রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ২৬

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ২৬
নবনী নীলা

জিম হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” ভোর পাঁচটা থেকে খেয়াল করেছি সে সারা বাড়ি ঘুরে বেরিয়েছে। বেশ কয়েকবার অভ্রর রূমে গিয়েছে। আর আরোহী ম্যাডামের রূমের সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে ছিলো।”
জিমের কথা শুনে আদিল এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। গেস্ট রুমের উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।

রুমে এসে বেশ অবাক হল আদিল। এই লোকটাকে কখনো সে এর আগে দেখিনি, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মুখ কি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে অথচ কাছে যেতেই সে নিজেকে খুব ভীতু নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। জিম দরজাটা বন্ধ করতেই আড়চোখে তাকালো লোকটা। আদিল এগিয়ে এসে লোকটা ঠিক সামনে একটি টুল টেনে বসল। কতক্ষণ চুপ করে থেকে সামনে বসা লোকটার চোখের দিকে তাকাল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তারপর শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,” কে তুমি? এ বাড়িতে এসেছো কেন?”
উত্তরে লোকটা কোন জবাব দিল না তার চাওনিতে একটু ভয় থাকলেও কেমন যেন এক অদ্ভূত ভাবে তাকিয়ে রয়েছে সে।

লোকটাকে চুপ থাকতে দেখেন আদিল দ্বিতীয় বার করা ধমক দিয়ে বলল ,”কে তুমি? একটা কথা আমি দ্বিতীয়বার বলতে পছন্দ করি না। তাই তুমি কে? তোমার উদ্দেশ্য কি? আর কে তোমাকে পাঠিয়েছে? সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে তবেই তুমি ছাড়া পাবে।
আদিল আর জিম দুজনেই অবাক কারণ লোকটা কোন কথাই বলছো না। গুটিসুটি মেরে ভয়ার্ত চোখে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলছে।

আদিলের রাগ মাত্রাছাড়া হলো, তার বাড়িতে ছদ্মবেশে লোকটা কি করে এলো ভেবেই তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আদিল রাগ সামলাতে না পেরে লোকটার কলার শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” যা জানতে চেয়েছি চুপচাপ বল। নয়তো তোমার এমন অবস্থা করব তুমি ভাবতেও পারছ না। কি নাম তোমার?

আদিল খেয়াল করলো সামনে বসে থাকা লোকটি ঢোক গিলছে। তারমানে সে ভয় পেয়েছে। এটাই তো চাই ভয় দেখিয়েই সবটা জানতে হবে তাকে। কারণ যদি এই ছেলেকে ভয় দেখিয়ে সে কিছু বের করতে না পারে তাহলে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। আর এটা সে কিছুতেই চায় না কারণ, পুলিশ পর্যন্ত খবর গেলে ফাহাদকে কোনদিনও তার ধরাই হবে না। ক্ষমতার জোরে ঠিক নিজের লোককে বাঁচিয়ে নিবে নয়তো নিজেই শেষ করে ফেলবে।
আদিলের ধমকে কাজ হলো। লোকটা বলল,” আমার নাম হান্নান। আমি আমি এখানে আপনার একজন কর্মচারী রাতুলের অবর্তমানে এসেছি। সে একটু অসুস্থ।”

আদিল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,” কার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছ?তোমার গলায় তো রাতুলের আইডি কার্ড ঝুলছে। ‘
লোকটা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,” খোঁজ করে দেখুন সে সত্যি অসুস্থ। আর কার্ড নিয়ে এসেছি যেনো বিপদে পড়লে কাজে লাগে।”

আদিল হান্নানের কলার ছেড়ে দিয়ে জিমের দিকে তাকালো। জিম হান্নানের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,” রাতুলের সাথে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু রাতের ফোন ধরছেনা রাতুলের অবর্তমানে যে তুমি এসেছো আমাদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি?”

হান্নান নামের লোকটি প্রথমে চুপ করে রইলো। তারপর বললো,” এসব করতে হয় আমি জানতাম না।”
আদিল ছেলেটি কলার ছেরে দিয়ে উঠে দাঁড়াল তারপর পকেট এ দুই হাত ধরে কঠিন গলায় বলল,” তোমার এই মিথ্যে কথা গুলো আমরা সত্যি ভেবে তোমাকে ছেড়ে দিবো সেটা যদি ভেবে থাকো তাহলে সেটা ভুল।তোমাকে কে পাঠিয়েছে সেটা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। তোমার যা করার আমিই করবো কিন্তু তার আগে রাতুলের সঙ্গে তোমরা কি করেছো সেটা জেনে নেই। তারপর তোমাকে …..।” বাকিটা না বলেই রুমে থেকে হনহনিয়ে বেড়িয়ে পড়ল আদিল।
জিম বের হওয়ার সময় গেস্টরুমটা বাইরে দিয়ে তালাবদ্ধ করে দিলো।

