মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪৮

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪৮
সাদিয়া জাহান উম্মি

সেদিনের ঘটনার পরেরদিনই সবাই বাংলাদেশ ব্যাক করল।ওমন মনমানুষিকতা নিয়ে কি আর ঘুরাঘুরি করা যায়?তাই চলে যাবার সিদ্ধান্তটাই সঠিক মনে করল ওরা।বাংলাদেশে আসতেই রুদ্রিকদের যেন দম ফেলবার সময় নেই।সামনে অনার্স ফাইনাল ইয়ার এক্সাম।তাই পড়াশোনায় পুরোপুরি মনোযোগি হয়ে উঠল ওরা।

অনিক আর কখনও সিয়ার কাছে যায়নি ভালোবাসার আবদার নিয়ে।সিয়া তো অনিককে এখন দেখতেই পারে না।সেদিনের সেই কথাগুলো খুব বাজেভাবে আঘাত করেছে ওকে।যা সিয়া কোনোদিন ভুলবে না।
তবে সিয়ার সাথে এখন সেদিনের মাস্ক ম্যানের সাথে প্রায়ই কথা হয়।আজ পর্যন্ত লোকটার চেহারা দেখতে পায়নি সিয়া।সেদিন চা খেতে নিয়েও লোকটা দোকান থেকে সরে অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছিলো।আর মাথার হুডিটা এতোটাই বড়ো ছিলো যে মুখের অর্ধেকটাই ঘোরা ছিলো তাই দেখেনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এদিকে রিয়ান দিন যতো যাচ্ছিলো ততোই আসক্ত হয়ে পরছিলো সিয়ার প্রতি।সেদিনের পর থেকে সিয়াকে সে কোনোভাবেই ভুলতে পারেনি।সিয়ার মায়াময় চেহারাটা ওকে সর্বদা জ্বালাতন করে বেড়ায়।কি হচ্ছে ওর সাথে?ও তো আগে এমন ছিলো নাহ?এখন রিয়ান অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।হ্যা সে মানছে একটা সময় সে প্রচুর খারাপ ছিলো।কিন্তু মেয়েদের সাথে কখনও অসভ্যতামো করেনি। মেয়েদের সাথে অহেতুক কথাও বলত না।

হ্যা সে অথৈর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলো তা নিত্যন্তই সে রুদ্রিককে দেখতে পারে না এইজন্যে।কিন্তু রিয়ান এতোটাও খারাপ না।সে কাউকে খু*ন করতো না।সে তো নিত্যন্তই জেনির জেদের কাছে হার মেনে সে মেঘালয় গিয়েছিলো।কিন্তু ওর নিয়ত ছিলো অথৈকে কিডন্যাপ করত।এরপর রুদ্রিককে ব্লাকমেইল করতো।ভয় দেখিয়ে জেনিকে বিয়ে করার জন্যে জোড় করত।কিন্তু এখন আর এসব নিয়ত ওর নেই।সে ভালো হতে চায়।এতোদিনে বুঝেছে জোড় করে কখনও ভালোবাসা আদায় করা যায় না।আর ভালোবাসার মানুষদের আলাদা করা যায় না।যতোই চেষ্টা করুক।

যেদিন বাংলাদেশে আসল।জেনি তখন রাগে নিজের হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো।সে অথৈকে মারার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলো।রিয়ান ওকে বুঝিয়েছে।নিজের সবটা দিয়ে।যে জোড় করে কোনো কিছু পাওয়া যায় না।রুদ্রিক যদি ওর ভাগ্য থাকতো তাহলে রুদ্রিক ওরই হতো যেকোন মূল্যে।কিন্তু এখন আর রুদ্রিক আর ওর হবে না।জেনি সেদিন অনেক কেঁদেছিলো।তারপর রিয়ানকে বলে সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে।রিয়ান বোনের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।এখান থেকে চলে গেলে জেনির মন ভালো হবে।সব পিছুটান ছেড়ে দিবে।তাই কয়েকদিনের মধ্যেই জেনিকে লন্ডন পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এদিকে অনিকের অবস্থা দিন দিন অনেক খারাপ হচ্ছে।ও ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরেছে।তাই রুদ্রিক বাকিদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।অনিকের সাথে সব ঠিক করে নিবে।নাহলে একাকিত্ব অনিককে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে।সে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।এভাবে ছেলেটা নিজের জীবন নষ্ট করে দিলে হবে না।তাই সিদ্ধান্ত নিলো অনিকের সাথে খোলাখুলি কথা বলার।
তাই পাঁচ বন্ধু আজ এক জায়গায় হয়েছে।মারিয়াকে বলেছে সিয়াকে নিয়ে আসতে এখানে।আজ দুজনকে মুখোমুখিভাবে বসিয়ে এই বিষয়ে একটা হেনস্তা করতে হবে।নীল আর ইহান অনিককে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে।

