বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১৯

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১৯
ইলমা বেহরোজ

হ্রদের ওপাড়ে এলানের দেখা মিলে।দিশারি দ্রুত সেতু হেঁটে এলানের কাছে আসে।এলান ক্যামেরায় মিরিকের সৌন্দর্য বন্দি করছিল।দিশারি চুল ঠিক করে।লাজুক হাসি নিয়ে ডাকলো,
—-“এক্সকিউজমি?”
এলান তাকায়।দিশারির মুখটা পরিচিত মনে হয়।দুয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরোপুরি চিনতে পারে।এলান হেসে বললো,
—-“হাই?”
—-“হ্যালো?কেমন আছেন?”
এলান ইংলিশে বললো,
—-“ভালো।তুমি কেমন আছো?”
—-“ভালো।আপনার নামটা জানা হলোনা।”
—-“এলান মেলসন।তোমার নাম কি?”
—-“জান্নাতুল দিশারি।”
—-“অনুগ্রহ করে ছোট করে বলবে তোমার নামটা?”
—-“দিশা।”
—-“দীচা?”
—-” না,দিশা!”
—-“দিচা?”

দিশারির মেজাজ খিঁচড়ে যায়।তাঁর এতো সুন্দর সহজ নামটা এতো বিকৃতভাবে উচ্চারণ করছে একজন।অথচ,সে নিরুপায়।কারণ, তাঁর শ্বেতাঙ্গ মানুষের সাথে প্রেমের সখ বহুদিনের।দিশারি জোরপূর্বক হেসে বললো,
—-“একাই এসেছেন?”
—-“না, পরিবার আছে সাথে।”
দিশারি ভাবলো পরিবার হয়তো মা বাবা ভাই বোন হবে।পরিচিত হওয়া উচিৎ।ক্রাশের পরিবার বলে কথা।দিশারি বললো,
—-“কই আপনার পরিবার?”
এলান আঙ্গুলে ইশারা করলো।দিশারি ইশারা অনুসরণ করে তাকায়।একজন ধবধবে সাদা সুন্দরী মহিলাকে দেখতে পায়। স্বর্ণকেশী।পাশে একটা হ্যান্ডসাম ছেলে আরেকটা সুন্দরী মেয়ে।ছেলে-মেয়ে দুটির বয়স ১৮-১৯ হবে।দিশারি হেসে ইংলিশে বললো,
—-“আপনার তিনটা ভাই-বোন খুব সুন্দর।”
এলান হেসে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—-“ভাই-বোন নয়।একজন আমার স্ত্রী বাকি দুজন ছেলে-মেয়ে।”
দিশারির কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো।মুখ থেকে আক্ষেপের সুর ঝড়ে পড়লো,
—-“ও আল্লাহ!আপনি বিবাহিত!”
—-“সরি?প্লীজ ইংলিশে কথা বলুন।”
দিশারি কিছু বললোনা।সে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে এলানের স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েকে দেখছে।এতো বড় ডিঙ্গি ছেলে-মেয়ে হ্যান্ডসাম এলানের কীভাবে হয়?দিশারির মাথায় ঢুকছে না। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
—-“আপনি মজা করছেন না তো?এতো বড় ছেলে-মেয়ে আপনার!ইম্পসিবল!”
—-“আমার বয়স বায়ান্ন চলছে।যখন তেত্রিশ বয়স আমার তখন আমার ছেলে হয়।”
দিশারির মাথা ভনভন করে উঠলো।সে ভেবেছিল এলানের বয়স বেশি হলে ৩৩-৩৪ হবে।এত হবে কে ভেবেছিল!বাপের বয়সী!দিশারি এলানকে কিছু না বলে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিক দিয়ে উল্টো ভৌ-দৌড় শুরু করে।এলান পিছন ডাকে কয়বার।কিন্তু কে শুনে কার কথা।দিশারির দৌড় দেখে বুঝায় যাচ্ছে সে আর এলানের দিকে ফিরছেনা।

