মধুবালা পর্ব ৫

মধুবালা পর্ব ৫
ফারজানা আক্তার

ছোঁয়াকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে শুভ্র। ছোঁয়া ভয়ে চোখ-মুখ খিঁচে ফেলে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শুভ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলে “তোর মতো মধুমালার সাথে যদি হাজার ছেলেও ঘষাঘষি করে তবুও এই শুভ্র জে’লা’স ফিল করবেনা বুঝেছিস।”
কিছুটা সাহস জুগিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে ছোঁয়া বলে “হাতে ব্যাথা লাগছে খুব। প্লিজ ছেড়ে দাও ভাইয়া।”

শুভ্রর রাগ যেনো সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে। ছোঁয়ার চোখ বেয়ে অনবরত জল ঝরতেছে। ছোঁয়া বসে আছে খাটের কোণে জড়োসড়ো হয়ে আর শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে একহাত কোমরে এবং আরেক হাত দেওয়ালের সাথে চেপে রেখে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে শুভ্র। শুভ্র চাইনি এতোটা রাগ দেখাতে ছোঁয়ার সাথে কিন্তু কিভাবে কি হয়ে গেলো সে বুঝতে পারেনি। আঁড়চোখে ছোঁয়ার দিকে তাকাতেই বুকে যেনো মোচড় দিয়ে উঠলো শুভ্রর। ছোঁয়া হাত ধরে বসে বসে বোবা কান্না কাঁদছে। শুভ্র ঠা’স করে দরজা খুলে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। শুভ্র যেতেই ছোঁয়া দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওর ফ্রেন্ড রকিকে কল দিয়ে বলে “দোস্ত একটা সাহায্য করবি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কি করতে হবে বল শুধু। জানটাও হাজির করে দিবো চাইলে তুই।”
“জান দিতে হবেনা। আমি আমার ফেসবুক রিলেশন দিতে চাই। ”
“তো দে। সমস্যা কি?”
“আমি তোর সাথে ট্যাগ করে রিলেশন স্ট্যাটাস দিতে চাই। প্লিজ না করিসনা।”

রকি মুহুর্তেই হ্যাঁ বলে দিলো কিছু না ভেবে কারণ রকি মনে মনে ছোঁয়াকে ভীষণ পছন্দ করে শুধু বন্ধুত্ব নষ্ট হবে ভেবে কখনো প্রকাশ করেনি সেটা। কিন্তু পর মুহুর্তেই রকির হাস্যজ্জোল মুখে নেমে এলো আমাবস্যা যখন ছোঁয়া বললো এটা ফেক স্ট্যাটাস। তবুও রকি ছোঁয়ার কাছে কিছু প্রকাশ করেনি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কল কেটে দেয়।

ছোঁয়ার ছোট চাচি জায়েদা বেগম একা একা নিজের রুমে বসে আছেন আর ভাবছেন ছোঁয়ার কথা। ছোঁয়াকে দেখলেই কেমন জানি আপন আপন লাগে উনার। বাড়ির অন্যকোনো ছোট সদস্যদের জন্য এমন অনুভূতি হয়নি কখনো যা ছোঁয়ার জন্য হয়।
ছোঁয়ার মা সেলিনা পারভীন জায়েদা বেগমের রুমে প্রবেশ করতে করতে বলে “কড়া করে চা করে এনেছি। বিকালে এই বাড়ি একদম নিস্তব্ধ হয়ে যায় কারণ সবাই ঘুমায় কিন্তু তুমি কখনোও ঘুমাওনা আর আমারও আজ ঘুম উড়ে গেলো কোথাও জানি তাই একটু বিরক্ত করতে আসলাম তোমায়।”

“আরে আপা বিরক্ত করবেন কেনো? আপনি এসে তো ভালোই করেছেন। বিকালের এই সময়টা ভীষণ বি’ষা’ক্ত ভাবে কাটে আমার সবসময়ই একা একা। জানেন আপা আমি এতক্ষণ ছোঁয়ার কথায় ভাবছিলাম।”
“আচ্ছা! কি ভাবছিলে? ”
“ভাবছিলাম আমার একটা ছেলে থাকলে ছোঁয়া মাকে বউ করে আমার কাছেই রেখে দিতাম। জানেন আপা আপনার ছোট দেবর তো আমাকে বলছিলো ছোঁয়াকে কাগজে কলমে আমরা নিয়ে নিলে ভালো হতো। মেয়েটার প্রতি আপনার ছোট দেবরেরও ভীষণ দূর্বলতা আছে আপা। উনি সবসময়ই ছোঁয়ার কথায় মগ্ন থাকেন। রাতেও ঘুমাতে ঘুমাতে ছোঁয়ার নাম জপে মাঝে মাঝে।”