রাতুল আদিলের খুবই বিশ্বস্ত একজন কর্মচারী প্রায় অনেক বছর ধরেই বাড়িত কাজ করতেছে কয়েকদিন ধরে হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে আসলে এভাবে চলে যাওয়াটা সে খেয়াল করিনি কিন্তু হঠাৎ কী এমন হলো এভাবে চলে যেতে হতো?
কিন্তু এবার পুরো বিষয়টা তাকে ভাবাচ্ছে রাতুলকে বহুবার ফোন করো কোনভাবে তার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি তাই আদিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে নিজে গিয়ে দেখা করবে।

আদিল সময় নষ্ট করলো না তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ল। তবে জিম সঙ্গে যেতে চাইলে আদিল বারণ করল। বাড়িতে তার অবর্তমানে একজনকে থাকা দরকার আর জিম এর থেকে বেশি বিশ্বাসী হয়তো সে আর কাউকে করো না।

কাবাডে নিজের শাড়ি গুলো গুছিয়ে রাখতে গিয়ে স্নিগ্ধা একটি বক্স খুঁজে পেলো। তার শরীর ভাজে এটা কি করছো? আগ্রহ নিয়ে বক্সটা খুলতেই আদিলের দেওয়া সেই প্রথম উপহারটি চোখে পড়ল তার।
এখানে যে রেখেছিল তার মাথায় ছিল না। স্নিগ্ধা বক্স খুলে লকেটটা হাতে নিলো। সে রাতে সে লকেটটা ভালো করে দেখেনি। কিন্তু জিনিসটা অনেক সুন্দর সবচেয়ে বেশি সুন্দর এই নীল পাথরটা, যা সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।
লকেট হাতে নিতেই স্নিগ্ধার একটা কথা মনে পড়ল। আদিল তখন তাকে লকেটটা দিয়ে বলেছিল,”সে যেনো এইটা সব সময় পড়ে।’ তখন উত্তর এসে বলেছিলো,” ভালবাসার প্রথম উপহার ভালোবেসে তবেই পড়বে সে।”

লকেটা দেখে হঠাৎ তার মনে পড়ল এই কথাগুলো। সে তো ভুলেই গিয়েছিল। আচ্ছা সে যে বললো যেদিন ভালোবাসবে সেদিন পড়বে। সে কি পেরেছে ভালোবাসতে? নিজের মনে এই প্রশ্ন জাগতেই স্নিগ্ধা লকেটটা বক্সে করে তুলে রাখলো। মনের এই প্রশ্নটা সে আবারো অগ্রাহ্য করলো। সবটা শাড়ী গুছিয়ে কাবাডে তুলতে যাবে, হঠাৎ স্পৃহার চিৎকার কানে এলো তার।

সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মক ব্যথা পেয়েছে স্নিগ্ধা।অনেক উচু থেকে পড়ার কারণে বলতে গেলে পা মচকে গেছে আর হাতের প্রায় অনেক জায়গায় কেটে গেছে। মাথাও বেশ আঘাত পেয়েছে সে। স্পৃহা ব্যথায় আর্তনাদ করছে কিছুক্ষণ পরপর।

স্পৃহার এমন অবস্থা হয়েছে সে উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পাচ্ছে না আর এসবের মাঝে ডান হাতের তালু থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে। রক্ত সহ্য করতে পারে না সে। রক্ত দেখলেই তার শরীর ভীষণ ভাবে কাঁপতে শুরু করে এবং মানসিকভাবে এই চাপ সে নিতে পারে না।

স্পৃহার এমন আর্তনাদের সবাই ছুটে এসেছে কর্মচারী থেকে শুরু করে সবাই। উঠে দাড়াতে পর্যন্ত পারছে না সে। আর এই দিকে থর থর করে কাপছে স্পৃহা।
সেই মুহূর্তে জিম এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিলো স্পৃহাকে। স্পৃহা ব্যাথায় জিমের শার্ট চেপে ধরেছে।
স্নিগ্ধা এসেই হতভম্ব হয়ে গেলো। অভ্র দৌড়ে স্পৃহার কাছে চলে এসেছে। স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে স্পৃহার পাশে বসলো। তারপর চিন্তিত গলায় বললো,” কি করে পড়ে গেলি তুই? নিজের অবস্থা দেখেছিস? এই জন্যে তোকে বলি একটু সাবধানে চলা ফেরা করবি। দেখলি তো কতটা ব্যাথা পেয়েছিস?”

