ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৫  

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৫  
নীহারিকা নুর

রুমের মাঝে পিন পতন নিরবতা। বাবা মেয়ে দুজন খাটের দুপাশে বসা। মেয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছে বাবা কি বলবে সেটা শোনার জন্য। মনে মনে কিছু টা ভয়ও হচ্ছে। বাবা যদি বকা দেয়। ভাইকে আসতে দেখে নুরনাহার সেই মুহুর্তেই রুম ছেড়েছে। তরুর এতক্ষণের ভাবনা, ভয় সবটাই বৃথা গেল নুরুল ইসলাম এর কথায়। তিনি তরুকে কোনরুপ বকাঝকা করলেন না। বরং এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। ছোট স্বরে জিজ্ঞেস করলেন

– তুমি কি তোমার ফুপির সাথে যেতে চাচ্ছ না?
তরু কোন জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। নুরুল ইসলাম বুজলেন মেয়ে কি চাচ্ছে। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছেও এই মুহুর্তে পূরণ করতে পারছেন না তিনি। তার আর মাত্র তিনদিন ছুটি আছে৷ ওদিকে খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা কে’স হাতে নিয়েছে। সেখানেও যেতে হবে। আর মেয়েকে এখানে রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে এই এলাকায়ই এমন কেউ আছে যে তাদের পরিবারের ভালো চায় না। তিনি আবার তরুকে বললেন

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আমি বুজতে পেরেছি মামনি। শোন কোন বাবা মা ই তার সন্তানের খারাপ চায় না। আমিও তোমার ভালোর জন্যই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। বাবার উপর রেগে থেকো না৷। তুমি রেডি হও আমি গিয়ে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।
বাবার কথায় আর দ্বিমত করল না তরু। এমনিতেও বাবার উপর কথা বলার সাহস নেই। তার উপর বাবা নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে বলছে তার মানে বাবা খুব সিরিয়াস।তাই তরুও আর দেরী না করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। বোঝাল ঠিক আছে বাবা।

মেয়ের সম্মতি পেয়ে মনে মনে খুশি হলেন নুরুল ইসলাম। অনেক ছেলে মেয়েরাই আছে যারা নিজেদের মন মতো না হলে প্রায়সই বাবা মায়ের সাথে উচু গলায় কথা বলে কিন্তু তরুর ক্ষেত্রে এটা কখনোই দেখেননি নুরুল ইসলাম। তার কথা বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়। এতে অবশ্য নুরুল ইসলাম খুশি। তবে মেয়ে মনে মনে যে তাকে ভয় পায় ভীষণ এটা হয়ত তিনি জানেনও না।

নুরুল ইসলাম মেয়েকে শাওয়ার নিয়ে রেডি হতে বললেন। তারপর যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই বেরিয়ে গেলেন। বাবা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তরু বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে কয়েকবার শ্বাস নিল। ও যে কি ভয়ই না পেয়েছিল। ও তো ভেবেছিল ওর বাবা হয়ত কালকের ঘটনার জন্য রেগে আছে ওর উপর৷ এখন বাবা যা বলে গেল তা করাই ভালো।
তিনটা বাজতে আর মাত্র দু ঘন্টা বাকি। অন্তত আাধ ঘন্টা আগেই বাসা থেকে বের হতে হবে। হাতে নষ্ট করার মতো আর সময় নেই৷ তরু আর এক মুহুর্ত ও সময় নষ্ট না করে আলমারি থেকে জামা নিয়ে শাওয়ারে ঢুকে গেল।

তরু রুম থেকে যাওয়ার পরেই সেখানে প্রবেশ করে তহমিনা বেগম। দ্রুত হাতে মেয়ের এলোমেলো করে ফেলা রাখা সব জামা কাপড় গুছিয়ে দেন। তারপর যা যা প্রয়োজন সব কিছুই গুছিয়ে দেন। তরু বের হওয়ার আগেই তিনি আবার রুম ছাড়েন। তিনি কোন ভাবেই মেয়ের সামনে যেতে চাচ্ছে না। যদি কান্না এসে পড়ে সেই ভয়ে। অবশ্য তার মেয়ে তো অনেক স্ট্রং। কিন্তু তিনি নিজেই তো ইমোশনাল মানুষ।

