মম চিত্তে পর্ব ১৪

মম চিত্তে পর্ব ১৪
সাহেদা আক্তার

ফেরদৌসী শর্তের কথা জানতে চাইলেন। মম বলল, আমার দুটো শর্ত। প্রথম শর্ত হচ্ছে ঘরোয়াভাবে বিয়ে হতে হবে। বাইরের কাউকে বিয়ের ব্যাপারে জানানো যাবে না। আমি চাই না সবাই এটা বলুক যে অফিসে জয়েন করেই অফিসের বসকে হাত করেছে। কথার অনেক হাত পা গজায়। আর দ্বিতীয় শর্ত হলো আব্বু সুস্থ হওয়া পর্যন্ত আমি আব্বুর সাথে থাকবো। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে হেসে বললেন, বেশ। তবে সারাজীবন তো এই দুই শর্ত মানা যাবে না। এক সময় তো সবাই জানবে।

– অন্তত তিন মাস।
– আচ্ছা। আমি সবাইকে বলে দেবো। এখন বলো শাড়ি গয়না কেমন লেগেছে। এগুলোয় হবে?
– জ্বি। ঘরোয়া বিয়েতে এত বেশি সাজের তো প্রয়োজন হবে না।
– ওমা! আমার ছেলে দেখবে না ওর বউকে কেমন লাগে বিয়ের সাজে!
মম লজ্জা পেল। তিনি মমকে নিয়ে এসে বসলেন কেবিনের ভেতর। রায়হান সাহেব তাঁদের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে পারলেন না৷ ভয়ে ভয়ে আছেন বিয়েটা হবে কি না। রাকিব হাসান বললেন, বিয়ের ডেটটা ঠিক করবেন কবে? কথাটা শুনে রায়হান সাহেবের বুক থেকে একটা বড় পাথর নামল। তাহলে বিয়েটা হচ্ছে। তিনি বললেন, ভালো কাজ যত তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যায়৷
– তাহলে আগামী শুক্রবার?
– আমার কোনো আপত্তি নেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মম চুপ করে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে পারল না রায়হান সাহেবের কথা ভেবে। সবাই সবার মতো গল্প করছে। ও একটু পর বেরিয়ে এল বাইরে। বসল কেবিনের বাইরের চেয়ারগুলোয়। যদিও শর্তে রাজি হয়েছেন তবুও ভেতরে অস্বস্তি লাগছে। বিয়ের কথা বলছে মানে রিয়ান রাজি বিয়েতে। ও কি সব জেনে পছন্দ করেছে!? নাকি রনকের মতো সবার চাপে পড়ে বিয়েটা করতে চাইছে? তাছাড়া ফারিজা যে বলল ও রিয়ানের হবু বউ এটা কতটুকু সত্যি!? সবাই রায়হান সাহেবের কাছে আছে দেখে মম বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে।
রিয়ান ওর রুমে বসে আছে। মম ব্যাগ রেখে সোজা ওর রুমে রওনা দিল। কথা বলা দরকার। রুমের কাছে আসতেই ফারিজা বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। ওকে বলল, কোথায় যাচ্ছো? মম প্রতিউত্তরে বলল, দেখতেই তো পাচ্ছেন স্যারের রুমের দিকে যাচ্ছি। মম এগিয়ে যেতে লাগলে ফারিজা আবার বাঁধা দিয়ে বলল, যাওয়া যাবে না।

– কেন?
– তোমার এক্সেস নেই।
– কে বলেছে আমার এক্সেস নেই? ক’দিন আগেও তো…
– ক’দিন আগের কথা চলে গেছে। এখন তোমার প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
– তাই? লেট মি সি।

