মধুবালা পর্ব ৬

মধুবালা পর্ব ৬
ফারজানা আক্তার

শীতল হাওয়া বয়ে চলেছে ছোঁয়ার প্রাণজুড়ে। নিজের রুমে চুপটি মে’রে মন খারাপ করে বসে আছে ছোঁয়া। শুভ্রর এমন অবস্থার জন্য মনে মনে নিজেকেই দায়ি করছে সে। পুরো রুম জোড়ে পায়চারি করছে। দুই হাতকে একটার সাথে আরেকটা মলামলি করছে শুধু। কিছুই ভালো লাগছেনা এই মুহুর্তে ছোঁয়ার। বুকের ভেতর কেমন অজানা ছটপট করছে শুধু। ছোঁয়ার ইচ্ছে করছে এক ছুটে শুভ্রর রুমে ছুটে যেতে কিন্তু আবার ইগো বাঁধা দেয়। শুভ্র যে রাতে ওর চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলছে তা মনে পরে যাচ্ছে ওর। শুভ্র ছোঁয়া দু’জনেরই জেদ সমান সমান। কেউই কারো থেকে কম নয়।

পিটপিট করে চোখ খুলে শুভ্র। পুরো পরিবার শুভ্রর রুমে উপস্থিত শুধু ছোঁয়া ছাড়া কিন্তু শুভ্রর চোখ যে শুধু ছোঁয়াকেই খুঁজে চলেছে। শুভ্রর অশান্ত মনটা যেনো কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। শুভ্রর জ্ঞান ফিরতেই ওর মা নাজমা বেগম ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। মহিলাটার মনটা বড্ড নরম। অল্পতেই উনি ভে’ঙে পরেন। মায়ের এমন আহ্লাদী কান্না দেখে শুভ্র একটু বিরক্ত হয়। কেনো জানি নিজের মায়ের সাথেই শুভ্রর একটা দূরত্ব আছে ছোটবেলা থেকে। জেদ শব্দটা বড্ড ভয়ানক। আর সেই জেদের বসেই শুভ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুব দ্রুতই সে বিয়ে করবে। আর এই জেদের কারণেই হয়তো আপন মায়ের সাথে তার এতোটা দূরত্ব।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রেশার লো হয়ে এবং ঠান্ডা পানিতে প্রায়ই কয়েক ঘন্টা ভিজার কারণেই জ্ঞান হারায় শুভ্র। ডাক্তার বলেছে কিছু একটা নিয়ে ভীষণ চিন্তা করছে শুভ্র অনেকদিন ধরে তাই এমন অবস্থা। সবাই খেয়াল করে শুভ্রর মুখটা মলিন হয়ে আছে, ঠোঁট গুলোও শুকনো, কপালে গোটা গোটা ব্রণ, চোখের নিচে হালকা কালি। ফর্সা চেহারায় এই হালকা কালি যেনো সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

শুভ্রর মা বারংবার জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে কি নিয়ে সে এতো চিন্তা করছে কিন্তু মায়ের কথাকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না শুভ্র। তারপর সবাই সেটা খেয়াল করে একে একে সবাই জিজ্ঞেস করতে থাকে তবুও শুভ্র চুপ থাকে। যখন বেলাল মির্জা একটু উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন তখন শুভ্র গলা খাখারি দিয়ে বলে “বিয়ে করতে চাই আমি।”
সবাই যেনো অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। হা হয়ে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। পিনপতন নীরবতা বয়ে গিয়েছে পুরো রুম জুড়ে।

দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কথাটি শুনে ফেলেছে ছোঁয়া। এক দৌড়ে ছাঁদে চলে যায় সে। পাঁজর ভা’ঙা কষ্টে বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যেনো। ছোঁয়া বুঝে উঠতে পারছেনা শুভ্র বিয়ে করলে ওর কেনো এতো কষ্ট লাগছে। ও তো কখনোই শুভ্রকে ভালোবাসেনি। ওর আকর্ষণ তো ছিলো শুধুমাত্র খান্দানী বালা জোড়া। তবুও কেনো কষ্ট হচ্ছে? হয়তো বালা জোড়া অন্য কারো আয়ত্তে চলে যাবে বলে। কিভাবে সহ্য করবে ওর প্রিয় জিনিস অন্যকারো হাত সাজাবে সেটা। এসব ভাবতে ভাবতেই কান্নার ব্যাগ যেনো বেড়ে যায় ছোঁয়ার।

হঠাৎ কারো হাত ছোঁয়ার কাঁধ স্পর্শ করতেই চমকে উঠে ছোঁয়া। পাশ ফিরে দেখে লিলি দাঁড়িয়ে আছে মুখটা মলিন করে। ছোঁয়া চোখের জল মুছে নিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে লিলিকে বলে “চল কলেজের দেরি হয়ে যাবে। আর ১০দিন পর থেকে পরিক্ষা। ”

