মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪৭

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪৭
সাদিয়া জাহান উম্মি

জেনির সাথে ফোনে কথা বলছিলো রিয়ান।হঠাৎ পিছন থেকে চিকন রিনিঝিনি মেয়েলি কণ্ঠস্বর কানে এসে পৌছাতেই চটজলদি পিছনে ফিরে তাকায়।তাকাতেই সিয়ার হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা ভেসে উঠে ওর অক্ষিপটে।সিয়াকে সে চিনে।কিন্তু সিয়াও ওকে চিনে।কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে চিনছে না।না চিনবারই কথা।কারন রিয়ান মুখে মাস্ক পরে আছে।

গায়ে ব্লাক কালারের হুডি জড়ানো।সেই হুডির টুপিটা মাথায় দেওয়া।যার কারনে চোখের অর্ধকখানি ঢেকে আছে।চোখে সানগ্লাসও পরা আছে।তাই ও যে রিয়ান তা কেউ বুঝবে না।সিয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।এদিকে সিয়া রিয়ান তাকাতেই চুপ হয়ে গেলো।প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে।লোকটাকে ডেকে তো ফেলল এখন কি বলবে?এদিকে রিয়ান সিয়ার কোনো নডচড় না দেখে এইবার নিজেই বলে উঠে,’ জি বলুন?কিছু বলবেন?’
রিয়ানের কথায় নড়েচড়ে উঠে সিয়া।শুকনো ঢোক গিলে নেয়।জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে,’ আসলে হয়েছে কি।ওই আরকি…’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সিয়াকে থামিয়ে দিয়ে রিয়ান বলে উঠল,’ আসলে নকলে পরে বলা যাবে।আগে কিজন্যে আমায় ডেকেছেন সেটা বলুন।’
সিয়া নাক মুখ কুচকে আসতে চাইছে।তাও নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে।এই লোক তো ভারি বজ্জাত।এইভাবে কেউ কারো সাথে কথা বলে?আরে ও তো বলতেই নিয়েছিলো।বেটা খবিশটাই তো থামিয়ে দিলো।

মনের কথা মনের মাঝে চেপে রাখল সিয়া।বলল,’ আসলে সকালে আমি রুটব্রিজ যাওয়ার পথে ওই পিচ্ছিল সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পরে যাচ্ছিলাম।আপনিই তো আমাকে হ্যাল্প করলেন।আমাকে এতো বড়ো একটা বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।আপনাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত আমি দেয়নি।আমি আপনাকে পরে অনেক খুঁজেছিলাম কিন্তু আপনাকে পায়নি।এরজন্যে আমার মনটা অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু এখন আবার আপনাকে খুঁজে পেয়ে অনেক ভালো লাগছে।আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ তখন আমাকে এতো বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে।’

রিয়ান শান্ত হয়ে সিয়ার পুরোটা কথা শুনল।কেন যেন ওএ সিয়ার কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগেনি।বিরক্ত ফিল হয়নি ওর।রিয়ান শান্ত কণ্ঠে বলে,’ ইটস ওকে।আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আপনাকে হ্যাল্প করত।’
‘ কিন্তু এখন হ্যাল্পটা তো আপনি করেছেন।তাই ধন্যবাদটা আপনিই পাওনা।’
‘ হুম!’
রিয়ান আবার অন্যদিকে ঘুরে যেতে নিতেই সিয়া উত্তেজিত হয়ে বলে,’ আরে আরে?কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’
রিয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরল।বলল,’ তো?এখন কি আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো?’
‘ না সেটা বলছি না।’
‘ তো?’

সিয়া আমতা আমতা করে বলে উঠল,’ আপনি আমার এতো বড়ো একটা উপকার করেছেন।বিনিময়ে শুধু আমি ধন্যবাদ জানালে বিষয়টা অনেক খারাপ দেখায়।’
রিয়ান বলে,’ সমস্যা নেই।আমি আপনার ধন্যবাদ নিয়েছি।’
‘ এভাবে তো বললে হবে না।’
‘ তাহলে কি বলব?’

