রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩৪

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩৪
সিমরান মিমি

চেয়ারে বসে টেবিলের উপর রাখা বইয়ে মাথা রেখে ঝিমুচ্ছে আর্শি।মন-মেজাজ কিচ্ছু ভালো নেই।একে তো সারাবছর বইয়ের ধারে-কাছে না যাওয়ার কারনে সম্পুর্ন অচেনা বস্তু এগুলো।তার উপর পড়তে গেলেও পাভেল ভাইকে নিয়ে নানা জল্পনা -কল্পনায় মেতে থাকে।একজন মৃত মানুষকে নিয়ে এমন কল্পনা করা বরাবর’ই অনুচিত। তা জেনেও মন বারবার ভেসে যাচ্ছে অযৌক্তিক কল্পনায়।

এই যেমন পাভেল ভাই বেচে থাকলে তাদের বিয়ে হতো,খুব সুন্দর একটা সংসার হতো,আর্শি সারাক্ষণ দুষ্টুমি করতো তার সাথে, তাদের একটা ছোট্ট বাচ্চা থাকতো।পরক্ষণেই বাস্তবে আসতেই বিষাদে ছেয়ে পড়ে পুরো মুখমন্ডল।আবারো ভাবনায় মশগুল হয় সে।আচ্ছা,যদি এখন হুট করে পাভেল ভাই বেচে উঠতো।তার কাছে এসে চিৎকার করে বলতো “আর্শি আমি তোমার ভালোবাসার জোরেই ফিরে এসেছি।তখন?তখন দেশ-বিদেশের মানুষ ছুটে আসতে আর্শি নামের এই প্রনয় প্রেয়সীকে দেখতে। ইশশ এটা তো কেমন সিনেমাটিক ভাবনা হয়ে গেল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভাবনাতে মশগুল থাকতেই হঠাৎ করে খালি পায়ের উপর চিকন বেতের বাড়ি পড়লো।আতকে উঠে লাফ দিয়ে চেয়ারের উপর দাড়ালো আর্শি। পা টা বারকয়েক ঝাড়ি দিয়ে ছলছল চোখে রাহুলের দিকে তাকালো।মুহুর্তেই অশ্রুরা হানা দিলো বড় বড় মায়াবী চোখ দুটোতে।পায়ের উপর টা লাল হয়ে গেছে।রাহুল ধমকে সামনের চেয়ারে বসলো।কন্ঠে কাঠিন্য এনে বললো-

কি ভাবছিলে তুমি?কতটুকু পড়েছো?
আর্শি নাক টেনে অন্য দিকে তাকালো।এটা তো তার জামাই।অথচ ভাব দেখো,যেন একে বেতন দিয়ে হোম টিউটর হিসেবে রেখেছে।তার উপর এতো বড় মেয়ে সে।তার গায়ে কথায় কথায় হাত দেয়।অসভ্য শিক্ষক।এর নাকি ভার্সিটিতে চাকরি হয়েছে।দু-দিন ও টিকবে না এই চাকরী।কান ধরে টেনে গেটের বাইরে বের করে দেবে স্টুডেন্ট রা।থমথমে মুখে বললো-
হয়েছে তো প পড়া।

রাহুল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বই হাতে নিলো।গ্রামারের রুলসের মধ্যে অসংখ্য A+P লেখা।ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।ইচ্ছে করছে আরো দুটো দিতে।নিজেকে ক্ষান্ত করে ত্যাড়া কন্ঠে বললো-

শোনো আর্শি,সকাল সাতটা থেকে এগারোটা,আবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে এগারোটা।অন্তত এই আট ঘন্টা পড়ায় মন দাও।বাকি পুরো ষোলো ঘন্টা তোমার মরে যাওয়া প্রেমিককে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করো আমার কিচ্ছু যায় আসে না।এতো বড় মেয়ে অথচ গ্রামারের গ ও পারো না।কে পাস করাইছিলো এসএস সি তে।মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ো,যদি কোনো রকমে এইচএসসি তে ফেল করো বা করার আশাও থাকে।তাহলে তোমায় পিরোজপুরো ছুড়ে মারতে আমার দু মিনিট ও লাগবে না।সেখানে যাওয়ার পর আরো তো দুইটা ভাই আছে বেচে।এবারে ওরা ধরে বিয়ে দিয়ে দিবে।