দিশারি হাঁপাতে হাঁপাতে সায়নকে বললো,
—-“পানি দে….
সায়নের সোজাসাপটা ধমক,
—-“ওই হালার পুতের লগে কি করছিলি?”
দিশারি ভারী ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বললো,
—-“কে হালার পুত?”
—-“বিদেশিডা!এলাইন্নে!”
দিশারি ব্যথিত কন্ঠে কান্নার ভাব নিয়ে বললো,
—-“এ নাম আর নিস না রে দোস্ত।এতো বড় বাঁশ জীবনে কমই খাইছি।”
সায়নের মুখের কঠিন ভাবটা চলে যেতে থাকে।আগ্রহ নিয়ে বললো,
—-“কেন?কি হইছে?”
—-“ব্যাটার বয়স বায়ান্ন।এডি কোনো কথা ক?আমার আব্বারই বয়স চুয়ান্ন।”
সায়ন একটু অবাক হয়।সে জানে আমেরিকানদের বয়স ধরা যায়না।তবে এতো ফিট হবে ভাবেনি।কিন্তু প্রকাশ করলোনা।হো হো করে হেসে উঠলো।দিশারির দিকে এক আঙ্গুল নিশানা করে,পেটে এক হাত রেখে অনবরত হাসতে থাকে।দিশারির কাটা গায়ে যেন নুনের ছিটা পড়ছে।কাটা কাটা গলায় বললো,
—-“তুই হাসছিস?”
সায়ন জবাবে হাসতেই থাকলো।আশে-পাশের কিছু মানুষ আড়চোখে দেখছে।দিশারি চোখ কটমট করে তাকায়।তারপর হাঁটা শুরু করে।সায়ন পিছন পিছন দৌড়ে আসে।

দুজন দেখতে পায় ঘোড়ায় চেপে বিভোর-ধারা ফেরত আসছে।এক মিনিটের মধ্যে ওদের সামনে ঘোড়া থামে।বিভোর আগে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে।সায়ন ক্যামেরাটা দিশারির হাতে দিয়ে চাপা গলায় বললো,
—-“ওদের দুজনের উপর উড়াধুড়া ক্লিক শুরু কর।”
—-“আমি কেন।তুই কর।”
সায়ন দিশারির মাথায় গাট্টা মেরে বললো,

—“আমি এখানে সিনেমা ঘটাবো।আর তুই সেই সিনেমা ক্যামেরায় বন্দি করবি।কথা কম বল…
সায়ন বিভোরের পিছনে এসে দাঁড়ায়।বিভোর এক হাত বাড়ায় ধারাকে নামানোর জন্য।ধারা বিভোরের হাত ধরে যখনি নামতে যাবে তখন সায়ন পিছন থেকে বিভোরের হাঁটুর পিছনে হাঁটু দিয়ে ধাক্কা দেয়।আকস্মিক ঘটনায় বিভোরের হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়ে ফলে ধারাকে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে।জোরে আওয়াজ হয়।দিশারি কেঁপে উঠে।তবুও ক্লিক করা থামেনি।দু-তিনজন মানুষ দৌড়ে আসে।বিভোর দ্রুত উঠে পড়ে ধারাকে নিয়ে।একজন লোক বিভোরকে অন্য ভাষায় কিছু একটা বললো।বিভোর ভাষাটা জানেনা।হয়তো জিজ্ঞাসা করছে, সে ঠিক আছে নাকি।আন্দাজে,বিভোর মাথা নাড়ায়।লোকটি হেসে চলে যায়।তাঁর মানে আন্দাজই ঠিক।
বিভোর এদিক-ওদিক তাকিয়ে সায়নকে খুঁজতে থাকে।সায়ন ততক্ষণে কিছুটা দূরে চলে গেছে।বিভোরের চোখে পড়তেই ওদিকে দৌড়ায়।সায়ন বিভোরকে আসতে দেখে দৌড়াতে থাকে।পাগলের মতো দুজন যুবককে দৌড়াতে দেখে অনেক পর্যটক তাকিয়ে আছে।আর এক ফুট বাকি সায়নকে ধরতে তখন সায়ন আচমকা পিছন ফিরে বিভোরের কোমর চেপে ধরে বললো,

