যদি তুমি বলো পর্ব ৩০

যদি তুমি বলো পর্ব ৩০
আফনান লারা

ঔষুধটা ছিল তিথির স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য।ছোট থেকেই ওর স্মৃতিতে সমস্যা। নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা,কথা সে ভুলে যায়।একেবারেই ভুলে যায়।ইশান ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে আর তাই সে এই ঔষুধটা আনিয়েছে।
তিথি ভেবেছে অন্য কিছু তাই তো সে ফেলে দিলো।
ইশান ওকে নিয়ে বাসায় ফিরতেই দুজনে দেখে সোফায় মা আর তামিয়া বসা।তিথি ভাবলো সে এখন ঝাড়ি খাবে কিন্তু মা তাকে ঝাড়ি না দিয়ে চুপ করে ছিলেন।ইশান তখন তিথির পিঠে চিমটি দিয়ে আস্তে করে বললো মায়ের পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসতে।

তিথিও তাই করে।কিন্তু বসতে গিয়ে তার অনেক ভয় হচ্ছিলো।
তামিয়া ঘুরে এসে তিথির পাশে বসলো।এখন তিথি মাঝখানে আর দু পাশে মা আর তামিয়া।
কেউ কিছু বলছেনা।ইশান ও তার রুমে চলে গেছে।মা অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর বললেন,’আমাদের সাথে সংয়ের মতন বসে না থেকে নিজের জামাইয়ের কাছে যাও।তার কি লাগবে দেখো।আর হ্যাঁ!বিদেশে গিয়ে আমার ছেলেকে জ্বালাতন করবেনা একদম।ও যা বলবে শুনবে। সে তো আর তোমায় গিলে ফেলবেনা!’
তিথি বিড়বিড় করে বললো,’গিলেই ফেলবে।যে দামড়া ছেলে আপনার!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

‘কিছু বললে?’
‘নাহ তো’
‘বিড়বিড় আমার পছন্দ না,তার পরেও তুমি যেটা বললে তা আমি শুনে ফেলেছি।ছেলেরা তো দামড়াই হয়!সে যাই হোক।ওখানে গিয়ে ঘাউড়ামি করবেনা।তোমার তো আবার ঘাউড়ামি করার স্বভাব!এখন যাও ইশানের কাছে,ওর কিছু কাজ বাকি ছিল।তুমি আসতে দেরি করছো বলে ও তোমায় আনতে গেছে।কতবার করে বলেছি ড্রাইভারকে পাঠা,তোর যেতে হবেনা।
কে শোনে কার কথা!ওনার বউকে তো ড্রাইভার একা পেয়ে চুমু খাবে!কেমন বউ ওনার!মুখের নাই ছিরি!’

তিথি হা করে ইশানের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।সিনেমার শাশুড়িদের মতন কথা বলছে আন্টি।তবে একটা কথা ঠিক বলছে তার মুখের আসলেই কোনো ছিরি নাই।
এরপর তিথি যাবার সময় দাঁত কেলিয়ে বলে গেলো,’মুখের ছিরি নাই দেখেই আপনার ছেলে উন্মাদ আমার প্রেমে,ছিরি থাকলে তো এই বংশ ধংস হয়ে যেতো’

এই বলে তিথি দিলো এক দৌড়। মিসেস আরাফাত তেলেবেগুনে জ্বলছেন।তামিয়া এক পাশে মিটমিট করে হাসছিল।
তিথি দৌড়াতে দৌড়াতে রুমে ঢোকার সময় ইশানের সাথে এক ধাক্কা খেলো।ইশান প্রায় পড়েই যাচ্ছিল,কোনোমতে সে দেয়ালটা ধরে দুজনকেই পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচালো।
তিথি ইশানের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’আচ্ছা আমার কি দেখে আপনি এত উন্মাদ হলেন বলবেন?’
‘আমি উন্মাদ? তাও তোর জন্য?’

‘আমি বলিনি, কথাটা শ্রদ্ধেয় শাশুড়ি মা বলেছেন।ছেলে সম্পর্কে ছেলের মায়েরা কোনোদিন মিথ্যা বলেনা।’
ইশান তখন জানতে চাইলো আর কি বলেছে।
তিথি আয়নার কাছে গিয়ে নিজের মুখটা দেখতে দেখতে বললো,’বলেছে আমি অপরুপা সুন্দরী তাই আপনি এত উন্মাদ ‘
‘আমার মা এ কথা বলতেই পারেনা!মায়ের কাছে তুই সুন্দর না’
‘আর আপনার কাছে?’