পাঁচজন এক জায়গায় হতেই অনিক প্রশ্ন করে,
‘ তোরা আমাকে এখানে এনেছিস ক্যান?’
রুদ্রিক শান্ত কণ্ঠে বলে উঠে,
‘ কি চাচ্ছিস তুই?কি হাল করেছিস নিজের?এমন ছন্নছাড়া হয়ে আছিস কেন?’
অনিক তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
‘ যেখানে আমার গোটা জীবনটাই ছন্নছাড়া। সেখানে আমার বাহিরের দিকটা ছন্নছাড়া দেখে তোরা এমন রিয়েক্ট করছিস কেন?’

রুদ্রিক বিরক্ত হয়ে বলে,
‘ ফাউল কথা বলিস না অনিক।তুই আন্টি আংকেলের একমাত্র সন্তান।এটা ভুলে যাস না।তোর কিছু হলে উনাদের কি হবে একবার ভেবেছিস?’
অনিক কোনো শব্দ করল নাহ।রুদ্রিক ফের বলে,

‘ তুই মনে করছিস এমন দেবদাস হয়ে ঘুরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?তুই সিয়াকে সেদিন যা নয় তাই বলেছিস।একবার তো মেয়েটার কথা শুনে দেখতি।ও কি বলে?হ্যা ও তো তোর উপর অভিমান করে আছে।তোকে হয়তো প্রথমে বলতে চাইতো না।কিন্তু ভুলে যাস না।এই মেয়েটাই তোকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে।তাই তোর কাছে আবার কিছু লুকোচুরিও করত না।’
অনিক ছলছল চোখে তাকালো রুদ্রিকের দিকে।ধরা গলায় বলে,

‘ আমি সেদিন অনেক বড়ো পাপ করে ফেলেছি দোস্ত।আমাকে এর বিনিময়ে যেই শাস্তি দিবি সব মেনে নিবো।তবু দোস্ত আমার সিয়াকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে।ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না দোস্ত। আমি এই কয়টাদিন যাবত যেই মরন যন্ত্রণা ভোগ করছি।তা বলে বোঝানো যাবে না।আমার নিঃশ্বাস আটকে যায়। আমাকে বাঁচা রুদ্রিক।আমার সিয়াকে আমার কাছে এনে দে।আমি দরকার পরলে ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবো।ও যা বলবে তাই করবো।তারপরেও আমার কাছে ফিরে আসতে বল।’

রুদ্রিক দ্রুত পায়ে এসে অনিককে জড়িয়ে ধরল।অনিকের এই হাহাকার দেখে ওর বুকটা ফেটে যাচ্ছে।ও একটু হলেও বুঝতে পারছে অনিকের কষ্টটা।রুদ্রিক বলে উঠে,
‘ যাকে এতোটা ভালোবাসিস তাকে কেন সেদিন ওমন কথাগুলো বললি অনিক।একটা মেয়ের কাছে চরিত্রহীনা উপাধিটা শোনা যে কতোটা যন্ত্রণাদায়ক তা বলে বোঝানো যাবে না।সিয়া আমাকে সব বলেছে।সেদিন রুটব্রিজ যাওয়ার পথে ও পরে যেতে নিয়েছিলো নাহ?তখন একটা লোক ওকে সাহায্য করেছিলো।লোকটাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্যে লোকটার সাথে এক কাপ চা খেয়েছিলো।ব্যস এইটুকুই।আর শোন অনিক। একটা সম্পর্ক কখনও বিশ্বাস ছাড়া টিকিয়ে রাখা যায় না।বিশ্বাস হলো একটা সম্পর্কের মেইন খুটি।আর তুই সেই বিশ্বাসটা করতে পারিসনি।’

