মধুবালা পর্ব ৮

মধুবালা পর্ব ৮
ফারজানা আক্তার

অতিরিক্ত নে’শা পান করার কারণে ট্রাক চালকের ক্ষতি বেশি হয়েছে তাই শুভ্র কোনোমতে বেঁচে গেলেও ট্রাক চালককে বাঁচাতে পারেননি ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেও। পরিক্ষা করে জানা গেছে ট্রাক চালক প্রায়ই অনেক বছর ধরে নেশা করতে করতে ভেতরে ক্যান্চার হওয়ার ভাব চলে আসছিলো।

ট্রাক চালকের বউ আর পাঁচ বছরের বাচ্চাটার কান্নায় লিলিও কেঁদে ফেলে তবুও কিছুটা স্বার্থপর হয়ে চলে গেলো সেই ক্যাবিনে যেখানে শুভ্র কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুভ্রর মা তো এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। লিলি বাসায় কল করে বলে শুভ্রর অপারেশন সাকসেস, শুভ্রকে ক্যাবিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খবরটা শোনা মাত্রই ছোঁয়া আবারো নামাজে দাঁড়িয়ে যায়, এবারের কান্নাটা সুখের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাত এখন ১০টা ছুঁই ছুঁই। ছোঁয়া বসে আছে নামাজ শেষ করে। মনটা বেশি ভালো না হলেও মোটামুটি ভালো হয়েছে এই মুহুর্তে। ছোঁয়ার ভীষণ ইচ্ছে করছে শুভ্রকে দু-চোখ ভরে একবার দেখতে কিন্তু তা তো সম্ভব না। ছোঁয়ার যে হাসপাতালে যাওয়ার অধিকার নেই। বেলাল মির্জা না চাইলে ছোঁয়া কখনোই হাসপাতালে যাওয়ার সাহস পাবেনা। কিন্তু শুভ্রকে দেখার যে তৃষ্ণা খুব। তবে কি ছোঁয়া ভালোবেসে ফেলেছি শুভ্রকে? নিজের মনের কাছে নিজেই বারংবার প্রশ্ন করে বসে ছোঁয়া কিন্তু উত্তর পায়না কখনো। এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ছোঁয়া বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

শুভ্রর জ্ঞান ফিরতেই সে দেখতে পেলো নাজমা বেগম বেলাল মির্জা সোফায় বসে আছে আর লিলি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র চোখ বুলিয়ে পুরো রুম একবার পর্যবেক্ষণ করে নিলো কিন্তু যাকে খুঁজলো তাকে পেলোনা দৃষ্টির সীমানায়। বুকটা ভার হয়ে আসলো শুভ্রর। ইচ্ছে করছে চোখ দুটো আবারও বুঁজে নিতে, তাও চিরকালের জন্য।

ভালোবাসার মানুষের পাশে যে অন্যকাউকে সহ্য করা ভীষণ য’ন্ত্র’ণা’র। খুব নীরবেই শুভ্রর চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে। শরীরটা যেনো হালকা কাঁপছে। শুভ্রর মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছে, হাত পায়েও বেশ লেগেছে। সুস্থ হতে একমাস কিংবা তার বেশিও সময় লাগতে পারে বলে ডাক্তার জানিয়েছেন।
লিলি শুভ্রর দিকে তাকাতেই ওর জ্ঞান ফিরেছে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে দেয় এক চিৎকার। বেলাল মির্জা আর নাজমা বেগমও ছুটে আসেন শুভ্রর কাছে।

এমন মুহুর্তেও নাজমা বেগমের কষ্টসব ন্যাকামি মনে হচ্ছে শুভ্রর। খুব ধীরে একটু সময় নিয়ে শুভ্র লিলিকে বলে মা যেনো এখনই চলে যায় এখান থেকে নয়তো সে নিজেকে কষ্ট দিবে আরো। যেনো অসহায় হয়ে যায় এসব শুনে নাজমা বেগম। তবুও ছেলের ভালোর জন্য নীরবে বেরিয়ে যান ক্যাবিন থেকে। বেলাল মির্জা মান্নান মির্জাকে কল দেয়, উনি একটু কাজে নিচে গিয়েছিলেন। মান্নান মির্জা এসে শুভ্র কে একটুখানি দেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় নাজমা বেগমকে সাথে নিয়ে।

গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। চোখের জল যেনো বাঁধা মানছেননা নাজমা বেগমের।
“ভাবি আর কত কাঁদবেন? অসুস্থ হয়ে যাবেন যে। আমাদের শুভ্র সম্পূর্ণ সুস্থ আছে এখন। চিন্তার কোনো কারণ নেই আর।”

“মান্নান ভাই আমার ছেলেটা কি কখনোই স্বাভাবিক হবেনা আর আমার সাথে? ওর সাথে কি খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছিলাম আমি? আমি তো ওর ভালোই চেয়েছিলাম কিন্তু ওর ভালো চাওয়া টা যে এতোটা ভ’য়ং’ক’র হয়ে উঠবে তা তো জানা ছিলোনা আমার।”
কথাগুলো বলেই আরো বেশিই কান্না করতে থাকেন নাজমা বেগম। মান্নান মির্জা চুপ হয়ে আছে মলিন মুখ করে। নাজমা বেগমকে সান্তনা দেওয়ার যে ভাষা উনার কাছে নেই। মায়ের মন খুবই দূর্বল যে।

পরেরদিন সেলিনা পারভীন হাসপাতালে এসে লিলিকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আগামীকাল আবার পরিক্ষা আছে লিলির তাই। বড় মাকে দেখে শুভ্র যেনো স্বস্তি পেলো কিছুটা। যদি সেলিনা পারভীন না এসে নাজমা বেগম আসতেন তবে দম বন্ধ হয়ে আসতো শুভ্রর।

লিলি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ছোঁয়ার কাছে যায়। ছোঁয়া পড়ার টেবিলে বসে আছে মনমরা হয়ে। কিছুই পড়তে পারছেনা ছোঁয়া। মনটা বারবার বলছে এক নজর শুভ্রকে দেখবো। মনের সাথে যুদ্ধ করে ছোঁয়া চোখ-মুখ খিঁচে বসে আছে বই সামনে নিয়ে। ভালোবাসার মানুষকে দেখার তৃষ্ণাটাই অন্যরকম হয় যা হয়তো ছোঁয়া বুঝতে পারছেনা এখনো।

পেঁছন থেকে লিলি এসে জড়িয়ে ধরতেই হঠাৎ ভরকে যায় ছোঁয়া। লিলিকে দেখেই সব লজ্জা-শরম ভুলে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে শুভ্রর কথা।
লিলি কিছুটা মুচকি হেঁসে বলে “নিজেই দেখে নাও নিজের প্রিয়তমকে।”
কথাটা বলতে বলতেই লিলি ওর ফোনটা এগিয়ে দেয় ছোঁয়ার দিকে।

শুভ্রর অনেক গুলো ছবি+ভিডিও করেছে লিলি। কিছুতে শুভ্র ঘুমন্ত আর কিছুতে জাগ্রত।
ছোঁয়া ছবি ভিডিও গুলো দেখে দেখে অশ্রু চোখেই মৃদু হাসছে। লিলি মুগ্ধ নয়নে দেখছে ছোঁয়াকে। খানিকপর হালকা কেঁশে লিলি বললো “তবুও কি বলবি তুই আমার ভাইকে ভালোবাসিস না?”
কথাটা ছোঁয়ার কর্ণকুহর হতেই ছোঁয়া লিলিকে ফোনটা দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। লিলি মুচকি হাসে।

দেখতে দেখতেই কেটে গেলো দুই সপ্তাহ। শুভ্র আজ হাসাপাতাল থেকে ফিরছে। শুভ্রকে আবারো নতুন গাড়ি করে বাসায় আনা হচ্ছে। বেলাল মির্জা ছেলের জন্য আবারো নতুন গাড়ি কিনেছে একটা। কথায় বলে টাকা থাকলে খরচ করতে গায়ে লাগেনা এমনই বেলাল মির্জা।

শুভ্র চুপচাপ বসে প্রকৃতি দেখছে। মনটা ভীষণ চটপট করছে ছোঁয়াকে একটা নজর দেখার জন্য। হাসপাতালে সবাই গেছে শুভ্রকে দেখতে শুধুমাত্র ছোঁয়া ছাড়া। যদিও ছোঁয়াকে লিলি ভিডিও কলে দেখিয়েছে শুভ্রকে কয়েকবার কিন্তু শুভ্রর কাছে সব অজানা।

লিলি বলতে চাইলেও ছোঁয়া প্রমিজ নিয়েছে লিলির থেকে এই কথা যেনো কেউ না জানে। শুভ্রর হবু স্ত্রী টিয়াও গেছে কয়েকবার। পরিক্ষা শেষ হতেই টিয়ারা সবাই চলে এসেছে চট্টগ্রাম। আজকেও টিয়া আনতে গিয়েছে শুভ্রকে। ছোঁয়ার উপড় বেশ রাগ আর অভিমান জমে গিয়েছে শুভ্রর। টিয়া ঢাকা থেকে আসতে পারলে ছোঁয়া কেনো যেতে পারেনি এই একটাই প্রশ্ন শুভ্রর হৃদয়ে আঁ’চ’ড় কাঁটছে। এই মুহুর্তে টিয়া ওর পাশের সিটে বসে থাকলেও ভাবনাতে শুধু ছোঁয়ার আসা-যাওয়া।

গাড়ি এসে থামলো মির্জা বাড়ির সামনে। গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করতেই সবাই এসে ঘরের সদর দরজায় ভীড় করে ফেলেছে। টিয়া গাড়ি থেকে নেমে শুভ্রর হাত ধরে ওকে গাড়ি থেকে নামায়। সবার মুখে চিকচিক করছে খুশি। শুভ্র সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কারণ সবাই উপস্থিত থাকলেও ছোঁয়া যে নেই উপস্থিত।
অথচ শুভ্র জানেইনা যে ছোঁয়া ছাঁদ থেকে দেখছে ওকে।

এভাবে কেটে গেলো আরো কয়েকটা দিন। শুভ্র কিছু কিছু সুস্থ হয়েছে এখন। তবে এখনো একটু একটু কুঁড়িয়ে হাটে।
এতোদিন হয়ে গেলেও ছোঁয়া এখনো শুভ্রর রুমে আসেনি। শুভ্র আর থাকতে পারলোনা এবার।
ছোঁয়া গোসল করছে। এই ফাঁকে শুভ্র ছোঁয়ার রুমে এসে ওর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। শুভ্রর কানে পানির শব্দ ভেসে আসছে। এতেই যেনো কেমন শান্তি শান্তি লাগছে শুভ্রর।

টিয়া মাঝে মাঝে খুব ঘনিষ্ঠ হতে চাই শুভ্রর সাথে কিন্তু শুভ্র বারবার এড়িয়ে যায় এতে টিয়ার বেশ রাগ হয় তবুও টিয়া নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছে সুন্দরভাবে বিয়েটা হয়ে যাওয়ার জন্য। কথা হয়েছে শুভ্র সম্পূর্ণ সুস্থ হলেই টিয়া আর শুভ্রর বিয়ের কথাবার্তা হবে কিন্তু এতোদিন অপেক্ষা করতে পারছেনা টিয়া।

টিয়া ঢাকা শহরের মেয়ে। খুব টাইটপিট জামা পরিধান করে টিয়া যা শুভ্রর ভীষণ অপছন্দ। টিয়া চট্টগ্রাম আসার পর থেকে টপস জিন্স পরা বাদ দিলেও সেলোয়ার-কামিজের সাথে ওড়না রাখেনা গায়ে এতেই শুভ্রর রাগ হয় কিন্তু সে কিছুই প্রকাশ করেনা শুধু কয়েকবার বলেছে যেনো ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নেয় বাসায় বড় রা আছে।

টিয়া কখনোই শুভ্রর এই কথায় পাত্তা দেয়নি তাই শুভ্রও নিজের মতোই থাকে, টিয়াকে নিজের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেয়না তেমন।
ছোঁয়া গোসল সেরে একটা কালো টি-শার্ট আর প্লাজু পরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আয়নার সামনে গিয়ে চুল মুছাই ব্যাস্ত। শুভ্রকে খেয়াল করেনি ছোঁয়া। গুন গুন করে গানও ধরেছে চুল মুছতে মুছতে।

“তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে
আমায় ভীষণ পীঁড়া দিচ্ছে
বলো কবে ছুঁতে দিবে…..”
“এখন এই মুহুর্তে”

ছোঁয়াকে আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে না দিয়ে শুভ্র ছোঁয়ার পেঁছনে এসে বলে কথাটি। ছোঁয়া চমকে যায় হঠাৎ শুভ্রর কন্ঠ শোনে। দ্রুত চুল মোছার টাওয়াল টা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয় ছোয়া কোনোমতে। এই কয়দিনে দুজন একবারও মুখোমুখি হয়নি। শুভ্রও তেমন রুম থেকে বের হয়নি। আয়নায় নিজের পেঁছনে শুভ্রকে দেখে চোখজোড়া জলে ভিজে উঠেছে ছোঁয়ার। কান্নাটা গলায় আঁটকে দিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে ছোঁয়া বলে উঠে “শুভ্র ভাই আপনি এখানে?”

“কেউ তো আর আমায় দেখতে যাবেনা তাই আমিই আসলাম। আমার তো আর কারো মতো এতো জেদ নেই।”
“জেদ না থাকলে এ’ক্সি’ডে’ন্ট টা কেনো হলো?”
“তা তো হওয়ার ছিলো তাই হয়েছে।”
“জানা আছে আমার।
আচ্ছা এবার নিজের রুমে যান। আমি চেঞ্জ করবো।”
“তো কর। আমি কি জড়িয়ে ধরে রেখেছি তোকে?”
“টিয়া আপু তুমি?”

মধুবালা পর্ব ৭

ছোঁয়া কথাটা বলতেই পিঁছু ফিরে তাকায় শুভ্র। শুভ্র দেখে ওর পেঁছনে কেউ নেই। ছোঁয়া যে ওকে বোকা বানিয়েছে এটা বুঝতে পেরে বেশ রেগে যায় শুভ্র। রাগি চক্ষুতে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে যায় শুভ্র। একটা শুকনো ঢুক গিলে ছোঁয়া বলে “নিজের পায়ে নিজেই কু’ড়া’ল মারলি তুই ছোঁয়া।”

মধুবালা পর্ব ৯