মন বিনিময় পর্ব ২৪ (২)

মন বিনিময় পর্ব ২৪ (২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা

রুম ছেড়ে বেরোতেই পথিমধ্যে রাহিতার দেখা হয় দীপ্তর সাথে। ছেলেটা হাটছে এদিকে ওদিক এবং উশখুশ করছে একটু পরপর বাড়ির মেইনগেটের দিক চেয়ে। রাহিতার দিকে চোখ পড়তেই এতক্ষণের চিন্তিত ভাব সরিয়ে হাসি টানে মুখে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলে,

—আরে, নতুন ভাবী যে? রেস্ট নিয়েছেন ঠিকমতো? জার্নির ক্লান্তি দূর হয়েছে?
—জি, ভাইয়া। আপনি এদিকে কি করছেন? কাউকে খুজছেন?
সহাস্যে উত্তর দেয় রাহিতা। ওর প্রশ্নে খানিকটা ইতস্তত করে দীপ্ত। কাচুমাচু ভঙিতে বলে,
—না তো। আমি আবার কাকে খুজবো…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দীপ্তর কথা মোটেও বিশ্বাস হয়না রাহিতার। সে বুঝে দীপ্ত ওর থেকে কিছু লুকোতে চাইছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সহজ হতে পারছেনা। তাই কিছু একটা ভেবে রাহিতা ওর সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করে। নম্র মুখে বলে,
—আচ্ছা, এসব বাদ দিন। আপনাদের সম্পর্কে ঠিকমতো কিছু শুনাই তো হলোনা। বিয়ের সময় তাড়াহুড়ায় সবাইকে দেখেছিলাম, এখন আর সঠিক মনে নেই। দুই ভাইবোন না আপনারা?
রাহিতার কথায় এবার নিজ চিন্তাভাবনা ঝেড়ে মাথা নাড়ে দীপ্ত। সেভাবেই বলে,

—হ্যাঁ, আমরা দুই ভাইবোন। আমার ছোটবোন নীতি, ওর-ই বিয়ে। আব্বুরা চার ভাইবোন। আমার এক চাচা ও দুই ফুপি, দিলারা ফুপিসহ। এইতো আমাদের পরিবার! ছোট চাচা অর্থাৎ স্বপ্নিল ভাইয়ের ছোটমামা রাতে আসবে। তখন ওদের সাথে দেখা হবে। এছাড়াও রাতে আরও একজন আত্মীয় আসবেন, সীমা ফুপ্পি। উনি হচ্ছেন…

কথাটা বলেই থেমে গেলো দীপ্ত। হুট করে তার মনে পড়লো কথা বলতে বলতে সে একটু বেশিই বলে ফেলেছে। তাই মুখে কলুপ আটাই শ্রেয় মনে করলো এখন। এদিকে দীপ্তকে চুপ থাকতে দেখে রাহিতা অসন্তুষ্ট হলো। মাত্রই কাংক্ষিত কথাটা শুনতে যাচ্ছিলো এমন সময় দীপ্তর থেমে যাওয়াটা একদমই ভালো লাগলোনা তার। তাইতো অশান্ত গলায় বলে,
—কি হলো? থেমে গেলেন কেন ভাইয়া? বলুন না!
—আসলে ভাবী, আমার না একটা কাজ মনে পড়ে গেছে। আমি এখন আসি?
—আপনিও বাহানা দিয়ে পালাতে চাইছেন, তাইতো?

এবার ধরা পড়ায় মাথা নত করে নীরব দাঁড়িয়ে রয় দীপ্ত। রাহিতাকে এর বিপরীতে কি উত্তর দেবে সে ভেবে পায়না। এদিকে দীপ্তর নীরবতা লক্ষ্য করে রাহিতা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হতাশ গলায় বলে,
—আমি জানিনা আপনারা আমার থেকে কেন সীমা খালামনির বিষয়টা লুকোতে চাইছেন যেখানে একটু পর উনি নিজেই আসবেন এ বাসায়। তখন তো তার সাথে দেখা হবেই তাইনা? তাহলে আমায় আগে বললে সমস্যা কোথায়?

