বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ গল্পের লিংক || সাদিয়া জাহান উম্মি

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১
সাদিয়া জাহান উম্মি

‘ আমি তোমার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি শুভ।তুমি কিভাবে পারলে আমায় রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে?’ বিয়ের আসরে এমন একটা কথা বজ্রপাতের ন্যায় শোনালো।অষ্টাদশী বয়সী আরাবী তখন স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে রইলো কথাটা শুনে মুখ হতে একটা টু শব্দও বের হলো নাহ।শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ও তো বিয়ে করতে চায়নি।ওকে মেরে ধরে দু’দিন ঘর বন্দি করে রেখেছে খাবার দেওয়া তো দূর একটা গ্লাস পানিও দেয়নি কেউ।

এতো এতো অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শেষমেষ বিয়েতে রাজি হয়ে যায় আরাবী।ভেবেছে বিয়ে করলেই বোধহয় এখান থেকে মুক্তি পাবে।ভালো একটা জীবন পাবে।কিন্তু হায় কপাল স্বপ্ন দেখার আগেই তা ভেঙ্গে গেলো।চোখ ভরে উঠলো আরাবীর।তাও কিছু বললো না।কিইবা বলবে যারা এই জঘন্য কাজ করতে যাচ্ছিলো তারাই এইবার ঘটনাটা সামলাক।ও এতো বছর যাবত নীরব দর্শক হয়েছিলো।ওর কাজই হলো মুখ বুঝে সব সহ্য করা।সেখানে আজই বা কি বলবে ও?যেখানে ও শুভ নামের এই লোকটাকে বিন্দু পরিমান চিনে নাহ। এদিকে সেই মেয়েটি এগিয়ে আসলো শুভ’র দিকে।রাগি কন্ঠে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ তুমি যদি আমাকে এই মুহূর্তে বিয়ে করে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা না দেও।তাহলে আমি আত্মহত্যা করবো।আর তার যার সম্পূর্ণ দোষী তোমাকে করে যাবো।এইযে দেখো আমার হাতে বিষ।সাথে করেই নিয়ে এসেছি।’
শুভ ভয় পেয়ে গেলো।অনুরোধের স্বরে বলে,
-‘ নাহ নাহ প্লিজ।এমন কিছু করো না।আমি করবো তোমাকে বিয়ে।আর আমার সন্তান তোমার পেটে।আর যাই হোক আমি আমার সন্তান আমার অংশকে অস্বিকার করতে পারবো না।’

শুভ’র কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো হানিফ আহমেদ।শুভ’র কাছে তেড়ে গিয়ে বলে,
-‘ এসব কি হ্যা?আরাবীকে বিয়ে করবে বলেছো।তুমি নিজেই তো সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলে।বলেছিলে আরাবীকে তোমার সাথে বিয়ে দিলে তুমি আমাকে পাঁচ লক্ষ টাকা দিবে।কিন্তু কোথায় গেলো সেটা?তুমি কথার খেলাপ হলে কেন?’
শুভ চকিতো তাহায় হানিফ আহমেদের দিকে।বললো,

-‘ আ…আমি আপনাকে করা ওয়াদা রাখবো।আপনাকে পুরো টাকাই দেওয়া হবে।শুধু আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারবো না।আমি আমার সন্তানকে বেছে নিলাম।আসি ভালো থাকবেন।এই রনি উনাকে উনার টাকাটা দিয়ে দে।’
রনি নামের ছেলেটি হানিফ আহমেদের হাতে টাকার ব্যাগিটা দিয়ে সেও শুভ’র পিছে পিছে চলে গেলো।এদিকে এতোক্ষন সকল কথা পাথরের মূর্তির ন্যায় শুনে যাচ্ছিলো আরাবী।একটা মানুষ কিভাবে এতোটা জঘন্য হতে পারে তা ভাবতে পারছে না আরাবী।শুধুমাত্র টাকার লোভে লোকটা ওকে বিক্রি করে দিতে যাচ্ছিলো।আরাবীর ঘৃনা হচ্ছে নিজের উপর। চোখ ঝাপিয়ে অশ্রুরা বেড়িয়ে আসলো।গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে।সেই অশ্রুসিক্ত অভিমানি নয়নে তাকালো মায়ের দিকে।আরাবী মা তখন ঘরের এককোনায় আচঁলে মুখ চেপে কাঁদছে।ঠোঁট ভেঙ্গে আর্তনাদ করে কান্নাগুলো বেড়িয়ে আসতে চাইছে।কিন্তু চেয়েও কাঁদতে পারছে না আরাবী।কার জন্যে কাঁদবে?কিসের জন্যে কাঁদবে?আজ মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েই বোধহয় পাপ হয়েছে ওর।চরম পরিমানের পাপ।এদিকে হানিফ আহমেদ হাসিমুখে আরাবীর সামনে এসে দাঁড়ালো।টাকার ব্যাগটায় আরেকবার নজর বুলিয়ে। আনন্দিত হয়ে বলে,

