মনের কোণে পর্ব ২৬

মনের কোণে পর্ব ২৬
আফনান লারা

সকালে মর্জিনার ডাকে উঠেছিল লিখি আর নাবিল।সে বলছিল তারা দুজন ঘর থেকে বের হবে এখন,কাজে যেতে হবে তাদের।ওরা যদি থাকতে চায় তবে চাবিটা রেখে দিতে।
নাবিল শুরুতেই বলে দিলো তারা চলে যাবে,আর থাকবেনা।মর্জিনা আর রাকিবের সাথে তাই ওরা দুজনও বেরিয়েছে।বুকের ভেতর হাজার ভয়।ওসমান তো নিশ্চয় এখনও দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।

কিন্তু বাইরের পরিস্থিতি ঠিক সেরকম হয়ে আছে যেরকম লিখি বুঝিয়েছিল মিসেস সামিয়াকে।তিনি কথামতো জনাব অনাবিলকে কথা জানিয়ে দু গ্রুপে ভে*জা’ল লাগিয়ে দিয়েছেন সেটাই দেখছে ওরা দাঁড়িয়ে থেকে।
নাবিল অপেক্ষা না করে লিখির হাত ধরে ঐ জায়গা দিয়ে পাশ কাটিয়ে কলোনীতে ঢুকে গেছে।মামার বাসায় ভুলেও ঢোকা যাবেনা,ওখানে বাবা থাকতে পারে।সকাল থেকে মা তো একবার কলও দেয়নি তারমানে বি’পদ আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তাই দুজনে সোজা ভাঁড়া নেওয়া বাসায় এসে উঠেছে।দুজনে দুরুমে ঢুকে সবার আগে ফ্রেশ হয়ে একসাথে এসে বসলো ফ্লোরে।আসবাব না থাকলেও এটা নিজের বাসা মনে করে আরাম লাগছে,অন্য মানুষের বাসায় সেই আরাম পাওয়া যায়না।
নাবিল ভাবছে অন্য কিছু।মায়ের সাথে একবার হলেও কথা বলা জরুরি।ঐদিকের কি হাল তা জানতে হবে কিন্তু সমস্যা হলো যদি ফোনটা বাবা ধরে??
সকাল নয়টা বাজে তখন।মাকে ফোন না করে নাবিল আর থাকতে পারছেনা, শেষে বুদ্ধি করে বাবুকে কল করলো।কিন্তু তার ফোন সুইচড্ অফ,চিন্তা এবার হাজারখানেক বেড়ে গেলো।
“একবার গিয়ে দেখে আসবো??”
লিখি তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আপনার বাবা তো আমাকে চেনেননা,আমি বরং মামার বাসা ঘুরে আসি’

‘ওসমান যদি বাই চান্স ওখানে চলে আসে?তুমি কোথাও যাবেনা।বসে থাকো।’
দুজনে আবারও গাপটি মে*রে বসে রইলো।পেটে সকালের খিধে আর মাথায় শতে শতে চিন্তা।কিরকম পরিস্থিতি ওখানে আর এখানে বইছে।কবে সব ঠিক হবে!!
সকাল দশটা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগে মিসেস সামিয়ার কল আসলো নাবিলের নাম্বারে।তার সন্দেহ হলো বলে লিখিকে রিসিভ করতে ওর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে সে।লিখি ভয়ে ভয়ে রিসিভ করে হ্যালো বললো।ওপার থেকে মিসেস সামিয়া বললেন,’নাবিল কোথায়?ওর বাবাকে সেসব বলেছি লিখি!! তুমি যা যা বলতে বলেছিলে।সেরকম ঘটনা ঘটছে আপাতত, উনি গেটের বাইরে।চোখ বড় বড় করে দেখছেন কোথাও নাবিল আছে কিনা।তোমরা ভুলেও বাসা থেকে বের হবানা,আর এখানেও আসবেনা।উনি কয়েকবার এখানে এসেও ঘুরে গেছেন’

লিখি হাঁপ ছেড়ে কলটা কাটলো।এবার সমস্যা হলো খাবার পাবে কই।নাবিল তখন দুষ্টুমি করে বললো,’চিকনি চামেলীকে বলবো নাকি খাবার দিয়ে যেতে?’
‘যান।আর জীবনে ঘরে ঢুকতে দিবো না।ভেবে চিন্তে বাইরে পা রাখবেন’
ওর কথা শুনে নাবিলের পেট ফাটা হাসি আসলো, হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে।লিখি গাল ফুলিয়ে ওর হাসি দেখছে।নাবিলের হাসির রহস্য তার অজানা।শেষে হাসিটাকে থামিয়ে সে লিখির অজানাকে জানাতে রুপান্তরিত করেছে।বলে,’তুমি কি জে’লা’স হও??সেজন্য তোমার এত আয়োজন?’

