ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ১৮

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ১৮
লেখনিতে : মিমি মুসকান

রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর উনাকে খুঁজছি। হঠাৎ কারো চেনা গলা পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। পেছন থেকে কেউ বলে উঠল..
– এই ভূতনি!

আমি সাথে সাথে পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি উনি একটা রিক্সায় বসে আছেন। তার মুখে মাস্ক নেই তার কারন তিনি সিগারেট খাচ্ছে।‌‌ বিয়ের দিন পর আজ দ্বিতীয় বার তাকে আমি সিগারেট খেতে দেখলাম। একটা তার হাতে, কিছুক্ষণ পর পরই সেটা মুখে দিচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রিক্সার নিচেও কয়েকটা পরে আছে তার মানে উনি এতোক্ষণ ধরে’ই এগুলো খাচ্ছিলেন। এতোসব উনি কিভাবে খান। ভেবেই আমার মাথা ‌ধরেছে।
উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে আমি কি ভাবছি। রিক্সার হুড দেওয়া যার অর্থ উনি লুকিয়ে এখানে এসব খাচ্ছিলেন। এটা উনার স্বভাব না, কারন উনি সব সময় এসব খায় না। হয়তো রেগে গেলে খেয়ে থাকেন। যেমনটা আজ হলো। উনি আমার নিশ্চুপতা দেখে বলে উঠেন…

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– কি ভাবছো ভূতনি!
আমি একটু গম্ভীর গলায় বলি..
– এখানে কি করছেন? ক্লাস করে নি কেন আজ। এখানে বসে এইসব হাবিজাবি খাচ্ছেন।
– মন চায় নি করতে তাই। বসো এখানে বাসায় যাবে তো।
বলেই একটু সরে বসলেন তিনি।
– আমি এই রিক্সায় করে যাবো না।
– কেন?
– আপনি এখানে বসে এসব খেয়েছেন। পুরো রিক্সায় এখন এসবের গন্ধ। আমার ভালো লাগে না এই গন্ধ মাথা ঘুরাই।

উনি হাতের অর্ধেক সিগারেট ফেলে কিঞ্চিত হেসে নিচে নামে।‌ অতঃপর রিক্সাওয়ালা কে ‌টাকা দিয়ে বলে..
– এই নিন আপনার ভাড়া।
বলেই আমার হাত ধরে হাঁটতে থাকে।‌ খুব অস্বস্তিকর লাগছে আমার। কখনো এভাবে কারো হাত ধরে রাস্তায় হাটে নি। আর তার মধ্যে উনি! কোনো হুঁশ নেই। যেভাবে আমার হাত ধরে রেখেছে মনে হচ্ছে আমি কোথায় পালিয়ে যাবো।‌ কোনো কথা ছিল না বলে এমনেই বলি…
– কোথায় গিয়েছিলেন আপনি!
– না।
– তাহলে ভাড়া দিয়ে এলেন যে।
– এতোক্ষণ বসে ছিলাম উনার রিক্সায়। আমার জন্য উনি রিক্সা নিয়ে বের হতে পারে নি। তাই!
– ওহ্।‌ আপনার শরীর থেকে গন্ধ আসছে এসবের ছিঃ।
উনি কিছু বললেন না। আমি আবার বলে উঠি..

– আচ্ছা একটা কথা বলি।
উনি এবার বলে উঠেন…
– তুমি একটা কথা কখন বলো! একটা জিজ্ঞেস করলে তো দশটা বলো।
আমি মুখ ফুলিয়ে রইলাম। উনি একটা রিক্সা দাঁড় করিয়ে সেখানে আমাকে বসিয়ে দিলো। অতঃপর নিজে বসে বলতে লাগল…

