বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১২

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১২
ইলমা বেহরোজ

বিভোরের ভাবনার সুঁতো ছিড়ে ফোনের রিংটোনে।প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে।দিশারি কল করেছে।বিভোর উঠে বসে রিসিভড করলো।
——-“হুম বল?”
——-“দোস্ত কই তুই?”
——-“আছি আশেপাশেই।”
দিশারি চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ে।বিভোরের উৎকন্ঠা,
——-“দিশু!কি হইছে?কানতাছোস ক্যান?”
——-“তুই আয় আগে।”

কল কেটে কপালের চামড়া কিঞ্চিৎ ভাঁজ করে বিভোর। ভাবে,কি হলো?এদিকে ধারা ঘুমে।সে দূরত্ব কমিয়ে ধারার পাশে বসে।ধারাকে কয়েকবার ডাকে।সাড়া নেই।বাধ্য হয়ে ধারার মাথায় হাত রাখে।চুলে হাত বুলিয়ে ডাকে,
——-“ধারা উঠুন।আমাদের ফিরতে হবে।ধারা?”
ধারা পিটপিট করে চোখ খুলে।বিভোরকে চোখের সামনে দেখে লাফিয়ে উঠলো।চারপাশ খেয়াল করে দেখে অসহায় দৃষ্টিতে বিভোরের দিকে তাকায়।বললো,
——-“আই এম সরি!ক্লান্ত লাগছিলো।তাই…..
——-“কৈফিয়ত দিতে হবেনা।উঠুন।হোটলে ফিরবো।”
ধারা দ্রুত উঠে বললো,
——-“জ্বি চলুন।
বিভোর দ্রুত হাঁটছিলো।ধারা বাধা দিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

——-“আস্তে হাঁটুন না।আশপাশ উপভোগ করতে করতে যাই।”
——-“ধারা আমার একটু তাড়া আছে।”
——-“ওহ আচ্ছা দ্রুতই চলুন।”
নিরবতা পালন করে পাশাপাশি ওরা দুজন বড় বড় পা ফেলে এগুতে থাকে।ধারা খেয়াল করলো বিভোর কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবছে।ব্যাক্তিগত হতে পারে তাই প্রশ্ন করলোনা।আড়চোখে বিভোরের অবয়ব চুষে নিচ্ছে সে মনের অতলে।বিভোরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে ধারা তিন-চার ইঞ্চি পিছনে আসে।বিভোর প্রশ্ন করলো,

——-“পিছনে পড়লে কেনো?”
——-“আপনি আগে আগে হাঁটুন।আমি আছি পিছনে।”
বিভোর জবাবে কিছু বললোনা।
ক্যাজুয়াল স্নিকার,হুডি,জিন্সে বিভোরকে রাজপুত্র মনে হচ্ছে ধারার।ধারা একা একা ঠোঁট কামড়ে হাঁটে আর মনে মনে বিড়বিড় করে,
——-“বরটা কি জোস মাইরি।”
কিন্তু ধারা মনে মনে বিড়বিড় করছে ভাবলেও সে মুখ ফসকেই বিড়বিড় করেছে এবং পুরো কথাটা বিভোরের কানেও পৌঁছেছে।ধারা লজ্জা পাবে ভেবে বিভোর আর কিছু বললোনা।নিজ মনে হেসেছে।
হোটেলে পৌঁছে দিশারির রুমের সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় সায়নকে দেখতে পায় বিভোর।সায়ন বিভোরকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে।সায়ন বললো,

——“দোস্ত একটা ভুল কইরা ফেলছি দিশারির সাথে।ও আমারে ভুল বুঝতাছে দরজা খুলতাছেনা।”
বিভোর সায়নকে পাশ কাটিয়ে দিশারিকে ডাকে।দিশারি দরজা খুলে সরে যায় সামনে থেকে।বিভোর রুমে ঢুকে সাথে ধারা।সায়ন যে মুহূর্তে ঢুকতে যাবে দিশারি চিৎকার করে উঠলো,
——-“বান্দির পুতে এইখানে কি করে?ওরে ক চইলা যাইতে।আমি কিন্তু ওরে জবাই করে ফেলুম।”
সায়ন এগুতে এগুতে ভীত স্বরে বললো,
——-“দিশু প্লীজ ক্ষমা করে দে।”
——-“কুত্তার বাইচ্চা তুই বের হয়ে যা কইতাছি।”
বিভোর ধমকে উঠলো,
——-“কি শুরু করেছিস দিশা?গালাগালি করছিস কেনো?এইটা হোটেল।ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।কি হইছে বলবি তো?”
দিশারি কেঁদে বিছানায় বসে।ধারা পাশে এসে বসে।মুখ খুললো,
——-“কি হইছে আপু?”
সায়ন ধীর গলায় বললো,

——-“আমি বলি।”
——“বল।” বিভোর ভ্রু দুটি বাঁকিয়ে বললো।
সায়ন কয়েকবার ঢোক গিললো।সে জানে বিভোর সবটা শোনার পর আক্রমণ করবে তাঁকে।তবুও বলতে তো হবেই।নতমুখে সায়ন বললো,
——-“আ…আই কিসড হার নেক।”
বিভোর চমকিত হয়ে তাকায়।
——-“কি বললি?”
দিশারি ডুকরে আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো।
সায়ন দেখতে পায় বিভোরের চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে।সায়ন নিজেকে সামলিয়ে দ্রুত বললো,
——-“দোস্ত বিশ্বাস কর আমি আসলে বুঝতে পারিনি কখন……

বিভোর সায়নের শার্টের কলার খামচে ধরে।রাগে কিড়মিড় করে চাপা গলায় বললো,
——–“দুই-তিন মাস পর পর গার্লফ্রেন্ড চেঞ্জ করোস।ডেটিং করোস।তবুও মজা মিটেনি তোর?ফ্রেন্ডের উপর হাত বাড়াইছোস।তোদের মতো পোলাদের জন্যই আমাদের মারা খেতে হয়।মেয়ে ফ্রেন্ড সাথে দেখলেই নোংরা মনোভাব নিয়ে মানুষ তাকায়।তুই দিশারির সাথে এমনটা কেমনে করলি?”
সায়ন কিছু বলার আগে দিশারি বললো,
——“ছাইড়া দে ওরে।যার স্বভাব যেমন সে তেমনই থাকে।তাঁর চোখে সব মেয়েই গার্লফ্রেন্ড হয়।ওরে ফ্রেন্ড কইতেও লজ্জা লাগতাছে।ওর লগে আমার স্কুল লাইফ থাইকা ফ্রেন্ডশিপ আছিলো।আর আইজ ও!”

দিশারি আবার কাঁদতে বসে।ধারা সায়নের দিকে তাকায়।সায়নের ঠোঁট দুটো কাঁপছে চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে।সায়ন বিভোরের হাত থেকে ছুটে দ্রুত বেগে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।বিভোর দিশারির পাশে এসে বসে।সান্ত্বনা দেয়,
——-“দোস্ত এসব মনে রাখিস না।অন্যায় হয়ে গেছে ওর।ছেড়ে দে।দুর্ঘটনা ভেবে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর। কাঁদিস না অসুস্থ হয়ে পড়বি।কিছু খাবি নিয়ে আসবো?ওহ না এখন তো দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে।ঘুমা তুই এখন।”
দিশারি তবুও কাঁদছিল।বিভোর ধমকে বললো,

——-“কি বলছি,ঘুমাইতে বলছি না?দরজাটা লাগাইয়া শান্তি হইয়া ঘুমা।কালকে আমাদের বাতাসিয়া লুপ যেতে হবে সক্কাল সক্কাল।”
সায়ন দিশারির রুম থেকে বেরুবার সময় দেখতে পায় ঊর্মি কান পেতে সব শুনেছে।সায়ন ভ্রুক্ষেপ না করে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ে।রাস্তার পাশে এসে বসে মাথা নত করে।কিছুক্ষণের মধ্যে বিভোর আসে। সায়ন এর পাশে বসে।সায়ন অভিমানে তাকায়নি।বিভোর সায়নের কাঁধে এক হাত রেখে বললো,
——-“দোস্ত?”
সায়নের গলা কাঁপছে।সে কান্না জড়িত কন্ঠে বললো,

——-” বিশ্বাস কর আমি নিজের ইচ্ছায় করিনাই। আমার এমন কোন ইচ্ছে ছিল না কখনো।হয়তো দিশারির জন্য আমার মনে একটা অনুভূতি আ…..
সায়ন কথার মাঝে থেমে যায়।বিভোর অবাক চাউনিতে তাকায়।প্রশ্ন করলো,
——-“ভালবাসিস দিশারিকে?”
সায়ন অনেকক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললো,
——-“জানি না।”

——-“আচ্ছা এটা নিয়ে তোর সাথে পরে কথা বলব।কাজটা আসলেই ভালো করিস নাই।তখন আমি রাগে তোকে অনেক কিছু বলে ফেলেছি।মনে রাখিস না।আসলে আমার রাগ উঠে গেছিল।দিশারি কেমন কইরা কাঁদছিল।ও হার্ট হুইছে খুব।”
——-“জানি দোস্ত।বিশ্বাস কর যখন ও কানতেছিল আমার খুব কষ্ট হইতাছিলো।মনে হইতাছিলো আমি মইরা যাই।”
——-“হইছে তুই আর কান্দিস না।এসব ঝামেলা মিটে যাবে।জলদি সব মিটে যাবে। ”
——-“ও আর আমার লগে কথা কইব না দেখিস।”
——–“হ ওর অনেক অভিমান।”
সায়ন বিভোরের দুই হাত মুঠোয় নিয়ে বললো,
——-“আমি একটা পাপ কইরা ফেলছি।ওরে বলিস আমারে মাফ করে দিতে।আমারে যে শাস্তি দিব মেনে নিমু।ও যেন আমার সাথে কথা বলা বন্ধ না করে।”
বিভোর হেসে জবাব দিলো,
——–” না কথা বলা বন্ধ করবে না।এবার আয়।গিয়ে ঘুমা।”

সায়ন রুমে এসে দেখে ঊর্মি গাল ফুলিয়ে বসে আছে।সায়ন অপরাধী মুখ করে কিছু বলতে চেয়েছিল।তার আগেই ঊর্মি বললো,
——-“শোনো সায়ন।আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমিও তোমাকে কখনো ভালোবাসিনি।জাস্ট টাইম পাস ছিলো।তোমার মতো আমিও হয়তোবা ফোর টুয়েন্টি টাইপ মেয়ে।জানি এসব করা ভালো না তবুও।যাইহোক আমার এনগেজড হয়ে গেছিল আমাদের রিলেশনশিপ এর এক মাস পর পরই।আমার উঠবি ফ্রান্সে থাকে।সে গত সপ্তাহে দেশে ফিরেছে। আমি জানতামনা।সে জেনে গেছে যে আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।আমি বয়ফ্রেন্ডের সাথে দার্জিলিং চলে এসেছি।এজন্য তাঁর সাথে আমার গতকাল হোটেলে আসার পর থেকে ভেজাল চলছে ফোনে।আমি এমনি তোমার সাথে ব্রেকাপ করতাম।যতটুকু বুঝেছি তুমি দিশারি নামের মেয়েটাকে ভালোবাসো তাঁর প্রতি তোমার কোন ফিলিংস আছে।দুর্বল কোন ফিলিংস আছে।সো আমাকে ছাড়তে তোমার কোন রকম কষ্ট অবশ্যই হবে না। তাহলে আমি বরং যাই? ”
সায়ন হা করে তাকিয়ে আছে সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।কোনোমতে বললো,

——-“এতো রাতে কই যাবা?”
ঊর্মি লাগেজটা হাতে নিয়ে বললো,
——–“এ দেখো সবকিছু গুছানো আছে।আমি আগে থেকে প্ল্যান করে রাখছিলাম আজ রাতে আমি এমনিতেই হোটেল থেকে চলে যাবো।রক গার্ডেনে যখন তোমরা আনন্দে ভিজছিলে।তখন আমার উডবির সাথে আমার দেখা হয়।সে আমাদের কে ফলো করে দার্জিলিং চলে এসেছে।এবং একটু দূরের হোটেলটাই সে আছে।তাঁকে আমি কথা দিয়েছি আমি আজ রাতেই তাঁর কাছে চলে যাবো এবং তোমার সাথে ব্রেকাপ করবো।”

কথা শেষ করে ঊর্মি বেরিয়ে যায়।সায়ন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে।সে তাজ্জব বনে গেছে!
সায়ন বিভোরের কাছে তাঁর ফোনটা রেখে এসেছিল।বিভোর ফোনটা ফিরিয়ে দেওয়ার উছিলাই ঊর্মি আর সায়নের সব কথা শুনে।
বিভোরের খুব রাগ হয়।এমন একটা মেয়ে নিজের কু-কীর্তি গলা উঁচু করে বললো তবুও সায়ন কিছু বলতে পারলোনা।তাঁরও কিছু বলার নেই।সায়ন আর ঊর্মি যে একই পথের যাত্রী।এসব মানুষ দুনিয়াতে কেন যে আসে!তবে বিভোরের পৈশাচিক আনন্দও হচ্ছে।সায়নের শিক্ষা হয়েছে।বেশ হয়েছে।

ঊর্মি দরজার বাইরে বিভোরকে দেখে চমকায়।সে বিভোরকে যথেষ্ট ভয় পায়।দ্রুত পা ফেলে বেরিয়ে যায়।
ধারার বিভোরকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তাই বেরুবার জন্য দরজা খুলে তখন দেখলো ঊর্মি লাগেজ হাতে নিচে নেমে যাচ্ছে।ভারী অবাক হয়ে সায়নের রুমের দিকে আসে সে।
বিভোর রুমে ঢুকেই বেসুরা গলায় গান গেয়ে উঠলো,
——-“তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা…..
সায়ন গাল ফুলিয়ে বিছানায় বসলো।বিভোর ভ্রু নাচিয়ে বললো,

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১১

——-“কেমন বোধ করছো মামা?”
বিভোর হো হো করে হেসে উঠলো।গগণ কাঁপানো সেই হাসি।ধারা নিজের দু’গালে হাত রেখে বিভোরের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ঘোর লাগা গলায় বিড়বিড় করে,
——–“সো সুইট!”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১৩