—-“সরি,সরি।মারিস না।তোর মাইর অনেক শক্ত।”
বিভোর পিছনে তাকায়।দেখে ধারা-দিশারি অন্যদিকে ফিরে কথা বলছে।বিভোর সায়নকে সামনে দাঁড় করিয়ে গালে চুমো দিয়ে বললো,
—-“ছবি তুলছিলি তাই চুম্মা দিতে দৌড়াইলাম।ফিরেই দ্রুত হোয়াটস অ্যাপে পাঠাবি।”
সায়ন অবাক হয়।ভাষার ভান্ডারে কথা মজুদ নেই মনে হচ্ছে।বিভোর এভাবে দৌড়ালো চুম্মা দিতে?ইটস পসিবল!সায়ন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বুকে ফুঁ দেয়।তারপর বললো,
—-“ছবি তুলে দিছি ট্রিট দে…..
বিভোর কঠিন চোখে তাকায়।সায়ন স্বাভাবিকভাবে বললো,
—-“লাগবেনা।আমিই আমারে ট্রিট দিমু।”
বিভোর মুচকি হাসে।বললো,
—-“যা,দিশারিকে নিয়ে ঘোড়ায় উঠ।”
—-“আচ্ছা যামু, আগে ক ধারারে ভালবাসস?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে বিভোর সংকোচে পড়ে।দূর্বল গলায় বললো,
—-“কি বলছিস।তিন দিনে ভালবাসা হয় নাকি।”
—-“হয়।প্রেমের ইতিহাস পড়িস না?”
—-“সময় কই?”
—-“ভালবাসস?”
বিব্রত হয়ে উঠলো বিভোর,
—-“সায়ন!”
—-“আমারে কইবিনা?”

বিভোর প্যান্টের পকেটে দু’হাত রাখে।দুয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে কিছু ভাবে।তারপর বললো,
—-“একদিন রাস্তায় একটা মেয়েকে দেখলাম ভারী সুন্দর তাঁর হাসি।আম্মাকে বললাম মুখ ফসকে।বিয়ে করিয়ে সেই মেয়েকেই বাড়ির বৌ বানানো হলো।বিয়ের রাতে শুনি তাঁর নাম ধারা।এর আগে নামো জানতামনা।তখনো ধারার প্রতি কোনোরকম অনুভূতি কাজ করছিলনা।সকালে উঠে শুনি বউ পালিয়েছে।এক বছর পার হয় ধারার মুখটাও ভুলে যাই।শুধু হুটহাট মনে হতো আমার একটা বউ আছে।শুধু কাছে নেই।এক বছর পর যখন দেখা হলো কোনো কারণ ছাড়াই মনে হলো আমার আপনের চেয়েও আপনজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে।শরীরের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে শীতল একটা অনুভূতিতে।আমি এখনো বুঝলামনা এমনটা মনে হবার কারণ।তারপ…….
—-“শুনছি বউ নাকি জামাইয়ের বাঁ পাঁজরের সৃষ্টি হয়।তাহলে তোর বাঁ পাঁজরের সৃষ্টি যে মানুষটা তাঁকে তো তোর আপন মনেই হবে।”
সায়নের যুক্তি বিভোরের মনে ধরলো। হালকা হেসে বললো,