‘কিসের আয়োজন?’
‘এই যে ঘরে ঢুকতে দেবেনা’
‘কোন বউ জামাইর চরিত্র এমন জেনে ঢুকতে দেবে?’
‘অবশ্যই দেবে’
‘আমি দেবোনা।যান তো আপনি!মেজাজ খারাপ করবেননা’
ধ’মক দিয়ে গালটা তালের মতন ফুলিয়ে অন্য রুমে চলে গেছে লিখি।এই তো বেশ ভাল ছিল কিছুক্ষণ আগে অথচ থার্ড পারসন ঢুকে যাওয়ায় আবার সে রেগে গেছে।তাকে রাগানোর একটাই পন্থা,ঐ চিকনি চামেলী।
লিখিকে রাগাতে তার ভীষণ ভাল লাগে,কিন্তু সে বোঝেনা এটা শুধু মজা করার জন্য বলে নাবিল।সে বোঝে উল্টো।

‘ফাঁকা রুমে কতকাল একা বসে থাকা যায়?তাও শীতল মেঝেতে?
কেমন অদ্ভুত একটা সিচুয়েশন,নতুন বিয়ে করা বউ পাশের রুমে দিব্যি গাল ফুলিয়ে বসে আছে আর আমি তার নতুন বিয়ে করা বর হয়ে ;না তার রাগ ভাঙ্গাচ্ছি আর না আমরা আমাদের মন মালিন্যকে দূরে ঠেলে রোমান্টিকতার স্বাদ নিচ্ছি।কেমন বিবাহিত আমরা?সেই বিবাহিত জীবনে আবার জে’লা’স হওয়া।মানায় না তোমায় লিখি।অবশ্য,আমার বেলায় ও মানায় না তোমাকে জে’লা’স ফিল করানোর।আমরা সত্যিকারের হাসবেন্ড- ওয়াইফ না যে এগুলো আমাদের বেলায় খাটবে।’
—-
লিখি গাল ফুলানোর সময় ভাবছিল একই কথা।তারা তো সেরকম স্বামী- স্ত্রী না, কিংবা তাদের প্রেমের সম্পর্কও নেই যে এই সিচুয়েশনে তার মন খারাপ হবে,জে’লা’স ফিল হবে।তবে কেন সে রাগ করে এখানে চলে আসলো?নাবিল কি ভাবছে?’

‘লিখি??নিয়ে যাও,মনিশা পিঠা এনেছে।’
কথাটা শুনে লিখি মনে করেছে নাবিল আবারও মজা করতে ওর নাম নিয়ে ডাকছে।রেগেমেগে লিখি ছুটে এসে বললো,’আপনি আবারও মশকরা করছেন ঐ ফ*কি*ন্নি…..’
মনিশাকে তখন সামনে দেখে লিখির মুখের কথা আটকে গেলো।তার মানে নাবিল সত্যি বলছিল।