কথাটা শুনতেই আঁধার ছেঁয়ে গেলেন সেলিনা পারভীনের মুখে। বুকের মাঝে যেনো অজানা ভয় এসে হুট করেই বাসা বেঁধেছে। মুখটা মলিন হয়ে এসেছে। অদ্ভুত রকম কষ্ট উঁকি দিয়েছে বুক পাঁজরে।
সেলিনা পারভীনের এমন অবস্থা দেখে জায়েদা বেগম জিজ্ঞেস করলেন “ভাবী আপনার কি শরীর খারাপ করছে?”
“নাহ বোন। বিকালে ঘুমাই তো রোজ আজ হঠাৎ ঘুম না হওয়ায় এমন লাগতেছে। চিন্তা করিওনা রাতে ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চা খেয়ে বলো কেমন হয়েছে। ”

সেলিনা পারভীন খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলেন কথাগুলো। কিন্তু জায়েদা বেগমের কেমন জানি একটুখানি সন্দেহ হলো সেলিনা পারভীনের আচরণে। তবুও দুজনের মনের অস্পষ্ট কথা দু’জনেই আঁড়াল করে হাসাহাসি করে সময়টা পার করে দেন।

খাবার টেবিলে লিলির দৃষ্টি যায় ছোঁয়ার হাতে। হাতটা কেমন জানি নিলচে হয়ে আছে। লিলি জিজ্ঞেস করতেই ছোঁয়া কাচুমাচু করা শুরু করে। শুভ্র বসে আছে গম্ভীর হয়ে। লিলির কথা শুনে সবাই-ই জিজ্ঞেস করে একে একে। জায়েদা বেগম আর সেলিনা পারভীন তো প্রায়ই কান্নাই করে ফেলে। এসব দেখে বেলাল মির্জা আর আনজুমা খাতুন মুখ বাঁকায়। ছোঁয়া কোনোরকম কথা কাটিয়ে দ্রুত খেয়ে রুমে চলে যায়।

ছোঁয়া খাটে আধশোয়া হয়ে শুয়ে ফোন হাতে নিয়ে ডাটা অন করেই ফেসবুকে গিয়ে রিলেশন স্ট্যাটাস দেয়। তারপর কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটি করে বাঁকা হেঁসে ফোন রেখে ঘুমিয়ে যায়।

ছোঁয়ার ছোট চাচা জীবন মির্জা আর জায়েদা বেগম বসে বসে ছোঁয়াকে নিয়ে কথা বলছেন।
জীবন মির্জা একটু গলা খাখারি দিয়ে বলেন “ছোঁয়াকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় আমার। মেয়েটা সবার সাথে থেকেও যেনো ভীষণ একা। চঞ্চল হলেও মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো সে কারো সাথে শেয়ার করেনা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুঁ’ড়ে মেয়েটাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যায়। এক টুকরো প্রকৃত সুখ মেঘ থেকে ছি’নি’য়ে এনে দি মেয়েটার হাতে। কিন্তু আমার হাত যে শী’ক’ল দিয়ে বাঁধা। মেয়েটা যে আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে।”

“হুম ঠিক বলেছো তুমি। ছোঁয়া যদি আমার নিজের মেয়ে হতো তবে সত্যি সত্যিই ওকে নিয়ে হারিয়ে যেতাম দূর অজানাই। এমন পরিবারের ছায়াও ছোঁয়ার উপর পরতে দিতামনা যে পরিবারে এক সদস্যকে একেক চোখে দেখে।”
এভাবে কথা বলতে বলতেই দু’জনে কেঁদে দেয় কিন্তু দু’জনের মনের অবস্থা দুই রকম। এই পরিবারের অনেক কঠিন সত্যি যে জায়েদা বেগমের অজানা এখনো।

মাঝরাতে হঠাৎ ছোঁয়া ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। এক জগ পানি ছোঁয়ার মুখ থেকে সারা শরীরে বৃষ্টির মতো বয়ে গেছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা ছোঁয়া। হালকা হালকা শীত পরছে ইদানীং। এমন গায়ে কাঁ’টা দেওয়ার মতো শীতে এক জগ ঠান্ডা পানিতে ছোঁয়া ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। চোখ উল্টিয়ে সামনে তাকাতেই পুরুষালি অবয়ব কাউকে দেখতে পেয়ে তাকে চিনতে মোটেও ভুল করেনি ছোঁয়া।

ছোঁয়া রাগে দুঃখে ফুঁসতে ফুঁসতে দ্রুত উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখ দিয়ে যেনো আ’গু’ন ঝ’ড়’ছে। ছোঁয়া শুভ্রর চোখ দেখেই যেনো ভয়ে কেঁপে উঠে আবার রাগও হচ্ছে শুভ্রর এমন অ’স’ভ্য’তা’র জন্য। ছোঁয়ার গায়ের নীল টি-শার্ট টা ভিজে লেপ্টে রয়েছে শরীরের সাথে। ছোঁয়ার খুব শীত শীত লাগছে তাই সে কাবার্ড খুলে একটা খয়েরি রঙের টি-শার্ট আর কালো রঙের প্লাজু বের করে ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই শুভ্র ছোঁয়ার হাত টান দিয়ে কাপড়গুলো মেঝেতে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলে “সাহস হলো কি করে তোর অন্য ছেলের সাথে রিলেশনে যাস?