– কি বলবে বলো! না হলে তোমার পেট ব্যাথা করবে। যেই লেভেলের বাঁচাল তুমি।
উনার কথাটা কেন জানি খুব গায়ে লাগল। রাগ হচ্ছে খুব, কথা বললাম না আর উনার সাথে। উনি কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলেন না। হয়তো বুঝেছেন আমি রেগে আছি। বাসায় চলে এলাম। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে না একটু আগে উনি এতো রেগে ছিলেন। প্রতিদিনের মতো আজও আমাকে পড়তে বসালেন। আমি এখনও কথা বলিনি উনার সাথে। শুধু হ্যাঁ কিংবা না বলছি। পড়া শেষে উনি আমাকে বলেন…

– আজ আমার সাথে ঝগড়া করে মনব্রত রেখেছো, ভালো কথা কিন্তু সেটাই একটা লাভ হয়েছে। খুব ভালো করলে পড়লে আজ! প্রতিদিন এমন’টা করো তাহলে পড়ালেখা‌ ভালো হবে।
বলেই নিচে চলে গেলেন।
রাগে আমার শরীর জ্বলছে, উফফ এই লোকটা এমন কেন? দেখছে আমার রাগ হচ্ছে তাও এমন করছে কেন। আজ স্কুটি নিয়ে বের হয়নি। ভার্সিটি থেকে এসে কতোক্ষণ শুয়ে ছিলেন। আমিও বলে নি কিছু।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই বসে খাবার খাচ্ছে। আমি আপু’র পাশে বসে আছি। এর মধ্যে হঠাৎ উনার একটা কল আসে। উনি ফোনের দিকে তাকিয়ে খাবার না খেয়েই উঠে যান। বাবা এসব দেখে বলে উঠেন..

– আহি খাবার শেষ করো উঠো!
– বাবা আমার খাওয়া শেষ, আর খাবো না।
বলেই উনি চলে যান। কিছুক্ষণ পর আমিও উঠে উনার পিছু পিছু যাই। এসে দেখে উনি ঘরে নেই। আমি বেলকনিতে একটু উঁকি দিয়ে দেখি উনি দোলনায় বসে আছে। হাতে সিগারেট! আমার কেন জানি মনে হচ্ছে একটু আগে নিতি’র সাথে কথা বলেছেন উনি। আমি একটু একটু করে উনার কাছে গেলাম। আমার উপস্থিতি উনি অনেক আগেই পেয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে।
উনি ‌বলে উঠেন..

– তুমি এখানে কেন আসলে, তোমার মাথা ঘুরাবে শেষে।
– আপনি খাবার না খেয়ে এইসব কেন খাচ্ছেন আবার কিছু হয়েছে?
– না কি হবে?
– নিতি আপু কল করেছিলি আবার!
– হুম!
– কি বললো?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন..
– নিতি বুঝতে চাইছে না। পাগলামি করছে?
– আপনি আমাকে বিয়ে ‌না করে নিতি আপু কে করতে পারতেন।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে..

– তোমার কাছে কিছু জানতে চেয়েছি আমি।
– আচ্ছা আপনি তো আমায় কষ্ট দাওয়ার জন্য’ই বিয়ে করেছেন। তাহলে তো আপনি..
পুরো কথা শেষ করার আগেই সামনে তাকিয়ে দেখি উনি রেগে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভয়ে চুপ হয়ে যাই। উনি উঠে আমার কাছে এসে আস্তে করে বলেন..
– তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য আবার অনেক পথ আছে, তার জন্য নিতি’র দরকার নেই বুঝলে।
উনার ধমকে চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু একটা কথা আমার মাথায় আজ সেই সকাল থেকে ঘুরছে। তখন ঝগড়ার কারনে বলতে পারি নি।‌ তাই এখন উনাকে জিজ্ঞেস করি….