মম তার কার্ড দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল আসলেই মেশিনে নট এলাউড দেখাচ্ছে। ওর ব্যাপারটা বেশ বিরক্ত লাগল। ফোন বের করে রিয়ানের নাম্বার খুঁজে নিল। হুট করেই একদিন ওর নাম্বারে ফোন দিয়ে কথা বলেছিল ওর সাথে। রায়হান সাহেবের খবর নিয়ে বলেছিল সাহায্য লাগলে এই নাম্বারে ফোন করে জানাতে। তখনই সেভ করেছিল।
ফোন দিয়ে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল মম৷ কাচের দেয়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরে রিয়ান একটা ফাইলের দিকে ঝুঁকে আছে। ফোন বাজতেই না দেখে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিয়ে বলল, হ্যালো, মি. রিয়ান বলছি।
– ফোন রিসিভ করার আগে যে কে ফোন দিয়েছে তা দেখতে হয় জানা নেই?
– ওহ, সরি সরি। হ্যাঁ বলুন মিস মম।

মম চাপা গলায় বলল, মিস থেকে যখন মিসেস করছেন তো দরজায় এক্সেস বন্ধ করেছেন কেন? রিয়ান বলল, আপনার তো এক্সেস আছে। মম বাইরে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, যদি থাকে আমি কি সাধে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি? রিয়ান বাইরে তাকিয়ে দেখল মম ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ও দ্রুত কম্পিউটারে এক্সেস প্রোগ্রামে ওর নাম ইন্ট্রি করে বলল, আসুন ভেতরে। মম আবার মেশিনে কার্ড দিতে লাগলে ফারিজা বলল, যাকেই ফোন দাও না কেন ভেতরে এক্সেস করতে পারবে না। ও কার্ড দিতে যখন দরজা খুলে গেল তখন ফারিজার দিকে ফিরে বলল, যেখানে মালিক এক্সেস দিয়েছে সেখানে অন্য কাউকে ফোন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বলে মম ভেতরে চলে গেল।
চেয়ারের কাছে আসতে রিয়ান বলল, বসুন। মম চেয়ারে বসে বলল, বিয়ের আগেই রুমে ঢোকার অনুমতি বন্ধ করে দিয়েছেন!? বিয়ের পর কি করবেন? রিয়ান হাতের ফাইল টেবিলে রেখে বলল, আমি এক্সেস বন্ধ করিনি।
– তাহলে বলতে চাইছেন আপনার কম্পিউটার নিজে নিজে কাজ করে?
– তা নয়। মনে হচ্ছে কেউ আমার কম্পিউটারে হাত দিয়েছে। আচ্ছা, আমি দেখছি। বাই দ্যা ওয়ে, ফোনে যে বললেন মিস থেকে মিসেস করছি বলতে কি বোঝালেন?

– আপনার বাবা মা আমাদের বিয়ের ডেট ফাইনাল করেছেন।
– আপনি তো বিয়েতে রাজি নয়। বলেননি কেন? আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি এখুনি ফোন দিয়ে বলছি।
রিয়ান ফোনে হাত দিতেই মম বাঁধা দিয়ে বলল, অনেক কিছু ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়। তা আপনি বলুন তো একজন ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি কেন হলেন? ও চুপ করে রইল। মম যে ডিভোর্সি এটা ওর জানা ছিল না। ওকে চুপ থাকতে দেখে বলল, জানতেন না তো আমি ডিভোর্সি? একমাস অন্যের ঘরে ছিলাম। তার পরকিয়া সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছে। এবার আপনি সিদ্ধান্তে নিন। মম উঠে যাচ্ছিল ; রিয়ান বলে উঠল, আমি আপনাকে যেতে বলিনি মিস মম। মম ওর দিকে তাকাল। মুখ কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। মমও চুপ করে বসে রইল ওর দিকে তাকিয়ে।

