রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১১

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১১
নবনী নীলা

জিম সরু দৃষ্টিতে পিছনে তাকালো। তারপর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো। স্পৃহা তেজী গলায় বললো,” দেখে হাঁটতে পারেন না।”
জিম দাতে দাঁত চিপে তাকালো। মেয়েটা নিজে ধাক্কা দিয়ে তাকে মেজাজ দেখাচ্ছে। জিম বির বির করে বললো,” স্টুপিড।”

বির বির করে বললেও স্পৃহা স্পষ্ট শুনেছে যে তাকে স্টুপিড বলা হয়েছে। তারপর তেলে বেগুনে চটে গিয়ে বললো,” এই আপনি কাকে স্টুপিড বললেন? হ্যা। কি সমস্যা কি আপনার? নিজে এমন রোবোটিক শরীর নিয়ে হাঁটেন, তো দেখে শুনে হাঁটবেন না? আবার আমাকে স্টুপিড বলছে। আমি স্টুপিড হলে আপনি কি? আপনি হলেন স্টুপিডের উপরের লেভেলের স্টুপিড।” বলেই হনহনিয়ে জিমকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জিম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি আশ্চর্য মেয়ে! শুধু স্টুপিড বলায় পাঁচটা কথা শুনিয়ে দিয়ে গেলো।
স্নিগ্ধা রূমে চুপ চাপ বসে আছে। একটা মানুষ কারোর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকলে কি কোনোভাবে নিজেকে শান্ত রাখা যায়। আদিল রুমে আসার পর থেকেই বুকের কাছে হাত ভাজ করে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা ইচ্ছে করে এমন করছে, তাকে চূড়ান্ত অসস্তিতে ফেলতে চায় সে। স্নিগ্ধা বইয়ের থেকে চোখ সরিয়ে আড় চোখে অভ্রর দিকে তাকালো। অভ্র অদিলের দেখাদেখি এক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। আর কিছুক্ষণ পর পর চোখের পাতা ফেলছে। মানে তাকে কেউ শান্তিতে থাকতে দিবে না। চুপ করে থাকলেও তাকেই জ্বালাবে।

স্নিগ্ধা ফট করে বই বন্ধ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আদিলের দিকে তাকালো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,” এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?”
” তোমার হুট করে এই রাগের কারণ কি? শুধু মেয়েগুলো তোমার ঘরে উকি দিয়েছে এই জন্যে এতো রাগ?”,আদিল শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো। স্নিগ্ধা দাতে দাঁত চিপলো।

এর মাঝেই স্পৃহা ফরিদা আপাকে সঙ্গে নিয়ে রুমে এলো। তারপর নিশব্দে খাবার গুলো একে একে টেবিলে রেখে ফরিদা আপা চলে গেলো। স্পৃহা পা টিপে টিপে আদিলের কাছে গিয়ে নিচু গলায় বললো,” তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। খুবই লজ্জা লাগছে বলতে, আসলে আমার ঐ বান্ধুবি গুলো তোমাকে …..”

এতটুকু বলেই স্পৃহা থেমে গেলো। পরের লাইনগুলো কিভাবে বলবে সে? তার বান্ধুবীগুলো যে এতো ফাজিল সেটা কি তার জানা ছিলো? সকাল বেলা আদিলকে শার্টলেস দেখে ফিসফিস করে উল্টা পাল্টা কিসব বলেছে সেইগুলো শুনেই স্নিগ্ধা ক্ষেপে গেছে।

আদিল স্পৃহাকে চুপ থাকতে দেখে ভ্রু তুলে বললো,” কি হলো? কথাটা শেষ করো।”
স্পৃহা অস্পষ্ট গলায় কোনোভাবে বলেই দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। অভ্র বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে স্পৃহার পিছু পিছু চলে গেলো। অভ্রর এই বাড়িতে একটাই কাজ স্পৃহার পিছু পিছু যাওয়া।

আদিল হাত ধুয়ে এসে স্নিগ্ধার পাশে বসলো। তারপর বাম হাতে টান দিয়ে স্নিগ্ধার সামনে থেকে বইটা নিয়ে নিতেই।স্নিগ্ধা অবাক চোখে তাকালো তারপর হাত বাড়িয়ে বইটা ধরতেই আদিলের চোখে চোখ পড়লো। স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলো। আদিলের চোখের দিকে তাকাতেই গত কালের ঘটনা মনে পড়লো তার। স্নিগ্ধার মধ্যেকার আড়ষ্টতা আরো বাড়লো। আদিল বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বললো,” আবার বই পড়ছো? তা আজকেও কি মিসির আলী?”

