বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৮

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৮
ইলমা বেহরোজ

চারদিক নিস্তব্ধতায় একাকার।বুকটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে।কেউ নেই পাশে।কেউ নেই।পুরো দুনিয়াতে একা একমাত্র সে বেঁচে আছে।এমন একটা অনুভূতি নিয়ে নীরবে জল ফেলছে বিভোর।তখনি একটা ডাক ভেতরের অস্তিত্ব কাঁপিয়ে তুলে।বিভোর চমকে তাকায়।ধারা!দু’হাতে খামচে ধরে আছে বরফ।বেঁচে আছে!বিভোরের রক্ত চলাচল আচমকা বেড়ে যায়।
দ্রুত এগিয়ে এসে ধারাকে তুলে।ধারা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বিভোরকে জড়িয়ে ধরে।বিভোর বাকরুদ্ধ! ধারার কোমরে ক্লাইম্বিং দড়ি বাঁধা!সে দড়ি লক্ষ্য করে সামনে তাকায়।ডেমরার এবং জেম্বা দড়ির মাথা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।বিভোর মৃদু হেসে শক্ত করে ধারাকে জড়িয়ে ধরে।এরপর চোখে জল নিয়েই মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে বলে,

— “দড়ি ছুঁড়ে দিতে।নিজে রিস্ক নিয়ে লাফ দিতে গেলে কেনো?”
ধারা মাস্ক খুলে জবাব দেয়,
— “এতো হাওয়ায় এই দড়ি আসতো তোমার কাছে?”
— “সে আসতোনা।কিন্তু যদি দড়ি থেকে ছুটে যেতে?”
— “ছুটবো কেনো?দেখো বন্ধনী কত সুন্দর করে লাগিয়ে দিয়েছে জেম্বা।”
বিভোর কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।সে ধারার ভালবাসায় হতবাক।ধারা দু’হাত বিভোরের গালে রেখে মৃদু ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁপা গলায় বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “তুমি বুঝোনা আমি তোমাকে কতো করে চাই? এভাবে চলে যেতে কেনো চাইলে?”
বিভোর হেসে ফেলে।চোখ বুজে শেষ চোখের জল ফেলে।এরপর দুজন অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে নেয়।বিভোর এক হাতে ধারার কোমর ধরে অন্য হাতে দড়ি ধরে।এরপর পা দিয়ে পায়ের নিচের বরফ ঠেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রিভাসের দিকে।ধাক্কা খায় সামনের বরফ শৃঙ্গের সাথে।দুজনই ব্যাথা পায় কিছুটা।কিন্তু বেঁচেতো আছে!কিছু মুহূর্ত আগে দুনিয়ার আশা ছেড়ে দিতে হয়েছিল।মিনিট খানিকের মধ্যে ফেলে আসা স্তম্ভটি হাওয়ার দাপটে ভেঙে পড়ে ক্রিভাসে।ধারা নিচে তাকায়।তারা দুজন ঝুলে আছে গভীর খাদের উপর।কি ভয়ংকর!দুজনের জীবন এখন ডেমরার ও জেম্বার হাতে।ডেমরার চেঁচিয়ে বললো,

— “বিইভোর তুমি কি উপরে উঠে আসার জন্য প্রস্তুত? ”
বিভোর জবাব দেয়,
— “প্রস্তুত। ”
ডেমরার ও জেম্বা দড়ি টেনে পিছু হটতে থাকে।বিভোর বরফের গায়ে পা ফেলে ক্লাইম্বিং করে উপরে উঠে আসে।তখনো চারপাশে ঝড়ো হাওয়া চলছিল।চিকন বরফের পথটি পাড়ি দিয়ে ওরা দ্রুত একটা সমতল জায়গায় আসে।খুব কাছাকাছি কোনো বরফের স্তম্ভ, স্তূপ,পাহাড় নেই।পুরোটাই সমতল।বিভোর জেম্বা ও ডেমরারকে জড়িয়ে ধরে।কৃতজ্ঞতা জানায়,
— “আমি কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো বুঝে উঠতে পারছিনা।থ্যাংক ইউ,থ্যাংক ইউ সো মাচ।”
জেম্বা বললো,
— “এটা আমার কর্তব্য ছিল।এজন্যই আসা।”
ডেমরার বললো,

— ” আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তোমার অর্ধাঙ্গিনী বিইভোর।সে সাহস করে এমন একটি পদক্ষেপ না নিলে কিছুই হতোনা।”
বিভোর ঘুরে দাঁড়ায়।ডেমরার, ফজলুল,জেম্বা একটু দূরে গিয়ে বসে।হাওয়া ধীরে ধীরে কমতির পথে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।তবে ঠান্ডায় শরীর শিরশির করছে।শারিরীক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রবলভাবে।বিভোর এগিয়ে এসে ধারার চোখের দিকে তাকায়।ধারা পটপট করে দ্রুত বলে,
— “আমি জানি এখন তুমি আমাকে কিস করবে।আমার কোনো সমস্যা নেই।আমি প্রস্তুত।তুমি করতে পারো।ঠান্ডা লাগছে খুব।একটু গরম হওয়া যাবে।”
বিভোর কপাল কুঁচকে ফেলে।ধারা আড়চোখে বিভোরের দিকে তাকায়।এরপর দুজন একসাথে হেসে উঠে।বিভোর হাত বাড়িয়ে ধারাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকায়।শুকরিয়া আল্লাহর প্রতি!

ছয়-সাত ঘন্টার ব্যবধানে হিমালয় শান্ত হয়ে আসে।এত বড় ঝড়ের কবলে পড়েও বেঁচে আছে পাঁচ জন।এ কোনো সামান্য কথা নয়।দুপুরে জেম্বার বানানো চা ও স্যুপ খেয়ে যাত্রা শুরু হয় চূড়ার দিকে।শেষটা তো দেখতেই হবে।শরীরে রাজ্যের সব শক্তি এসে ভর করে সবার।আজ এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছাতেই হবে।ইচ্ছে হচ্ছে দ্রুত গতিতে উঠে যেতে।কিন্তু জেম্বা বলছে, ধীরে চলতে।তাই ধীরে চলতে হচ্ছে।
দীর্ঘ তিন ঘন্টা হাঁটার পর ধারার কেমন অস্বস্তি হতে থাকে চোখে। চোখ কটকট করছে, চোখের মনি দুটিতে ব্যাথা ব্যাথা ভাব। সারা শরীর ঢাকা থাকলে হবে কী?চোখ দুটো তো খোলা।ঠান্ডায় হয়তো এমন হচ্ছে।যত সময় যাচ্ছে ব্যাথা এবং অস্বস্তি বাড়ছে।চোখে কেমন একটা ঝাপসা ঝাপসা ভাব, ভয় পেয়ে যায় ধারা।বিভোর খেয়াল করে বললো,

— “কি হয়েছে ধারা?”
— “কিছুনা।”
— “মুখটা ওমন দেখাচ্ছে কেন?”
ধারা বলতে গিয়েও বললোনা।বিভোর টেনশন করবে তাহলে।আর কিছুটা পথ তারপরই এভারেস্ট চূড়া। কি দরকার টেনশন দেওয়া।ধারা বলে,
— “এমনি।চিন্তা হচ্ছে পৌঁছাতে পারব নাকি।”
— “মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছি।আল্লাহ ফিরিয়েছেন চূড়ায় তোলার জন্যই।”
জবাবে ধারা হাসলো।বিভোর দড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে উঠছে।চারিদিকে সব বিশাল বরফশৃঙ্গ।কিন্তু কোনো শৃঙ্গই বিভোরদের মাথার চেয়ে উঁচু নয়।ওরা এতোটাই উচ্চতায় রয়েছে।পূর্বে দূরে মেঘের স্তরের ওপর দিয়ে যে বিশাল পর্বতমালা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ওটা কাঞ্চনজঙ্ঘা। ওদের সামনে অর্থাৎ উত্তর দিকে আছে এভারেস্ট। কিন্তু দেখা যাচ্ছেনা।সামনে যে চূড়াটা সেটা সাউথ সামিট।তারপর আসল এভারেস্ট শৃঙ্গ।
ধারার চোখের যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে।দ্রুত সানগ্লাস পড়ে নেয়।চোখে এখন হালকা দেখা যাচ্ছে।এভাবেই পৌঁছে যায় সাউথ সামিটে।হালকা ভাবেই দেখতে পায়, এভারেস্ট চূড়া!উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে ধারা,