সিয়া ঠোঁট প্রসস্থ করে হেসে বলে,’ ওইযে দূরে দেখছেন।এখানের ওই টং দোকানটায় অনেক মজাদার চা পাওয়া যায়।আপনি যদি আমার সাথে এককাপ চা খান এখন।তাহলে বুঝে নিবো আপনি আমার ধন্যবাদ গ্রহন করেছেন।’
কথাগুলো বলতে বলতে সিয়া দূরে থাকা টং দোকানটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো।রিয়ান সেদিকে একপলক তাকিয়ে আবার সিয়ার দিকে তাকালো।তাকাতেই রিয়ানের বুকের বা-পাশটায় কেমন যেন করে উঠল।

চারদিকে আবছা অন্ধকার।এই রিসোর্টার প্রতিটি কোনে কোনে একটা করে বাঁশের খুটি গেড়ে রাখা হয়েছে।সেই বাঁশের খুটির সাথে একটা করে হ্যারিকেন টানানো।সেই হ্যারিকেনের হলদে আলোতে সিয়ার মুখশ্রীটা বড্ড আদুরে দেখালো।ঠোঁটের ভাজের ওই হাসিটুক বড্ড কোমল লাগলো।হৃদয়ে গেঁথে রাখার মতো।ওই হলদে আভায় সিয়ার ডাগরআঁখিজোড়া যেন জ্বলজ্বল করছে।রিয়ানের ঘোর লেগে যাচ্ছে ওই চোখজোড়ার দিকে তাকাতেই।কি হচ্ছে এসব ওর সাথে?আগে তো এমন হয়নি।এ কেমন অনুভূতি।

‘ কি হলো?যাবেন নাহ?’
আচমকা সিয়ার কণ্ঠে ঘোর কাটে রিয়ানের।নিজের বেহায়াপনায় নিজেই অবাক রিয়ান।এভাবে কোনো মেয়ের দিকে ও কোনোদিন তাকায় না।কোনো মেয়ের মুখটা এতো আদুরে লাগেনি ওর কাছে।তবে আজ হঠাৎ এমন কেন হলো?এই সিয়াকে তো ও বহু দেখেছে।যেহেতু সে জেনির ফ্রেন্ড।অহরহ ওদের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে।তখন তো এইভাবে কোনোদিন সিয়াকে ও খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেনি।তবে আজ কেন?বার বার মনকে একই প্রশ্ন করল রিয়ান।কিন্তু এই ‘ কেন?’ এর উত্তর মিলল নাহ।রিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’ এখন তো অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।’

‘ আমি মেয়ে মানুষ হয়ে আমার সমস্যা হচ্ছে না।তবে আপনি এমন করছেন কেন?নাকি আমার ধন্যবাদটা এক্সেপ্ট করতে চাইছেন নাহ?’
‘ এমন কিছু না।’
‘ তাহলে চলুন।’

সিয়ার জোড়াজুড়িতে শেষমেষ বাধ্য হয়ে রিয়ান রাজি হলো।আর এমনিতেও কেন যেন ওর মন সম্মতি দিচ্ছিলো না যে ও সিয়াকে নাকচ করে ফিরিয়ে দিবে।সিয়া আর রিয়ান চুপচাপ বেশ খানিকটা দুরুত্ব রেখে পাশাপাশি হাটছে।এমন নিরবতা ভালো লাগছিলো না সিয়ার।তাই সিয়া নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে বলে,’ আপনি কি এখানে একা এসেছেন?’
রিয়ান শান্ত চোখে সিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,’ না,আমি আর আমার বোন এসেছি।’
‘ ওহ! আমরা যেই রিসোর্টে উঠেছি।সেখানেই উঠেছেন তাই নাহ?’
‘ নাহ!’
অবাক হলো সিয়া।প্রশ্ন করল,’ তাহলে এখানে আপনি কি করছিলেন?’

