রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ২০

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ২০
নবনী নীলা

স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে বললো,” কি করছেন? ছাড়ুন।” আদিল স্নিগ্ধাকে বিছানায় বসিয়ে দিলো তারপর বেশ রেগে গিয়ে বললো,” তুমি নিজের খেয়াল রাখো না কেনো?”
স্নিগ্ধা হতভম্ব হয়ে তাকালো।হুট করে রেগে গেলো কেনো লোকটা? আদিল রাগী চোখে স্নিগ্ধার দিকে এক পলক তাকালো তারপর স্নিগ্ধার পাশে বসে পায়ে হাত দিতেই স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে বললো,” তেমন কিছু হয়নি….” এইটুকু বলতেই আদিলের অগ্নিদৃষ্টি তার চোখে পড়লো। স্নিগ্ধা চুপ করে গেলো। বাপরে এমন রাগের কি হয়েছে?

স্পৃহা এই বাড়ির পেন্টিং গুলো দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে কেনো স্নিগ্ধা তাকে খোঁজ নিতে বলেছিলো। সে খোঁজ নেয়নি এমন না। খোঁজ নিয়েছে তবে তেমন কিছু সে খুঁজে পায় নি। পেইন্টিংগুলোর নিচে খুব পেচিয়ে লেখা আছে একটি নাম। নামটা হলো আরোহী। কিন্তু এই নামের কোনো আর্টিস্ট সে খুঁজে পায় নি। পেইন্টিং গুলো তুলনা মূলুক অসাধারণ হলেও যিনি এই ছবিগুলো একেছেন তিনি খুব সাধারণ কেউ। কিন্তু তার বোনের হটাৎ এই মানুষটিকে খুঁজে বের করার এতো আগ্রহ কেনো? কে এই আরোহী? আপুকে তো নামটাই বলা হয়নি। স্পৃহা রুম থেকে বের হয়ে স্নিগ্ধার রুমে এলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রুমে এসে স্পৃহা অবাক হয়ে তাকালো। ডাক্তার কি করছে এইখানে? কারোর কি শরীর খারাপ হয়েছে। স্নিগ্ধা কপাল দুই আঙ্গুলে ধরে বিছানায় মুখ কালো করে বসে আছে। স্পৃহা ব্যাস্ত হয়ে স্নিগ্ধার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,” আপু, কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ করেছে?”

স্নিগ্ধা বিরক্তি নিয়ে এক পলক আদিলের দিকে তাকালো তারপর স্পৃহাকে বললো,” জানি না।” স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জানি না আবার কেমন কথা? এর মাঝেই আদিল ডাক্তারকে বললো,” ইনফেকশন হওয়ার কি কোনো চান্স আছে?”
ডাক্টার সাহেব ঠোঁট চেপে একটু হাসলেন।অল্প একটু কাঁচ গেঁথে যাওয়ায় আদিলের এমন অস্থিরতা দেখে যেনো তার নিজের কথাই মনে পড়ে গেলো।

কোনো সমস্যা নেই জেনেও ডাক্তার সাহেব বললেন,” আপাদত ইনফেকশন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে ওনার প্রতি একটু খেয়াল রাখবেন।”
স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে ডাক্তারের দিকে তাকালো।খেয়াল রাখতে বলার জন্যে আর ভালো মানুষ পেলেন না উনি। কি হয়েছে এমন? এর জন্যে এই লোক আবার ডাক্তারকে বাসায় নিয়ে এসেছে। তারপর ডাক্তারের উদ্দেশ্য বললো,” আমি ঠিক আছি। আমার খেয়াল আমি নিজেই রাখতে পারি।”

আদিল তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” নিজের খেয়াল রাখতে পারো বলেই তো পায়ের এই অবস্থা করেছো।” স্নিগ্ধা দাতে দাঁত চিপে তাকালো।
ডাক্তার সাহেব যাওয়ার জন্যে উঠে দাড়ালেন তারপর স্নিগ্ধাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” বিয়ের পর ছেলেরা বউকে নিয়ে এমন একটু আকটু পাগলামি করে।” বলেই হেসে তাকালেন।

স্নিগ্ধা ডাক্তারের এমন কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। পাশেই স্পৃহা বসে আছে এই মেয়ে তো আরো পাকনা। আদিল কথাটায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলো না কিন্তু স্পৃহা উঠে বললো,” আপনিও বিয়ের পর পাগলামি করেছিলেন,বুঝি?”
ডাক্তার সাহেব জোরে হো করে হেসে উঠলেন। স্নিগ্ধা স্পৃহার হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসালো। মুখে যা আসে বলে ফেলে এই মেয়ে। ডাক্তার সাহেব বললেন,” ভালোবাসা মানেই তো পাগলামি। শোনো মেয়ে! ভালোবাসলে পাগলামি করতে হয়।”

ডাক্তারের কথায় আদিল মৃদু হাসলো।কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্পৃহা ফিক করে হেসে ফেললো। স্নিগ্ধা কড়া চোখে তাকালো। তার বোনটা এমন ডানপিঠে হয়েছে কেনো?
ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে আদিল নিচে নেমে গেলো। ডাক্তার চলে যেতেই স্নিগ্ধা স্পৃহার কান টেনে ধরে বললো,” এতো পাকনা কেনো তুই? মাকে বলবো তোর জন্যে ছেলে খুঁজতে?”

