বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১১

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১১
ইলমা বেহরোজ

ধারা বিভোরকে রুমে না পেয়ে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে আসে।পরনে লাইট ব্লু জিন্স,স্লিভলেস ডেনিম শার্ট,লেদারের জ্যাকেট।পায়ে হাই নেক কেডস।সন্ধ্যার পর পর দার্জিলিং ঠান্ডা পড়ে খুব।মাস যা ই হোক।ধারার চোখ জোড়া খুঁজতে থাকে একজনকে।এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে রাস্তা অনেকটা হেঁটে আসে।তখন দূরে কাঙ্খিত মানুষটির দেখা পায়।ঠোঁটে ফুটে উঠে এক চিলতে হাসি।দূর থেকে বিভোরও ধারাকে দেখতে পায়।দুজনই দ্রুত হেঁটে আসে অন্যজনের কাছে।একসাথে বলে উঠে,হাই।দুজনে হাসে।বিভোর ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো,

——“কোথাও যাচ্ছেন?”
ধারা মিনমিনে স্বরে বললো,
——“এইতো হাঁটছি।রাতের দার্জিলিং দেখছি।”
——“ওহ।”
——“আপনি কি করছেন?”
—–“আমিও সেইম। ঘোরাঘুরি করছি।”
—–“তো চলুন একসাথেই হাঁটি।”
বিভোর ধারার চোখে চোখ রাখে।ধারা চোখ সরিয়ে নেয়।বিভোর স্বাভাবিক গলায় বললো,
——“চলুন।”
—–“চলুন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দুজন পাশাপাশি হাঁটছে।কথা বলছেনা কেউই।ভাষার ভান্ডারে কথা মজুদ নেই।কথা বলতে গেলে কন্ঠটা কাঁপে।অথচ,তাঁদের বিয়ের বয়স এক বছরের উপর।ধারা বিভোরকে যত দেখছে,যত পাশে পাচ্ছে তত মুগ্ধ হচ্ছে।কে বলবে?ধারা তাঁর বউ।প্রথম দিনই থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দেওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু কতো স্বাভাবিক ব্যবহার!যেনো প্রথম পরিচয়।বিভোর নিরবতা ভেঙ্গে বললো,
——“আমি যদি এখন এই রাতের বেলা কোথাও নিয়ে যেতে চাই।যাবেন?”
ধারা থমকায়।কয়েক সেকেন্ড কিছু চিন্তা করে বললো,
——“যাবো।”
বিভোর হাত বাড়িয়ে দেয়।ধারা ভ্রু উপরে তুলে প্রশ্ন করে,
——“কি?”
—–“হাত?”
ধারা গোপনে গভীর নিঃশ্বাস নেয়।তারপর এক হাত রাখে বিভোরের হাতের উপর।বিভোর ধারার হাতের স্পর্শ পেয়ে শক্ত করে চেপে ধরে।বলে,

—–“চলুন।”
হাঁটা শুরু করে বিভোর।ধারার মনে প্রশ্ন জাগে।কই যাচ্ছে তাঁরা?কিন্তু কিছু বললোনা।বিভোরের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটে।প্রায় ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর ধারা টের পায় তাঁরা লোকালয় থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে।যতো দূর চোখ যায় দৈত্যের মতো উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল পাহাড় আর পাহাড়।উঁচু-নিচু পাহাড়,ঢেউ খেলানো পাহাড়,সারি সারি পাহাড়,ঘন সবুজ অরণ্যের পাহাড়,আলো-ছায়ার পাহাড়।এ যে পাহাড়ের রাজ্য!
সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় এসে দাঁড়ায় বিভোর।পাশে ধারা।ধারা দুচোখ মেলে রাতের পাহাড় দেখছে মুগ্ধ নয়নে।বিভোর ঘাসে শুয়ে পড়ে।ধারা দ্রুত বলে উঠলো,

—–“ভিজে যাবেন তো।ঘাসে অনেক কুয়াশা।”
বিভোর মৃদু হাসলো।ধারার চোখে সেটা পড়লোনা।বিভোর বললো,
—–“মেঘের রাজ্যে এসেছি আর ভিজবোনা?আশে-পাশে ঘন যেটাকে আপনি কুয়াশা ভাবছেন।সেটা কুয়াশা নয় মেঘ।”
ধারা হেসে বলে,
——“সত্যি?”
——“হুম সত্যি।হাত বাড়ান।মেঘ এসে ধরা দিবে।”
অবিশ্বাস্য ভরসাতে ধারা হাত বাড়ায়।অদ্ভুত!হাতের তালুতে পানি এসে জমেছে।ধাড়া খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললো,

—–“কি চমৎকার। ”
বিভোর হাসির রেখা দীর্ঘ করে বললো,
—–“আপনার চুলে,জ্যাকেটে হাত রেখে দেখেন। ”
ধারা জ্যাকেটে এক হাত রাখে,অন্য হাত মাথায়।অদ্ভুত সব ভিজে-ভিজে!কি আশ্চর্য!
বিভোর ধারার খুশি দেখে প্রানবন্ত হয়ে উঠে।জোর গলায় বললো,
—–“এবার আকাশে তাকান।”
ধারার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম।আকাশে তাকায়।চিৎকার করে উঠে,
—–“ও গড!ও গড!এতো তারা।”
যতো দূর চোখ যায়,কেবল তারা আর তারা।ছোট-বড়,কাছের-দূরের,উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল তারা! যেন মিছিল বেরিয়েছে তারাদের।সব তারা জমা হয়েছে এই এখানে!এই দার্জিলিংয়ের আকাশে।

