রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৯

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৯
নবনী নীলা

আদিল তখন থেকে খেয়াল করছে তার কথায় স্নিগ্ধা কোনো কিছু বলছে না। মুখের সামনে একটা বই নিয়ে বসে আছে। আদিল হাত বাড়িয়ে ছো মেরে স্নিগ্ধার হাত থেকে বইটা নিয়ে বইয়ের নাম দেখতে লাগলো। স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বললো,” বই নিয়েছেন কেনো? আমার বই ফেরত দিন।”

আদিল বইয়ের নামটা পড়ে বললো,” বাহ্ নিজের বরকে রেখে দেখি মিসির আলী নিয়ে খুব ব্যাস্ত তুমি!আমাকে ইগনোর করছো কেনো?”
স্নিগ্ধা ভ্রু কুচকে বললো,” আপনাকে ইগনোর করা কি সহজ কথা? আপনি হলেন মৌমাছি, মৌমাছিকে যেমন সহ্য করা যায় না তেমনি সরিয়ে দেওয়াও যায় না। আপনি হলেন সেই মৌমাছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদিল মৃদু হেসে বললো,” মৌমাছি ফুলের আশেপাশে ঘুর ঘুর করবে এইটাই তো স্বাভাবিক।”
স্নিগ্ধা দাতে দাত চেপে বললো,” আমার বইটা ফেরত দিন।” সব প্রশ্নের উত্তর থাকে এই ছেলের কাছে।
আদিল বইটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” তুমি কোনোদিন প্রেমের উপন্যাস পড়ো নি, তাই না?”
স্নিগ্ধা বিরক্তি নিয়ে তাকালো তারপর বললো,” আমি প্রেমের উপন্যাস পড়েছি কি পড়িনি তা দিয়ে আপনার কি?”
আদিল কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে বলল,” অবশ্যই আমার অনেক কিছু। প্রেমের উপন্যাস পড় নি বলেই তো আজ তোমার মধ্যে কোনো রোমান্টিসিজম নেই। ”

স্নিগ্ধার কথাটা ভীষন গায়ে লাগলো। স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বইটা নেওয়ার আগেই আদিল এক হাতে বই রেখে উচুঁ করে ধরতেই স্নিগ্ধার রাগ হলো। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” শুনুন, আমার মধ্যে কি আছে আর কি নেই সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। বইটা ফেরত দিন বলছি।”

আদিল বইয়ের দিকে ঈশারা করে বললো,” নিয়ে নাও।” স্নিগ্ধা পড়লো মহা বিপদে। একেই এমন লম্বা তার উপর হাত উঁচু করে বই ধরে আছে।সে কি রাক্ষস যে হাত লম্বা করে বইটা নিয়ে আসবে। স্নিগ্ধা পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বইটা আদিলের হাত থেকে নেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। বই নেওয়ার চেষ্টায় স্নিগ্ধা আদিলের খুব কাছে চলে এসেছে। আদিল অপলকে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। খুব কাছ থেকে দেখছে স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধার অবশ্য সেই দিকে খেয়াল নেই, সে বই নিতে ব্যাস্ত। আদিলের মধ্যে কেমন একটা ঘোর কাজ করছে, সে আস্তে আস্তে স্নিগ্ধার কাছে ঝুকে আসতেই স্নিগ্ধার টনক নড়ল। বিস্ময় নিয়ে আদিলের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধা কিছু বুঝে উঠার আগেই আদিল তার ডান গালে গভীর ভাবে ঠোট ছুইয়ে দিলো।

স্নিগ্ধার থমকে গেলো। সঙ্গে যেনো তার চারিপাশ থমকে গেল। কি হয়েছে সেটা আন্দাজ করে মুখ হা হয়ে গেলো তার। চোখ বড় বড় করে আদিলের দিকে তাকাতেই আদিল মৃদু হেসে তাকালো। প্রতিবারের মতন এবারো শিউরে উঠলো সে। স্নিগ্ধার বিষ্ময় কাটার আগেই ঘরে স্পৃহা এসে হাজির। সে যদিও আপু আপু ডাকতে ব্যাস্ত হয়ে এলো। তাই আদিল কিছু বলার সুযোগ পেলো না। স্নিগ্ধা স্পৃহার ডাক শুনে ছিটকে সরে দাঁড়ালো।

স্পৃহা ঘরে এসে এমন শান্ত, চুপচাপ পরিবেশ দেখে অবাক হয়ে বললো,” বাবা, এমন নিস্তব্দ হয়ে আছে কেনো? কি করছিলে তোমরা?”
স্পৃহার এই প্রশ্নের স্নিগ্ধার চেহারা লাল হয়ে গেলো। সঙ্গে হার্ট বিট বেড়ে গেলো দ্বিগুণ ভাবে। আদিল এক পলক স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। লজ্জায় নাজেহাল অবস্থা তার। স্পৃহা নিজের বোনের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,” কি রে আপু? তোর মাথা ব্যাথা সেরেছে?”