স্নিগ্ধা এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকালো। সেই ঘটনা মনে পড়তেই শিউরে উঠলো সে। প্রথম স্পর্শের কথা মনে পড়তেই মনে হলো সেই স্পর্শ সে আবারো অনুভব করছে। আদিল লক্ষ্য করলো স্নিগ্ধার ধরে রাখা বইয়ের প্রান্তভাগের বাঁধন আস্তে আস্তে সহজ হচ্ছে। আদিল বইটা আস্তে করে টানতেই স্নিগ্ধার হাতের বাঁধন ছুটে গেলো। স্নিগ্ধা নিজের দুই হাত গুটিয়ে নিজের কোলে নিয়ে বসে রইলো।

আদিল বইটা একপাশে রেখে খাবারের প্লেটটা হাতে নিতে নিতে বললো,” আজকে আমার মেজাজ একটু খারাপ। কিন্তু তাও তোমার এই রাগ করা দেখে, না হেসে পারলাম না।”
স্নিগ্ধা আড় চোখে তাকালো। আজ সত্যিই লোকটা কেমন শান্ত হয়ে আছে। শান্ত কিন্তু গম্ভির। আদিল বেশ রেগে বললো,” খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেছ কেনো? কি সমস্যা তোমার?”

স্নিগ্ধা বিরক্তির সুরে বললো,” আমার সমস্যা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার ভালোলাগছে না তাই খাবো না।”
আদিল শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো তারপর খাবারের প্লেটটা একপাশে রেখে স্নিগ্ধার দিকে এগিয়ে এসে বললো,” তাহলে চলো দুজনে একসাথে শাওয়ার নেই, আমারো মেজাজ ঠিক হয়ে যাবে।”

কথাটা শুনে স্নিগ্ধার পিলে চমকে উঠলো। আদিলের অন্য সব কথার মতন এই কথাটা দুষ্টামির ছলে বলেনি। কথা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা সিরিয়াস। স্নিগ্ধা জড়সর হয়ে বসলো তারপর তেজী গলায় বললো,” ছি! কি বলছেন এইসব। আপনার লজ্জা করছে না এইসব বলতে?”

আদিল সিরিয়াস হয়ে বললো,” নাহ্ একদম লজ্জা করছে না। এক্ষুনি বুঝতে পারবে তুমি। খাবার নিয়ে রাগ করা আমার সবচেয়ে অপছন্দের কাজ আর তুমি সেটাই করছো। দুপুর কটা বাজে খেয়াল আছে তোমার? ইউ বেটার ফিনিশ দিস ফুড রাইট নাও।”
স্নিগ্ধা বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। খেতে চায়নি বলে এমন হুমকি শুনতে হচ্ছে তাকে? এ কাকে বিয়ে করেছে সে? আশ্চর্য!

স্নিগ্ধা চুপ করে বসে আছে। সে নিজের মত বদলায় নি। এইসব আজগুবি হুমকি দিয়ে কাজ হবে না।
আদিল খাবারের প্লেটটা স্নিগ্ধার দিকে এগিয়ে দিলো। স্নিগ্ধা রেগে প্লেটটা একপাশে রাখলো। আদিলের মাথা যন্ত্রনা আরো বাড়ছে। আর এইদিকে এই মেয়ে কোনো কথাই শুনছে না। ঠিক আছে সেও কম যায় না।
আদিল সুন্দর করে নিজের শার্টের হাতা ভাজ করলো তারপর স্নিগ্ধা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে কোলে তুলে নিলো। স্নিগ্ধা চকিত গলায় বললো,” কি করছেন কি আপনি?”

আদিল চুপ করে করে রইলো। ওয়াশরুমে ঢুকতেই স্নিগ্ধার হৃদ কম্পন বেড়ে গেলো। সত্যি সত্যি তো নিয়ে এলো এইবার কি হবে? ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। আদিল স্নিগ্ধাকে ঠিক শাওয়ারের সামনে দাড় করিয়ে দিলো। স্নিগ্ধা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আদিল স্নিগ্ধার এক হাত শক্ত করে ধরে ফেললো। স্নিগ্ধা অপষ্ট গলায় বললো,” ছাড়ুন কি করছেন? আমাকে যেতে দিন।”