ইশান কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো।তিথি ব্যাগগুলো খুলে দেখছে কিছু বাদ গেছে কিনা।খুলতেই একটা সুতা তার হাতে পড়লো।সুতাটা চেনা চেনা লাগলো। হঠাৎ মনে আসলো মামির প্রেগন্যান্সির সময় ওনার হাতে ঠিক এরকমই একটা সুতা ছিল।তাহলে এটা ওর ব্যাগে কেন!
সুতাটা সরিয়ে রেখে তিথি অন্য কাজে চলে যায়।ইশান যখন রুমে ফেরে তখন দেখে ঐ সুতাটা টেবিলের উপর বলপয়েন্ট দিয়ে রাখা।

সে প্রচণ্ড রেগে যায়।সুতাটা তুলে ব্যাগে ভরতে ভরতে তিথিকে ডাকে।
তিথি কাঁথা টেনে শুয়ে পড়েছিল,খুব ভোরে ফ্লাইট কিনা।তাই।
ইশান কাছে এসে ওকে ঘুম থেকে তুলে বসালো।
তিথি চোখ ডলতে ডলতে বললো,’কাল যাবেন না নাকি?’
‘তুই এটা সরিয়েছিস কেন?’
‘তো সরাবোনা?আপনি তো বলছিলেন আমাকে কখনও ছুঁবেন ও না।তাহলে ঐ সুতার কাজ কি?’
‘মানে?’

‘ঐ সুতা তো গর্ভবতী নারীরা পরে।আমি গর্ভবতী নাকি কোনোদিন হবো?’
ইশান তিথির হাত ছেড়ে দিলো।তিথি তো ভাল পেঁচে ফেলেছে!
তিথি আবারও শুয়ে পড়ে।
ইশান নিজেও অনেক ক্লান্ত।আজ তার অনেক দখল গেছে।তাই সে তিথির পাশে শুতেই তিথি আবারও উঠে বসে।ইশান ওকে উঠে বসতে দেখে কিছু বললোনা,কিন্তু তিথি বললো,’আপনি কি করতে চাইছেন?’
‘ঘুমাতে চাইছি’

তিথি বালিশটা নিয়ে উঠে পড়লো।সে সোফায় ঘুমাবে।যাওয়াই ধরছিল তখন ইশান বললো ঐ সোফার কভারে অস্বস্তি লাগে।সে নিজেও ঘুমাতে পারেনা ওখানে,তিথিও পারবেনা।
তার পরেও তিথি চেষ্টা করলো,আসলেই ঐ কভারে কিছু একটা সমস্যা আছে।ঘুম কেড়ে নিয়ে যায়।বাধ্য হয়ে ইশানকে ডান বাম থেকে লক্ষ করে তিথি আবার আগের জায়গায় এসে শুয়ে পড়লো।
ইশানের গায়ের তীব্র পারফিউমের গন্ধ এসে নাকে লাগতেই তিথি নড়েচড়ে ওঠে। এ প্রথম সে ইশানের পাশে একসাথে ঘুমাবে।

ভাবতেই তার আর ঘুম আসছেনা,ভয় কাজ করছে।
ইশান মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে,তিথি ওকেই দেখছিল। আগের ইশানের গায়ের রঙ এত উজ্জ্বল ছিল না।কালো কুচকুচে ছিল।মুখে কি এমন লাগিয়েছে!নাকি কোম্পানির নুডুলস খেয়ে এই অবস্থা!
তা হলে তো শুধু মুখ সাদা হতো।সারা শরীর সাদা করছে কেমনে!

তিথি একটু একটু করে হাত বাড়িয়ে ইশানের হাতে ঘষা দিলো।ক্রিম থাকলে উঠে যায় কিনা।
ওমনি ইশান চোখ বন্ধ রেখে বলে ওঠে,’আগের ইশান রোদেপুড়ে বাবার ক্ষেতে ধান বুনতো বলে সারা রঙ কালো কুচকুচে ছিল।শহরে এসে রোদে পোড়া দাগ উঠানোই জন্মের আসল রঙ চলে এসেছে।ঘষে তুলা যাবেনা’
তিথি জিভ কামড়ে হাতটা সরিয়ে ফেলে।ইশান তাকে ধরে উত্তমমধ্যম দেয়নি এই অনেক।তারপর সে ভাবে একটা প্রশ্ন!ইশান এত টাকার মালিক হলো কি করে!