– আপনি কি বিয়েটা ভাঙার জন্য ডিভোর্সের ব্যাপারটা সামনে আনলেন?
– আপনার তাই মনে হচ্ছে? আমার তো তা মনে হচ্ছে না। এখানে কেবল আমি বিয়ে করছি না। আপনিও করছেন। আপনার জানাটাও জরুরি। সমাজে ডিভোর্স শব্দটা মেয়ের জীবনে একটা কালো ক্ষতের মতো। যা সারাজীবনেও ভালো করা যায় না। ডিভোর্সি জানলে ছেলেরা একশ কদম পিছিয়ে যায় বিয়ে থেকে। তাই জানতে এসেছিলাম আপনি কেন রাজি হলেন।
– আমার দাদি কখনো কারো জন্য খারাপ কিছু পছন্দ করেনি। তাই আমার বিশ্বাস আপনিও তেমন হবেন।
– তাই বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন!?
– আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে মিস মম।

হঠাৎ রিয়ানের এমন কথা মম আশা করেনি। কি আশা করেছিল তাও বেমালুম ভুলে গেল এই কথাটার পর। কি বলবে কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে রইল ওর দিকে। রিয়ান হেসে বলল, এর থেকে বড় কারণ আর কি হতে পারে বিয়েতে রাজি হওয়ার? মম প্রতিউত্তরে কিছু খুঁজে পেল না। বাইরে ফারিজা উঁকিঝুঁকি মারছে এবং সেটা মমর চোখে পড়তে রিয়ানকে জিজ্ঞেস করল, মিস ফারিজার ব্যাপারে কি ভাবেন?
– ওর ব্যাপারে কি ভাববো? ওর এককালে আমার ভার্সিটিতে ক্লাসমেট ছিল। ভার্সিটি লাইফ শেষ হওয়ার পর এই অফিসে এপ্লাই করল আমার পিএ পোস্টের জন্য। হয়েও গেল। ভালোই কাজ করে মেয়েটা।
– এর বাইরে আর কিছু নেই?

রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আর কি থাকবে? মম বলল, কিছু না। মনে মনে বলল, মিথ্যা কথা ভালোই রটাতে পারো মিস ফারিজা। একটা ছোট শাস্তি তো তোমার প্রাপ্য মিথ্যার জন্য। ফারিজা তখনো বাইরে থেকে দেখছে ওদের। মম হঠাৎ উঠে গিয়ে রিয়ানের চেয়ারটা ঘুরিয়ে চেয়ারের দুই হাতলে হাত রেখে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগে রিয়ানের ডান গালে একটা কিস করে বসল। ওর এমন আচরণে কিছুটা অবাক হয়ে গেল রিয়ান। মম উঠে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে বলল, সবকিছুর একটা কারণ থাকে। বলে লজ্জায় বেরিয়ে গেল।
বাইরে এসে ফারিজার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। তখনো ওর লজ্জায় কান লাল হয়ে আছে। মম কিছু না বলে নিজের টেবিলের দিকে রওনা দিল। ফারিজা যে রাগে কাঁপছিল সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল। কিন্তু পাত্তা দিল না। এটা একটা ছোট শাস্তি মাত্র। কাউকে ভালোবাসলে তাঁকে নিজের কাছে রাখার জন্য মিথ্যা রটনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত? ভাগ্যে না থাকলে কি সত্যিই জোর করে ভালাোবাসার মানুষকে পাওয়া যায়?

