বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৫

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৫
সাদিয়া জাহান উম্মি

কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরাবী।আর ওকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে ইফতি।পুরো নাম ইফতিয়াক সাখাওয়াত ইফাত।কেউ কেউ ইফতি ডাকে কেউ অথবা ইফাত।মানে যার যেটা ভাল লাগে।এতে অবশ্য ইফতির কিছু যায় আসে না।তবে বেশির ভাগ সবাই ইফতিয়াককে ছোট করে ইফতি ডাকে।তবে মাঝে মাঝে মিলি ছেলেকে ইফাত ডাকতে পছন্দ করেন।ইফতি এইবার খপ করে আরাবীর হাত ধরলো।আরাবী এতে ঘাবড়ে গেলো।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ইফতির দিকে।ইফতি ঠোঁট চওড়া করে হাসলো।বললো,

-‘ আই কান্ট বিলিভ দিস আম্মু।তুমি সত্যি বলছো এটা আরাবী?’
মিলি বিরক্ত হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন।এই নিয়ে দশবার একই প্রশ্ন করে ফেলেছে ইফতি।আরাবীকে যখন নূর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।তখন হতেই ঘুরিয়ে পেচিয়ে আরাবীকে দেখে চলেছে ইফতি।ইফতি সন্ধিহান গলায় বলে,
-‘ ছিচকাদুনে আরাবী এতো শান্ত আরাবী কবে থেকে হলো?আর এমন ভীতুই বা কবে হলো?আমি যেই আরাবীকে চিনতাম সে তো এমন ছিলো না।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইফতি’র কথায় তাচ্ছিল্য হাসলো আরাবী।আনমনে বললো,
-‘ পরিস্থিতি মানুষকে অনেক বদলে দেয় ইফতি ভাইয়া।তুমি যেই আরাবীকে চিনতে সেতো সেই আটবছর আগেই মারা গেছে।এখন আরাবী প্রায় মৃত।তার নিশ্বাসটুকু চলছে শুধুমাত্র তার মায়ের জন্যে।মা না থাকলে আরাবী সেই কবেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতো।’

ইফতি বেশ অবাক হলো আরাবীর কথায়।এইটুকুন মেয়ে। তার কন্ঠে এতো বিষাদবানি শুনে কেমন যেন বুকটায় চিনচিনে ব্যাথা করে উঠলো ইফতির।আরাবীর চেহারার মলিনতাই বলে দিচ্ছে। এই মেয়েটার মনে কষ্ট।অনেক অনেক বেশিই কষ্ট।ইফতি ধ্যান মগ্ন আরাবীর উদ্দেশ্যে বললো,
-‘ তোর আমাকে মনে আছে আরাবী?’
ইফতির প্রশ্নে তার দিকে তাকায় আরাবী।ছোট্ট কন্ঠ বলে,

-‘ হ্যা,মনে থাকবে না কেন?তুমিই ছিলে আমার আনন্দের একমাত্র সাথি।’
-‘ যাক মনে তো রেখেছিস এই অনেক।নাহলে সেইভাবে গুম হয়ে গিয়েছিলি?তোর নামটা পর্যন্ত গায়েব করে দিয়ে কোথায় যে চলে গিয়েছিলি কে জানে?এতো খুজেছি তাও পায়নি।বাই দ্যা ওয়ে,লিপি আন্টি ভালো আছে?কোথায় তিনি আসেন নি তোর সাথে?’
মায়ের কথা জিজ্ঞেস করায় মনটা একটুখানি হয়ে গেলো আরাবীর।চেহারাটা আবারও মলিনতায় ছেয়ে গেলো।উদাস কন্ঠে বলে,

-‘ মা ভালো আছে ইফতি ভাইয়া।অনেক ভালো আছে।এতোটাই ভালো আছেন যে তাকে এতো করে বললাম আমার সাথে চলে আসতে তিনি আসলেন নাহ!’
-‘ মানে বুঝলাম নাহ!’
থয়মত খেয়ে যায় আরাবী।উফফ একটুতেই কেন এতো ইমোশনাল হয়ে যায় যে ও।নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো আরাবী।কথা ঘুরানোর জন্যে বললো,

-‘ ভাইয়া তুমি মাত্র অফিস থেকে এসেছো।আগে রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নেও কেমন?আমিও রুমে যাচ্ছি।’
আরাবী আর ইফতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উপরে চলে গেলো।এদিকে ইফতি যেন আশ্চর্যের চুড়ায় পৌছে গেলো।হঠাৎ হলো কি মেয়েটার?জিজ্ঞাসাসূচক চোখে মায়ের দিকে তাকাতেই মিলি ছেলের দৃষ্টি বুঝতে পারলো।তারপর আরাবীর সাথে ঘটা সকল কিছু খুলে বললো।সব শুনে বিষ্মিত ইফতি।বললো,
-‘ আশ্চর্য? এ কেমন মানুষ এরা?ওটাকে তো পুলিশে দেওয়া দরকার।আর সেখানে কিনা আন্টি ওইখানেই থেকে গেলো।যদি আন্টিকে কিছু করে বসে লোকটা?’