তরু রুমে এসে দেখল একদম সব কিছু পরিপাটি করা। তরুর বুজতে বাকি রইল না যে রুমে কে এসেছিল। হাতে থাকা তোয়ালেটা শুকাতে দিয়ে তরু বের হয় রুম থেকে। তহমিনা তখন সবার জন্য খাবার সাজাতে ব্যাস্ত। তার রান্না ইতোমধ্যে শেষ। এখন পরিবেশনের জন্য গোছগাছ করছেন।

নুরনাহার সেখানে নেই। তিনি তার জিনিস পত্র গোছগাছ করতে গিয়েছেন। তরু যে এসেছে তহমিনা তা দেখেনি। সে অন্য দিকে মুখ করে কাজে ব্যাস্ত। তরু আস্তে আস্তে পেছনে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে হাত থেমে যায় তহমিনা বেগমের। যার থেকে দূরে থাকতে সামনে গেলেন না সেই এখন সামনে। তহমিনা নিজেকে সংযত রেখে বললেন

– এখানে কি করছ। যাও চুল শুকিয়ে মুখে একটু ক্রিম দাও। এমনিই তো দেখতে যা লাগছে না। এই অবস্থায় কি যাবে নাকি?
– আম্মু তুমি পালাই পালাই করছ কেন?
– দূর পা’গলি মেয়ে পালাই পালাই করব কেন। আমি তো আমার কাজ করতেছি।
– হুম বুঝি বুঝি।

– হইছে আর পাকনামি করতে হবে না। শোন ওখানে গিয়ে একদম ভালো মেয়ে হয়ে থাকবি। ফুপিকে একটুও জ্বালাতন করবি না। ফুপির যেন কোন কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবি।
– ফুপি ফুপির ছোট মা কে নিয়ে যাচ্ছে। মা তার মেয়ের একদম কষ্ট হতে দিবে না দেখো তুমি।
মেয়ের কথা শুনে তহমিনা হেসে দেয়। অবশ্য মাকে হাসানোর জন্যই তরু এমনটা বলেছে।
এরপর একে একে সবাই আসে সেখানে। একসাথে খেতে বসে সবাই।

দেখতে দেখতে প্রায় আড়াইটা বেজে যায়। সবকিছু মোটামুটি গোছগাছ। সবাই মোটামুটি রেডিও। তখন লাঠি ভর করে আস্তে আস্তে সেখানে উপস্থিত হয় তারামন বিবি। তার নাতনি চলে যাচ্ছে বলে তারও কষ্ট হচ্ছে। তবে তিনি জানেন গ্রামের মানুষ কেমন৷ তারা তরুকে কথা শোনাতে একটা সুযোগ ও হাতছাড়া করবে না৷ এরকম বাজে কথা হয়ত তরু সহ্য করতে পারবে না। এজন্যই তো তিনি তার নাতনিকে দূরে রাখার পরামর্শ দিলেন।

তিনি এসে নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন একদম ভালো মেয়ে হয়ে থাকার জন্য। নুরুল ইসলাম তার কথা রাখলেন। তিনি গিয়ে মেয়েকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। তবে তার থাকার সময় হবে না। তিনি রাতের বাসে আবার ফিরে আসবে।

