রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৬

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৬
নবনী নীলা

হুট করেই স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙতেই সে পাশে তাকালো। অভ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। স্নিগ্ধা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো,রাত একটা পনেরো, অথচ আদিল এখনো বাড়ি ফেরেনি। এতো কিসের ব্যস্ততা তার? স্নিগ্ধা বেশ সাবধানে অভ্রের পাশ থেকে উঠে পড়ল। গল্প শুনতে শুনতে অভ্র এই ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধা কোনো শব্দ না করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

এই বাড়িটা তার কাছে ধীরে ধীরে রহস্যময় হয়ে উঠেছে। এই বাড়িতে কোনো ফ্যামিলি ফটো নেই। কিন্তু কেনো? এমন কি অভ্রর ঘরে অভ্রর মায়ের ছবি পর্যন্ত নেই। এইটা কি অন্যায় না? এই বাচ্চাটির কি অধিকার নেই তার মাকে দেখার?
স্নিগ্ধার সন্দেহ আরো গাঢ় হয়েছে যখন সে দোতলার শেষ রুমটি তালাবদ্ধ দেখেছে। রোজ একবার একজন স্টাফ রুমটা পরিষ্কার করে আবার তালা দিয়ে রাখে। বিষয়টা স্নিগ্ধার কাছে খুবই অদ্ভূত লেগেছে। এমন কি আছে ঐ রুমে যে এত যত্ন করে রাখা হয় আর সবার থেকে আড়াল?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

স্নিগ্ধা সকাল থেকেই আদিলের জন্যে অপেক্ষা করছিলো। একটা কারণে সে ভীষন রেগে আছে। আজ সে নিজের মা বাবার সাথে দেখা করবে ভেবে বের হতে যাচ্ছিল। সেই সময় গার্ডরা তাকে বের হতে দেয় নি।
আদিল নাকি তাদের বলে রেখেছে তার অনুমতি ছাড়া যেনো স্নিগ্ধাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া না হয়। কিন্তু কেনো? সবকিছুতে ওই লোকটার পারমিশন নিতে হবে কেনো? এমন একটা বাড়িতে তাকে থাকতে হচ্ছে, যেখানে কথা বলার কেউ নেই।কেমন নিস্তব্দ একটি বাড়ি। মনে হয় কতগুলো রবোমানবের মাঝে সে একটি মাত্র মানুষ।

অভ্রর মতন একটা ছোট্ট শিশুকে নাকি জন্মের পর থেকে এই চার দেওয়ালের ভিতরেই থাকতে হচ্ছে। তাহলে কি তার সাথেও তাই হবে। কখনই না, সে এইসব মেনে নিবে না।
অভ্রর ব্যাপারটা জানার পর থেকে স্নিগ্ধার মাথায় রীতিমত রক্ত উঠে গেছে। একটা বাচ্চাকে এইভাবে কষ্ট দেওয়ার কি কোনো মানে হয়?

স্নিগ্ধা সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখলো জিম একপাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাই তুলছে। স্নিগ্ধা এগিয়ে গেলো তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,” কোথায় আপনার স্যার?”
স্নিগ্ধাকে দেখে জিম বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো তারপর বললো,” উনি তো আনোয়ার সাহেবের ঘরে ছিলেন।”
জিম ভেবেছিলো এ কথা শুনার সঙ্গে সঙ্গে স্নিগ্ধা উপরের রূমে চলে যাবে কিন্তু না স্নিগ্ধা আরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাক্কা গিন্নির মতোন বলল,” এতো রাত হলো কেনো?”

জিম কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বললো,” একটা কাজে স্যার আটকে গেছিলো। ”
স্নিগ্ধা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হলো না জিমের। মিথ্যে কথাটা ধরতে পেরে সে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেলো। স্নিগ্ধা রুমে ঢুকেই দেখলো আদিল ঘুমন্ত অভ্রর কপালে চুমু একে দিচ্ছে।

আদিলকে দেখে খুব টায়ার্ড মনে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু স্নিগ্ধার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তার হাতে বাঁধা সাদা রুমালটি। যার উল্টা পিঠে বিন্দু বিন্দু রক্তের দাগ ভাসছে। লোকটা কি কাউকে মেরেছে? নাকি নিজেকে নিজে আঘাত করেছে।
স্নিগ্ধাকে এইভাবে দরজার পাশে স্তম্ভিত অবস্থায় দাড়িয়ে থাকতে থেকে আদিল এগিয়ে এলো নিজের ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,” হটাৎ এতো রাত জাগার কি প্রয়োজন পড়লো তোমার? তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্যে জেগে নেই?”