‘ একটা কাজে এসেছিলাম।এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে।সেও নাকি এখানে ঘুরতে এসেছে।তাই ভাবলাম দেখা করে যাই।’
রিয়ানের মিথ্যে কথাটা একটুও ধরতে পারলো না সিয়া।সরল মনের সবটা বিশ্বাস করে নিয়ে বলে,’ ভালো করেছেন।তা এখন কি করবেন?রাত হয়ে আসছে।আপনার বোন তো মেইবি একা আছে।রিসোর্টে ফিরে যাবেন?’
রিয়ান হালকা হেসে বলে,’ না গিয়ে উপায় নেই।একমাত্র বোন আমার।’
মাস্কের আড়ালে যেই হাসি দেখতে পেলো না সিয়া।বলে,’ আপনার বোনকে অনেক আদর করেন তাই নাহ?’
‘ একটা মাত্র বোন আমার আদর তো করবই।ওর জন্যে সব করতে প্রস্তুত।’
‘ খু/নও করতে পারবেন?’

চমকে উঠল রিয়ান।প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলো।সিয়া কি কিছু টের পেলো নাকি?নাহলে এমন একটা কথা কেন বলবে?রিয়ানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে।আবারও কোনো বানোয়াট মিথ্যে বলার আগেই সিয়ার খিলখিল হাসির শব্দে চারদিক মুখোরিত হলো।রিয়ান যেন আটকে গেলো সেই হাসির মাঝে।হুঁশ ফারিয়ে ফেলল।মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেই থাকলো সেই হাসি।এতো সুন্দর কারো হাসি হয় বুঝি?কারো হাসির শব্দের ঝংকারে বুঝি এইভাবে বুক কেঁপে উঠে?সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়?সিয়া হাসি থামালো।তবে এখনও ঠোঁটে মুচঁকি হাসি লেগে আছে।

‘ আমি তো মজা করলাম।ভয় পেয়েছেন নাকি আপনি?নাকি সত্যি সত্যি কাউকে খু/ন করবেন?’
রিয়ান নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিলো।শক্ত কণ্ঠে বলে উঠে,’ ফারদার এমন মজা কারো সাথে করবেন না।এটা ব্যাড ম্যানার্স।’
‘ আচ্ছা সরি।’

নিভিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে সিয়া।রিয়ান থমকে গেলো।মেয়েটা কি ওর শক্ত কথার ধাঁচে রাখ করেছে?কষ্ট পেয়েছে? নাহলে এভাবে কথা বলল কেন?কণ্ঠটায় কেমন যেন মন খারাপের আভাস পেলো।রিয়ান ধীর স্বরে বলে উঠে,’ আপনি কি আমার কথায় মন খারাপ করেছেন?’

সিয়া অবাক হলো।পর পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’ আমার মন খারাপ হলেই বা কি?আপনি কি করবেন?’
রিয়ান লম্বা শ্বাস ফেলে বলে,’ আপনার সাথে এককাপ চায়ের জায়গায় দু কাপ চা খেলে,আপনার মন ভালো হবে?’
সিয়া হেসে ফেলল রিয়ানের কথায়।মন ভালো করার উপায় শুনে বেশ মজা পেয়েছে ও।এদিকে সিয়ার হাসি দেখে যেন হৃদয় জুড়িয়ে গেলো রিয়ানের।একটা কথাই মাথায় আসল।মেয়েটা মন খারাপ করলে ওর একদম ভালো লাগে না।একটুও না।মেয়েটা হাসুক।এইভাবেই হাসুক।সবসময় এমনই প্রাণজ্জ্বল থাকুক।এইভাবেই ওদের মাঝে টুকটাক কথা হলো এককাপ চায়ের সাথে।রাত সাড়ে আটটা নাগাত সিয়াকে রিসোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে রিয়ান চলে যায়।

সিয়া রিয়ানকে বিদায় দিয়ে যখন নিজের কটেজে ফিরে যাবে।তখনই ওর কটেজের সামনে অনিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।অনিককে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো সিয়া।তবে কিছুই বলল না।অনিকের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো।কিন্তু পারলো না।তার আগেই অনিক শক্ত করে সিয়ার হাত চেপে ধরেছে। এতোটাই শক্ত করে ধরেছে যে মনে হচ্ছে সিয়ার হাতটা কবজি থেকে ভেঙ্গে যাবে।সিয়া ব্যথাতুর আওয়াজ করে উঠল।চাপা কণ্ঠে বলে,’ কি করছেন আপনি?এইভাবে হাত ধরেছেন কেন?হাত ছাড়ুন।আমার ব্যথা লাগছে। ‘