-‘ তোকে পেলে আমার ওতোটাও লস হয়নি।তোর মাধ্যমে কতোগুলো টাকা পেলাম।যাক ভালোই হলো তোকে আবারও কোন বড়লোক বেডার লগে বিয়ার দেওয়ার ব্যবস্থা করুম খুব শীঘ্রই।বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা পাবো আমি।তুই হলি আমার সোনার ডিম পারা হাঁস।আজ আমি অনেক খুশি এই খুশিতে তোদের মা, মেয়েকে আমি পেট ভরে কাচ্চি খাওয়াবো যা। কই হুনছোস?নিয়া যা তোর মাইয়ারে।আমি এখন একটা কাজে যাইতাছি।’

হানিফ আহমেদ বেড়িয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।এইদিকে পাড়াপ্রতিবেশিরাও নানান আফসোস করে বিদায় নিলেন।আরাবীর মা এগিয়ে এসে আরাবীকে ধরে ওর রুমে নিয়ে আসলেন।মেয়েটার গায়ে বিন্দুপরিমান শক্তি নেই। সারা গায়ে মারের দাগ।আরাবীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন তিনি।অসহায় কন্ঠে বললেন,
-‘ মারে মা।আমারে মাফ করে দে তুই।আমি মা হয়ে পারিনা তোকে রক্ষা করতে।আমারে মাফ কর তুই মা।আমি মা নামের কলঙ্ক।’

আরাবী আর পারলো না নিজেকে সামলাতে।ওর মাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।কিয়ৎক্ষন অতিবাহিত হয়।কিন্তু কান্না তো থামে না।এতো কেঁদেও তো মনের আঘাত সারে।ইসস,কান্নার কারনে যদি সকল কষ্টগুলো মুছে যেতো কতোই না ভালো হতো।কিন্তু হায় আফসোস।তা তো হবার কথা নয়।আরাবী মা মেয়েকে সামনে এনে চোখ মুছে দিলেন।
-‘ আর কাঁদবি না।আর কাঁদবি না তুই।আজ থেকে তুই মুক্তি পাবি।স্বাধিনভাবে বাঁচবি।অনেক হয়েছে।আমার মতো আমি তোকে এইভাবে তিলে তিলে মরতে দেখতে পারি নাহ।তুই বাঁচবি।অামি বাঁচাবো তোকে।’
আরাবী অবাক হয় মায়ের কথা শুনে।আশ্চর্য কন্ঠে বলে,

-‘এসব কি বলছো তুমি? কেন এমন করছো মা?’
-‘ আমি ঠিক বলছি।ওই জা*নোয়ারটা বাড়িতে নেই।এই সুযোগ।তুই পালিয়ে যা মা।পালিয়ে যা।আমি তোকে তোর বাবার বন্ধুর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।লোকগুলো অনেক ভালো।তোকে একদমে মেয়ের মতো করে রাখবে।ছোট থাকতে তুই ছিলি তাদের চোখের মনি।এখন একমাত্র উনারাই তোর আস্তা।তুই চলে যা মা।চলে যা।এইখানে থেকে তুই বাঁচতি পারবি না।তোকে আমার দিব্যি তুই চলে যা।’

ঢাকার বাসে বসে আছে আরাবী।অবশেষে সে মায়ের কথা রেখেছে।পালিয়ে এসেছে সেই জা*হান্নাম থেকে।তার মার কাছে কিছু জমানো টাকা ছিলো তাই হাতে গুজে দিয়েছে ওর মা।আরাবী চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরলো।জীবনটা কেন এতো কঠিন ওর জন্যে?কেন আর পাঁচটা মেয়ের মতো ও বাচঁতে পারছে না।আজ বাবার কথা খুব করে মনে পরছে আরাবী।কতো ভালোবাসতো ওর বাবা ওকে।কিন্তু একটা ঝড়েই সব লন্ডভন্ড হয়ে যায় একনিমিষে।আরাবীর মা আর বাবার প্রেমের বিয়ে ছিলো।আরাবীর বাবার ফ্যামিলি কেউ রাজি ছিলো না এই সম্পর্কে।