– আপনার জীবনে কোনো মেয়ে ছিল!
আমার কোথায় উনি চমকে যান। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে…
– এই কথা কেন বললে?
– নাহ আপনি তখন নিতি আপু কে যে বললেন, আমার আমার লাইফে কোনো মেয়ের জায়গা নেই and you know it very well. এটার মানে কি?
– কিছু না।
বলেই উনি যেতে লাগলেন।
আমি উনার কাছে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলি…

– বলুন না প্লিজ প্লিজ, আচ্ছা কোনো মেয়েকে ভালোবাসতেন আপনি!
আমার কথায় উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলে…
– ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে।
– হ্যাঁ অবশ্যই আছে।
উনি খানিকক্ষণ দেওয়ালে মাথা ঠেকে চোখ বন্ধ করে আমাকে বলল..
– তাহলে হয়তো সে আমার ভালোবাসা ছিলো না!
আমি উনার কথা শুনে অবাক হয়ে বলি..

– কে সে?
– ছিলো একজন! অনেক পুরোনো কথা বাদ দাও।
বলেই রুমে চলে এলেন। আমি উনার পিছু পিছু খোঁচাতে খোঁচাতে বলি…
– এই বলুন না প্লিজ, আমি শুনবো।‌ বলুন না!
উনি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে..
– প্রেম, ভালোবাসার প্রতি এতো ইন্টারেস্ট কেন তোমার। তুমি দিন দিন পাকনা ভূতনি হয়ে যাচ্ছো।
আমি রেগে বলি..

– রাখুন তো আপনার উপাধি দেওয়া। আগে বলুন কে সে?
– আরে সে রকম কেউ নেই ভূতনি।
– তাহলে বললেন যে..
– সেটা শুধু ওই বয়সে আমার attraction ছিলো আর কিছু না।
আমি ভ্রু কুঁচকে বলি…
– ওই বয়স মানে, কতো বছর আগে।
– অনেক….
– আপনার বন্ধুরা জানে।
– তারা তখন আমার সাথে ছিল। জানে বৈকি! তার জন্য আমার সে বার পরিক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল।
– বাহ এতো প্রেম। তা তাকে বিয়ে না করে আমাকে কেন করলেন?
– আরে ভূতনি! সে তো তখন আমার ক্রাশ ছিলো তাই তার বিয়ে হওয়াতে আমি একটু ড্রিপরেশন এ গেছিলাম বুঝলে।

– বাহ্ ক্রাশ, সেই বয়সে ক্রাশ ও খেলেন।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলে…
– এমন ভাবে বলছো যেন তুমি খাও না!
মুখ ভেংচি দিয়ে বলি…
– নাহ!
– আমার‌ প্রতি ক্রাশ খাও নি তুমি!
আমি উনার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলি..
– আপনার প্রতি ক্রাশ তাও আমি হি হি হি। কি আছে আপনার যে ক্রাশ খাবো।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে..

– কি বললে তুমি।
– নাহ নাহ কিছু না। আপনার লাভ স্টোরি বলুন।
উনি আমার মাথায় বাড়ি মেরে…
– আরে ভুতনি সেটা কোনো লাভ স্টোরি ছিল না। বুঝলে…
– আপনি বললেই হতো!
– যদি এমন হতো তাহলে আজ এখানে তুমি থাকতে না বুঝলে!
– কেন?

– সেটা তোমার মতো ভূতনি’র মাথায় ঢুকবে না। কিন্তু একটা কথা শোন আমি আজ পর্যন্ত কাউকে ভালোবাসি নি। আর ভালোবাসা সম্পর্কে কোনো ধারনা নেই আমার। এটার অনূভুতি কেমন জানি না।
– সমস্যা কি নিতি আপু এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।‌ প্রেম করে অনূভুতি বুঝে নিন।
– কেন? প্রেম আর ভালোবাসা কি এক!
– আমি কিভাবে বলবো? অভিজ্ঞ কাউকে জিজ্ঞেস করুন।
– কাকে করবো? বলো!
– আমি কিভাবে বলবো!
– একটা কথা জানো তুমি একমাত্র মেয়ে যে কি না তার বর কে ভাগ বসাতে দিতে চাইছো।
– আপনার মতো বর ( দীর্ঘশ্বাস ফেলি )
উনি আমার পাশে বসে বলে …