বিভোর উঠে দাঁড়ায় ধারার পাশে।ধারা আচমকা বিভোরকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে।এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে বলতে থাকে,
——“থ্যাঙ্কিউ,থ্যাঙ্কিউ,থ্যাঙ্কিউ,থ্যাঙ্কিউ!আপনি এতো জোস কেনো।মাবূদ এতো সুন্দর পৃথিবী। আমি লক্ষ জনম বাঁচতে চাই। ”
বিভোরের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠে।মুহূর্তে কয়েকবার মেরুদণ্ড বরাবর তীক্ষ্ণ শীতল স্রোত নেমে গেল।
কিছু সেকেন্ড পর,ধারার খেয়াল হয় সে বিভোরের বুকে।দু’হাতে খামচে ধরে রেখেছে বিভোরের জ্যাকেট।ধারা সর্বাঙ্গে ভয়,অস্বস্তি এসে ভর করে।সরে দূরে গিয়ে নত হয়ে দাঁড়ায়।কাঁপা ঠোঁটে বলে,
——“সরি।”
বিভোর ধারার অপ্রস্তুত হওয়াটা বুঝতে পেরেছে।হেসে বললো,
—–“ইটস ওকে।হাসবেন্ডকেই ধরেছো।মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি।”
ধারা চমকে তাকায়।বিভোর জিভ কাটে।সে মুখ ফসকে কি বলে ফেললো!নিজেকে সামলিয়ে বললো,
—–“সরি।”
ধারা হো হো করে হেসে উঠে।পাহাড়ের তুমুল হাওয়ায় ধারা খোলা চুল উড়ছে।তারার আলো আছে?তবে সেই আলোয় ধারার বাঁকা দাঁত স্পষ্ট। বিভোর হাসে।ধারা বললো,

—–“সমান সমান।”
বিভোর জবাবে শুধু হাসলো।দুজন নিরবতার সাথে আকাশে তাকায়।দুজনের ভেতরে নৈসর্গিক অনুভূতি।রাতের আকাশ উপভোগের সাথে এক অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি।বিভোর ঘাসে শুয়ে পড়ে।ধারা দূরত্ব রেখে ঘাসে বসে।আকাশে চোখ রেখে বলে,
—–“মনে হচ্ছে তারায় তারায় যেন তারার মহাসমাবেশ বসে গেছে আকাশে।”
বিভোর জবাব দেয়,
——“হু।”
কিছু তারা যেন পাহাড়ের দিকে এগিয়ে এসেছে। মেঘ জমাট বেঁধে আড়াল করতে চাইলে মনে হয় সারি বেঁধে মিছিল করে চলেছে তারারাও।
তারার এই মুগ্ধতার মধ্যেই চলছিল দূর পাহাড়ের মেঘ ছুঁয়ে আসা তুমুল হাওয়ার দাপুটে ঝাপটানি। হাওয়ায় শরীর কেঁপে উঠলেও চোখ বুজে আসছে ঘুমে।বিভোর ঘোর লাগা গলায় বললো,
——“যদি পারতাম আজীবন পাটি বিছিয়ে প্রতিটা রাত কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে রাতভর তারা গুনতাম।ঘুমাতাম না।”
রাত গড়াচ্ছে।মেঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে তখন হেসে উঠতে থাকলো চাঁদ।এতোক্ষণ দার্জিলিংয়ের আকাশে সুন্দরের যে খানিক অপূর্ণতা ছিল,তা যেন পূর্ণ করে দিলো এ শুভ্র চাঁদ।বিভোর ধারাকে বললো,

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১০

—–“চাঁদ দেখতে ভালবাসেন ধারা?”
চারপাশ নিশ্চুপ।কোনো সাড়া নেই।বিভোর আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকায়।দেখে,ধারা ঘাসে ঘুমিয়ে পড়েছে।বিভোর আরেকবার ডাকে,
—–“শুনছেন ধারা?”
নিশ্চুপ।
—–“ধারা চাঁদ উঠেছে দেখবেন না?”
নিশ্চুপ।

বিভোর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।গলা থেকে মাফলার খুলে ভাঁজ করে ধারার মাথার নিচে রাখে।তারপর নিজের দু’হাত মাথার নিচে রেখে আবার শুয়ে পড়ে।চোখ নিক্ষেপ করে আকাশের দিকে।বুকে একটা ঝড় বইছে সে টের পাচ্ছে।ঝড়টা ভালবাসার।জায়েজ হওয়া স্বত্তেও পাশে না তাকিয়ে। বিভোর তারাদের ভীরে ধারার মুখটা খুঁজে খুঁজে খুঁটিয়ে দেখছে।
প্রিয়তমা নয়ন বুজে নিদ্রার অতলে
প্রিয়তমের নয়ন খুঁজে তাঁহারে তারাদের ভীরে।

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১২