ওর তো কোনো কোটিপতি মামা,চাচা নাই যে ওকে তুলে ধরবে!
কৌতুহল নিয়ে তিথি ইশানকে প্রশ্নটা করে বসে।
ইশান তখন বললো,’একবার কোনো জেদ ধরলে এবার সেটা দেশে হোক কিংবা বিদেশ।তা পূরণ হবেই’
তিথি একটু এগিয়ে বললো,’না মানে কেউ হেল্প না করলে এতদূর নিজ থেকে যাওয়া তো অসম্ভব ‘
‘আমাদের ভিটার জমি বিক্রি করে সবাইকে ভাঁড়া বাসায় রেখে বিদেশ গিয়েছিলাম।’
তিথি চুপ করে থাকলো। তাকে পাবার জন্য ইশান কত কি সেক্রিফাইস করেছে!

তিথি আবারও কি বলার জন্য মুখ খুললো ওমনি ইশান ওর মুখে হাত দিয়ে বললো চুপ করতে এবং ঘুমাতে।
তিথি সোজা হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশান একটা চোখ খুলে ওর দিকে তাকায়।ওর কানের লম্বা চিকন স্বর্ণের দুলটা লেপটে আছে।এই দুলটা ইশান তার আয়ের প্রথম টাকা দিয়ে কিনেছিল।তা বোধহয় তিথি কোনোদিন জানবেনা।
“”””যে পুরুষ নারীকে উন্মাদের মতন ভালবাসে,তার সেই উন্মাদনা সেই নারী কখনওই বোঝেনা,কেউ এসে বুঝিয়ে দিলেও বোঝেনা!

আর যে নারী বোঝে তাকে কোনোদিন কোনো পুরুষ উন্মাদের মতন ভালবাসেনা।””””
ইশানের চোখ বলছে তিথি একবার তাকে জড়িয়ে ধরুক নিজ থেকে,সে অতীতের সব আঘাত ভুলে তাকে কাছে টেনে নিবে।
হঠাৎ ইশানের মনে আসলো মাকে করা তিথির অপমান।এটা তো এত সহজে ভোলার নয়!
ওমনি ইশান উঠে বসে বললো,’উঠ!’

‘ওমা কেন!’
‘বলছি উঠ!’
তিথি তাই উঠে বসলো। ইশান ওর দিকে হাতটা বাড়িয়ে ধরে বললো,’নে হাত টিপ’
‘কেনো?আমি ঘুমাবোনা?’
‘নাহ’

এই বলে ইশান শুয়ে পড়ে।তিথি তখন ওর হাত টিপতে টিপতে বলে আপনার মাকে অপমান করেছি সে কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে বুঝি?’
ইশান কিছু বলেনা কিন্তু মনে মনে ঠিকই হাসছিল।
তিথি হাত টিপতে টিপতে ওর হাতের উপরই ঘুমিয়ে পড়ে।খুব ভোরে ইশানের ফোনে এলার্ম বাজতেই সে জেগে গেলো। চোখ দুটো মেলে দেখে তিথির মুখ।

সেকালে ইশান চাইতো তার প্রতিটা সকাল যেন এই মুখ দেখেই শুরু হয়।তার ইচ্ছাটা থমকে থাকলেও এখন তা পূর্ণতা পেয়েছে।

যদি তুমি বলো পর্ব ২৯

তিথির কপালে হাত দিয়ে সেখানে ঠোঁট ছোঁয়াতে যেতেই তিথি হাত নিয়ে ইশানের চুলের মুঠি ধরে ঘুমের ঘোরে বললো,’আম্মু ঝাড়ু ধরছি শক্ত করে,এইবার দেখো কত সুন্দর করে ঘর ঝাড়ু দিয়ে চকচকা বানিয়ে দিবো।’
এই বলে সে ইশানের চুল টানা শুরু করে।ইশান অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।তারপর তিথির চুলের মুঠি ধরে বললো,’এইবার আমি চকচকা করবো”

যদি তুমি বলো পর্ব ৩১