স্নিগ্ধা কিছু বলতে পারছে না মনে হচ্ছে তার গলা দিয়ে আওয়াজই বের হচ্ছে না। স্নিগ্ধাকে এমন স্তম্ভিত অবস্থায় দেখে স্পৃহা আদিলের দিকে তাকিয়ে বললো,” কি হয়েছে আপুর?”
আদিল হাসি আটকে বললো,” ছোট খাটো একটা শক খেয়েছে।”
স্নিগ্ধা আড় চোখে আদিলের দিকে তাকালো। অসভ্য লোকটা কি বলে দিবে? স্পৃহা অবাক হয়ে বললো,” মানে? ইলেকট্রিক শক?”

” নাহ্, ঠিক ইলেকট্রিক শক না। মানে হিউম্যান বডি…..” বাকিটা বলার আগেই স্নিগ্ধা ফট করে বললো,” মিসির আলী।” অনেক কষ্টে গলা দিয়ে আওয়াজটা বের হয়েছে তার।
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই স্নিগ্ধা বললো,” বই পড়ছিলাম তো। বই পড়ে আমি একটু…….।” এতোটুকু বলে স্নিগ্ধা থেমে গেলো।

আদিল ভ্রু কুঁচকে হাতে থাকা বইটার দিকে তাকালো। স্পৃহা কিছুই বুঝলো না। তবুও বুঝার ভান করে বললো,” ও আচ্ছা। যাই হোক আমি তোমাদের ডিনারের জন্যে ডাকতে এসেছিলাম।”
স্নিগ্ধা স্পৃহার হাত শক্ত করে ধরে ব্যাস্ত হয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল,” চল যাই। ”
স্পৃহা যেতে যেতে আদিলের উদ্দেশ্যে বললো,” জিজু জলদি এসো।”
আদিল হাতে থাকা বইটার দিকে তাকালো তারপর কি ভেবে বইটা বুক সেলফের সবচেয়ে উপরের তাকের মাঝ বরাবর রাখলো। তারপর নিচে নেমে এলো।

অভ্র নিজের নাম বদলেছে তার নাম আজ নবিতা। হটাৎ নবিতা নাম রাখার পিছনে কারণ খুঁজছেন? সত্যি বলতে কোনো কারণ নেই। তার ইচ্ছে হয়েছে সে নাম বদলেছে।
যেমন এখন তার খুব ইচ্ছে সে জিমের ল্যাপটপে গেম খেলবে। কিন্তু ল্যাপটপ তার সবচেয়ে দরকারি ডিভাইস সেটি অভ্রর হাতে যাওয়া মানেই দুই খন্ড। জিম নানা ভাবে অভ্রকে বোঝাতে চাইছে কিন্তু অভ্র মানছে না। স্পৃহা পাশ দিয়েই যাচ্ছিল অভ্রকে জিমের পিছু পিছু ঘুরতে দেখে বললো,” কি ব্যাপার তুমি এই রবোমানবের পিছু পিছু হাটছো কেনো?”

অভ্র চোখ পিট পিট করে বললো,” আমি গেইম খেলবো।”
স্পৃহা অভ্রর হাত ধরে বললো,” চলো আমার সাথে চলো আমি তোমাকে আমি দেই। এই রোবটের সাথে কথা বলে লাভ নেই।”

অভ্র স্পৃহার হাত ধরে তার রুমে চলে গেল। জিম আড় চোখে তাকিয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখলো। এমন অদ্ভুত মেয়ে সে জীবনে দেখেনি। এ বাড়ির প্রতিটা মেয়ে এতো অদ্ভূত কেনো?
স্নিগ্ধা খাওয়া শেষে আনমনে স্পৃহার ঘরে বসে আছে। নিজেকে বড্ড অগোছালো লাগছে তার। বার বার শুধু সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়ছে। সেই মুহূর্তটা যেনো তার মাথায় চিরো জীবনের জন্যে সেইভ হয়ে গেছে। কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না। স্পৃহা ঘরে ঢুকে স্নিগ্ধাকে এমন আনমনে বসে থাকতে দেখে বললো,” বাপরে মহারানি দেখি আমার ঘরে।”

