রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১০

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১০
নবনী নীলা

স্নিগ্ধা ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো তার ঠিক পিছনে আদিল ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু
এই হাসি দেখে তো বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করছে তার। এই মুহূর্তে ঘুমই পারে তাকে রক্ষা করতে। স্নিগ্ধার এই চিন্তার মাঝেই আদিল বলে উঠলো,” নিজের বরকে এত রাত পর্যন্ত বসিয়ে রাখা কি তোমার ঠিক হয়েছে?”

স্নিগ্ধা এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকালো যেনো ঘরে আদিল নামের কোনো ব্যাক্তি নেই। শুধু দেওয়ালে দেওয়ালে তার কণ্ঠ ভেসে বেড়াচ্ছে। স্নিগ্ধা চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো। আদিলের দিকে একবারো তাকালো না। তবে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছে আদিল তার খুব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একজনের দৃষ্টি তার উপর স্থির আছে জেনে তার পক্ষে ফট করে শুয়ে পড়া বেশ অসস্তি দায়ক।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদিল বেশ পরখ করে দেখছে স্নিগ্ধাকে, মেয়েটা কি সারারাত এইভাবে চুপচাপ ঠোঁট কামড়ে বসে থাকবে? আদিল ধীর গতিতে এগিয়ে স্নিগ্ধার পাশে বসলো। স্নিগ্ধার জড়তা আরো বাড়লো। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলো সে।
আদিল কাছ ঘেঁষে বললো,”এইভাবে মূর্তির মতন বসে থাকলে কিন্তু আরো মারাত্মক কিছু হতে পারে।”

এইটুকু শুনে স্নিগ্ধা চোখ বড় বড় করে তাকালো। আরো মারাত্মক কিছু মানে? স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিললো। আদিল বেশ সিরিয়াস হয়ে এগিয়ে আসতেই স্নিগ্ধা হুড়মুড়িয়ে কয়েকধাপ পিছিয়ে একদম কর্নারে চলে গেলো। স্নিগ্ধার এই কাণ্ডে আদিল নিরবে হেসে ফেললো। তারপর আরেকটু জব্দ করতে নিজের শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো।

স্নিগ্ধা কতক্ষন চুপ করে থাকতে পারে সেটাও তো তার দেখা দরকার। একটা,দুটো, তিনটা, চারটা সবগুলো বোতাম খুলে ফেলতেই স্নিগ্ধা শাড়ির আঁচল শক্ত করে ধরে চোখ মুখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেললো তারপর কাপা কাপা গলায় বললো,” কি করছেন কি আপনি? শার্ট খুলছেন কেনো?”

আদিল শার্টটা একপাশে রাখতে রাখতে বললো,” তুমি এই ঘরে আসার পর থেকে কেমন যেনো উষ্ণতা বেড়ে গেছে। তাই খুলে রেখেছি।” স্নিগ্ধা কথাটা শোনার পর পরই দুই হাত দিয়ে নিজের চোখ ধরলো। নিশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে তার।
আদিল স্নিগ্ধার একদম কাছে আসতেই স্নিগ্ধার হৃদ কম্পন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো। আদিল স্নিগ্ধার কানের কাছে মুখ এনে ফিচেল গলায় বললো,” অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও।” কথাটা শুনে স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে ফেললো। হাত সরিয়ে আদিলের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলো সে। আবারো হাতের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেললো। এইভাবে আদিলকে দেখে স্তম্ভিত সে। চওড়া কাঁধ, লোমবিহীন বুক আর ঠোঁটে সেই মৃদু হাসি। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।

আদিলের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। অনেক জব্দ করা হয়েছে। আদিল বেশ স্বাভাবিক ভাবেই পাশের বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বললো,” তুমি ঠিক কিসের জন্যে অপেক্ষা করছো? কোনো ভাবে কি চাইছো যে আমি তোমার কাছে যাই?”
স্নিগ্ধা ফট করে তাকালো।

আদিলকে এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে শুয়ে থাকতে দেখে তার রাগ আকাশ ছুঁই। এইসবের মানে কি? এতোক্ষণ তার মানে ইচ্ছে করে তাকে ….। ভেবেই রাগ হচ্ছে। কত সহজে তাকে বোকা বানিয়ে ফেললো। স্নিগ্ধা হাত মুষ্টি বন্ধ করে নিজের রাগ সামলে নিচ্ছে এর মাঝে আদিল আবার বললো,” তুমি ঘুমাচ্ছো না কেনো কেনো? আমি কাছে আসব?”