অনিক পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। সিয়ার দিকে তাকায়।সিয়া অনিকের দিকে তাকাতেই সাথে সাথে ভয় পেয়ে যায়।অনিকের চোখজোড়া অস্বাভাবিকভাবে লাল হয়ে আছে।সেই সাথে ফর্সা মুখটাও রক্তিম আকার ধারন করেছে।হ্যারিকেনের হলদেটে আলোতে তা দেখতে আরও ভয়ানক লাগছে।অনিক শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’ ছেলেটা কে ছিলো সিয়া?’
অনিকের এহেন শীতল কণ্ঠে সিয়ার ভীতর শুদ্ধ নড়ে উঠে ভয়ে।সিয়া হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। সিয়ার কোনো জবাব না পেয়ে।অনিক এইবার আর নিজের রাগ সামলাতে পারলো না।ভয়াবহ রেগে চিৎকার করে উঠে,’ ছেলেটা কে ছিলো সিয়া?জাস্ট আন্সার দ্যা কুয়েশ্চেন।কে ছিলো?’

কথাটা বলার সময় অনিক সিয়ার হাতে প্রচন্ড জোড়ে চাপ দিচ্ছিলো।ব্যথায় সিয়ার চোখে পানি চলে এসেছে।সহ্য করতে না পেরে সিয়া সজোড়ে চ’ড় মেরে দেয় অনিক।সিয়ার দেওয়া চ’ড়টা যেন আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে বসল।অনিক প্রচন্ড রেগে সিয়ার গাল চেপে ধরল।অন্য হাতে সিয়ার চুল।এতোটাই চাপ দিয়ে গালগুলো ধরেছে যে মনে হচ্ছে সিয়ার জান বের হয়ে যাবে।সিয়া শব্দ করে কেঁদে উঠল।

কিন্তু সেই কান্না অনিকের মন গলাতে পারলো না।আজ রাগে অনিক নিজের দিক বেদিক ভুলে বসেছে।সে চিৎকার করে বলে উঠে,’ আমাকে তোর ভালোলাগে না।আমার সাথে তুই সম্পর্ক রাখবি না।আমাকে তুই বিয়ে করতে পারবি না।তুই নানান বাহানা দিয়ে আমাকে বার বার রিজেক্ট করেছিস।কিন্তু তলেতলে ঠিকই নাগড় জুটিয়ে রেখেছিস।সেই নাগড় এখন এখানেও এসেছে।তার সাথে আবার রাতের অন্ধকারে দেখাও করছিস।আর সবার সামনে তুই ইনোসেন্ট সাজিস।বুঝাস তুই ভাজা মাছ উলটে খেতে জানিস না।

আরে তুই আমাকে বলিস আমি প্লেবয়। আমি তোকে ঠকিয়েছি।তোকে রেখে অন্য মেয়ের সাথে প্রেম করেছি।আরে হ্যা করেছি।তো?আমি যা করেছি সবার সামনে করেছি।আমি যেমন সবাই আমাকে তেমনভাবেই দেখেছে।কিন্তু তুই?তুই কি হ্যা?তুই তো একটা চরিত্রহীনা।রাতের অন্ধকারে প্রেমিকের সাথে গিয়ে নিজের ইজ্জত বিলিয়ে আসিস।আর দিনের আলোতে ভদ্রতার মুখোশ পরে সবার সামনে ঘুরে বেড়াস।আরে তুই আমাকে কি রিজেক্ট করবি?আমিই তোকে রিজেক্ট করলাম।তোর মতো চরিত্রহীনার পিছনে আমি অনিক আর কখনও সাবো না।চরিত্রহী…..’