অন্ধকার একটা ঘরের মধ্যে বসে আছে আসিফ। এই রুমে একটা দরজা ছাড়া আর কিছুই নেই৷ একটা কারেন্ট এর বাল্ব ও নেই। শুধু একটা টেবিল ল্যাম্প আর উপরে ভনভন করে ঘুরতে থাকা একটা পাখা। না আছে একটা খাট। ফ্লোরিং করা। আসিফ এর মনে হচ্ছে কোন জে’লখানায় বন্ধী আছে সে। সেখানের পরিবেশও বোধহয় এর থেকে ভালো। এখান থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তাই দেখতে পাচ্ছে না আসিফ। আসিফ মোটামুটি জানে ওকে এখানে কে আটকে রেখেছে। ওর কানে বারবার শুধু বাজছে সেদিন এর শোনা কথা গুলো।

বিয়ের কিছু শপিং বাকি ছিল। শাড়ী, শেরওয়ানী কেনা হয় নি। আবির চেয়েছিল তরুকে নিয়ে দুজনে পছন্দ করে এগুলো কিনবে। সেই কথা মতো তরুকে নিয়েই শপিং এ গিয়েছিল। শপিং করে ফেরার পরে আবিরই তরুকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। তরু বারবার বলার পরেও আবির সেদিন বাসায় আসে নি। তাই তরুকে একা একাই বাসায় চলে আসতে হয়েছিল। বাসায় আসার পর তহমিনা দেখতে চেয়েছিল যে কি কি আনল। তহমিনা প্রথম ব্যাগটা খুলতেই দেখল সেখানে আবির এর শেরওয়ানি রয়েছে। তহমিনা সাথে সাথে তরুকে ডাকে।

– তরু এই তরু৷ তুই শেরওয়ানি নিয়ে চলে এসেছিস কেন। তোর কি আবার এগুলো পড়ার ইচ্ছে আছে নাকি।
– দূর আম্মু মজা করো না তো। ভুলবসত আবির এর শেরওয়ানি নিয়ে চলে এসেছি।
– সেটা তো বুজতে পেরেছি। কিন্তু এখন এটা দিয়ে আসতে আবার কে যাবে। এতদূর এর পথ। কি ঝামেলা বাধিয়ে ফেললি বল তো।
সেই মুহুর্তে আসিফ ওই বাড়িতে আসছিল। এসেছিল মূলত নুরুল ইসলাম এর কাছে। এসে এই অবস্থা দেখে আসিফ বলেছিল

– আন্টি চিন্তা করো না তুমি এখনই আবির ভাইয়াকে ফোন করে দেখ সে কোথায় আছে। হয়ত বেশি দূর যায় নি। তাকে রাস্তার মাথায় আসতে বলো আমি অতটুকু গিয়ে পৌছে আসি।
– হ্যা আসিফ সেটা একদম ঠিক বলেছ। দাড়াও আমি এখনি ফোন করে দেখতেছি।
তহমিনা তখনি আবিরকে ফোন করে। আবির বেশিদূর যায়নি। যখন শুনল শেরওয়ানি রেখে গেছে তখন আবার ব্যাক করতেই হলো। নয়ত আবার যাওয়া লাগবে শপিং এ।

আবির গাড়ি ঘুরিয়ে আবার আসে সেই রাস্তার মাথা অবধি যেখানে তরুকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তরুদের বাসা এখান থেকে কিছুটা ভেতরের দিকে। অত ভিতরে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তই এখানেই অপেক্ষা করতে লাগল। এদিকে আসিফ তো হেটে হেটে আসছে। তার আসতে আসতে একটু দেরী হয়ে গেল।
এর মধ্যে আবির এর ফোনে একটা ফোন আসে। ফোন বের করে দেখে আবির বাবা ফোন দিয়েছে।
তিনি ওপাশ থেকে কিছু একটা বলতেই আবির এপাশ থেকে জবাব দিল

– ওহ কাম অন পাপা। তুমি রিকোয়েস্ট করেছ বলে আমি এতদূর এসেছি। এখনো অবধি ড্রামা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ওই গ্রামের ক্ষেত মেয়েকে বিয়ে ইম্পসিবল। তুমি বলছ বলেই আমি বিয়ের আসর অবধি যাব। তার আগে যদি তুমি বিয়ে ভাঙতে না পার তাহলে আমিই উঠে চলে আসব।