স্নিগ্ধা উত্তরে কিছু বললো না। বললে কি বলবে? হ্যা আপনার জন্য জেগে আছি। হ্যা তারপর মহাজন উল্টা পাল্টা কথা শুরু করবে। তাই নিরবতাকেই নিজের হাতিয়ার বানালো সে। আদিল ঘড়িটা একপাশে রেখে মৃদু হেসে মাথা কাত করে জিজ্ঞেস করলো,” তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে?”

স্নিগ্ধা আদিলের কথায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর নিজেকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে সোজা প্রস্ন করে বসলো,” আপনার হাতে কি হয়েছে?”
আদিল ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধার এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো আদিল হাতের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে রেগে গিয়েছিলো। কিন্তু পরক্ষনেই নিজের রাগ চাপা দিয়ে একটা ভ্রু তুলে বললো,” কেনো তোমার কি আমার জন্যে চিন্তা হচ্ছে?”

স্নিগ্ধার ভীষন রাগ হচ্ছে, আদিল এতো কৌশলে কথাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে যে এই কয়দিনের পরিচয়ে তার পক্ষে অধিকার খাটিয়ে প্রশ্নের জবাব চাওয়া সম্ভব না।
স্নিগ্ধাকে এমন অপ্রস্তুত হতে দেখে আদিল বেশ মজা পাচ্ছে। নিজেকে সংযত রাখতে গিয়ে স্নিগ্ধা রাগটাও দেখাতে পারছে না। আদিল নিশ্চুপে স্নিগ্ধার কাছাকাছি এগিয়ে আসতে লাগলো। স্নিগ্ধা আগে থেকেই দেওয়ালের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো।

আদিল কাছে এসে দুপাশে হাত রেখে দাড়াতেই স্নিগ্ধা অস্থির হয়ে উঠলো। বিচলিত চোখে তাকালো। তার বুকের ভেতরে ধুক ধুক বাড়তে লাগলো। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
স্নিগ্ধা এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কি করছেন কি আপনি?”
আদিল ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,” যা করতে চাইছি সেটা কি করে দেখবো?,” তারপর একটু থেমে স্নিগ্ধার অগোছালো দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” হুম্?”

স্নিগ্ধা রাগী চোখে তাকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সে চোখের হালকা লাজুক দৃষ্টিতে আদিল মৃদু হেসে বললো,” তুমি এত ঝাঁঝালো কেনো?”
স্নিগ্ধা এবার ভুত দেখার মতোন করে তাকালো।তারপর রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,” ঝাঁঝালো মানে? দেখুন অনেক আজে বাজে বকেছেন। আমার একটাও প্রশ্নের উত্তর তো দিলেন না কায়দা করে এড়িয়ে গেলেন। এখন আমাকে আবার আমাকে ঝাঁঝালো বলছেন। আমি ঝাঁঝালো তো বিয়ে করেছেন কেনো? আমি কি আপনাকে নেমন্তন দিয়ে বলেছিলাম যে আসুন, এসে আমাকে বিয়ে করুন।”

আদিল ঝুকে এসে স্নিগ্ধার কানের কাছে মুখ আনতেই স্নিগ্ধা শিউরে উঠলো। শক্ত করে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে চোখ বুঝতেই আদিল ফিচেল গলায় বললো,” কারণ, তোমাকে দেখার পর থেকে ঝাল জিনিস আমার একটু বেশিই ভালো লাগে।”

স্নিগ্ধা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। পাশ ফিরতে আদিলের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে ফেললো সে। তারপর নিজেকে শান্ত করে প্রসঙ্গ ঘুরাতে গম্ভীর গলায় বললো,” দেখুন, আজে বাজে কথা বন্ধ করুন। আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলার প্রয়োজন ছিলো। তাই আমি এতক্ষন জেগে ছিলাম।”