বড্ড বেড়ে গেছিস তুই তাইনা? এই কারণেই ওইদিন ছেলেটা এভাবে তোর হাত ধরেছিলো বুঝতে পারছি সব এবার। আচ্ছা ছেলেটা কি শুধু হাত ধরেছে নাকি রুম ডেটেও গিয়েছিস তোরা? আমি তো একটু ছুঁলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠিস। কোথায় কোথায় টাচ করেছে ছেলেটা বলতো শুনি? নাকি বিয়ের আগেই বাসর সেরে ফেলেছিস?”
শুভ্রর কথা শেষ হতে না হতেই ছোঁয়া গায়ের সব শক্তি দিয়ে থা’প্প’ড় লাগিয়ে দেয় ওকে। গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় শুভ্র। অ’গ্নি দৃষ্টিতে ছোঁয়াকে যেনো সে গিলে খাবে। ছোঁয়া নিজেও ভীষণ অবাক। ক্ষো’ভে’র চো’টে ছোঁয়া নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি আর।

“আপনি খারাপ সেটা জানতাম কিন্তু এতোটা জ’ঘ’ন্য তা জানতাম নাহ। হ্যাঁ আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য পাগল ছিলাম একসময় কিন্তু এখন আপনার প্রতি কিংবা আপনাদের ঘরের বউয়ের খান্দানী বালার প্রতি কোনো লোভ নেই আমার। কিভাবে পারলেন আপনি আমার চরিত্রে এতো বড় দাগ লাগাতে? ছিঃ”

“ওহ্ এখন তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম। ছেলেটাকে খুব আপন করে নিয়েছিস নাহ? কয়দিন হয়েছে এই সম্পর্কের?”
“আপনাকে বলা প্রয়োজন মনে করিনা। কে আপনি হ্যাঁ? ভুলে যাবেননা আপনি আমার জেটাতো ভাই নিজের ভাই নও?”
“ওহ্। ঠিক বলেছিস। এক মাসের মধ্যেই আমি বিয়ে করে দেখিয়ে দিবো তোকে, তুই পারলে আমিও পারি।”

কথাটা বলেই হনহন করে বেলকনি দিয়েই বেড়িয়ে গেলো শুভ্র। ছোঁয়া ধপাস করে বসে পরলো নিচে। শুভ্র যে সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতো খারাপ কথা বলবে ওর চরিত্র নিয়ে তা ছোঁয়ার কল্পনার বাহিরে ছিলো। কিভাবে পারলো শুভ্র এমন বাজে ইঙ্গিতে কথা বলতে? ঘৃ’ণা’য় গা ঘিন ঘিন করছে ছোঁয়ার। শুভ্র চাইলে দরজা দিয়েও যেতে পারতো কিন্তু রা’গে ক্ষো’ভে সে যেখান দিয়ে আসছে সেখান দিয়েই চলে যায়। ছোঁয়া ভাবতে পারছেনা শুভ্র বেলকনির দরজা বারবার কিভাবে খুলে ফেলে।

সব চিন্তা বাদ দিয়ে ছোঁয়া কাপড় চেঞ্জ করে আসে। কিন্তু বিছানা ভিজে যাওয়ায় সে আর বিছানায় না শুইয়ে নিচে বিছানা করে সেখানে গুটিশুটি মে’রে শুয়ে পরে।

মধুবালা পর্ব ৪

শুভ্র রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায় শাওয়ারের নিচে। হঠাৎ কেনো জানি শুভ্রর বুকটা ভীষণ খালি খালি লাগছে। অদ্ভুত রকমের কষ্ট হচ্ছে। শুভ্র বুঝতে পারছেনা হঠাৎ হঠাৎ কি হয়ে যায় ওর। কেনো সে এমন অদ্ভুত আচরণ করে ফেলে ছোঁয়ার সাথে। তবে কি শুভ্র সত্যিই কিছু অনুভব করে ছোঁয়ার জন্য?
এসব ভাবতে ভাবতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে শুভ্র।

মধুবালা পর্ব ৬