এই কথা শোনা মাত্রই আসিফ এর পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছিল মনে হচ্ছে। আবির এর যখন ফোন বাজছিল তখনই আসিফ সেখানে এসেছিল। কিন্তু আবির ফোন রিসিভ করায় সে আর ডাক দেয় নি আসিফকে। অপেক্ষা করছিল আবির এর কথা শেষ হওয়ার। আবির সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলায় খেয়াল করে নি যে আসিফ এসে ওর পাশে দাড়িয়েছে। ওপাশ থেকে কি বলেছে সেটা শুনতে পায় নি আসিফ।

তবে আবির এর কথা গুলো স্পষ্ট কানে ঢুকেছিল। তার মানে আবির আর আবির এর পুরো পরিবার মিলে নুরুল ইসলাম কাকাকে ঠকাচ্ছে। আবির এর রাগ হয়েছিল নুরুল ইসলাম এর উপর যে তিনি তরুকে বিয়ে দেওয়ার আগে কেন পুরোপুরি খবর নিল না। অবশ্য তাকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। এতদিন এদের কারো আচরনেই বোঝা যায় নি যে তারা কি চায়। তাদের নাটক এতটাই নিখুত ছিল। আসিফ মনে মনে ঠিক করে এই বিয়ে আর একটুও সামনে আগাতে দিবে না। তার আগেই আটকাবে। আসিফ জানালায় টোকা দিয়ে ডাকে

– আবির ভাই আপনার শেরওয়ানি।
আসিফ এর কন্ঠ পেয়ে আবির তাড়াতাড়ি ফোন কান থেকে নামায়। তারপর নরম শুরে বলে
– স্যরি ভাই আপনাকে আবার আমার জন্য কষ্ট করতে হলো। তখন যদি দেখে নিতাম সব তাহলে আর এই ভুলটা হতো না।
– ভুলটা করে ভালোই করেছেন আবির ভাই। নয়ত আমার বোনটার অনেক বড় লস হয়ে যেত। আজ এখান অবধি না আসলে তো জানতেই পারতাম না যে আপনারা প্রতারক, ঠক।

– মুখে লাগাম দেন আসিফ ভাই। মনে রাখবেন তরু আপনার আপন বোন না। আর দুদিন বাধে সে আমার স্ত্রী হবে। আপনি আপনার নাকটা আমাদের মাঝে না গলিয়ে ঠিক জায়গায় রাখেন। আমাদের মাঝে আসতে গেলে সেটা ভালো হবে না৷
– তরু আমার আপন বোন না হলেও কম কিছু নয়। ওর ক্ষতি আমি হতে দিব না৷ আমি এখনি নুরুল ইসলাম কাকাকে সব বলে দিব।

আসিফ আর কথা না বাড়িয়ে পেছন ঘুরে হাটা ধরে। এক মিনিট ও যায় নি তার আগেই মাথায় জোড়ে আঘাত লাগে আসিফ এর। কাপতে কাপতে পেছন ঘুরে দেখে আবির হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। লাঠিটায় বালু মাখা। হয়ত এখান থেকেই কুড়িয়ে নিয়েছে। আসিফ কিছু বলতে পারে না। এর আগেই জ্ঞান হারায়। আঘাতটা জোরেই ছিল।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৪

যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে এই অন্ধকার কুটুরিতে আবিষ্কার করে। তখন কটা বাজে তা জানা নেই আসিফ এর। এই রুমে একটা ঘড়িও নেই। জ্ঞান ফেরার পরে আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হয়। ও শুনেছিল সেটা চুপচাপ নুরুল ইসলাম কাকাকে বললেই হতো। কেন যে বোকামি করে আবিরকে আবার বলতে গিয়েছিল। তবে আসিফ এটাই এখনো বুজতে পারছে না আবির কেন এমন করল।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৬