স্নিগ্ধা জড়তা ভুলে কড়া চোখে তাকালো কিন্তু লাভ হলো না পরক্ষনেই আদিল বললো,” নিরবতা সম্মতির লক্ষণ, তাহলে কাছে আছি।” বলে স্নিগ্ধার দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধা চোখ বড় বড় করে বললো,”একদম না।” বলেই ভয়ার্ত বাঘিনীর মতন একপাশে শুয়ে পড়লো। তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক ভাবে।

আদিল তার দৃষ্টি সামনে রেখে মৃদু হাসলো তারপর দুইহাত মাথার পিছনে রেখে চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আদিলের বাজে অভ্যাসের একটি হলো সে অন্য কোথায় গিয়ে ঘুমাতে পারে না। নিজের বিছানা ছাড়া তার ভালো ঘুম হয় না। বেশ কিছুক্ষণ পর আদিল চোখ খুলে তাকালো। চেষ্টা করেও লাভ নেই, ঘুম আসছে না তার।

আদিল ঘাড় ঘুরিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। ঘুমিয়ে পড়েছে সে। আদিল মাথার নিচে একটা হাত রেখে পাশ ফিরলো তারপর অপলকে তাকিয়ে রইলো। জানালা দিয়ে চাঁদের আবছা আলো মুখে এসে পড়েছে স্নিগ্ধার। অপরূপা লাগছে তাকে।

আদিলের ঘুম ভাঙলো বেশ দেরিতে। ভোরের দিকে ঘুম আসে তার। ঘুম থেকে উঠে সে বেশ অবাক হলো। কারণ বেলা দশটা বাজে অথচ এ বাড়ির কেউ তাকে ঘুম থেকে তুলে নি। আদিল উঠে বসতেই দেখলো বিছানার একপাশে সাদা তোয়ালে রাখা আছে তার জন্যে। আদিলের ঘুম ঘুম ভাব এখনো কাটেনি, সে হাত বাড়িয়ে তোয়ালেটা নিলো। তারপর ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতেই একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলো।

নিচে তিনটি মেয়ে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এরা স্পৃহার সমবয়সী। আদিলকে দেখে তারা দাড়িয়ে পড়লো। সবার চোখে মুখে বিষ্ময় কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। আদিল এদিক সেদিক তাকালো জিম, অভ্র, স্নিগ্ধা এরা সবাই কোথায়? তার শাশুড়িকেও তো দেখছে না। আদিল বেশ অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো। একটি মেয়ে এগিয়ে এসে বললো,” ভাইয়া কেমন আছেন?”

আদিল কিছু বলতে যাবে এর আগেই স্নিগ্ধা পাশের রুম থেকে বেশ রেগে বের হলো পিছে পিছে মুখ কালো করে বের হলো স্পৃহা।
স্নিগ্ধা বের হতেই মেয়েটির দিকে তাকালো। যেনো তাকে এক্ষুনি কাচা গিলে ফেলবে। আদিল স্নিগ্ধার এমন রূপ এর আগে দেখে নি। স্নিগ্ধা রেগে আদিলকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আদিল অবাক হয়ে তাকালো স্পৃহার দিকে। এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বললো,” কোনো সমস্যা?”

স্পৃহা নিচু গলায় বললো,” আসলে, হয়েছে কি। আমার কিছু ফ্রেন্ড তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। তুমি ঘুমাচ্ছিলে শুনে ওরা জাস্ট রুমে উকি মেরে দেখেছিল। তখন আপু রূমের সামনে দিয়ে যেতেই দেখে ফেলেছে। কিন্তু এতে আমার কি দোষ বলো। ওদের না হয় ঝাড়ি মেরেছে ঠিক আছে কিন্তু আমাকে রাগ দেখালো কেনো?”
আদিল ভ্রু কুঁচকে ফেললো। স্পৃহা মিন মিনে গলায় বললো,” তুমি কি রাগ করেছো?ওরা একটু এমনই, মানে কিভাবে বুঝাই।”

আদিল মাথা নেড়ে বললো,” আচ্ছা। ইটস ওকে। আমি রাগ করিনি। এতো এক্সপ্লেইন করতে হবে না তোমায়।”
স্পৃহা সস্তির নিশ্বাস ফেলতেই আদিল বললো,” তোমার বান্ধবীরা এতক্ষণ এসে বসে আছে চলো আলাপ করে নিই।”
স্পৃহা হেসে উঠে বললো,” আচ্ছা তুমি আগে ব্রেকফাস্ট করে নাও। নয়তো আম্মু স্কুল থেকে ফিরে আমাকে বকবে। এমনিতেও আমরা আজ কলেজে যাবো না, ওরা অপেক্ষা করতে পারবে।”