মম টেবিলে বসতে তৌসিফা জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস? মম কম্পিউটার ওপেন করতে করতে বলল, ভালো। আচ্ছা কালকে যে রিপোর্টটা করতে বলেছিল মিটিংয়ে করেছো? আমার লাগবে কাগজগুলো। তৌসিফা ওকে রিপোর্ট বুঝিয়ে দিতে লাগল। মম মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছিল। তাই খেয়াল করেনি ফারিজা প্রায় বিশটার মতো ফাইল এনে ওর টেবিলে সজোরে রাখল। দুইজনে শব্দ শুনে ওর দিকে তাকাল। ফারিজা নকল হাসি দিয়ে বলল, এই ফাইলগুলো শেষ করো আর আমাকে রিপোর্ট জমা দাও আজকের মধ্যে। আর যে স্বপ্ন দেখছো সেই স্বপ্ন ভুলে যাও। তোমাকে যাতে স্যারের আশেপাশে না দেখি। না হলে এই চাকরি তোমার আর করা হবে না। বলে ফারিজা চলে গেল। তৌসিফা কিছু না বুঝে মমকে জিজ্ঞেস করল, কি হলো বলো তো!? মম ফাইলগুলো দেখতে দেখতে বলল, হিংসেতে জ্বলছে। পোড়া গন্ধ পাওনি? তৌসিফা ওর কথায় মুখ চেপে হাসতে লাগল। মম ফাইল গুলো দেখা শেষ করে বলল, এগুলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফাইল না। অযথা দিয়ে গেল। এইগুলোর কোনো কাজই নেই এখন। শুধু শুধু আমার টেবিলটা জ্যাম করলো। মম একটা চেয়ার এনে তাতে ফাইলগুলো রেখে নিজের কাজ করতে লাগল।

দুপুরে রিয়ানের রুম থেকে ডাক পড়ল। মম কি করবে বুঝতে পারল না। ওর সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। লজ্জায় ডুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কি ভেবে যে কাজটা করল! মাথায় যা এসেছিল তা করে এখন পস্তাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে কাজ করতে লাগল আর নিজে নিজে বিড়বিড় করতে লাগল। সবাই খেতে চলে গেছে আরো দশ পনের মিনিট আগে। ও একলা বসে কাজ করতে লাগল। কাঁধে কারো অস্বস্তিকর স্পর্শ পেয়ে চেয়ার সরিয়ে তাকিয়ে দেখল রাসেল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। মমর ভেতরে ভেতরে মেজাজ খারাপ হলেও বাইরে বলল, কিছু বলবেন?
– খেতে যাবে না?
– জ্বি কাজ শেষ করে।
– তাহলে তো দেরি হয়ে যাবে। চলো আজকে আমার পক্ষ থেকে তোমার ট্রিট।

মম একটা ফাইল হাতে নিয়ে বলল, সরি, স্যার আমাকে ডেকেছিল। ভুলে গিয়েছিলাম। আসি। ও সরে চলে এল রিয়ানের রুমে সামনে। রাসেলের কথা বলবে কি না ভাবতে ভাবতে রিয়ানের রুমে প্রবেশ করল। ঢুকে রিয়ানের দিকে তাকাতে আবার তখনের কথা মনে পড়ল। রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, এতক্ষণে আসার সময় হলো? কখন লাঞ্চ নিয়ে বসে আছি! এসো, বসো। মম নিচের দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসল। রিয়ানের টোল পড়া হাসিতে ও লজ্জায় আগা গোড়া লাল হয়ে গেল। ওর কোনো রেসপন্স না দেখে রিয়ান বলল, আমি কি খাবার বেড়ে দেবো?
– না না না। আ…আমি দিচ্ছি।

মম চিত্তে পর্ব ১৩

মম প্লেট টেনে নিয়ে খাবার বেড়ে রিয়ানকে দিল। রিয়ান আবার হেসে বলল, আমি তো আপনার কথা বলেছিলাম আর আপনি আমাকে খাবার বেড়ে দিলেন? এখন থেকে প্র্যাকটিস করছেন? গুড গুড। মমর কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগল। রিয়ান আবার বলল, চামুচগুলো দিন তো। মম অন্যদিকে তাকিয়ে এগিয়ে দিল। ও চামুচ নিয়ে খাওয়া শুরু করে বলল, আপনাকে লজ্জা পেলে ভালোই লাগে দেখতে। মম খাবারটা বেড়ে মাত্র খাওয়া শুরু করছিল। ওর কথা শুনে বাম হাত দিয়ে জামা খামচে ধরে বলল, আপনি কি আমাকে খেতে দেবেন না আমি উঠে যাবো?

মম চিত্তে পর্ব ১৫