বাকিটা আর অনিক বলতে পারলো না।তার আগেই চোয়াল বরাবর শক্ত হাতের শক্তিশালী একটা ঘুষি খেলো।ঘুষিটা এতো জোড়েই ছিলো যে অনিক ছিটকে মাটিতে পরে গিয়েছে।সিয়াও পরে যেতে নিয়েছিলো।তার আগেই অথৈ সিয়াকে ধরে ফেলে।অনিনের নাক থেকে গলগল করে রক্ত পরছে।ঠোঁট ফেটে রক্ত পরছে।

একটা ঘুষি মেরে যেন রুদ্রিক শান্তি পেলো না।আবারও তেড়ে গিয়ে অনিকের কলার ধরে ওকে সোজা করে দাঁড় করালো।তারপর কোনোকিছু না ভেবেই আবারও ঘুষি মারলো।আরেক গালে।এরপর অনিকের পেটে।ইচ্ছেমতো মারল।রুদ্রিকের মারের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আগেই নীল আর সাফাত গিয়ে ধরল রুদ্রিককে। আর সাফাত ধরল অনিককে।অনিকের অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে।কিন্তু এতেও যেন রাগ কমছে না রুদ্রিকের।রুদ্রিক রাগে চিৎকার করে উঠে,’ তোরা কেনো আটকাচ্ছিস আমায়?কেন?ওর জন্যে?’

আবার অনিকের দিকে তাকিয়ে বলে,’ আরে এই তুই এমন জা/নোয়ার হলি কবে থেকে রে?তুই সিয়াকে এসব কথা বলার সাহস কোথায় পাস?তুই যেই মুখ থেকে সিয়াকে চরিত্র/হীন বলেছিস আমি সেই ঠোঁট ছিড়ে ফেলব।ছাড় আমায়।তোকে বন্ধু ভাবতেও আমার ঘেন্না হচ্ছে।যেই ছেলের মন মানুষিকতা এতো খারাপ সে আমার বন্ধু কখনও হতে পারে না।তাকে আমি আমার বন্ধু মানি না।’

নীল আর ইহান রুদ্রিককে টেনে সরিয়ে আনল।সাফাত অনিককে ধরে নিয়ে আসতে নিলে।অনিক সাফাতের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনে।তারপর নিজেই টলতে টলতে সিয়াদের কটেজের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
এদিকে সিয়া অনবরত কাঁদছে।আজ যেন ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছে।যাকে সে মনের সবটা দিয়ে ভালোবাসল আজ তার মুখ থেকে এমন সব কথা শুনেছে। যা শোনার আগে সিয়া মরে কেন গেলো না।অনিকের বলা প্রতিটি কথা ওকে ভীতরে ভীতরে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।আজ যেন নিজের প্রতিই ঘৃনা হচ্ছে কেন সে ভালোবাসল অনিককে?কেন এইভাবে নিজের সবটা উজাড় করে পাগলের মতো ভালোবাসল?অথৈ সিয়ার চোখ মুছে দিয়ে বলে,’ আপু কেঁদো না আর। থামো আপু।অসুস্থ হয়ে যাবে আপু।’

সিয়া জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো।অনেক কষ্টে নিজের কষ্টগুলোকে ভীতরে চাপা দিয়ে দিলো।না এইভাবে কাঁদলে চলবে না।আজ যেসব কথা অনিক বলেছে তার মুখ্য জবাব দিতেই হবে।নাহলে নিজের বিবেগের কাছে সিয়া ছোটো হয়ে যাবে।সিয়া নিজের চোখ মুছে নিলো।অথৈ থেকে নিজেকে ছাড়াতে নিলেই অথৈ বলে,’ আপু তুমি…’
‘ আমি ঠিক আছি অথৈ। চিন্তা করো না।’

অথৈ আর কিছু বলল না।সিয়া নিজেকে কঠোর রূপে রূপান্তরিত করল।একপা একপা করে এগিয়ে যায় অনিকের দিকে।অনিকের অবস্থা অনেক খারাপ।সিয়াকে নিজের কাছে এসে দাঁড়াতে দেখে অনিক নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
সিয়া শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,’ আমি রাতের অন্ধকারে কার সাথে দেখা করেছি।কি করেছি! এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে মি.অনিক হাসান?আপনি কে হোন আমাকে প্রশ্ন করার?কেউ না।কেউ নন আপনি আমার।তবে কেন আমাকে চরিত্র/হীন বললেন?কোক সাহসে?বলুন কোন সাহসে?’
সিয়া সজোড়ে চড় মেরে বসল অনিকের গায়ে।

তারপর আবার চিৎকার করে বলে,’আমাকে আপনি রিজেক্ট করেছেন তাই নাহ?আরে আপনি আমার জীবনে এক্সিট করলে তো আমায় রিজেক্ট করবেন?আপনি তো আমার জীবনে কোনো ম্যাটারই করেননা।তবে কোন সাহসে আমাকে এসব বিশ্রি কথাগুলো বললেন?’
আবারও চড় মারলো সিয়া। অনবরত পাঁচ ছয়টা চড় মারলো।অনিক কিছুই বলল না।ও শুধু স্তব্ধ হয়ে সিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

সিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।কান্নায় ভেঙে পরল।
‘ তোরা সবাই শুনে নেহ এই লোকটাকে…এই লোকটাকে ভালোবেসে আমি আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো পাপ করেছি।যেই পাপ কোনোদিন মাফ করা যাবে না।ঠিক শুনেছেন মি.অনিক হাসান।আপনাকে ভালোবেসে আমি সবচেয়ে বড়ো পাপ করেছি।আজ নিজের প্রতি নিজের ঘৃনা হচ্ছে।যে আমি কিনা এমন জঘন্য মন মানুষিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে ভালোবেসেছি।’
সিয়ার কথা একেকটা কথা যেন অনিকের পুরো সত্তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে যে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুলটা আজ করেছে।

সিয়া দুহাতে চোখ মুছে নিলো।কিন্তু বেহায়া চোখের জল আবারও গাল বেয়ে গড়াতে লাগল।সিয়া ভেজা কণ্ঠে বলে উঠে,’ আজ আমার বন্ধু বান্ধব।আরও যারা আছে।এই আকাশ,বাতাশ সব কিছু সাক্ষি রেখে আমি বললাম।আপনার প্রতি আমার যেই ভালোবাসা মনের মধ্যে আছে তা এখানেই এই মেঘালয়ের মাটিতেই আমি কবর দিয়ে দিলাম।আজ থেকে আমার মনের মধ্যে অনিক হাসান নামক মানুষটির জন্যে কোনো ভালোবাসা নেই।আজ আমি নিজ হাতে তা মাটি চাপা দিয়ে দিলাম।তবুও যদি এই বেহায়া মন আপনাকে আবারও কোনোদিন স্মরণ করে।তাহলে আজকের ঘটনা মনে করব আমি।আর সেদিন নিজেকেই নিজে শেষ করে দিবো।এটা আজ আমি ওয়াদা করে গেলাম।’

কথাগুলো বলেই সিয়া কাঁদতে কাঁদতে নিজের কটেজে চলে গেলো। অথৈ,রিধি,পিহু,মারিয়া ওরা সবাই সিয়ার পিছু পিছু চলে গেলো।
এদিকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে অনিক।কি করে ফেলল সে আজ? এ কি করে ফেলল?এইভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে এতোবড়ো কষ্ট,আঘাত কিভাবে দিয়ে ফেলল?এইজন্যেই বলে রাগ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।মানুষকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করে দেয়।তাদের দ্বারা এমন সব পাপকার্য করিয়ে ফেলে যা কোনোদিন জীবন থেকে মোছা যাবে না।
ইহান অনিকের কাছে এসে বলে,’ তুই তো আমাদের বন্ধু?তাই না রে অনিক?তাহলে তোর মন এমন কুৎসিত কেন রে?তুই নিজের ভীতরে এসব পুষে আছিস? তুই যে আমার বন্ধু ভাবতেই আমার ঘৃনা হচ্ছে।’

নীল বলে,’ মেয়েটা তোকে প্রচন্ড ভালোবেসেছিলো অনিক।আজ তুই সেই ভালোবাসা একেবারে নিজ হাতে গলা টিপে নিঃশেষ করে দিলি।কিভাবে পারলি অনিক?একবারও তোর বুক কাঁপল নাহ?ওইসব ভাষা উচ্চারণ করতে একবারও বিবেকে নাড়া দিলো নাহ?এতোটা খারাপ তুই কবে হলি?’