—-“চোখে চোখ পড়তে থাকে।যখন চোখে চোখ পড়ে কেমন একটা বৈদ্যুতিক ঝিলিক মারে চারপাশটা।সাথে ভেতরটাও।কথা হয়।ধারার যেকোনো কথাতে একটা আকর্ষণ অনুভব করা শুরু করি।যাই বলুক ভালো লাগে।ও যখন হাসে তখনো কেমন হয় একটা আমার।খুব ভালো একটা মেয়ে ধারা।ওর পাশে থাকতে ভালো লাগে।ওকে আগলে রাখতে ভালো লাগে।ধারা পাগলাটে স্বভাবের।কিন্তু অসাধারণ একটা মেয়ে।ওর ইচ্ছেশক্তি প্রবল।আর….আর ও যখন স্পর্শ করে হৃদয়ে তোলপাড় হয়।আমি আমার অনুভূতি বুঝাতে পারছিনা।এইটুকু বলি,এর আগে আর কোনো মেয়ের প্রতি এমন আকর্ষণ অনুভব করিনি।দ্যাটস ইট।”
সায়ন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে।বিভোরকে পরখ করে দেখে।হালকা হেসে বললো,
—-“তুই খুব চাপা স্বভাবের।উপর দিয়ে বুঝার উপায় নেই ভেতরে কি চলে।”
—-“মেবি।”

বিভোর ঘুরে দাঁড়ায়।সাথে সাথে আৎকে উঠে।ধারা আর দিশারি পিছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি ও।কল্পনায় এতো মগ্ন ছিল।জিভ ভারী হয়ে আসে।ধারার চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে সব শুনেছে।বিভোর আমতাআমতা করে কিছু বলতে চেয়েছিল তাঁর আগে ধারা জায়গা ত্যাগ করে।বিভোর পিছন যেতে চাইলে দিশারি আটকায়।তারপর সায়নকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
—-“তোর কাছে একটা পায়েল নাকি আছে?ধারা বললো।ওইটা ওর পায়েল।ফেরত দে…….
সায়ন বুকপকেট থেকে বের করে দেয়।দিশারি পায়েলটা বিভোরের হাতে দিয়ে বললো,
—-“ওরে দিয়ে দিস।”
বিভোর পায়েলটা শক্ত করে মুঠোয় ধরে।ধারার কাছে আসে।পিছন থেকে ডাকে,
—-“ধারা?”
ধারা তাকাতে পারছেনা লজ্জায়।বিভোরের মনের এতোটা স্থান জুড়ে সে।নিজের কানে শুনেছে।খুশিতে,লজ্জায় আত্মহারা হয়ে পড়েছে।পায়ের তলার মাটি শিরশির করছে।সাথে সারা শরীরে ঝিরিঝিরি কাঁপন।বিভোর আবার বললো,
—-“তোমার পায়েল।”

ধারা নিজেকে সামলিয়ে ঘুরে তাকায়।বিভোরের চোখে চোখ পড়তেই বুক কেঁপে উঠলো।অন্যবার এই চাহনিতে ভালবাসা দেখলেও এখন প্রচন্ড আবেগ,আর মাদকতা দেখছে যেনো।ধারা ঢোক গিলে হাত বাড়ায় পায়েল নিতে।বিভোর ইতস্তত হয়ে বললো,
—-“আমি পরিয়ে দেই?”
ধারা এইটাই চেয়েছিল।কিন্তু এই মুহূর্তে যেনো পা স্তব্ধ হয়ে গেলো বা মাটি কামড়ে ধরে রেখেছে।বিভোর হাঁটুগেড়ে বসে।ধারার নিজের পা কে বড্ড ভারী মনে হচ্ছে।কিছুতেই মাটি থেকে তুলে বিভোরের হাঁটুর উপর রাখতে পারছেনা।বিভোর দেখে ধারার পা কাঁপছে।মৃদু হেসে ডান হাতে ধারার বাম পা ধরে নিজের হাঁটুতে রাখে।ধারা মিনমিনে গলায় কোনোমতে বললো,

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ১৮

—-“থাক…..
বিভোর শুনলোনা।যত্ন করে পায়েল পরিয়ে দেয়।পরানো শেষ হতেই ধারা পা সরিয়ে নেয়।দু সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।পরপরই দিশারির দিকে দৌড়াতে থাকে।দৌড়ানোর মাঝে একবার উড়োচুল সরিয়ে পিছন ফিরে তাকায়।বিভোরো তাকিয়ে ছিল!

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ২০