আদিল মাথা নেড়ে বললো,” আচ্ছা, চলো। কিন্তু অভ্রকে দেখছি না কেনো?”
স্পৃহা বললো,” অভ্র ওই রোবট মানে জিম নামের লোকটার সাথে বাইরে গেছে।”

স্নিগ্ধা নিজের রুমে বসে আছে। মাথা তার প্রচন্ড ব্যাথা করছে। রাগ পুষে রাখলে তার প্রচুর মাথা যন্ত্রণা হয়। স্পৃহার এই বান্ধুবীদের তার অসহ্য লাগছে। এইভাবে কেউ কারোর ঘরে উকি মারে? এইসবের কোনো মানে আছে? এতোক্ষণ হয়েছে এখনো বুঝি যায় নি। আজকে মা আসুক একবার। এমন অভদ্র মেয়েদের স্পৃহা মিশে কেনো জানতে চাইবে সে।
স্নিগ্ধা ঘড়ি দেখে দেড় ঘণ্টা পর নিচে নামলো। নীচে নামতেই মেয়েদের হাসির আওয়াজ কানে আসলো তার, স্নিগ্ধা দাতে দাঁত চিপলো। স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে দেখলো সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। অভ্র চলে এসেছে, সে একটা মেয়ের কোলে বসে আছে।

সিঙ্গেল একটা সোফায় আদিল বসে আছে। সে বেশ ভালো করেই কথা বলছে। স্নিগ্ধার অকারনেই প্রচুর রাগ লাগছে। সে যে তখন থেকে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কারোর কোনো খেয়াল আছে?
স্নিগ্ধা দ্বিতীয়বারের মতন নিজের ঘরে চলে গেল। আদিল ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সিড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো স্নিগ্ধা সিড়ি বেয়ে উপরে যাচ্ছে।

আদিল স্নিগ্ধার আজকের ব্যাবহারে বেশ চমকালো। হটাৎ আজ এতো রেগে আছে কেনো স্নিগ্ধা।
দুপুরে স্নিগ্ধা খাবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। তাই স্নিগ্ধার রাগ ভাঙাতে অভ্র আর স্পৃহা স্নিগ্ধার ঘরে এসে বিছানার উপর বসে আছে। বিছানার একপাশে স্নিগ্ধা বই সামনে নিয়ে বসে আছে। কারোর সাথে কোনো কথা বলছে না।
স্পৃহা পড়েছে মহা মুশকিলে। তার বোনের রাগ যে কত ভয়ানক শুধু সেই জানে। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে কিছু একটা মনে ধরে রাগ করে বসে থাকবে। স্পৃহা অভ্রকে ঈশারা করতেই অভ্র স্নিগ্ধার শাড়ির আঁচল টেনে বললো,” খেতে চলো। চলো না।”

স্নিগ্ধা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো,” নাহ্, আমাকে আদর দেখাতে হবে না। তুমি গিয়ে তোমার নতুন যে ফ্রেন্ড হয়েছে তার কোলে বসে থাকো।”
অভ্র না সূচক মাথা নেড়ে বললো,” নাহ্, আর বসবো না। সরি।” স্নিগ্ধা কোনো উত্তর দিলো না।
অভ্র ঠোঁট উল্টে স্পৃহার দিকে তাকাতেই। স্পৃহা হতাশ গলায় বললো,” আমি আর কোনোদিন ওদের বাসায় আনবো না। প্লিজ খেতে চল।”

আদিল জিমের সাথে কাজে বাইরে গিয়েছিল মাত্র ফিরলো। রুমে ঢুকেই সবার এমন মুখ দেখে সে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। আদিলকে দেখে স্পৃহা বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেলো। তারপর নিচু গলায় বলল,” জিজু তোমার বউ রাগ করেছে খাবে না বলছে।”
আদিল ঘাড় কাত করে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো তারপর বললো,” কেনো?”
স্পৃহা মলিন চোখে তাকিয়ে বললো,” রাগ হয়েছে যে তাই খাবে না।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৯

আদিল শার্টের হাতা ভাজ করতে ব্যাস্ত ছিলো তারপর মাথা নেড়ে বললো,” খাবারটা রুমে পাঠাও, আমি দেখছি।”
স্পৃহা যেনো প্রাণ ফিরে পেলো,এক গাল হেসে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রুম থেকে বের হয়ে সে রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে চোখ বন্ধ করে সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। কিন্তু সামনে এগিয়ে যেতেই কারোর সাথে অকোপটে ধাক্কা খেয়ে হতভম্ব হয়ে চোখ খুললো সে।
জিম সরু দৃষ্টিতে পিছনে তাকালো। তারপর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো। স্পৃহা তেজী গলায় বললো,” দেখে হাঁটতে পারেন না।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১১