অনিক কান্না করে দিলো।
‘ আমি জানি রে আমি ওকে অবিশ্বাস করে সবচেয়ে বড়ো পাপ করেছি।আমি সেই পাপের প্রায়েশ্চিত্ত যেকোনো মূল্যে করতে রাজি আছি।ওকে একবার বলনা আমার কাছে ফিরে আসতে।আমি সত্যি বলছি আমি অনেক ভালো হয়ে যাবো।এতোটা ভালো হবো যে ও আর কোনো অভিযোগ করতে পারবে না।ও যেভাবে চাইবে।যেমনভাবে চাইবে।আমি সেইভাবেই সব করব।তবুও ওকে আমার হতে বল।আমি ওকে হারাতে পারবো না।ও তো আমার প্রাণ বল।নিজের প্রাণকে হারিয়ে কি কেউ কখনও বেঁচে থাকতে পারে?’

ইহান অনিকের কাধে হাত রেখে বলে,’ কাঁদিস না দোস্ত।সিয়া তোর ভাগ্যে লিখা থাকলে ও তোরই হবে।আমরা ওকে এখানে ডেকেছি।মারিয়া ওকে নিয়ে এই আসল বলে।তুই তোর সবটা দিয়ে চেষ্টা করিস।ওকে বোঝাস যে তুই সেদিন যা করেছিস আর বলেছিস।রাগের মাথায় বলে ফেলেছিস।’
অনিক চোখ মুছে বলে,’ ও এখানে আসবে?’

ইহান মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো।ওরা সবাই অপেক্ষা করতে লাগল।এর মধ্যে সবাই অনিককে নানান কথা বলে ওর মনোবল শক্ত করল।একটু পরেই দেখা গেলো সিয়া আর মারিয়া আসছে।সিয়া মাথা নিচু করে আছে।অনিক একধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটাকে সেদিন কতো কষ্টটাই না ও দিয়েছে।কতো খারাপ কথা বলেছে।ওই মেয়েটা ওকে সবটা উজাড় করেই ভালোবাসল।কিন্তু এর বিনিময়ে ওর কাছ থেকে শুধু অপমান আর লাঞ্চনাই পেয়েছে।আজ কিভাবে সিয়ার দিকে তাকাবে অনিক?কিভাবে সিয়ার চোখে চোখ মিলাবে?

মারিয়া সিয়াকে নিয়ে সবার সামনে দাঁড়ালো।সিয়া একপলক অনিককে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।অনিক তা দেখে কষ্ট পেলো।সিয়া শক্ত কণ্ঠে বলে,’ আমাকে এখানে কেন এনেছিস মারিয়া?’
রুদ্রিক সিয়ার মাথায় হাত রাখল।নরম গলায় বলে,

‘ সিয়া দেখ আমার কথা মন দিয়ে শোন।সব পরিস্থিতি সবসময় এক থাকে না।ভবিষ্যতে কি হবে? না হবে?কেউ-ই আমরা বলতে পারিনা।সেদিন অনিক যা করেছে রাগের মাথায় করেছে।আমি বলছিনা তুই খারাপ।কিন্তু একবার অনিকের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাব।এমনভাবে রাতের অন্ধকারে যদি অনিককে তুই অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখতি তোর কি খারাপ লাগতো নাহ?রাগ হতো না?’

সিয়া কোনো ভণিতা করল না।সোজাসাপটা বলে ফেলল,
‘ হ্যা আমার খারাপ লাগতো।রাগ হতো প্রচুর।কিন্তু তাও আমি নিজেকে সামলে নিতাম।আগে ওর কাছ থেকে পুরো বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইতাম।কিন্তু ও কি তা করেছে?’