আদিল মৃদু হেসে বললো,” এতো সহজে না।” বলেই শাওয়ার অন করলো। আর সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ধারার মতোন পানি এসে ভিজিয়ে দিতে লাগলো তাদের দুজনকে। আদিল এক হাতে স্নিগ্ধার কোমড় জড়িয়ে নিজে ঝুকে এসে স্নিগ্ধার মাথার সাথে নিজের মাথা মিলিয়ে চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে এই বর্ষণের ধারাকে।

এই শীতল পানির বর্ষণেও কেমন এক উষ্ণতা অনুভব করছে স্নিগ্ধা। সেই উষ্ণতায় বার বার কেপে উঠছে সে। চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। নিজের উপর কেনো জানি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে সে। অদ্ভুত এক অনুভূতি ভিতর থেকে নাড়া দিচ্ছে তাকে। কিছুক্ষণ পর আদিল চোখ খুলে তাকালো স্নিগ্ধার দিকে। চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা। হটাৎ আদিল এক ঘোর লাগা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” ভালোবাসো আমায়?”

স্নিগ্ধা পাথরের মতন দাড়িয়ে আছে। প্রশ্নটা শুনে হৃদ কম্পন কয়েকশগুন বেড়ে গেলো তার। হটাৎ এই প্রশ্নের জবাব জানতে চাইছে কেনো আদিল। এই প্রশ্নের উত্তর তো তার কাছে নেই। তাহলে জবাব জানতে চাওয়াটা কি অর্থহীন নয়? আদিল স্নিগ্ধাকে নিজের আরো কাছে এনে জিজ্ঞেস করলো,” বলো, ভালোবাসো আমায়?”

আদিলের এতো কাছাকাছি এসে অস্থিরতায় কেপে উঠলো স্নিগ্ধা। চোখ খোলার সাহস তার নেই। আদিল হাতের বাধন আরো শক্ত করতেই স্নিগ্ধা অস্পষ্ট গলায় বললো,” নাহ্।”
প্রতিউত্তরে আদিল কিছু বললো না। সে নিজেকে সংযত করে হাতের বাধন সহজ করলো। নিরবে নিঃশ্বাস ফেলে শাওয়ার অফ করে দিলো। হটাৎ নিজেকে আদিলের বাঁধন থেকে মুক্ত আবিষ্কার করে চোখ খুলে তাকালো স্নিগ্ধা। কিন্তু আদিলের চোখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই।

একবার নিজের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো স্নিগ্ধা। ভিজে শাড়িটা তার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকার কারণে সব বোঝা যাচ্ছে। স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে দুই বাহু জড়িয়ে ধরে অন্যপাশ ফিরে দাড়ালো।

বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে স্নিগ্ধা। ভেজা চুলগুলো মুড়িয়ে রেখেছে শুভ্র রঙের তোয়ালে দিয়ে। আদিল ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে বেরিয়ে এসে দেখে স্পৃহা দ্বিতীয়বারের মতোন খাবার প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকেছে। আদিলই তাকে বলেছিলো আবার খাবার নিয়ে আসতে কারণ আগের খাবারটা ঠান্ডা হয়ে গেছিলো। স্পৃহা স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো,” এমন সন্ধ্যা বেলায়। হটাৎ গোসল করলি যে? ”

স্নিগ্ধা কড়া চোখে তাকাতেই স্পৃহা ভয়ে ভয়ে হেসে বললো,” না মানে খাবার ঠান্ডা হয়ে গেল যে তাই।”
স্নিগ্ধা কড়া গলায় বললো,” আমি এখন খাবো না।”

কথাটা শুনে স্পৃহা আদিলের দিকে আড় চোখে তাকালো। কি আশ্চর্য! কোথায় ফেঁসে গেছে সে? এরা এমন কেনো? মাঝখানে বলির পাঠা সে। আদিল সামনের এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনে সরিয়ে বললো,” স্পৃহা তুমি জানতে চাইছিলে না হটাৎ সন্ধ্যা বেলায় তোমার দিদি গোসল করলো কেনো? আমি তোমাকে বলছি। ও যেহেতু খাবে না। প্লেটটা নিয়ে নাও, তারপর নিচে চলো। আমি তোমাকে ইন ডিটেইলস সবটা বলছি।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১০

কথাটা শুনে স্পৃহা বিষম খেলো। তারপর ঠোঁট টিপে হেসে প্লেটটা নিয়ে যাওয়ার জন্যে হাত বাড়ানোর আগেই স্নিগ্ধা খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে বসলো। দাতে দাঁত চিপে বসে আছে সে। অসভ্য লোকটার মুখে কোনো লাগাম নেই।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১২