বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২
সাদিয়া জাহান উম্মি

উচুঁ দুতলা বিষিষ্ট এক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরাবী।বাড়ির গেট’টা বেশ সুন্দর। একদম চোখ ধাধানো।কি সুন্দর করে সকাল সন্ধ্যা ফুল গাছ দিয়ে গেটটা জুড়ে আছে।আর তাতে অসংখ্য ফুল। বাড়িটা অনেক বড়।এখানে দুটো দুতলা ভবন আছে আরাবী ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো। আর দুটো বাড়ি ঘেরাও করে চারদিকে দেয়াল টানা।আরাবী আবার গেটের দিকে তাকালো।সেখানে গেটের পাশেই নেমপ্লেটে বাড়ির নাম লিখা ‘সাখাওয়াত ভিলা!’ প্রাহি হাতে থাকা ঠিকানাটা আরো একবার পরখ করে নিলো।যদি পাছে আবার ভুলটুল বাড়িতে এসে পড়ে।নাহ,ঠিক আছে একদম।এদিকে বাড়ির দারোয়ান এতোক্ষন ভ্রু-কুচকে দেখছিলো আরাবীকে।কিন্তু আরাবী কতোক্ষন যাবত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।এইবার প্রশ্ন করলেন তিনি,

-‘ কে তুমি?কি চাই গো মা তোমার?’
দারোয়ান লোকটির বয়স বেশি হলে পঞ্চাশোর্ধ্ব হবে।লোকটার বিনয়ী আচড়নে বেশ মুগ্ধ হলো আরাবী। মাথা নিচু করে বলে উঠলো,
-‘ জি আংকেল।এটা কি মিহান সাখাওয়াত এর বাড়ি?’
দারোয়ান জবাবে বলেন,
-‘ হো গো মা।এইডা মিহান সাখাওয়াতের বাড়ি।’
আরাবী মুখটা কাচুমাচু করে বলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ আসলে আমি গ্রাম থেকে এসেছি উনার সাথে দেখা করতে।উনার সাথে কি দেখা করা যাবে?’
দারোয়ান হাসলেন।আরাবীকে তার বসার সিট’টা দেখিয়ে দিয়ে বলেন,
-‘ তুমি এইহানে বসো মা।আমি স্যারের থেকে জিজ্ঞেস করে আসি। ওহ হ্যা তোমার নাম কি মা?’
আরাবী চেয়ারে বসেছিলো মাত্র।দারোয়ানের প্রশ্নে ধীর কন্ঠে বললো,
-‘ আরাবী। ইনসিয়া জাহান আরাবী।’

নামটা শোনা মাত্রই দারোয়ান চলে গেলো বাড়ির ভীতরে।বেশখানিক সময় পেরোলো।আরাবীর মনটা কেমন যেন খচখচ করছে।ভয়ও লাগছে।একা একা এতোদূর কখনো আসেনি আরাবী।আর সাথে এইভাবে অচেনা অজানা কারো বাসায় তো একদমি না।মায়ের কথায় তো এসে পরলো এখানে।কিন্তু লোকগুলো যদি ওকে এখানে থাকতে না দেয়?কি করবে প্রাহি?কোথায় যাবে?মায়ের কথায় ভরসা পেয়েই তো এখানে এসেছে ও? প্রাহি ভেবে নিয়েছিলো।

এখানে ও এমনিতেও বেশিদিন থাকতো না।যেহেতু ইন্টার পাশ করেছে বেশ ভালো গ্রেডে।তাই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে একটা ভালো চাকরি পেলেই এখন থেকে মেসে উঠে যেতো আরাবী। আনমনে এসব ভাবছিলো আরাবী।হঠাৎ ঝড়ের গতিতে একজন মহিলা এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।বিষ্ময়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো আরাবী।হঠাৎ আকস্মিক এমন করায় হৃৎপিন্ড’টা এতো জোড়ে লাফাচ্ছে যে মনে সেটা এই একটু পরেই বুক চিরে বেড়িয়ে আসবে।প্রায় অনেকক্ষন পর মহিলাটি ছেড়ে দিলো আরাবীকে।আরাবী এইবার চোখ তুলে তাকালো।বয়সটা ওর মায়ের মতোই হবে।সর্বাঙ্গে আভিজাত্যের ছোঁয়া।গায়ে মেরুন রঙ্গের শাড়ি জড়ানো।এতে যেন আরো সুন্দর লাগছে তাকে।মহিলাটি এইবার আরাবীর গাল স্পর্শ করলো।ভেজা কন্ঠে বললো,

