মধুবালা পর্ব ৭

মধুবালা পর্ব ৭
ফারজানা আক্তার

পুরো রাস্তা র’ক্তে মাখামাখি। কাক ডেকে চলেছে আপন মনে যেনো এক নিঃশ্বাসে। চারপাশে লোকজনের সমাগম। ট্রাকের চাপে শুভ্রর গাড়ি পুরো তেঁ’ত’লা হয়ে গিয়েছে। ট্রাকও উল্টে পরে রয়েছে। শুভ্রকে আর ট্রাক চালককে আলাদা আলাদা এম্বুলেন্সে তোলা হলো। এম্বুলেন্স চলছে খুব দ্রুত গতিতে। শুভ্র আর ট্রাক চালক দু’জনের অবস্থায়ই ভীষণ খারাপ।

হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দু’জনকে একসাথে ICU তে ঢুকানো হলো। ততক্ষণে বেলাল মির্জা নাজমা বেগম মান্নান মির্জা হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছে। নাজমা বেগম তো হাসপাতালে এসে ছেলের এহেন অবস্থা দেখে দু’বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। চিকিৎসা চলতেছে শুভ্র আর ট্রাক চালকের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরে মহা মুসকিল তো। আপনি আমাদের পিঁছু নিতে নিতে এখান অব্ধি চলে এসেছেন। বলতে হবে খুব সাংঘাতিক লোক আপনি কিন্তু আমিও ছোঁয়া মির্জা আমার সাথে লাগলে হার নিশ্চিত। এখনই পরিক্ষা শুরু হবে, যান বলছি এখান থেকে। স্যার এসে পরবে।”

ছোঁয়া খুব ভাব নিয়ে কথাগুলো বলছে। আলিফের মুখে মুচকি হাসি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে আর তা দেখে ছোঁয়ার গা জ্ব’লে যাচ্ছে। লিলি ছোঁয়ার হাত একটু চেপে ধরে চোখ রাঙ্গায়, ছোঁয়া পাত্তা না দিয়ে সেদিকে জিহ্ব দিয়ে ভেং’চি কেটে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। লিলি মুখে লজ্জা এনে আলিফের দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি কণ্ঠে বলে “ছোঁয়ার পক্ষ থেকে আমি সরি বলছি ভাইয়া। প্লিজ কিছু মনে করবেননা। আসলে সকালে আমারই ভুল ছিলো, আমি যদি একটু সাবধানে চলাফেরা করতাম তবে ওভাবে ধা’ক্কা লেগে পরে যেতাম না আর ছোঁয়াও আপনাকে দো’ষা’রো’প করতে পারতোনা। যাইহোক আমার বোনের পক্ষ থেকে আমিই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।”

আলিফ এখনো তার মায়াবীনির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লিলি লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। লিলির যে সাহস হচ্ছে না আর আলিফের দিকে তাকিয়ে থাকার। প্রথম দেখাই লিলির আলিফকে ভালো লাগতে শুরু করে। আর আলিফও তার মায়াবীনির মায়ায় আঁটকে পরেছে।

ছোঁয়া একহাতে লিলির বাহু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে
“তোর এতো আদিখ্যেতা দেখে সত্যিই গা জ্ব’লে যাচ্ছে আমার। দোষ এই মিস্টারের ছিলো তুই কেনো সরি বলবি? এই বোবা তো সরি বলা দূরের কথা একটা কথাও বের করেনি মুখ থেকে এখনো পর্যন্ত। চল আমরা নিজের জায়গায় গিয়ে বসি স্যার এখনই চলে আসবেন।”

ছোঁয়া কথাটা বলে নিজের সিটে যাওয়ার জন্য পেঁছন ঘুরে পা বাড়াতেই একজন পিওন এসে আলিফকে বলে “আলিফ স্যার নিন আপনার কক্ষের সব আসবাবপত্র। ”
এই কথা বলেই সব টেবিলের উপর রেখে চলে যান পিওন। আলিফের দিকে ফিরে ছোঁয়া আর লিলি ভয়ে একটা ঢুক গিলে। আলিফ ওদের অবস্থা বুঝতে পেরে চাপা হেঁসে কঠিন স্বরে বলে “সবাই নিজের সিটে গিয়ে বসো। সময় হয়ে এসেছে, শুরু হবে এখন পরিক্ষা।”

ছোঁয়া ভ্যাঁবাছ্যাঁকা খেয়ে যায়। বোকার মতো গিয়ে নিজের সিটে বসে যায় ছোঁয়া। হঠাৎ ছোঁয়ার মনে কেমন জানি অদ্ভুত রকমের অনুভূতি শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে বারংবার শুভ্র ভালো নেই কিন্তু পরিক্ষার প্রশ্ন হাতে নিয়েই সব ভাবনা ঝে’ড়ে ফেলে দেয় ছোঁয়া।

বিকালে বাড়ি ফিরতেই ছোঁয়ার কর্ণকুহর হয় শুভ্রর এ’ক্সি’ডে’ন্টে’র কথা। ছোঁয়ার মনে হচ্ছে ও যেনো কানে ভুল শুনেছে তাই সানিয়ার দুই বাহু ধরে ওকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বারংবার জিজ্ঞেস করে কিন্তু সানিয়া বারবার একই কথা বলাই ছোঁয়া শব্দ করে কেঁদে ফেলে সানিয়াকে জড়িয়ে ধরে। সানিয়া ছোঁয়ার বোন সোহার সাথে একই ক্লাসে পড়ে।

দশম শ্রেণিতে সাইন্স নিয়ে পড়ছে দুজন। সানিয়া বেশ বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে, সে অনেক কৌশলে ছোঁয়াকে বুঝানোর চেষ্টা করতেছে কিন্তু তবুও সে ব্যার্থ হলো। সোহা এসে ছোঁয়াকে এভাবে কাঁদতে দেখে সেও জড়িয়ে ধরলো ছোঁয়াকে। সানিয়া কিছুটা মুখ ভার করে চলে গেলো সেখান থেকে। তারও বুকটা খাঁ খাঁ করছে বেশ শুভ্রর এহেন অবস্থার জন্য। সানিয়ার টিনএজার বয়সের একমাত্র ক্রাশ শুভ্র কিন্তু এটা সানিয়া আর সানিয়ার অন্তর ছাড়া আর কেউই জানেনা কারণ সানিয়া খুব গম্ভীর একটা মেয়ে। সে কখনো মনের গোপনীয় কথা কারো সাথে শেয়ার করেনা।

সোহা নিজেকে সামলিয়ে ছোঁয়াকে খাটে বসিয়ে বললো “আপু তুই একটু শান্ত হ প্লীজ। শুভ্র ভাইয়ের কিছুই হবেনা দেখিস। চিকিৎসা তো চলছে, তুই বরং কান্না না করে দোয়া কর ভাইয়ার জন্য। ”

এইটুকু কথা বলেই সোহা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে থাকে। ছোঁয়া চোখের জল মুছে ওয়াশরুমে চলে যায়। উদ্দেশ্য ওজু করে নামাজ পড়বে। ছোঁয়া মোটেও দূর্বল নয়, সে যথেষ্ট স্ট্রং মেয়ে শুধু পরিবারের অন্যায়গুলো মুখ বুঝে সহ্য করে নেয় যার অর্থ সে নিজেই বুঝেনা। হয়তো পরিবারকে একটু বেশি ভালোবাসে বলে প্রতিবাদ করতে পারেনা। সোহা একটা ঢুক গিলে নিজের রুমে চলে যায়।
ছোঁয়া নামাজে বসে মলিন মুখে মাগরিবের নামাজ শেষ করে আবার ৮ রাকাআত নফল নামায পড়ে নেয় শুভ্রর সুস্থতার জন্য।

“হে আল্লাহ আমি জানিনা আমার কেনো এতো খারাপ লাগছে শুভ্র ভাইয়ার জন্য, তবে আমার মনে হচ্ছে যেনো আমার নিঃশ্বাস গুলো আঁটকে আঁটকে যাচ্ছে। বুকটা শূন্য শূন্য লাগছে হুট করে। হৃদপিণ্ড টা ছা’র’খা’র হয়ে যাচ্ছে। হে আল্লাহ তুমি আমার এই অশান্ত মনটাকে শান্ত করে দাও, সুস্থ করে দাও আমার শুভ্র ভাইয়াকে। আমি পারছিনা আর, আল্লাহ রহম করো।”
মোনাজাতে কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে শব্দ করে কেঁদে ফেলে ছোঁয়া।

আলিফ আহমেদ নিজের রুমে বসে আছে। চোখজোড়া জানালা বেদ করে কাঁচা রাস্তার দিকে। এই রাস্তা দিয়ে কতশত মানুষের চলাফেরা। এতো মানুষের মধ্যেও আলিফের দৃষ্টি খোঁজে চলেছে তার মায়াবীনিকে। কিছুই যেনো আর ভালো লাগছেনা তার।

মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আলিফ। তাদের একটা তিন রুমের ঘর আছে, আর ছোঁয়া লিলির বাসা রাজপ্রাসাদের থেকে কম যায়না। এটা মনে হতেই সব ভাবনা মাথা থেকে ঝে’ড়ে ফেলে সে। ওদের দুজন’কে দেখার পর থেকে আলিফের খুব বেশি ভালো লেগে যায় তার মায়াবীনিকে আর তাই সে মুহুর্তেই সব খোঁজ খবর নিয়ে ফেলে তার একটা বন্ধুকে দিয়ে। আলিফের পরিবারে ওর মা আর এক বোন ছাড়া আর কেউ নেই।

আলিফের ছোট বোনের জন্মের দশ বছর পরেই ওদের বাবা মারা যায় আর তারপর থেকেই আলিফ পড়ালেখার সাথে সাথে এই সংসারটাকেও আগলে রেখেছে খুব যত্নে। আলিফের বোন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। আলিফের কাঁধে এখনো অনেক দায়িত্ব এটা মনে পরতেই সে তার হৃদ স্পন্দনের ধুকপুক বন্ধ করার জন্য ছটপট করতে থাকে।
“কেনো মায়াবীনি এভাবে তুমি সামনে আসলে আমার? কেনো করে দিলে সবটা এলোমেলো? আমি যে নিস্ব হবো তুমিহীনা। কেনো এতোটা মায়া তোমার মুখশ্রী জুড়ে? মনটা যে বড্ড অবাধ্য।”

লিলি ভাইয়ের দূর্ঘটনার কথা শোনার পর পরই দ্রুত হাসাপাতালে চলে যায়। বড্ড বেশি ভালোবাসে কিনা ভাইকে। আপাতত অন্য সব কিছু লিলির ভাবনার বাইরে। বেলাল মির্জা নাজমা বেগম আর লিলি ICU এর বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মনটাই অশান্ত হয়ে আছে ভীষণ। মান্নান মির্জা একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিরবে চোখের জল বি’স’র্জন দিচ্ছে। উনার যে সাহস হচ্ছে না ভাই ভাবি আর ভাতিজীকে সান্তনা দেওয়ার। উনি নিজেই ভেতর থেকে ভে’ঙে পড়েছেন খুব।
ছোঁয়া আর নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখতে পারছেনা। এলোমেলো চুলে সে তার মায়ের কাছে ছুটে যায়। আনজুমা খাতুনের রুমের সামনে দিয়ে যেতেই ছোঁয়া খেয়াল করে তার দাদি শব্দ করে কাঁদছেন আর আল্লাহকে ডাকছেন। ছোঁয়ার বুকটা যেনো মোচড় দিয়ে উঠে।

সেলিনা পারভীন আর জায়েদা বেগম হলরুমে বসে ছিলেন সোফায়। ছোঁয়া দৌড়ে গিয়ে ওর মায়ের কোলে ঢলে পরে বলেন “আম্মু আমি হাসপাতালে যাবো প্লিজ আমাকে না করো না তোমরা। আমি আর স্থির হয়ে এখানে বসে থাকতে পারছিনা। বড় আব্বু যা বলে মুখ বুঁজে সইয়ে নিবো, কিছুই বলবোনা তবুও একটু শুভ্র ভাইকে দেখার তৃষ্ণা টা মিটাতে চাই আমি। আম্মু একটু বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ। আমি মানছি শুভ্র ভাই আর আমার সম্পর্ক টা একটু অন্যরকম কিন্তু বিশ্বাস করো আমি কখনোই শুভ্র ভাইয়ার কোনো ক্ষতি চাইনি।”

মেয়ের এমন আহাজারিতে জায়েদা বেগম আর সেলিনা পারভীন হু হু করে কেঁদে দিলেন। তারপর সেলিনা পারভীন অনেক কষ্টে ছোঁয়াকে বুঝিয়ে লিলিকে কল দেয় কথা বলার জন্য।
লিলি কল রিসিভ করেই চাপা কান্নায় ভে’ঙে পরেন। লিলি কাঁদছে এটা বুঝতে পেরেই ছোয়ার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। ছোঁয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে “শুভ্র ভাই কেমন.. কেমন আছে লিলি?”
“ভালো নেই আমার ভাইটা ছোঁয়া।

তুই জানিস ডাক্তার কি বলেছে? ডাক্তার বলেছে ভাইয়ার অবস্থা খুব সিরিয়াস। অন্য হাসপাতাল থেকে বড় ডাক্তার আনা হয়েছে। ট্রাক চালকের অবস্থা মোটামুটি বলেছেন কিন্তু ভাইয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। ডাক্তার আরো বলেছেন ভাইয়া আর ট্রাক চালক যে কোনো একজনের মৃত্যু নিশ্চিত কারণ তারা নাকি নেশা জাতীয় দ্রব্য পান করে ড্রাইভ করছিলো।
ছোঁয়া এই ছোঁয়া আমার ভাই টা বাঁচবে তো?”

মধুবালা পর্ব ৬

ভুলত্রুটি মার্জনীয়। মনমানসিকতা একদমই ভালো নেই, পর্বটা ভীষণ এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। গতকাল এক আত্মীয় মারা যাওয়ায় গল্প দেওয়া সম্ভব হয়নি আশা করি সবাই বুঝবে আমার দিকটা। আর আগামীকাল আমার মৃত আম্মু আব্বুর জন্য খতম পড়ানো হবে তাই একটু বেশিই বিজি থাকবো সো গল্প আগামীকালও দেওয়া হবেনা।
বাসায় মেহমান আছে তাই এই কয়েকটা দিন হয়তো অনিয়মিত হবো হয়তো তবুও সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো গল্প দেওয়ার আমি নিজের দিক থেকে। আশা করি সবাই বুঝবে, তবুও যদি কেউ অবুঝ থাকে তাহলে আর কিছু বলার নেই আমার।

মধুবালা পর্ব ৮