-‘ আমিও সেটাই ভাবছি।দেখি কিছু করতে পারি কিনা।লিপিকেও এখানে নিয়ে আসার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।আর যদি ও আসতে না চায় তাহলে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ওই লোকটা লিপির কোন ক্ষতি না করতে পারে।’
মায়ের চিন্তিত মুখশ্রী দেখে ইফতি বলে,
-‘ তুমি চিন্তা করো না মা।দেখি আমি ভাইয়ের সাথে কথা বলে নেই।ভাইকে বললে কাজটা আরো সহজ হবে!’
-‘ আচ্ছা তুই যা ভালো মনে করিস।’
-‘ আচ্ছা মা আমি উপরে যাচ্ছি।আজ কাজের অনেক প্রেসার গিয়েছে।আমার খাবারটা রুমে পাঠিয়ে দিও।ভালো লাগছে না!’
বলতে বলতে ইফতি নিজের রুমে চলে গেলো।মিলি ছেলের কথা অনুযায়ী চলে গেলেন রান্নাঘরে।

কক্ষের ভীতর অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে।ফ্লোরে বসে বিছানার সাথে মাথা ঠেকিয়ে আছে আরাবী।কিছু ভালো লাগছে না।পরশু যাবে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্যে। টিউশন অথবা একটা চাকরি খুজতে হবে।এভাবে তো অন্যের ঘারে বসে বসে খাওয়া যায় নাহ।যতোই বলুক মানুষগুলো নিজেরও তো একটা বিবেগ আছে।যদি ভালো মানের একটা চাকরি পায়।

তাহলে একটা ঘর খুজে নেবে থাকার জন্যে।সাথি নামের মহিলাটি যে ওর এখানে থাকা একদম পছন্দ করেনি তা আরাবী উনার মুখ দেখে বুঝেছে।আরাবী চায়না তার কারনে ওদের পরিবারের মাঝে কোন ঝামেলা হোক।দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাবী।আজান হয়েছে সেই ঘন্টা দুয়েক আগে।উঠে ওজু করে নিয়ে এশার নামাজটা আদায় করে নিলো।আল্লাহ্ তায়ালার কি অশেষ নেয়ামত নামাজ পরার সাথে সাথেই মনটা কি সুন্দর একনিমিষেই শান্ত হয়ে গিয়েছে।

নিজেকে কেমন হালকা হালকা লাগছে।আরাবীর হালকা হাসলো।ঘুম আসছে না এখনো।বিকেলে ঘুমানোর কারনে।তাই আরাবী বারান্দায় চলে গেলো।বারান্দায় যেতেই মনটা শীতল হয়ে আসলো।কি সুন্দর রাতের প্রকৃতি।বাগানটা চাঁদের আলোয় যেন কোন মায়ারাজ্য মনে হচ্ছে।বুকভরে শ্বাস নিলো আরাবী।মনটা ভরে গেলো।বাতাসের সাথে ফুলের গন্ধ মৌ মৌ করছে।বাগানে হাসনাহেনা,জুই,শিউলি,বেলী আর গন্ধরাজ ফুটে আছে।শুভ্রতা আর শুভ্রতা চারদিকে।

বাগানের চারদিকে বিচড়ণ করে চলেছে জোনাকি পোকারা তাদের বল নিয়ে।হঠাৎ একটা জোনাকি পোকা আরাবীর কাছে আসলো।আরাবী হাত বাড়িয়ে দিতেই জোনাকি পোকাটা আরাবীর হাতের উপর এসে বসলো।আরাবী হেসে দিলো।তারপর কিয়ৎক্ষন পর ফু দিয়ে জোনাকি পোকাটাকে উড়িয়ে দিলো।জোনাকিপোকাটা আবার মিশে গেলো ওর দলের মাঝে।আরাবীর যখন প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত।হঠাৎ মনে হলো কেউ ওকে দেখছে।