-‘ তুমি লিপি আর জিহাদ ভাইয়ের মেয়ে আরাবী?’
আরাবী মাথা নিচু করে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।মহিলাটি আবার বললো,
-‘ মাশাল্লাহ্।দেখতে পুরো জিহাদ ভাইয়ের মতো হয়েছো।’
অনেকদিন পর বাবার কথা এইভাবে বলায় চোখ ভরে আসে আরাবীর।তাও নিজেকে সামলে নিলো।মহিলাটিকে আবারও পরখ করলো।আস্তে আস্তে মহিলাটিকে চিনতে পারলো আরাবী।ধীরকন্ঠে ডাকলো,

-‘ মিলি আন্টি!’
মিলি বেগম যেন অবাক হয়ে তাকালো বললো,
-‘ তুমি আমায় চিনতে পেরেছো?’
আরাবী বললো,
-‘ হ্যা! ওই ভালোভাবে একটু তাকিয়েই চিন্তে সক্ষম হয়েছি।’
মিলি বেগম অত্যন্ত খুশি হলেন।পরক্ষনে কিছু একটা ভেবে বলেন,

-‘ এই দেখো তোমাকে বাহিরে দার করিয়ে রেখেছি।আসো আসো ভীতরে আসো।’
মিলি বেগম আরাবীকে টেনে বাড়ির ভীতরে নিয়ে আসলেন।মিলি বেগম থাকেন বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায়।আরাবীকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই আরাবী পুরো বাড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলো।ভীষন সুন্দর বাড়িটা।আরাবী তো চোখই সরাতে পারছে না।এদিকে আরাবীকে নিয়ে সোফায় বসাতেই।হঠাৎ কারো ডাকে চমকে উঠে,
-‘ মিলি মা?কেমন আছিস?’

আরাবী চমকে তাকালো।পরক্ষনে হুইল চেয়ারে বসা ব্যাক্তিটিকে চিনতে বিন্দুমাত্র সময় নিলো না।আরাবী দ্রুত পায়ে হেটে লোকটির সামনে বসে পরলো।বললো,
-‘ মিহান আংকেল।’
মিহান অনেক খুশি হলো যেন। খুশি হয়ে বলেন,
-‘ চিন্তে পেরেছিস আমাকে?’
আরাবী মাথা নাড়ালো।মিহান আরাবী’র মাথায় স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে দিলেন।এদিকে মিলি বেগম ট্রেভর্তি নাস্তা নিয়ে এসে বলেন,

-‘ কি গো মেয়েটা সবে আসলো।আগে কিছু একটা খেয়ে নিতে দেও।এতোটা পথ পারি দিয়ে এসেছে।নিশ্চয়ই খুব ক্ষুদা পেয়েছে ওর।’
মিহান আরাবীকে সোফায় বসতে বললেন।মিহানের দুটো পা নেই।প্রাহির বাবার যেই এক্সিডেন্ট হয়েছিলো সেই গাড়িতে তিনিও ছিলেন।আর এক্সিডেন্টে উনার পা দুটো নষ্ট হয়ে যায়।আরাবীর অনেক কিছুই মনে আছে ছোটবেলার।
মিলি আর মিহান এর সাথে টুকাটাকি কথা বলে হালকা নাস্তা করছে আরাবী।এর মাঝে হঠাৎ মিলি জিজ্ঞেস করলেন,
-‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো মা?’
আরাবী মিষ্টি হেসে বলে,
-‘ জি করুন আন্টি?’

-‘ তোমার সাথে কি কিছু হয়েছে?না মানে তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর তোমরা তোমাদের নানাবাড়ি চলে যাও।আমি আর তোমার আংকেল গিয়ে দেখা করে আসতাম তোমাদের সাথে।হঠাৎ একদিন গিয়ে দেখি তোমরা সেখানে নেই।আমি আর তোমার আংকেল তোমার মামাদের অনেক জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমরা কোথায় কিন্তু তারা কেউ তোমাদের ঠিকানা দিচ্ছিলো না।তোমার মামারা আমাদের অপমান করে সেখান থেকে পাঠিয়ে দেন।

অতঃপর গ্রামের মানুষ থেকে জানতে পারি তোমার মা’কে আবার বিয়ে দেওয়া হয়েছে।কিন্তু কোথায় সেটা কেউ জানেনা।কারন তোমার মামারা চুপিসারে তোমার মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।সেই থেকে তোমাদের কোন খোজ আমরা পায়নি।তো আজ হঠাৎ এতো বছর পর তুমি এখানে। আবার তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে।কি হয়েছে মা আমায় খুলে বলো?কোন সমস্যা?আমাকে বলতে পারো।আমি তো মা বল আমার সন্তানের কষ্ট আমি তাদের দেখেই বুঝে যাই।তোমাকে তো ছোট থাকতে আমার কাছেই আমি বেশি রাখতাম।তুমি আমার কতো আদরের ছিলে জানো তুমি?প্লিজ আরাবী কি হয়েছে আমায় সব বলো মা।’