কথাটা বলেই ছোঁয়া পা বাড়ায় রুমে যেতে কিন্তু লিলির কথা কর্ণকুহর হতেই যেনো আপনা আপনি ছোঁয়ার পা থেমে যায়।
লিলি খুব স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে “কি হলো বল খুব ভালোবাসিস আমার ভাইয়াটাকে তাইনা?”
ছোঁয়া একটা রহস্যময় হাসি দেয়। তারপর পেঁছন থেকে লিলিকে জড়িয়ে ধরে বলে “এতোটাই দূর্বল নয় যে এই ছোঁয়া কোনো ছেলের জন্য নিজের চোখের জল নষ্ট করবে। আমি কেঁদেছি আম্মু আমাকে একটা কসম দিয়েছে সেটার জন্য। ”

“কসম? কিসের কসম দিয়েছে মেজু চাচিম্মু তোকে?”
“ওই যে তোদের বংশের খান্দানী বালা আমি ছুঁলে যে অপবিত্র হয়ে যায় তাই বালা জোড়া আমি যেনো না ছুঁই আর সেটাই কসম করিয়েছে আম্মু আমায়।”
“এভাবে বলছিস কেনো ছোঁয়া? তুইও তো এই বংশেরই মেয়ে।”
একটু নরম কন্ঠে মন খারাপ করে বলে লিলি।
ছোঁয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে “এই ঘরের কে মনে করে সেটা বল তো? দাদি আর বড় আব্বু তো কখনোই আমাকে সেই অনুভূতি দেয়নি যে আমিও এই বংশের অংশ। জানিস মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয় আমার।”

আজ থেকে ছোঁয়ার পরিক্ষা শুরু। বাকি সব চিন্তা বাদ দিয়ে ছোঁয়া পড়ালেখা নিয়ে প্রচুর ব্যাস্ত হয়ে পরেছে। শুভ্র ছোঁয়ার সামনে বসে থাকলে দাঁড়িয়ে থাকলেও ছোঁয়া চোখ তোলে শুভ্রর দিকে তাকায়না আর এতেই যেনো শুভ্রর বুকটা ছা’র’খা’র হয়ে যায়। একদিন বিকালে ছোঁয়া ছাঁদে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ছিলো তখনই ছাঁদে প্রবেশ করে শুভ্র। শুভ্র প্রায়ই অনেকক্ষণ ছোঁয়ার কাছাকাছি যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ছোঁয়া সামান্য ভ্রুক্ষেপও করেনি। ছোঁয়া এমন ভাব ধরেছিলো যেনো সে শুভ্রর উপস্থিতি মোটেও টের পায়নি। সেদিন সারা রাত শুভ্রর আর ঘুম হয়নি।

আর মাত্র পাঁচ টা আছে ছোঁয়ার পরিক্ষা।
শুভ্রর মামাতো বোনের সাথেই শুভ্রর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই শুভ্রর মামাতো বোন টিয়া শুভ্রকে পছন্দ করতো। টিয়ারও পরিক্ষা চলছে তাই আপাতত শুধু কথাবার্তা বলেই রেখে দিয়েছে। শুভ্রর দাদার বাড়ি চট্টগ্রাম হলেও শুভ্রর নানার বাড়ি ঢাকা তাই পরিক্ষা শেষে টিয়া রা পুরো পরিবার চট্টগ্রামে চলে আসবে এবং টিয়া আর শুভ্রর বিয়ে পর্যন্ত থাকবেন সবাই।

আজ ছোঁয়া খুব তাড়াহুড়ো করে বেরোচ্ছে পরিক্ষার হলে যাওয়ার জন্য। কলেজ গিয়ে ছোঁয়ার কিছু কাজ আছে বলে। তাই সে লিলিকে বলেছে আজ শুভ্রর সাথেই যেতে ওকে। লিলিও আর কিছু বললোনা।
শুভ্র লিলিকে ড্রপ করে দিয়ে গাড়ি সার্ট দিবে তখনই লক্ষ করে কিছুটা দূরে ছোঁয়া রকির সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলছে আবার কিছুক্ষণ পর পর হাসতে হাসতে ছোঁয়া রকির বুকে হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে। এসব দেখেই শুভ্রর ভেতরটা যেনো দু’ম’রে মু’চ’ড়ে যাচ্ছে।

শুভ্র আর সময় নষ্ট না করেই চলে যায় সেখান থেকে। শুভ্র চলে গেলেই ছোঁয়া সেদিকে আঁড়চোখে চেয়ে একটা বাঁকা হাসি দেয়।
লিলি কলেজের সদর দরজায় প্রবেশ করতেই একটা পুরুষালি শরীরের সাথে ধা’ক্কা খেয়ে ধপাশ করে নিচে পরে গেলো কিন্তু ছেলেটা সোজা খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সানগ্লাসটা একটু ঠিক করে ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দেয় লিলির দিকে। লিলি তখনও হা হয়ে অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে।

হঠাৎ কোথায় থেকে ছোঁয়া দৌড়ে এসে লিলিকে নিচে থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে ছেলেটাকে ব’ক’তে শুরু করে দিলো।
“এই যে মিস্টার আপনি কী অন্ধ? চোখে দেখেননা? চোখ তো চারটা লাগিয়ে রেখেছেন তবুও কি চোখের সামনে এতো বড় মানুষটাকে লক্ষ করতে পারেননি?
এখন এভাবে হা হয়ে আছেন কেনো? দেখতে তো একদম ছ্যাঁচড়া লাগতেছে তাও এতো এটিটিউড কিসের হ্যাঁ?
দেখ বেটা ব্যাটখায় চাই রইছে। এই যে আপনি কি বোবা?

কেমনডা লাগে কোনো রেসস্পন্স-ই করেনা। এই লিলি চলতো। সকাল সকাল মেজাজটাই খারাপ করে দিলো।”
এটা বলেই চলে গেলো ছোঁয়া আর লিলি। লিলিকে ছোঁয়া যেনো একপ্রকার টেনে টেনেই নিয়ে গেলো। লিলি তবুও বারংবার পেঁছন ফিরে দেখে গিয়েছে সেই সুদর্শন পুরুষকে যতক্ষণ দৃষ্টির সীমানায় ছিলো। ছোঁয়ার কপালে যেনো বিরক্তির রেখা।
ছোঁয়া লিলি চলে গেছে। আর দেখা যাচ্ছে না তাদেরকে।

আলিফ আহমেদ নামের ছেলেটা যেনো বিরক্ত হলো ওদের চলে যাওয়াতে। আলিফ এতোক্ষণ যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। ছোঁয়ার কথা গুলো ওর কর্ণকুহর হলেও চোখজোড়া আঁটকে গিয়েছিলো সেই রমনির মাঝে যাকে দেখে হৃৎস্পন্দন টা ধুকপুক করে উঠেছিলো কয়েক মুহুর্ত আগে। ঘোর কাটতেই নিজের বোকামির জন্য কিছুটা লজ্জা পাই আলিফ। মুচকি হেঁসে মাথার চুলে হাতে বুলাতে থাকে আলিফ আর মুখে হালকা শব্দে উচ্চারণ করে “অদ্ভুত সুন্দর মেয়ে তুমি। ব্রণ মুখেও বড্ড বেশি মায়াবী লাগছে তোমায়। যদি তুমি আমার হও তবে অন্য কোনো রমনী এই আলিফের দৃষ্টির সীমানাতেও প্রবেশ করবেনা কথা দিলাম। অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে গেলে মায়াবীনি।”

পরিক্ষা শুরু হতে কয়েক মিনিট আছে। লিলি আর ছোঁয়ার সিট একই কক্ষে পরলেও তাদের সিট একটু দূরে দূরে পরেছে। আলিফ ক্লাসে প্রবেশ করতেই ছোঁয়ার চোখ যেনো বড় বড় হয়ে যায়। মুখে বিরক্তি নিয়ে ছোঁয়া এগিয়ে যায় আলিফের দিকে তারপর যা নয় তা বলতে শুরু করে ওকে সাথে রাগে ফুঁসছেও।
ক্লাসের সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। লিলি দৌড়ে যায় ছোঁয়ার দিকে। পুরো ক্লাস যেনো থমকে গেছে।

শুভ্রর কোনো হুঁশ নেই। এলোমেলো ভাবে খুব দ্রুতগতিতে গাড়ি নিয়ে ছুটে চলেছে সে। বারংবার শুভ্রর চোখে ভেসে উঠছে ছোঁয়া আর রকির সেই সুখময় মুহুর্তটা। জলে দু-চোখ ভরে গেলো শুভ্রর। শুভ্র গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো আরো। শুভ্র জানেনা ওর গন্তব্য। এক মনে চলছে গাড়ি।
শুভ্র হয়তো এখনো বুঝতে পারছেনা ছোঁয়া ওর বুকের সবটা জোড়ে মিশে গিয়েছে।

মধুবালা পর্ব ৫

সামনে একটা বড় ট্রাক ধেয়ে আসছে কিন্তু এসব কিছুই শুভ্রর ধ্যানে নাই। শুভ্রর চোখে শুধু ছোঁয়া আর রকির দৃশ্য আনাগোনা করছে। এই দৃশ্যে শুভ্রর কেনো এতোটা খারাপ লাগছে তা এখনো শুভ্র পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। অপরদিকে ট্রাকচালকও ম’দ খেয়ে একেবারে হুঁশহীন। ভাগ্যটাও অদ্ভুত। কার জীবন ঘড়ির টিকটিক শব্দ কবে থেমে যাবে তা কেউই টের পায়না আগে থেকে। ভালোবাসা সত্যিই নিষ্ঠুর। সঠিক সময়ে ভালোবাসার মায়নুষকে খাঁচায় বন্দি না করলে উড়ে যেতে সময় লাগেনা।
চারিদিকে লোকজনের ভীড় জমে গিয়েছে। এম্বুলেন্সও ডাকা হয়ে গেছে।

মধুবালা পর্ব ৭