খুব গভীরভাবে চেয়ে দেখছে।কিন্তু কে? আরাবী চারপাশে নজর ঘুরালো।না কাউকেই তো দেখছে।হঠাৎ আবারো সেই হালকা আলোর ঝলকানিটা এসে চোখে লাগলো।আশ্চর্য কি হচ্ছে ওর সাথে এসব?মনে হলো ওর ডানপাশ থেকে আসছে।কিন্তু ডানপাশে তো নূরদের বাড়ির কারো ঘরের বারান্দা।কিন্তু সেখানে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।বারান্দার থাইক্লাসগুলো টেনে দেওয়া।এতে চাইলো আরাবী আর কিছু দেখতে পারবে না।উফফ,বিরক্ত হলো আরাবী নিজের উপর নিজেই।কিসব উল্টাপাল্টা ভাবছে ও?আরাবী মুখ গুমড়া নিজের ঘরে চলে গেলো।বারান্দায় অহেতুক না দাঁড়িয়ে থেকে ঘুমানোই ভালো।নাহলে মাথা থেকে ওই আজগুবি চিন্তাধারা তো যাবে না।আরাবী সাতপাঁচ না ভেবে রুমে গিয়ে সুয়ে পরলো।

নূরদের বাড়ি………
এটা মিহানের বড় ভাইয়ের বাড়ি নিহাদ সাখাওয়াতের।তার স্ত্রী সাথি রহমান,মেয়ে নূর সাখাওয়াত আর তার একমাত্র ছেলে জায়ান সাখাওয়াত।এই নিয়ে তার শান্তিপূর্ণ জীবন। এখানে এসে বাড়ি করেছেন এই পাঁচবছর হলো।আগে স্বপরিবারে চট্টগ্রাম ছিলেন ব্যবসার জন্যে।তারপর ঢাকায় ব্যবসাটা ট্রান্সফার করতে ছুটে চলে আসেন নিজ শহরে।মিহান নিহাদকে অনেক বলেছিলো তার সাথে থাকতে।কিন্তু নিহাদ তা মানেনি।মিহানের ঘরটা দুতলা হলেও একটু ছোট।

সেখানে এতোগুলো মানুষ চিপাচিপি করে থাকার কোন কথায় আসে না।না না ভাইকে ছোট করার জন্যে নিহাদ এসব ভাবেনি।তারও ইচ্ছা ভাইয়ের সাথে থাকার।কিন্তু ওতোগুলো মানুষ একসাথে থাকলে অনেক ঝামেলা হবে ভেবে নিহাদ ভাইয়ের বিল্ডিংয়ের সাথে আরেকটা দু-তলা বিশিষ্ট বাড়ি তৈরি করে নিলেন।ব্যস ভাইও খুশি তিনিও খুশি।নিহাদ সাখাওয়াত মানুষটা বড্ড হাসিখুশি আর রসিক মানুষ তার পুরোটা পেয়েছে নূর।একেবারে বাবার মতো।

আর সাথি রহমান অনেক রাগি, গম্ভীর স্বভাবের মানুষ।সহজে কারো সাথে কথা বলেননা তিনি।আর অহেতুক কথা বলাও পছন্দ করে না।ঠিক তার মতোই হয়েছে জায়ান সাখাওয়াত।জায়ান যেন মায়ের থেকে এক ডিগ্রি বেশি।তার রাগ যেন সর্বদা মাথায় চরে থাকে।গম্ভীর মুখশ্রীটা দেখলে কেউ যে যেচে এসে কথা বলবে তারও কোন জো থাকে না।মানুষ ওর চেহারার এক্সপ্রেসন দেখলেই আর সামনে এগোতে সাহস পায়না। নিহাদ তার পুরো পরিবার নিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছেন।

এটা তার নিয়ম।সারাদিন যে যেখানেই থাকুক না কেন?রাতে সবাইকেদ একসাথে খেতে হবে।এদিকে নিহাদ বার বার সাথিকে ইশারা করছে ছেলেকে কিছু বলার জন্যে।সাথিও চোখ রাঙ্গিয়ে ইশারায় তাকে বুঝাচ্ছে সে নিজে কেন বলতে পারছে না।বিনিময়ে নিহাদ অসহায় চোখে তাকাচ্ছে।এদিকে বাবা মাকে এমন খোচাখুচি করতে দেখে জায়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৪

-‘ আমি জানি তোমরা কি নিয়ে এমন করছো?আমি এখন বিয়ে করবো না।আগেও বলেছি এখনো বলছি।আই এম নট রেড়ি ফোর ম্যারেজ য়েট।যখন সময় আসবে আমি নিজেই বলবো।সো প্লিজ স্টোপ ডুয়িং দিস।’
বলেই খাওয়া শেষ করে গটগট পায়ে উপরে চলে গেলো কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৬