— “ওইতো,ওইতো এভারেস্ট চূড়া।”
উত্তেজনায় শরীরের রক্ত টগবগ করছে।পাঁচ জনের ঠোঁটে জয়ের হাসি।আরেকটু পথ….একটু!সামনে রকওয়াল,শৈলপ্রাচীর – উচ্চতা প্রায় পঞ্চাশ-ষাট ফুট।এটাই সেই বিখ্যাত হিলারি স্টেপ।রক বা পাথরের ওয়াল বেয়ে কিছুটা উঠতেই ফজলুলের চিৎকার শোনা যায়।চারজন ফিরে তাকায়।ফজলুল পা ফসকে পড়ে গিয়ে পাথরে ধাক্কা খেয়ে মাথা ফেটে চৌচির।বিভোর এগিয়ে আসে ধরার জন্য তাঁর আগেই ফজলুল পাথরের গা থেকে ছুটে যায়।এত বড় বিপদ পেরিয়ে এই সামান্য পথে নির্মম মৃত্যু!মানা যাচ্ছেনা।চারজন কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।এরপর জেম্বা তাড়া দেয়।যে হারিয়ে গিয়েছে তাঁর জন্য সময় নষ্ট করে লাভ নেই।ধীর পায়ে আস্তে আস্তে একসময় ওরা হিলারি স্টেপের উপরে উঠে আসে।চোখে ছানি পড়লে মানুষ যেমন দেখতে পায় ধারাও তেমন দেখতে পাচ্ছে।সামনে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ডিগ্রির একটি বরফ ঢাল।এই ঢালই গিয়ে শেষ হয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে।ভেতরে কাজ করছে উন্মাদনা। বুকে যেন ঢাকের আওয়াজ। শরীরের পশম খাড়া হয়ে যায় বিভোরের।স্বপ্নের চূড়া এতো কাছে!নিজেকে সংযত করে খুব সাবধানে পা ফেলে।দু’দিকে খাড়া ঢাল।প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পূর্ণ পেরোতেই সামনে পড়ে প্রার্থনা পতাকা।মানে ওরা পৌঁছে গেছে।বিভোর দু’হাত উপরে তুলে লাফিয়ে উঠে।ধারাকে বলে,

— “ধারা আমরা পেরেছি।”
ধারা উত্তেজনায় কাঁপছে।সত্যি এসেছে!এ স্বপ্ন না কল্পনা।তব্ধা লেগে দাঁড়িয়ে পড়ে।যেনো চোখ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে নড়লেই স্বপ্ন ভেঙে যাবে।ওরা তিনজন ধারার দিকে এগিয়ে আসে।এরপর চারজন একসাথে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করে।বিভোর উন্মাদের মতো হয়ে বলতে থাকে,
— “আমরা পৌঁছে গেছি। স্বপ্নের এভারেস্ট চূড়া!আমি পেরেছি।ওহ আল্লাহ!”
ধারা খুশিতে রীতিমতো লাফাচ্ছে।চোখের ব্যাথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আনন্দে।জেম্বা ও ডেমরারের কাছে স্বাভাবিক মনে হতো যদি দূর্যোগ ছাড়াই পৌঁছানো যেতো এভারেস্ট চূড়া।কারণ,দুজন আরো এসেছে এভারেস্ট চূড়ায়।কিন্তু আজ আনন্দ হচ্ছে প্রথম এভারেস্ট চড়ার মতো!
জেম্বা স্যাটেলাইট ফোনে খবর দেয়।মুহূর্তে পুরো পৃথিবীতে ছড়ে যায় চারজনের নাম।এবার যেনো উল্লাস বেশি।এতো বড় দুর্যোগ টেক্কা দিয়ে চারজন এভারেস্ট চূড়ায়!উপরে আকাশ নীচে পুরো পৃথিবী!এই আনন্দ প্রকাশের ভাষা নেই।বুক ধুকপুক করছে।বিভোর আচমকা ধারাকে ডাকে,

— “ধারা?”
ধারা তাকায়।ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
— “কি?”
বিভোর চিৎকার করে বলে,
— “গোটা পৃথিবীকে সামনে রেখে বলছি, আমি তোমাকে ভালবাসি।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৭

ধারা হাসে।চোখ দুটোতে জল চিকচিক করছে। গেঁজ দাঁত ঝিলিক দেয়।সূর্য ডুবছে।তাঁর রক্ত লাল আলোয় চকচক করছে চারপাশ।ধারা দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিভোরের বুকে।ডেমরার সুন্দর মুহূর্তটির ভিডিও করে নেয়।এভারেস্ট চূড়ায় প্রপোজ!যে সেই কথা নয়!ঘন্টাখানেক পর ফেরার যাত্রা শুরু হয়।স্বপ্ন পূরণ অর্ধেক সমাপ্ত।বাকি আরো অর্ধেক পথ।ফেরার পথে বিপদ ওঁত পেতে থাকে বেশি।যত অভিযাত্রী মারা গিয়েছে এভারেস্ট জয়ের আবিষ্কারের পর থেকে তার বেশি অর্ধেকই ফেরার পথে!

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৯