তাই আরাবীর বাবা উপায় না পেয়ে আরাবীর মাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেন।আরাবীর মার ফ্যামিলির এতে কোন সমস্যা ছিলো না।আরাবীর বাবা ছিলো বড়লোক বাড়ির ছেলে।তারা এতে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। বছর না ঘুরতেই আরাবী ওর নায়ের গর্ভে আসে।এই খবর শুনে আরাবীর বাবার ফ্যামিলি না চাইতেও ছেলে আর ছেলের বউকে মেনে নেন।আরাবীর মানে মনে মনে কেউ মেনে না নিলেও আরাবীর বাবার ভয়ে কিছু বলতে পারতেন নাহ।কিন্তু আরাবীর বাবার অগোচড়ে ভীষন বাজে ব্যবহার করতেন সবাই।মাস গড়ায় আরাবীর মা বাবার কোল আলো করে জন্ম নেয় আরাবী

।কিন্তু এতে খুশি ছিলেন না আরাবী বাবা বাড়ির কেউ।তাদের তো নাতি চাই।কিন্তু হয়েছে মেয়ে।দিনে দিনে আরো অত্যাচার বারলো।আরাবী মা স্বামির মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে নিতেন।আরাবীর যখন দশ বছর বয়স তখন হঠাৎ খবর আসে আরাবীর বাবা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।এরপর আরাবীর মা আর আরাবীর সেই বাড়িতে থাকা যেন জাহান্নামে পরিনত হলো।একসময় ওদের সেই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো।আরাবীর মা মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন বাপের বাড়ি।কিন্তু ভাইয়ের বউরা তা সহ্য করতে পারতো নাহ।একসময় আরাবীর মামারা ওর মা’কে জোড় করে বিয়ে দিয়ে দেন হানিফ আহমেদের কাছে।হানিফ আহমেদের স্ত্রী মারা গিয়েছেন।তার একটা ছেলেও আছে আঠারো বছরের।

ছোট্ট আরাবীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সব মেনে নেয়।কিন্তু নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে কিছুতেই ভুলতে পারলেন নাহ তিনি।এদিক দিয়ে ভালোছিলো।হানিফ আহমেদ আরাবীর মাকে কোনদিক স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয় না।তিনি তার প্রথম স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন।তাই কোনদিন আরাবীর মার ধারেকাছেও যায়নি।হানিফ আহমেদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তাকে আনা হয়েছে শুধু উনার ছেলে আর উনার বুড়ো ম’কে দেখাশোনা করার জন্যে।এদিক দিয়ে আরাবীর মা যেন প্রানে বেচেছিলেন কারন নিজের ভালোবাসার মানুষ ছাড়া আর কারো স্পর্শ যে তিনি সহ্য করতে পারবেন নাহ।

আর আগেই নাহয় আত্মহত্যা করে বসুতেন।আস্তে আস্তে আরাবী বড় হতে থাকে।গ্রামের বিভিন্ন মানুষের নজর আরাবীর উপর পরে।হানিফ আহমেদ ছিলেন তুখোর নেশাখোর।তাকে মানুষ বিভিন্নভাবে টাকার লোভ দেখিয়ে আরাবীকে বিয়ে করার অফার দেয়।কিন্তু আরাবীর মা ছলেবলে অনেকভাবে মেয়েকে ইন্টার পর্যন্ত পড়ালেখা করিয়ে আনতে পেরেছেন।সাথে সাহায্যে ছিলো আরাবীর সৎভাই ফাহিম।সৎভাই হলে কি হবে আপন ভাইয়ের থেকে কমছিলো না সে।

আরাবী আর আরাবীর মাকে হানিফ আহমেদের কাছ থেকে ফাহিমই সবসময় রক্ষা করতো সে।কিন্তু ফাহিম বিদেশে ভালো একটা চাকরির অফার পেয়ে সেখানে চলে যায়।আর তার পরেই শুভ হানিফ আহমেদের কাছে আরাবীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় বিনিময়ে পাঁচলক্ষ টাকা অফার করে।লোভে পরে রাজি হয়ে যায় হানিফ আহমেদ।এরপর যা হলো তা তো আর বলা লাগবে নাহ।

আরাবী মায়ের জন্যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে।না জানি ওই জানো*য়ারটা ওর মাকে কি পরিমান অত্যাচার করছে।কিভাবে কি করবে আরাবী?মা’কে এতো করে বললো ওর সাথে চলে আসতে কিন্তু রাজি হলো না।আরাবীও মায়ের কসম ফেলতে পারলো না।সব ছেড়েছুড়ে রওনা হলো ওর মায়ের দেওয়া ঠিকানাতে।এখন একমাত্র উপর-ওয়ালা ভালো জানেন আগামীতে চলার পথে আরাবীর জন্যে কি লিখে রেখেছেন তিনি।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২