আরাবী মিলির এমন স্নেহমাখানো কথায় আর নিজেকে সামলাতে পারেনা।মিলিকে জড়িয়ে ধরে ধুকরে কেঁদে উঠে।কিছু বলে না মিলি।কাঁদতে দেয় আরাবীকে।কান্না থামতেই আরাবী আসতে আসতে সবটা বলে মিলি আর মিহানকে।সব শুনে তারা আশ্চর্য হয়ে যায়।মানুষ কতোটা খারাপ হলে কারো সাথে এমন করতে পারে।কি নিষ্ঠুর মানুষ।
মিহান সব শুনে বলে,

-‘ তোমার মা’কে কেন আনলে নাহ?তাকেও নিয়ে আসতে।ওই লোকটা যদি তোমার মায়ের কোন ক্ষতি করে দেয়?’
আরাবী চোখের জলগুলো মুছে বলে,
-‘ আমি অনেক বলেছি আংকেল।কিন্তু মা আসলো না।আমার দাদু ওখানে আছে।মানে ওই লোকটার মা।সে খুব ভালো মনের মানুষ।প্যারালাইজড তিনি।মা তাকে ফেলে যেতে চান না।বুড়ো মানুষ একা বাড়িতে কিভাবে থাকবেন?তাই এতো বলা সত্তেও মা আসিনি আমার সাথে।’
মিলি আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।মায়া মাখা কন্ঠে বলেন,

-‘ থাক মা কান্না করো না।আমরা আছি না।আমরা ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নিবো তোমার মা’র জন্যে।আর তুমি কোন চিন্তা করবে না।তুমি আমার মেয়ে।আমাকে ছোট থাকতে তুমি মাম্মাম আর মিহানকে পাপা বলে ডাকতে।এখনো তাই ডাকবে এতে আমি আর মিহান অনেক খুশি হবো।তুমি কোন জড়তা করবে না।আজ থেকে তোমার সকল দায়িত্ব আমার।ইফাত আসুক আমি ইফাতকে বলে তোমায় এখানকার ভার্সিটিতে ভর্তি করানোর জন্যে কথা বলবো নেহ।তুমি উপরে চলো আমার সাথে।তোমার রুম দেখিয়ে দিয়ে আসি।ফ্রেস হয়ে রেস্ট নেও।ভালো লাগবে শরীরটা।’

আরাবী সব শুনলো।কিন্তু ইফতার নামটা শুনে মনটা ব্যাকুল হয়ে গেলো।ইফতি ওকে ছোট থাকতে অনেক আদর করতো।কতো শতো চকলেট, পুতুল,টেডি গিফ্ট করতো ওকে।আর ও কান্না করলেই কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সারা বাড়ি।আরাবী রিনরিনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ ইফতি ভাইয়া কোথায় আন্টি?’
মিলি হাসলেন।বলেন,

-‘ ও এখন অফিসে।এই রাতেই আসবে। ও যে তোকে দেখলে কতোটা খুশি হবে।তোকে দেখলেই না জানি আমার ছেলেটা খুশিতে কি করে।আজ আমার পরিবারটা পূর্ণ আমার একটা মেয়ের খুব ইচ্ছা ছিলো কিন্তু ইফতি হওয়ার পর আমার আর কোন সন্তান হয়নি।কিন্তু তুমি যখন জন্ম নিকে সেদিন থেকে যেন আমার এই আফসোসটাও মিটে গিয়েছিলো।তারপর হারিয়ে গেলে তুমি।কিন্তু আজ আবার আমার মেয়ে আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।এইবার আর তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না আমি।কোথাও নাহ!’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১

মিলির কথায় প্রানটা জুরিয়ে যায়।কতো ভালো এই মানুষগুলো।আরাবী মিহান থেকে বিদায় নিয়ে মিলির সাথে রুমে চলে গেলো।ফ্রেস হয়ে একটা ঘুম দিলে শরীরটা ভালো লাগবে।কিন্তু তার আগে মায়ের সাথে কথা বলে নিবে।না জানি ওর মা কেমন আছে।ওই নিষ্ঠুর লোকটা না জানি কি করেছে ওর মায়ের সাথে।মায়ের কথা মনে পড়তেই বুকটা ভার হয়ে আসে আরাবীর। জানা নেই উপরওয়ালা ওর ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