রুদ্রিক রাগি গলায় বলে,’ তোরা কাকে কি বলছিস?ওকে ওকে এসব বলে লাভ নেই।যেই মানুষটার হৃদয় নোংরামো চিন্তাভাবমায় ঠাসা।সেই মানুষটার এসব কথাতে কোনোকিছু যায় আসবে না।আর কিসের বন্ধু?ও কোনোদিন আমাদের বন্ধু ভেবেছিলো?যে ও আমাদের কথা চিন্তা করবে?কিসের ভালোবাসার কথা বলে ও?ও সিয়াকে কোনোদিনও ভালোবাসেনি।যদি ভালোইবাসত।তাহলে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে এমন জঘন্য/নোংরা কথা বলতে পারতো নাহ।’
এই বলে রুদ্রিক চলে গেলো নিজের কটেজে।নীল আর ইহানও চলে গেলো।অনিক একা রয়ে গেলো।একটু পর সাফাত আসলো।ও-ও চলে গিয়েছিলো।এখন আবার এসেছে।সাফাত এসে অনিকের পাশে এসে দাঁড়ালো।অনি তা দেখে ভাঙা গলায় বলে,’ তুই..তুই কেন এসে..এসেছিস?’

সাফাত কিছু না বলে অনিককে ধরে একটা বেঞ্চে নিয়ে বসালো।এখানে একেক জায়গায় বেঞ্চ বানানো।যেখানে মানুষ বসে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য লুফে নেয়।সাফাত ফার্স্টএইড বক্স বাহির করল।তুলোতে হেক্সোসেল লাগিয়ে অনিকের আঘাতে চেপে ধরল।তা পরিষ্কার করতে লাগল।অনিক টু শব্দ করল না।আজ এই আঘাতগুলোতে বিন্দু পরিমান ব্যথা অনুভব করছে না।ও যা করেছে এর বিনিময়ে তা কমই হয়েছে।অনিক আবার বলে,’ চ..চলে যাহ সা..সাফাত।এসবের দর..দরকার নেই।আমি ঠিক আছি।’

সাফাত কিছুই বলল না।চুপচাপ অনিকের ব্যথাযুক্ত স্থানগুলো পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।তারপর অনিককে জোড় করে একটা ব্যথার ঔষুধ খাইয়ে দিলো।কাজ শেষ করে সাফাত উঠে দাঁড়ালো।অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলে উঠল,’ রাগের কারণে মানুষ শুধু তার জীবন নষ্ট করে না, অন্য মানুষের হৃদয়েও আঘাত করে।আর আজ তা তুই করেছিস।এরপর সিয়ার আশেপাশেও যেন তোকে না দেখি।সিয়াকে পাবার আশা চিরতরে ত্যাগ করে দে।তাহলে তোর জন্যেই ভালো হবে।কথাটা আমলে নিয়ে নিস।’

একটু থেমে আবার বলল,’ রাত হচ্ছে তোর কটেজে ফিরে যা।’
সাফাত হনহন করে চলে গেলো।সাফাত যেতেই অনিক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।আজ নিজ হাতে সব শেষ করে দিলো না।বন্ধুত্ব, ভালোবাসা সব হারিয়ে ফেলল।কেউ তাকে চায়না।সবাই তাকে এখন ঘৃনা করে।কি করবে অনিক?ঠিক কি করলে আগের মতো সব ঠিক হবে?মনের ভীতর থেকে আওয়াজ আসল।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪৬

‘ আর কিছু ঠিক হবে না অনিক।কিচ্ছু ঠিক হবে না।তুই হ্ব্রে গেছিস অনিক।গেরে গেছিস।’
অনিক দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল।বলে উঠল,
‘ আ’ম সরি সিয়া। আ’ম রেয়েলি ভেরি সরি।আমি এমনটা করতে চায়নি সিয়া।করতে চায়নি।আ’ম সরি এভ্রিওয়ান।সরিইইইইইই।’

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪৮