মায়াবতী সিজন ২ পর্ব ১২

মায়াবতী সিজন ২ পর্ব ১২
তানিশা সুলতানা

কলেজ ড্রেস পড়েছে তন্নি৷ সুন্দর করে হিজাব বেঁধে দিয়েছে তন্নির ছোট মামি সাথী। গতকাল আনোয়ারের দেওয়া নাক ফুল পড়ানো হয়েছে তন্নি। চিকন স্বর্নের দুটো চুড়ি দুই হাতে। বিবাহিত মহিলাদের না কি সব সময় এসব বহন করতে হয়। গলায় চেইনও দিয়েছিলো তন্নি রাখে নি। মোটা ভাড়ি একটা চেইন এনেছিলো। সেটা সব সময় পড়তে তন্নির অসুবিধা হবে। অথৈ বুঝতে পেরে বাবাকে বুঝিয়েছে। অর্ণব মনে মনে ভেবেছে চেইনটা সেই কিনে দিবে তন্নিকে।

কলেজে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি রেডি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে তন্নি। এতোবড় আয়নায় নিজেকে কখনো দেখা হয় নি। বাড়িতে তো ওই ছোট্ট ভাঙা একটা আয়না ছিলো। যেটাতে পুরো মুখ এক সাথে দেখা যেতো না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়নার পেছন বরাবর মায়ার বিশাল বড় একটা ছবি টাঙানো৷ ছবি মায়া খিল খিল করে হাসছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে কিশোরী বয়সের ছবিখানা৷ তন্নি মাকে দেখতে থাকে। একবার মাকে দেখছে আবার নিজেকে দেখছে। একদম মায়ের মতো তার চেহারা। যেনো মায়ার ফটোকপি।

মায়ের চেহারা পেয়েছে বলেই কি নানু চোখের আড়াল করতে চায় না? নানাভাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মামারা এলটু পরপরই মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তন্নি বেশ বুঝতে পারছে এই মানুষগুলো তার মাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। কিন্তু মা এই মানুষ গুলোকে কষ্ট দিয়ে পালিয়েছিলো। এই মুহুর্তে তন্নির মন বলছে “মা ভুল করেছিলো। খুব ভুল করেছিলো”

তারেক বিয়ে করেছে বলে তন্নির এটা মনে হচ্ছে না। কিন্তু মানুষের মুখে শুনেছে চিকিৎসা বিনে মারা গেছে মায়া। বাবার না হয় টাকা ছিলো না কিন্তু তিনি তো নানাদের সাহায্য নিতে পারতো।
আত্নসম্মানের জোরে এমনটা করে নি। এটা ভুল। কারণ আত্মসম্মান প্রখর হলে এই বাড়ির ওয়ারিশ নিতে চাইতো না।
তন্নির এসব ভাবনার মাঝে মমতা লাঠিতে ভর দিয়ে তন্নির রুমে ঢুকে

“বোনু রে খাইবা না?
তন্নি মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে নানুকে ধরে
” খাবো। তুমি খেয়েছো?
মমতা তন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়
“খামু তোমার লগে।
আইসো
তোমার নানা আর মামারাও বইসা আছে।

তন্নি নানুর হাত ধরে খাবার রুমে যায়। সত্যিই সকলে বসে আছে তন্নির জন্য। সাগর সকলের আড়ালে কখনো কখনো একটু ডিম ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে পুরছে।
বড় মামার একটা ছেলেই। আর ছোট মামার দুই ছেলে। দুজন টুইন। ছোট্ট ছোট্ট সবে হাঁটা শিখেছে।

তন্নি গিয়ে নানার পাশে বসে। আব্দুল্লাহ নিজে হাতে তন্নিকে খাবার বেরে দেয়। তন্নি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
এতো ভালোবাসা এতো যত্ন তার কপালে ছিলো? আগে কেনো এই সুখের রাজ্যে সে পা রাখতে পারে নি?
সাগরের বাইকে কলেজে যাচ্ছে তন্নি। সাগরকে বেস্ট ভাইয়ের কাতারে ফেললে মন্দ হবে না। ভাইরা এমনই হয়?
বাইকে ওঠার আগে সাগরের আবদার

” বোনু একটা সেলফি তুলি? তোর সাথে তো আমার একটাও পিক নেই।
তন্নি মাথা নেরে সম্মতি দেয়। পাক্কা ২০ টা পিকচার তুলে৷
কলেজে ঢুকতেই দেখতে পায় অথৈকে। সে তার ভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। অথৈয়ের ব্যাগ অর্ণবের কাঁধে। অথৈয়ের জুতো অর্ণবের হাতে। অথৈয়ের হেয়ার ব্যান্ড অর্ণবের মাথায়।
তন্নি হাসে। বোনের ক্ষেত্রে অর্ণব পৃথিবীর সব থেকে ধৈর্যশীল ব্যক্তি৷

তন্নিকে দেখতে পেয়ে অথৈ একে একে অর্ণবের থেকে সব কিছু নিয়ে নেয়। তারপর অর্ণবের এলোমেলো চুলগুলোও ঠিক করে দেয়। সাগর গালে হাত দিয়ে দেখছে অথৈকে। এই মেয়ে তার এলোমেলো চুল কবে ঠিক করে দেবে?
তন্নি নেমে গেছে অনেকখন আগেই। সে অথৈয়ের সাথে গল্পে মজেছে৷ আর সাগর মজে আছে অথৈয়ের ঠোঁটে। কিন্তু সুন্দর ঠোঁট নারিয়ে কথা বলে মেয়েটা। কখনো ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে হেসে উঠছে।

হঠাৎ সাগর অনুভব করে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে চট করে হেলমেট খুলে শুকনো ঢোক গিলে। এলোমেলো চুল গুলো বা হাতে ঠিক করে এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেরায়।
“কি রে ক্লাসে যাবি না?
অর্ণনের কথায় সাগর অপ্রস্তুত হাসে
” জ্বী ভাইয়া যাবো। আপনাদের ক্লাস নেই?

অর্ণব এক পলক তাকায় তন্নির দিকে। তারপর জবাব দেয়
“আজকের ক্লাস ক্যান্সেল। বউ আবদার করেছে তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে। তো ক্লাসে যাই কি করে।
অর্ণবের কথা শুনে তন্নির চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায়। সে কখন আবদার করলো?
অথৈ কোমরে হাত দিয়ে অর্ণবের দিকে তৃক্ষ দৃষ্টিতে তাকায়

“তুই নিজের দোষ আমার বন্ধুর ঘাড়ে দিবি না।
অর্ণবও দারুণ তেজে বলে
” তুই ও আমার আর আমার বউয়ের মাঝখানে আসবি না।
“বউ পরে আগে ও আমার জান। আমি বললে তন্নি তোকে তালাক দিয়ে দিবে।
অর্ণব হাল ছেড়ে দেয়। দুই কানে হাত দিয়ে অথৈকে বলে
” আমার ভুল হয়ে গেছে আমাকে ক্ষমা করে দিন।

আমি আমার বউকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চাচ্ছি। বউ রাজি না। চুমু দেওয়ার লোভ দেখিয়ে রাজি করিয়েছি।
তন্নি শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে ফেলে। মনে মনে কয়েকবার অর্ণবকে অসভ্য বলে গালিও দিয়ে ফেলে।
অথৈ মুখ টিপে হাসে। সাগর বেশ লজ্জা পেয়েছে। বোন হয় তো।
“আমি যাচ্ছি ভাই।

সাগর হেলমেট পড়ে আরও একবার তাকায় অথৈয়ের দিকে। তারপর বাইক নিয়ে চলে যায়।
অথৈ তন্নির হাত ধরে
“ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
” মায়াবতী এই কাবাডের হাড্ডিকে ওয়াশরুমে লক করে তাড়াতাড়ি চলে এসো কেমন? তোমার অনির পাপা তোমাকে না দেখে বেশিখন থাকতে পারবে না৷

তন্নি দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায়। লোকটা সাংঘাতিক। এই লোকটার কথাবার্তায় কবে জানি তন্নি হার্ট অ্যাটাক করে বসবে৷
তিনটা ক্লাস শেষ হতেই তন্নিকে বের করে দেয় অথৈ। আর দুটো ক্লাস হবে। তারপরই অথৈ যাবে। তন্নি অথৈকে সাথে যাওয়ার জন্য জোর করেছিলো। অথৈ যাবে না।
তন্নি যখন কাদো কাদো হয়ে অথৈকে বললো
“তোর ভাই আমাকে লজ্জা দিতে দিতে মেরেই ফেলবে”

নিলজ্জ ভাইয়ের নিলজ্জ বোন তখন এক গাল হেসে জবাব দিলো “এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে। ভাইয়ার সাথে তাল মিলাবি। তাতেও তোদের রোমাঞ্চ জমে ক্ষীর হয়ে যাবে আর আমি তাড়াতাড়ি ফুপি হয়ে যাবো”
হতদম্ভ হয়ে যাওয়া তন্নি অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বেরিয়ে এসেছে ক্লাস রুম থেকে।
গেইটের কাছে আসতেই দেখা মিলে দ্যা গ্রেট অসভ্য অর্ণব চৌধুরীর। তিনি চোখে রোদ চশমা পড়ে গাড়ির দরজা খুলে তাতে ভর দিয়ে ফোনে কথা বলছে।

তন্নি ভেবে পায় না এভাবে রোদে দাঁড়িয়ে থাকার কি হলো? গাড়িতে বসলেই তো পারতো।
তন্নি চুপচাপ অর্ণবের সামনে এসে দাঁড়ায়।
অর্ণব তন্নিকে দেখেই
“ঠিক আছে ভাই জমিয়ে রোমাঞ্চ করবি। খাট ভাঙতে না পারলে কাল সকালে সুইসাইড করে ফেলিস। তোর বেঁচে থাকার কোনে অধিকার নেই।
বলেই ফোন কেটে দেয় অর্ণব৷ তন্নি হাসফাস করতে থাকে।
অর্ণব সরে দাঁড়ায় তন্নি বসে পড়ে। অর্ণবও ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে

” আর বলো না
আমার বন্ধু বিয়ে করেছে আজকে। আজকেই তাদের ফুলসজ্জা। তাই একটু টিপস দিলাম।
তন্নি জবাব দেয় না। তবে বিরবির করে বলে “হুহহহ নিজে মনে হয় ফুলসজ্জার ওপর পিএইচডি করে ফেলেছে”
তন্নির বিরবির শুনে ফেলে অর্ণব। সে তন্নির দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে

“মনে মনে পিএইচডি করে বারোটা বাচ্চার বাপ হয়ে গেছি।
তন্নি চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে কাচুমাচু হয়ে বসে। অর্ণব তন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। আস্তে করে সিট বেল্ট বেঁধে দিয়ে তন্নির মুখে ফু দিয়ে।
তন্নি কেঁপে ওঠে। আরও একটু কাচুমাচু হয়ে যায়। নিঃশ্বাস আটকে ফেলেছে মেয়েটা।
আগেই জানতো এমনটা হবে। তাই তো অথৈকে আনতে চেয়েছিলো।
নিজের কাছাকাছি অর্ণবের অস্তিত্ব না পেয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে তন্নি। অর্ণবকে নিজের সিটে দেখে প্রাণ ভরে শ্বাস টানে।

অর্ণব তন্নিকে জোরে জোরে শ্বাস টানতে দেখে বলে ওঠে
” মায়াবতী তুমিও না
খালি আজেবাজে চিন্তা করো। আমি একটা মাসুম বাচ্চা ছেলে। আমাকে নিজে বাজে চিন্তা করে আমার চরিত্রে কালি লাগিয়ে দিচ্ছো। ছিহহ ছিহহহ

মায়াবতী সিজন ২ পর্ব ১১

লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।
তন্নি অর্ণবের কথা শুনে রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছে৷ হা করে তাকিয়ে আছে অর্ণবের দিকে।

মায়াবতী সিজন ২ পর্ব ১৩