আদিল স্নিগ্ধার কানের কাছে মুখ রেখেই বললো,” হুম্, বলো। আমি তো তোমার কাছেই আছি। নাকি আরেকটু কাছে আসতে হবে।” কথাটা বলে স্নিগ্ধার দিকে তাকাতেই দেখলো স্নিগ্ধা চোখ ছানবড়া করে তাকিয়ে আছে।
আদিল মনে মনে হাসলো তারপর স্নিগ্ধাকে আরো ভয় দেখতে একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতেই। স্নিগ্ধা আদিলের হাতের নিচ বেড়িয়ে এলো।

তারপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। হার্ট বিট যেনো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে তার।
আদিল মাথা নিচু করে হেসে ফেললো। তারপর দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুরে দাড়ালো।বুকের কাছে হাত ভাজ করে স্নিগ্ধার দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধা আড় চোখে একবার আদিলের দিকে তাকিয়ে বিছানায় গিয়ে অভ্রর পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। জেগে থেকে যে এমন বিপদে পড়তে হবে কে জানতো। কি সাংঘাতিক লোক রে বাবা! স্নিগ্ধা চাদর টেনে গলা পর্যন্ত দেখে চোখ বন্ধ করে রইলো। যা প্রশ্ন সেগুলো সকাল বেলা করতে হবে।

আদিল ফোঁস করে হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। কিন্তু সে জানে স্নিগ্ধার এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি তাকে আবার হতে হবে। কিন্তু স্নিগ্ধাকে সবটা বললে সে কি তাকে বুঝবে? যদি ভুল বুঝে ছেড়ে চলে যায়! তখন কি সে আটকাতে পারবে?
⭐ ভোরের আলো চোখে পড়তেই স্নিগ্ধার ঘুমটা ভেঙে গেলো। কিন্তু সে গাঢ় ঘুমের কারণে চোখ খুলতে পারলো না। তারপর হাত বাড়িয়ে অভ্রকে জড়িয়ে ধরতেই তার মনে হলো সে শক্তপেশির কাউকে জরিয়ে ধরেছে।

স্নিগ্ধা গাঢ় ঘুমের রেশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে চোখ মেললো। তারপর সামনে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেলো স্নিগ্ধার, ঘুমের ঘোরে এতক্ষণ তাহলে সে আদিলকে জড়িয়ে রেখেছে? স্নিগ্ধা দুঃস্বপ্ন দেখার মতোন লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়লো।
সকাল সকাল মারাত্মক একটা শক খেয়ে ঘুম ভেঙেছে তার। হৃদ কম্পন বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক ভাবে। স্নিগ্ধা ভ্যাবাচেকা খেয়ে আড় চোখে ঘুমন্ত আদিলের দিকে তাকালো। আসলেই কি ঘুমিয়ে আছে? জেগে থাকলে তো ভীষন বিপদ। কিন্তু সে আদিলের এতটা কাছাকাছি কি করে গেলো? মাঝে তো অভ্র ছিলো। স্নিগ্ধা মাঝে তাকিয়ে দেখে অভ্র নেই। কোথায় গেলো? ভেবেই চমকে আশে পাশে তাকিয়ে সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।

তারপর অনায়াসে তার মুখে হাসি ফুটে গেলো। এ কেমন সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী সে? আদিলের বুকের সাথে একদম মিশে আদিলকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে অচেতন হয়ে আছে অভ্র। আদিল তার এক বলিষ্ঠ হাতে আগলে রেখেছে তাকে। দেখেই কেমন মায়ায় পড়ে গেলো সে।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৫

পরক্ষনেই এই মহূর্তটাকে ক্যামেরা বন্দি করতে পা টিপে টিপে উঠে পড়লো সে। নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে ছবি তুলতেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট গিয়ে পড়লো আদিলের চোখে। স্নিগ্ধা একদম খেয়ালই করে নি যে লাইটটা অন করা ছিলো। ছবি তোলার পর দেখলো, আদিল ঘুম ঘুম চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা ফট করে ফোনটা লুকিয়ে ফেলে কিছু না হওয়ার ভান করতে লাগলো। কোনো লাভ হচ্ছে কিনা সে জানে না। আদিল তো তাকে ফোন হাতে দেখে নিয়েছে। আবার কি উল্টা পাল্টা কথা শুনতে হয় তাকে।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৭