অভ্র লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে পড়লো। স্পৃহা তার পাশে বসে স্নিগ্ধার কাধ ধরে ধাক্কা দিতেই স্নিগ্ধার হুশ ফিরলো।
স্পৃহা একটা ভ্রু তুলে বললো,” কি হয়েছে তোর?”
স্নিগ্ধা চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে বললো,” কই কিছু না তো।”
অভ্র স্পৃহার হাত ধরে টেনে বললো,” গেইম খেলবো। গেইম খেলবো।”

স্পৃহা অভ্রকে শান্ত করতে নিজের ল্যাপটপটা এগিয়ে দিলো। অভ্র গেইম খেলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়তেই স্পৃহা স্নিগ্ধার কাছ ঘেঁষে বসে বললো,” এই তুই আমার ঘরে বসে আছিস কেনো? নিজের রুমে যা। নাকি জিজুর সাথে রাগারাগি হয়েছে?”
স্নিগ্ধা আড় চোখে তাকালো তারপর অস্পষ্ট স্বরে বললো,” কিছু হয় নি। আমি আজকে তোর সাথে থাকবো।”

স্পৃহা হেসে উঠে বললো,” বিয়ের পর সবাই বরের কাছে যেতে ভয় পায় কেনো বুঝি না। আমার ফ্রেন্ড সামিহা ওর কিছুদিন আগে বিয়ে হলো। রিসেপশনের দিন বরের থেকে দশ হাত দূরে সরে থেকেছে। কোথায় বর ভয়ে দূরে দূরে থাকবে তা না তোরা পালাই পালাই করিস।”

স্নিগ্ধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো তারপর বললো,” বিয়ের পর টের পাবি। মুখে সবাই বলতে পারে।”
” আমার বরকে আমি ভয়ের উপর রাখবো। দেখিস তুই।”,বলেই ফিক করে হেসে ফেললো।
এইসবের মাঝে আয়েশা খাতুন রুমে এলেন। এতো রাতে স্নিগ্ধাকে এই রুমে দেখে অবাক হয়ে বললেন,” কি হয়েছে? তুই এই রুমে কি করিস?”

স্নিগ্ধা চুপ করে তাকিয়ে রইল কিন্তু কিছু বললো না। স্পৃহা রসিকতা করে বললো,” আপু রাগ করেছে। বরের সাথে থাকবে না।”
আয়েশা খাতুন হেসে ফেললেন। অভ্র এর মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,” কে বর?”
স্পৃহা অভ্রর কানে হেডফোন লাগিয়ে বললো,” বড়দের কথা শুনতে হয় না।”
আয়েশা খাতুন মেয়ের হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে বললো,” রাগ হয়েছে বরকে গিয়ে রাগ দেখাও। নিজেদের ব্যাপার আবার মানুষকে বলে বেড়াতে হয়?”

স্নিগ্ধা মুখ কালো করে বললো,” কিসের রাগ। কিছু হয় নি। আমি থাকি স্পৃহার কাছে আজ। একটু গল্প করতাম।”
আয়েশা খাতুন কড়া গলায় বললো,” নাহ্, এতো রাতে গল্প করতে হবে না।”
স্নিগ্ধা মুখ পানসে করে অভ্রর কাছে গেলো তারপর অভ্রর কান থেকে হেডফোন নামিয়ে বললো,” চলো আমার সাথে চলো।”

অভ্র সঙ্গে সঙ্গে না সূচক মাথা নেড়ে বললো,” নাহ্, আমি খেলবো।”
স্নিগ্ধা অভ্রকে কয়েকবার গুতো মারলো লাভ হলো না। সে গেইম খেলতে মগ্ন। স্নিগ্ধা গাল ফুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। স্পৃহা আর তার মা মুচকি মুচকি হাসলো।

স্নিগ্ধা নিজের রুমের দরজার সামনে কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। রুমে আরেকটু পরে যাবে। বুকের ভিতরটা কেমন অস্থির অস্থির করছে। আদিল কি ঘুমায় নি? স্নিগ্ধা অনেক্ষন পায়চারি করে তারপর আস্তে করে দরজা ফাঁক করে চোখ দিয়ে পুরো রুমটা দেখলো। রুমে আদিল নেই। তাহলে কি বাইরে আছে? এটাই সুযোগ রুমে গিয়ে ভিতরে থেকে দড়জা আটকে দিবে তাহলেই হবে। স্নিগ্ধা পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো তারপর প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলতেই মনে হলো কে যেনো তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৮

স্নিগ্ধা ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো তার ঠিক পিছনে আদিল ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু আদিলের এই হাসি দেখে তো বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করছে তার।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১০