নাবিল হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।মুখে সাথে সাথে হাসি ফুটিয়ে লিখি ওর হাত থেকে পিঠার বাটি নিয়ে বললো,’আমি বলছিলাম অন্য এক মেয়ের কথা।আমাদের আগের বাড়ির কাছে থাকত সে।তুমি আবার ভু’লটু’ল বুঝোনা’
‘আমি কেন ভু’ল বুঝবো?আমি কি ফ*কি’র নাকি,আমি হলাম বড়লোকের মেয়ে।’
‘একদম।এই তো তুমি কত চালাক’
মনিশা নাবিলের দিকে তাকিয়ে বললো,’আপনি খেয়ে দেখে বলবেন কেমন হয়েছে।আমি নিজে ঐ লাভ শেফেরটা বানিয়েছি’
এটা বলে মনিশা চলে গেলো।লিখি দেখলো নাবিল বাটি নিয়েছে পিঠা খেতে।তখনই ঐ বাটি থেকে লাভ শেফের টা সে সরিয়ে নিয়ে মুখে পুরে ফেললো।নাবিলকে খেতে দিলোনা।নাবিলের আবারও হাসি আসলো কিন্তু কন্ট্রোল করে রেখেছে।
লিখি এবার ওর পাশে গোল হয়ে বসে বললো,’আপনার জন্য বানানো পিঠাতে মিষ্টি অতিমাত্রায় দিয়েছে’
‘সে জানেও না আমি মিষ্টি কম খাই’
এটা শুনে লিখি খিলখিল করে হেসে উঠলো।প্রাণখুলে হাসছে সে।নাবিল অবাক চোখে ওর হাসি দেখে।

ওসমান দূরে ছিল বলে মা*র তার গায়ে পড়েনি তবে তার সব দলবল অনাবিলের আনা লোকদের হাতে বিপুল মা*র খেয়েছে।কিন্তু ওরা যে বেঁচে গেলো তা কিন্তু হয়নি।ওসমানের লোকেরাও দুমদাম মে*রেছিল।
দু গ্রুপ এখন চা বিরতি নিচ্ছে।ওসমান ভাবছে লিখি এখন কোথায় হতে পারে।বাবার ফোন এসেছিল। ওকে গা*ধা নাম দিলেন বাবা।সেও রাগ করে বলে দিয়েছে লিখিকে ধরা যদি এতই সোজা তবে তিনি যেন নিজে এসে ওকে খুঁজে বের করেন।কথাটা বলে লাইন কেটে দিয়েছে।এবার নিজের সম্মান বাবার সামনে ধরে রাখতে হলেও লিখিকে আজ ধ’রেই ফেলতে হবে।

অনাবিলের হলো একই ধারণা।নাবিল হাতের কাছে জেনেও তিনি ধ’রতে পারছেন না ওকে।বিজন্যাস পার্টনাররা বারবার জানতে চায় ওনার বড় ছেলে এবার কিসে পড়ে,কি জব করে।তখন লজ্জায় তার মা’থা হে’ট হয়ে যায়।নাবিলকে যত দ্রুত সম্ভব বিদেশ পাঠিয়ে দিতে হবে।এরকম বে*কার ঘুরতে দেওয়া যাবেনা।
মিসেস সামিয়া ওকে ফিনান্সিয়াল হেল্প করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।সামিয়ার থেকে ওর টাকা পাওয়া আগে বন্ধ করতে হবে তারপর দেখা যাবে টাকা পয়সা ছাড়া কি করে সে বাসা থেকে দূরে থাকে।

মাথায় এই চিন্তা চাপিয়ে তিনি ফিরে আসলেন নাবিলের মামার বাসায়।এসেই সামিয়ার থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বললেন,’আজ থেকে তোমার ফোন চালানো বন্ধ।যতদিন না নাবিল আমার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে ততদিন তুমি ফোন হাতেও নিতে পারবেনা।’
সামিয়া বিশ্বাস ও করতে পারছেনা উনি এমন একটা ডিসিশান নিলেন।
এতে করে তো নাবিলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।ওর খবরাখবর ও নেওয়া যাবেনা।নির্ঘাত বুঝে গেছে ওর সাথে তার আলাপ চলত।
শুধু তাই নয়, তিনি ফেরার সময় সাথে সামিয়া আর নাহিদকেও নিয়ে গেছেন।
লোক রেখে গেছেন নাবিলের মামার বাসার বাহিরে।নাবিল যেন ওর মামার সাথেও যোগাযোগ রাখতে না পারে সেজন্য।
নাবিল এতকিছু জানতনা কিন্তু বাবু লুকিয়ে ওকে কল করে সবটা জানিয়ে দিলো।
এবার নাবিলের চিন্তা আরও বেড়ে গেছে।
লিখি পিঠা শেষটা খেতে খেতে বললো,’আপনার বাবা দেখি সত্যি সত্যি মা*রা’ত্নক,আমাকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা।আপনার বাবার পকেট কে*টে আমি আমার সংসার চালাবো’
‘কি করে?’