স্পৃহা আর্তনাদ করে উঠে বললো,” আপু ছাড় লাগছে।” অভ্র দৌড়ে রুমে আসতেই স্নিগ্ধা স্পৃহার কান ছেড়ে দিলো। অভ্র লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো তারপর বললো,” তোমরা মারামারি করছো কেনো?”
স্পৃহা কান ডলতে ডলতে বললো,” তোমার আম্মু কতো পচা দেখেছো?”

অভ্র না সূচক মাথা নাড়ল তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,” ও আম্মু না ও মামোনি। ওকে আম্মু বলছো কেনো?” স্পৃহা আর স্নিগ্ধা দুজনেই হতবাক হয়ে তাকালো। স্নিগ্ধার মুখ মলিন হয়ে গেলো। অভ্রর কথাটা তার কেমন যেনো লাগলো। স্পৃহা স্নিগ্ধার দিকে তাকালো এক পলক তারপর অভ্রর কাছে গিয়ে বললো,” তাহলে তোমার আম্মু কে?”
স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে তাকালো।

অভ্র চোখের পাতা ফেলে বললো,” আরুহি।” স্নিগ্ধার বুকের ভিতরটা হটাৎ কেমন এক তোলপাড় শুরু হলো। অভ্র কি তাহলে নিজের মায়ের নাম বলছে?
স্নিগ্ধা মলিন চোখে প্রশ্ন করলো,” তোমার আম্মু কো….?” প্রশ্ন শেষ করার আগেই আদিল অভ্রকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু একে দিয়ে বললো,” চলো। আমরা একসাথে খেলবো। তোমার মামোনি রেস্ট করুক।”

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আদিল অভ্রকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। স্নিগ্ধা বিষণ্ণভরা মুখ নিয়ে বসে রইলো। অভ্রর বলা এই সামান্য কথায় একটু হলেও আঘাত পেয়েছে সে।
স্পৃহা হতবুদ্ধির মত বসে আছে। আরোহী মানে সারা বাড়িতে যার আঁকা ছবি সাজিয়ে রাখা হয়েছে সে অভ্রর মা? স্পৃহা নিজের বোনের দিকে তাকালো। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার। স্পৃহা একটু সাহস জুগিয়ে বললো,” আপু।”

স্নিগ্ধা মলিন চোখে তাকালো।তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” হুম।” স্পৃহা একটা ঢোক গিলে বললো,” যার নাম আমাকে বের করতে বলেছিস আমি নামটা পেয়েছি কিন্তু তোকে বলা হয়ে উঠেনি।”
স্নিগ্ধা হতাশ গলায় বললো,” আচ্ছা, বল।”

” এই বাড়িটির সব কয়টি পেইন্টিং অভ্রর মায়ের আকা মানে আরোহীর।”,বলেই থেমে গেলো স্পৃহা।
স্নিগ্ধা এক মুহূর্তের জন্যে একটু থমকে গেলো কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো হয়তো আদিল খুব ভালোবাসতো সেই মানুষটিকে তাই তো তার প্রতিটি জিনিস এইভাবে আগলে রেখেছে। বুকের ভিতরটা কেমন এক হাহাকার শুরু হয়েছে। স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বললো,” স্পৃহা তুই এখন যা। আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছে।”

স্পৃহা কথা বাড়ালো না। সে ভেবেছিল অভ্র হয়তো আদিলের ছেলে না। কিন্তু এখন সবটা আরো অস্পষ্ট লাগছে। স্পৃহা রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করে রাখার চেষ্টা করছে।কিন্তু কিছুতেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বুকের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে তার। স্নিগ্ধা চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো। কোনো মানুষকে এখনো ভালো না বাসলে কি তার প্রতিটা জিনিস এত যত্নে রাখে কেউ? আচ্ছা আদিলের আরোহীকে ভালোবাসাটা কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু এই সবকিছুতে স্নিগ্ধার কেনো জানি ভীষন কষ্ট লাগছে। অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে তাকে। আদিলের মনে যে কেউ থাকুক তাতে তো তার এতটা কষ্ট পাওয়ার কথা নয়। নিজের মনের সাথে নিজেই লড়াই করে যাচ্ছে সে।

আদিল রুমে ঢুকতেই স্নিগ্ধার মুখটা আরো বিষণ্ণতায় ভরে উঠলো। স্নিগ্ধার এই রুমে আর ভাল্লাগছে না। স্নিগ্ধা গায়ের চাদর সরিয়ে বিছানা থেকে পা নামাতেই আদিল সামনে এসে দাড়ালো। স্নিগ্ধা চোখ তুলে তাকালো। আদিল বুকের কাছে হাত ভাজ করে বললো,” একদম বিছানা থেকে নামবে না।”

গম্ভীর কণ্ঠে আদেশের মতন শুনালো কথাটা। স্নিগ্ধা সেই আদেশের পরোয়া করলো না। স্নিগ্ধা উঠে দাড়ালো। আদিল বিনা বাক্যে স্নিগ্ধার দুই বাহু ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলো। স্নিগ্ধা তীব্র বিরক্তি নিয়ে তাকালো তারপর তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” কি চাইছেন আপনি?”

” আমি চাইছি তুমি চুপচাপ বিছানায় বসে রেস্ট নিবে। হাঁটলে পায়ে ব্যাথা বাড়বে।” বলেই আদিল দুপাশে হাত রেখে ঝুকে আসতেই স্নিগ্ধা সরে এসে বললো,” আপনার আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না।” অভিমান ভরাক্রান্ত গলায় বললো সে।

আদিল আরেকটু ঝুকে এসে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো তারপর শীতল কণ্ঠে বললো,” আজ আবার বলছি, তুমি নামক এই সম্পূর্ন মানুষটা শুধুই আমার। তাই খেয়ালটাও আমাকেই রাখতে হবে।”

স্নিগ্ধা আদিলের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তারপর শান্ত স্বরে অভিযোগ করে বললো,” আমার এতোই যখন খেয়াল রাখতে চান, তাহলে আমার থেকে সব কিছু লুকিয়ে যাচ্ছেন কেনো? নাকি আমাকে শুধু ব্যাবহার করতেই এনেছেন?”
আদিল ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে তাকালো। তারপর স্নিগ্ধার হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলল,” তোমার থেকে সবটা লুকানোর কোনো ইচ্ছে ছিলো না আমার।

সেদিন তো সবটা বলতেই চেয়েছিলাম কিন্তু তার আগেই ফাহাদের বলা কথাগুলো তুমি বিশ্বাস করে বসে আছো। এরপর আমার বলা কথাগুলো তোমার কাছে ঠিক তেমনি শুনবে যেমনটা ফাহাদ চাইছে। তুমি ঠিক কতটা ফাহাদের কন্ট্রোলে হয়ে আছো তুমি নিজেও জানো না। তাই তো এতটা অধৈর্য্য হয়ে উঠেছ। তোমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে সে সফল। কিন্তু ফাহাদ যা চায় সেটা তো আমি হতে দিচ্ছি না।”

স্নিগ্ধা চুপ করে তাকিয়ে রইলো।আদিলের কথাগুলো যে ভুল তা নয়। কারণ ফাহাদের কথাগুলোই প্রতিমুহুর্তে তাকে ভাবিয়ে তোলে। রাগে ক্ষোভে তখন নিজেকে অসহায়ের মতন লাগে। স্নিগ্ধা কয়েকবার চোখের পলক ফেললো তারপর বললো,” শুধু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন?”
আদিল শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো তারপর শীতল গলায় বললো,” হুম বলো।”

স্নিগ্ধার ভিতরে অস্থিরতা বেড়ে গেলো।কিছুক্ষণ চুপ করে আদিলের দিকে তাকালো। প্রশ্নটা করতে যতটা কঠিন মনে তার চেয়েও বেশি কঠিন হচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবটা। স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে বললো,” আরোহী কে?” এই প্রশ্নের উত্তর শুনার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে সে। স্নিগ্ধা অসীম কৌতূহল নিয়ে আদিলের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিল প্রশ্নটা শুনে থমথমে হয়ে গেলো তারপর বললো,” অভ্র তো বলেই দিয়েছে।”

স্নিগ্ধা না সূচক মাথা নাড়লো। অস্থির মনকে শান্ত করে বললো,” আমি আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।”
আদিল মাথা নুইয়ে ফেললো তারপর চোখ বন্ধ করে ফোস করে একটা নিশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,” সে আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ যাকে আগলে রাখতে আমি ব্যার্থ হয়েছি।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ১৯

স্নিগ্ধা অপলকে তাকিয়ে আছে।আদিলের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ! মানে তার চেয়েও উর্ধ্বে কেউ। এই একটি মাত্র কথায় হটাৎ যেনো সবটা থমকে গেলো তার।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ২১