– আমার মতো বর মানে! ( আমার হাতে চিমটি কেটে ) তুমি জানো কতো মেয়ে পাগল আমার জন্য!
– আম্মুউউউ! আপনি আমাকে মারলেন কেন?
– ঠিক করেছি, আরেকটা দেবো। বলেই আবার চিমটি কাটলো।
আমি উনার চুল টানলাম। উনি বলে উঠলেন…
– ভূতনি তুমি আমার চুলের স্টাইল কষ্ট করে দিলে।
– ঠিক করেছি। আবার করবো। বলেই হাত দিতে গেলাম। উনি আমার হাত ধরে ফেললেন। অতঃপর বলেন…
– এখন আমি দেখাচ্ছি
বলেই দাঁত বের করে হেসে এক হাত দিয়ে আমার চুল গুলো উলট পালট করে দিলেন। সারারাত এভাবে মারামারি করলাম উনার সাথে।

দেখতে দেখতে আজ ১ মাস কেটে গেলো। মা আপু’র সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরো ভালো হলো। বাবা’র সাথেও অনেক ভালো। উনি এখন কথা বলে আমার সাথে। আর আহিয়ান! উনার সাথে আগের থেকেও এখন বেশি ঝগড়া লাগে। অথচ ঝগড়ার কোনো কারন নেই তবুও লাগে। বিশেষ করে আমি ঝগড়াটা লাগাই। ভালোই লাগে তার সাথে ঝগড়া করতে। সেটা এখন আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।‌

আজ প্রথম বার একা একা স্কুটি চালিয়ে ‌ভার্সিটিতে এসেছি। এতো দিন অনেক কষ্ট করে উনি আমাকে শিখিয়েছন কিন্তু আজ আমার সাথে আসে নি। ভার্সিটিতে আসার পর ইতি’র সাথে দেখা। আমার স্কুটি দেখে তার ভারী পছন্দ হলো। ইতি কে এখনো বিয়ের কথা বলি নি। আসলে কোথা থেকে শুরু করবো ভেবেই পায় নি। কি বলবো কি করে বলবো বুঝতে পারি নি। তাই আর বলা হয় নি।

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ১৭

নিতি এই এক মাস ভার্সিটি আসে নি। সেদিন আহিয়ান এর রাগের কারনে এখনো আসে নি। কারনটা হলো সেই কথা এখনোর ভার্সিটির কেউ ভুলে নি। এই এক মাস আমার কাছে কাটানো সবচেয়ে ভালো সময় ছিলো। না কোনো চিন্তা না ভয়। কারন নিতি ছিল না বলে কেউই আমাকে জ্বালায় নি। ভার্সিটিতে আহিয়ান অল্প কথা বলে আমার সাথে।‌ তবুও সেটা সাবধানে! আমার কথার এতো মূল্য দিবেন উনি আমি আগে ভাবিনি।
ভার্সিটিতে এসে বড় বট গাছ টার নিচে বসে আছি। অপেক্ষা করছি উনার। উনি এখনো আসে নি। আমাকে আগে ভাগে পাঠিয়ে দিলো। এখনো আসার নাম নেই। কিন্তু কেন। হঠাৎ ইতি বলে উঠলো..

– কিরে কি ভাবছিস।
– নাহ কিছু না।
– আচ্ছা তোর বর কে এখনো দেখালি না আমায় কেনো?
ইতি’র কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে গেল। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না। কি বলবো কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। ইতি আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো..
– কি রে।
– হুম ‌
এমন সময় কয়েকটা বাইক ঢুকলো ভার্সিটিতে।‌ আমি আর ইতি তাকিয়ে আছি সেদিকে। গুনে গুনে চার টা। আমি হিসাব করেছি। তখনই আচমকা…

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ১৯