সাফাত বলল,’ হ্যা এটা অনিকের অনেক বড়ো একটা ভুল।যে অনিক তোকে আগে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।কিন্তু সিয়া দুনিয়াতে সবাই এক হয় না।হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন এক হয় না।তেমন সব মানুষের রাগ,জেদ,আবেগ,ভালোবাসা এক হয় না।তুই নিজেও এটা বুঝতে পারছিস যে অনিক তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে।কি মানিস কিনা মানিস না সেটা বল?’
সিয়া চুপ করে রইলো।কি বলবে সে আর?হ্যা সে জানে অনিক বদলে গেছে।আগের সেই অনিকের সাথে এই অনিকের মধ্যে কোনো মিল নেই। আগের অনিক ওকে ভালোবাসতো না।আর এই অনিক ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে।কিন্তু অনিকের করা ব্যবহারগুলোও এ ভুলতে পারছে না।সিয়া কি করবে? কোন দিক দিশা পাচ্ছে না।
নীল বলে,’ সিয়া ভালোবাসা জীবনে একবার আসে বার বার না।তবুও তোকে জোড় করবো না।তোর মন যা চায়।তুই সেটাই কর।’

সিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে লাগল।হঠাৎ অনিক এসে সিয়ার হাতদুটো ওর হাতের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে।ধরা গলায় বলে উঠে,
‘ সিয়া প্লিজ সিয়া আমাকে ক্ষমা করে দে।আমি এইবার সত্যি সত্যি বলছি আর কোনোদিন তোকে কষ্ট দিবো না।কোনোদিন না।আমাকে একবার মাফ করে দে সিয়া।আমি তোকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখব।অনেক অনেক ভালোবাসব।যে আমার ভালোবাসায় তুই কোনো খাদ খুঁজে পাবি না সিয়া।আমাকে ফিরিয়ে দিস না সিয়া।আমি তাহলে পাগল হয়ে যাবো সিয়া।তোকে ছাড়া আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে সিয়া।’

অনিকের একেকটা বাক্যে যেন সিয়াকে হারিয়ে ফেলার তীব্র হাহাকার উপলব্ধি করতে পারছে সিয়া।অনিকের এই অবস্থা ও সহ্য করতে পারছে না। হাজার হোক সত্যি তো এটাই যে ও অনিককে ভালোবাসে।সেই ভালোবাসার মানুষটার এমন বিধ্বস্ত রূপ কিভাবে সহ্য করবে?কিন্তু চাইলেও অনিককে জড়িয়ে ধরে বলতে পারছে না।যে ‘ অনিক তুমি চিন্তা করো না।আমি আছি তো।আমি সবময় তোমার পাশে থাকব।’ অনিকের কাছে এগিয়ে যেতে নিলেই অনিকের বলা সেদিনের ‘ চরিত্রহীন!’ উপাধিটা বার বার কানে বাজে।বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই একটা কারন।

চরিত্রহীন এই একটা শব্দ বার বার কানে বাজতে থাকে সিয়ার।সিয়ার সারা শরীর কেঁপে উঠে।ফট করে অনিকের হাতের থেকে হাতদুটো ছাড়িয়ে নেয়। তারপর পিছু ফিরে যায়।মুখে হাত চেপে কান্না করে দেয়।এদিকে সিয়ার এইভাবে ঘুরে যাওয়ায় যেন অনিকের কলিজায় কেউ ছুরি দ্বারা আঘাত করে দিলো।
অনিক পাগলের মতো বলতে লাগে।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪৭

‘ সিয়া আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিস না এভাবে।আমি তোকে সত্যি ভালোবাসি।আমাকে এইভাবে জিন্দা লাশ বানিয়ে দিস না।আমি মরে যাবো সিয়া।আমি মরে…..!’
হঠাৎ অনিকের কথা থেমে যায়।সাথে সকলের চিৎকার ভেসে এসে কানে লাগল সিয়ার।
‘ অনিককককককককককক!’

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪৯