এই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।তারপর ইফতি ওকে নিজের রুমে গিয়ে সুইয়ে দিলো।ইফতি উঠে ঔষুধের বক্স আনতে নিতে গেলেই।আরাবী ইফতির হাত টেনে ধরে ওর দূর্বল হাত দিয়ে। দূর্বল গলায় বলে,’ উনাকে থামাও ভাইয়া।নাহলে উনি মেরে ফেলবেন ওই আদিকে।যাও ভাইয়া।’

‘ কিন্তু তুই…!’
‘ প্লিজ ভা…ভাইয়া!’
ইফতি আরাবীর কথা ফেলতে পারলো না।দ্রুত জায়ানের কাছে ছুটলো।কিন্তু গিয়ে দেখে নিহাদ সাহেব আর বাড়ির গার্ড্সরা জায়ানকে ধরে রেখেছে।তাও জায়ান বার বার রেগে বলছে, ‘ ছাড়ো আমায় তোমরা।ওকে আমি আজ টুকরো টুকরো করে ফেলবো।’

ইফতি জানে তার ভাই এখন এভাবে থামবে না।তাকে থামানোর একটাই উপায়।ইফতি যায় জায়ানের কাছে।গিয়ে বললো, ‘ ভাই থামো।ওকে আমরা দেখো নেবো।পুলিশ আসছে।তুমি আরাবীর কাছে যাও।ও কাঁদছে ভাইয়া।তোমাকে ডাকছে।আমার রুমে ও।’
আরাবীর কথা বলতে জায়ান শান্ত হয়ে গেলো।ওর আরাবী কাঁদছে,ওকে ডাকছে কথাটা শ্রবন হতেই।সবার থেকে ছটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বড়বড় পা ফেলে চলে গেলো। আরাবীর মা,নূর, সাথি,মিলি যেতে নিতেই ইফতি মানা করে দেয়।জায়ান আর আরাবীকে একা ছেড়ে দিতে।

হুরমুর করে ইফতির রুমে জায়ান প্রবেশ করে।আরাবী হঠাৎ এমন আওয়াজ হওয়ায়।ঝাপ্সা দৃষ্টিতে তাকায়। দরজার কাছে জায়ানকে দেখে। ফুপিঁয়ে কেঁদে উঠে আরাবী।জায়ান দ্রুত ছুটে যায় আরাবীর কাছে।ওর পাশে বসে আরাবীর বাহু ধরে জলদি ওকে নিজের বক্ষপিঞ্জারায় লুকিয়ে ফেলে।বহুক্ষন পর নিজের একমাত্র ভরসাযোগ্য ব্যাক্তির সান্নিধ্য পেয়ে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩১

আরাবী আর নিজেকে সামলাতে পারে না আরাবী।দূর্বল হাতজোড়া দিয়ে জায়ানের পিট খামছে ধরে জায়ানের বক্ষে মুখ লুকিয়ে তীব্র চিৎকারে কান্না করতে লাগলো আরাবী। আর আরাবীর এমন কান্নায় যেন জায়ানের বুকে তীব্র ব্যাথার সৃষ্টি হচ্ছে।মনে হচ্ছে কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে ওর হৃদয়ে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৩