স্পৃহা স্নিগ্ধার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর প্রায় কেঁদে ফেলে বললো,” আমি পড়িনি আমার মনে হলো কে যেনো আমাকে ধাক্কা দিয়েছে।”স্নিগ্ধা আর জিম দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো।
অভ্রর চোখে মুখে ভয়। সে টিভিতে ভূতের মুভিতে এমন অনেক কাহিনী দেখেছে। অভ্র দুই হাতে নিজের কান বন্ধ করে জিমের বুকের সাথে মিশে রইলো। জিম অভ্রকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো তারপর স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,” এমন কিছুই হয় নি। এই বাড়িতে কে তোমাকে ধাক্কা দিবে। হয়তো এটা তোমার মনের ভুল স্পৃহা।”

স্পৃহা কাপা শরীরে চোখ তুলে তাকালো জিমের দিকে তারপর কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে নুইয়ে পড়লো।
স্নিগ্ধার বুকের ভিতরটা অস্থিরতায় ভরে গেলো। স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে বললো,” জিম তুমি এখনো এইখানে কি করছো? গাড়ী বের করো ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।”
জিম এগিয়ে এসে স্পৃহাকে তুলে ধরলো তারপর মুখে পানি ছিটা দিতে দিতে স্নিগ্ধাকে বললো,” আমি ডক্টর কে ফোন করেছি এক্ষুনি এসে পড়লো।”

স্নিগ্ধা আরো অস্থির হয়ে বললো,” না। এইভাবে হবে না। ওকে হসপিটালে নিতে হবে। জিম প্লীজ গাড়ি বের করো। আমার বোন এমনিতেই অল্পতে ঘাবড়ে যায়।”
জিম চেষ্টা করে যাচ্ছে স্পৃহার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্যে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
এবার হসপিটালে নিতেই হবে কিন্তু তা হলে স্পৃহা আর অভ্র ওদের কি হবে? সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না কারণ রিস্ক আছে। তাকে একাই স্পৃহাকে নিয়ে যেতে হবে। বাড়ির সিকিউরিটি কে আরো সচেতন করে দিয়ে যেতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই হাতে।

জিম স্পৃহাকে আবার কোলে তুলে নিলো। তারপর স্নিগ্ধাকে বললো,” আপনি বাড়িতে থাকুক। অভ্রকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। এমনিতেই ও ভীষন ভয় পেয়েছে।”এইটুকু বলেই জিম গাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো।
যেতে যেতে তার কোলে থাকা এই কিশোরী মেয়ের দিকে সে এক পলক তাকালো। গাছের শুকনো পাতার মতন নেতিয়ে পড়ে আছে এই প্রাণচঞ্চল মেয়েটি। স্পৃহার এই মুখটা হটাৎ কেনো জানি জিমের ভিতরে এক ঝড় তুললো।
স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে অভ্রকে জড়িয়ে ধরলো।ভয়ে অভ্রর হার্টবিট মারাত্মক ভাবে বেড়ে গেছে। স্নিগ্ধা প্রথমে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো তারপর অভ্রকে কোলে তুলে বললো,” ভয় পাচ্ছো কেনো তুমি ? কিছু হয় নি। এইতো তোমার খালামণি কিছুক্ষণ পর বাসায় চলে আসবে।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ২৫

অভ্র কোনো কথা বললো না স্নিগ্ধাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। স্নিগ্ধা অভ্রকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। তারপর অনেক কষ্টে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। অভ্র কিছুতেই ঘুমাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টার পর সে ঘুমিয়েছে।
জিম বের হয়েছে প্রায় এক ঘন্টা কিন্তু এখনো কোনো খবর পায় নি সে। মনের ভিতরটা কেমন জানি করছে। স্নিগ্ধা নিজের ফোন নিয়ে রুমের থেকে বেরিয়ে এলো তারপর গেষ্ট রুম পেরিয়ে যেতেই সে দেখলো রুমটায় তালা বন্ধ করে রাখা কিন্তু আজ হটাৎ এই রুমে তালা মেরে রাখা হয়েছে কেনো? সকালের ঘটনাটা তার জানা নেই। সব কিছুর মতোই এই ঘটনাটিও তার থেকে আড়াল করা হয়েছে।
স্নিগ্ধা রুমটার দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আগেই কে যেনো পিছন থেকে রুমাল দিয়ে স্নিগ্ধার মুখ চেপে ধরলো।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ২৭

1 COMMENT

Comments are closed.