—এমন কিছুই না, ভাবী। কেউ আপনার থেকে কিছু লুকোতে চায়না। আসলে বিষয়টাই এমন যে…
—বিষয়টা যেমনই হোক আমারও তো জানার অধিকার আছে না, ভাইয়া?
রাহিতার প্রশ্নে মাথা নেড়ে সায় দেয় দীপ্ত। মেয়েটা মিথ্যে বলেনি, তার জানার পুরোপুরি অধিকার আছে। তাই সবকিছু ভুলে দীপ্ত সিদ্ধান্ত নেয় সে রাহিতাকে জানাবে সবটা।
—সীমা ফুপি হচ্ছে আব্বুদের ছোট চাচার মেয়ে। দিলারা ফুপির চাচাতো বোন। অর্থাৎ স্বপ্নিল ভাইদের দূরসম্পর্কের খালা।
কথাটা কর্ণগোচর হতেই কিছু একটা মাথায় আসে রাহিতার। মনে মনে কিছু একটার ছক কষে শ্বাসরোধ কণ্ঠে প্রায় তৎক্ষণাত সুধায়,

—আনিকা আপুর মা?
আচমকা রাহিতার এ প্রশ্নে কিছুটা চমকায় দীপ্ত। তবু দ্বিমত করেনা। এক পলক রাহিতার দিক চেয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয়। দীপ্তর সম্মতি পেয়ে এতক্ষণের সব ঘটনা যেন পরিষ্কার জলের ন্যায় স্বচ্ছ হয়ে যায় রাহিতার কাছে। এবার সে বুঝে জনৈক মহিলাকে নিয়ে কেন সবার এত চিন্তা, কেন স্বপ্নিলের এহেন আচরণ!
বেশ কিছুক্ষণ রাহিতাকে চুপ করে থাকতে দেখে দীপ্ত গলা ঝেড়ে বলে,

—ভাবী কি মন খারাপ করলেন? আসলে আমাদেরও মনে হচ্ছিলো এমনটাই হবে। তাইতো আপনাকে এ ব্যাপারে বলিনি কেউ।
—না না, আমার মন খারাপ কেন হবে? সবটা তো আগে থেকেই জানি। শুধু চিনিতাম না কাউকে। আজ চিনেও যাবো!
মলিন হেসে বলে রাহিতা। ওর মুখ দেখে মায়া হয় দীপ্তের। কি সাবলীলভাবেই না বলছে সবটা! কোনোকিছু হারিয়ে গেলে তার বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তা তার চেয়েও উত্তম কিছু দেন মানুষের জীবনে। তেমনটাই হয়েছে স্বপ্নিলের ক্ষেত্রে, সে সত্যিই ভাগ্যবান রাহিতাকে পেয়ে। মনে মনে ভাইয়ের জন্য খুশি হয় দীপ্ত। এরই মাঝে রাহিতা বলে উঠে,

—একটু আগে কি তবে সীমা খালামনির জন্যই দরজার দিকে তাকিয়ে উকি দিচ্ছিলেন?
—তখন? আরে নাহ! ওটা তো স্বপ্নিল ভাই আসছে কিনা দেখার জন্য উকি দিলাম। দিলারা ফুপি পাঠিয়ে দিলো ভাইয়া আসছে কিনা দেখার জন্য। একেতো সীমা ফুপির আসার কথা শুনেই ভাইয়ের মুড বিগড়ে গেছে। তাই তার সাথে দেখা হওয়ার আগে ভাইয়ের সাথে কথা বলতে চাইছিলেন ফুপি।
সবটা যেন বুঝে রাহিতা সেভাবে মাথা নাড়ায়। প্রসঙ্গ বদলাতে মুখে ফের হাসি টেনে জিজ্ঞেস করে,

—এতকিছু জানা হলো তবু আপনার সম্পর্কেই তো ঠিকমতো জানা হলোনা, ভাইয়া। আপনি কিসে পড়েন? মানে এখনো পড়াশোনা করছেন নাকি চাকরি?
—সব ঠিক থাকলে আমি গ্রাজুয়েশন করবো এ বছর। এরপর চাকরিতে ঢুকে যাবো।
—ওহ। সে হিসেবে তো আমি আপনার জুনিয়র। আমি সেকেন্ড ইয়ারে মাত্র। আপনি আমায় আপনি করে বলছেন শুনতে কেমন জানি লাগছে।
মাথা চুলকে বললো রাহিতা। ওর কথায় হেসে ফেললো দীপ্ত। চোখেমুখে অভিব্যক্তি এনে বললো,

—আপনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কে বড়। সে হিসেবে আপনি করে বলছি। স্বপ্নিল ভাই সম্পর্ক ও বয়সে আমার বড় এবং আমার প্রিয় এক কাজিন। সে হিসেবে আপনাকে ভাবী হিসেবে “আপনি” বলে ডাকাটাই আমার কাছে সম্মানের।
দীপ্তর কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে মাথা নাড়লো রাহিতা। ছেলেটা সত্যিই সম্পর্কের সম্মান করতে জানে। রাহিতার ভাবনার মাঝেই দীপ্ত বললো,

—সীমা ফুপি কিন্তু খুব সাংঘাতিক মানুষ। ছুরির মতো ধারালো জবান তার। আগেই সাবধান করে দিচ্ছি, তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন। হয়তো অনেককিছুই বলবে, মেয়ে মারা যাওয়ার বেশিদিন হয়নি কিনা? তাই মনে কস্ট নিবেন না তার কথায়।
কথাগুলো বলা শেষ হতেই দীপ্তর মা ডাকলো তাকে। রাহিতার থেকে বিদায় নিয়ে মায়ের ডাকে সে চলে গেলো। পেছনে ফেলে গেলো এক চিন্তিত রাহিতাকে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ৮টা পার হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। একটু আগেই বাসায় এসেছে স্বপ্নিলের ছোটমামা ও তার পরিবার। তাদের সাথে কথাবার্তা বলে ভালোই সময় কাটছিলো রাহিতার, এমন সময় এক পুরু কণ্ঠের মেয়েলি গলা শুনতে পেলো সবাই। দরজার দিকে চোখ পড়তেই শাশুড়ির বয়সী এক মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাহিতা। না চিনেও সে বুঝে এটাই তার কাংক্ষিত বিপদের আগমন! এরই মাঝে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে মহিলা। খানিকবাদে কিছুদূর বসে থাকা দিলারা বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,

—এতদিন পর তোর দেখা পেলাম। আজকাল নাকি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছিস। ছেলের বিয়ে হতে না হতেই এই হাল হলে তবে তো বাকি দিন পড়েই আছে!
তার কথায় বিস্মিত হলো রাহিতা। এভাবে কথা বলছে কেন তার শাশুড়ীর সাথে? বুঝাই যাচ্ছে স্বপ্নিলের বিয়ে নিয়ে এক চাপা ক্ষো’ভ জন্মে আছে মহিলার মনে, যেটার রাগ ঝাড়তেই এ অবেলায় আগমন তার। তবে দিলারা বেগমকে রাহিতার মতো এতটা বিচলিত হতে দেখা গেলোনা। তিনিও বোনের মতো করেই জবাব দিলেন নির্দ্বিধায়,

—এমন করে বলছিস যেন নিজে খুব খবর নিয়েছিলি এতদিন আমার? তোর নিজেরই কোনো খবর নাই আবার আমায় জিগাস।
দিলারার কথায় কিঞ্চিৎ অপমানিত বোধ করলেও তা গায়ে মাখলোনা সীমা। বরং তার চেহারা ও কণ্ঠে দেখা মিললো তাচ্ছিল্যতার! কথায় কথায় বলে উঠলেন,

—তো এতদিন পর যখন এলি তখন ছেলের বউকে আনিসনি সাথে? কোথায় সে? আমাদেরও দেখা!
—আলবত এনেছি। বিয়ের পর শশুড়বাড়ির প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে সে আসবেনা এটা কি হতে পারে নাকি? এই রাহি, সামনে আয় তো মা। তোর খালাশাশুড়ির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।

হুট করে শাশুড়ির কথায় চমকে উঠে রাহিতা। এতক্ষণ যেটা শুনার অপেক্ষা করছিলো সেটা কর্ণপাত হতেই অজানা আশংকায় বুকটা ধক করে উঠে তার! খানিকটা শংকা ও ভয় নিয়ে মৃদু পায়ে এগিয়ে যায় সীমা খালার সামনে। রাহিতা আসা মাত্রই ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষে’প করেন সীমা বেগম। যেন এতক্ষণ ওর অপেক্ষাতেই ছিলেন! তীর্যক চাহনিতে রাহিতাকে পা থেকে মাথা অব্দি পর্যবেক্ষণ চলে কিছুক্ষণ! দুরুদুরু বুকে তার হাবভাব লক্ষ্য করে ঘামতে থাকে রাহিতা। স্বপ্নিল ও দীপ্তর সতর্কবার্তা থেকে থেকে ভাসে কানে!

মন বিনিময় পর্ব ২৪

এদিকে স্বপ্নিলটাও এতক্ষণে বাড়ি ফিরলোনা, অন্যদিকে সীমা বেগম পৌঁছে গেছেন বাসায়। তার অগোচরে না জানি কতকিছুই শুনতে হবে রাহিতার আজ! হাসফাস করতে থাকা হৃদয়ে মেয়েটা এক বড়সড় ঢোক গিলে!

মন বিনিময় পর্ব ২৫