‘চলুন এ বাসা ছেড়ে আপনাদের বাসার পাশে বাসা ভাঁড়া নিই।তারপর সেখানে সংসার পা’তা’বো।আপনার মা সকাল- বিকাল সাহায্য করবে আর আপনার বাবা জানতেও পারবেনা আমরা তার কত কাছে আছি’
‘বাসা থেকে বের হলেই তো দেখে ফেলবে’
‘আপনার বাবা কি দারোয়ান?তাছাড়া আপনি জানেননা না ঠিক কোন সময়ে আপনার বাবা বাসা থেকে বের হয়?’
‘তাও ঠিক,কিন্তু বাবার লোকজন তো আমায় চেনে।দেখে ফেললে তারা বাবাকে জানিয়ে দেবে’
‘বাসা থেকে বের হলে মাস্ক পরে বের হবেন।দূর থেকে দেখে চিনলেও ভাববে অন্য একটা ছেলে।কারণ তারা মনে করবে এত কাছে থেকে গা ঢাকা দেওয়ার মতন বো*কা লোক আপনি নন।মাঝে মাঝে বাঁচার জন্য বোকা হতে হয়।’
‘সব বুঝলাম কিন্তু বাসা ভাঁড়া নেওয়া তো এত সহজ না,এখানে তো মামা থাকায় কাজ হয়ে গেলো।ওখানে বাসা ভাঁড়া নিব কি করে?’
‘আপনার মা আছেনা?’
‘মাকে কল করবো কেমনে?মায়ের তো নাকি ফোন নিয়ে গেছে’
‘ইচ্ছে নেই আপনার এ কারণে উপায় পাচ্ছেন না।,ল্যান্ড লাইনে কল করে সব জানিয়ে দেবেন।’
‘আমার মাথা ঘু’রছে।এত সোজা হবেনা সব।তুমি তোমার ক্ষেত আইডিয়া অফ রাখো’

লিখির সাজানো গোছানো প্ল্যানটাকে মাটি চা*পা দিয়ে দিয়েছে নাবিল।সে অন্য কিছু ভাবছে।আপাতত ভাবার মতন কিছু পাচ্ছে না বলে লিখি ভাবতে বসেছে যখন তাদের খাবারের প্রয়োজন পড়ে তখন ঐ চিকনি চামেলী কোথা থেকে খাবার নিয়ে হাজির হয়।এই ফ্ল্যাটে ক্যামেরা লাগানো নাকি?’
এটা ভেবে লিখি রুমের কোণায় কোণায় তাকালো আর ভেং’চি কা*টলো।আঙ্গুল তুলে মনিশাকে যা তা বললো।যদি সত্যি ক্যামেরা থেকে থাকে এত বকাঝকা শুনে কিংবা নিজের চোখে দেখে মনিশা নিজের রুমে বসে থাকতে পারবেনা।ছুটে আসবে ঝ*গ’ড়া করার জন্য।
লিখিকে তিরিংবিরিং করতে দেখে নাবিল একটা ধ’মক দিয়ে বললো,’সারাদিন মাথায় মনিশা ঘুরে??’

‘ওহো হো!!মনিশা।কি সুন্দর করে উচ্চারণ করলেন’
‘তুমি এত জে’লা’স কেন বলোতো সত্যি করে?আমায় ভালবেসে ফেলেছো?’
‘একদমই বা।আমি তো পারলে আপনাদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দিতাম’
‘তো দাও।ডাকছি মনিশাকে’
‘ডাকুন না’
‘ডাকছি’

মনের কোণে পর্ব ২৫

নাবিল দরজায় হাত রাখতেই লিখি ঠা’স করে পাশের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।এমনিতেও নাবিল যেতো না।শুধু দেখছিল লিখি কি করে।
‘মেয়ে তো প্রেমে পড়ে গেছে।আমার জিনিস চু*রি করে আমার উপরই ক্রাশড্।নাইস!’
লিখি দরজায় কান লাগিয়ে শুনছে ওরা এসেছে কিনা।বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার ভয়ে সে রুমে ঢুকেছে মূলত।

মনের কোণে পর্ব ২৭