যদি এখানে শান্তিমতো স্বাধীন ভাবে থাকতে চাও তাহলে লেখাপড়ায় মন দাও।নইলে দরজা খোলা আছে সোজা চলে যাও।আমি চাই না পাড়ার কেউ বলুক রাহুলের বউ ফেল করছে। মাথায় রেখো।
এগুলো দশ মিনিটের মধ্যে মাথায় ঢুকিয়ে নাও।নইলে ওই মাথা আবার ফাটাবো।
বলেই হনহন করে বাইরে বেরিয়ে গেল রাহুল।আর আর্শি।সেতো টলমল করা চোখ নিয়ে রাহুলের দিকে তাকিয়ে রইলো।
কি করে এতোগুলো কথা তাকে শোনালো সে?থাকবে না সে এই বাড়িতে।চলে যাবে।

মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল আর্শির।নাহ,মরে গেলেও ওই বাড়িতে সে আর হুশ থাকতে পা রাখবে না।প্রয়োজনে এখানে সবার কটু কথা শুনে তার পর বসে থাকবে।না না,সে মন দিয়ে পড়বে।এই বুড়ো ব্যাটাকে ভালো রেজাল্ট করে তারপর দেখিয়ে দেবে।হুহ।

দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ঢুকরে কেদে উঠলো স্পর্শী। হাতের ঘড়িতে চেয়ে দেখলো ১০:৪৭ বাজে।চোখের কোন মুছে সামনের দিকে তাকালো।লম্বা জ্যাম।তাহলে কি সে পারবে না নেতামশাইয়ের সাথে দেখা করতে?ওদিকে কি হলো কিচ্ছু জানে না সে।টানা আধ ঘন্টা ধরে সে জ্যামে আটকে রয়েছে।

এরইমধ্যে জ্যাম ছেড়ে দিলো।দ্রুত গাড়ি চলতে লাগলো জেলা জজ আদালতের উদ্দেশ্যে।গাড়ি থামতেই দ্রুত ভেতরে ছুটলো স্পর্শী।অজস্র উকিল,পুলিশ, আসামীদের আনাগোনা।সে তো কিছুই চেনে না।এতটা লম্বা ভবনগুলোর মধ্যে কিভাবে খুজে পাবে সে।একজন পুলিশের কাছে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো কাঙ্ক্ষিত ভবন টি।দ্রুত সেদিকে ছুটলো।আদালতে জাস্ট দশটায় কেসটা ওঠার কথা।বরিশাল থেকে আসতে আসতে যে এতটা দেরী হয়ে যাবে সেটা ক্ষুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি স্পর্শী।কে জানতো আজকে রাস্তায় এতটা জ্যাম হবে।

হঠাৎ আলতাফ শিকদার,মহীউদ্দীন শিকদার, সুমন সহ দলের অন্যান্যদের ম্লান মুখে বের হতে দেখেই পিলে চমকে উঠলো স্পর্শীর।ছুটে তাদের সামনে যেতেই সুমন ম্লান মুখে বললো-
ভাবি , আসতে এতো দেরী হলো কেন?
নিজেকে সংযত করে থমথমে কন্ঠে বললো-
জ্যাম ছিলো রাস্তায়।ওদিক টায় কি হলো?

বিতৃষ্ণায় উকিলের দিকে তাকালো সুমন।উকিল রাগত স্বরে বললো-
আমি না থাকলে ফাসি না হয় জেল হয়ে যেত।আসামীর খুনের ভিডিও ফুটেজ সহ অসংখ্য লোকের সাক্ষী আছে।তার উপরে এমপি সাহেব নিজে দোষ স্বীকার করছে।এখানে আমার আর কি করার ছিলো।তাও তো অনেক টেকনিক খাটানোর পর বাইশ বছর সাজা দিলো জজ সাহেব।

থমকে গেল স্পর্শী।অস্পষ্ট কন্ঠে মুখ দিয়ে আওড়ালো –
বাইশ বছর।
পরক্ষণেই উত্তেজিত কন্ঠে বললো-
নেতামশাই কোথায়?আমি ওনার সাথে দেখা করবো।
উকিল সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললো-
একটু পরেই পুলিশ নিয়া আসবে ওনাকে।এখান থেকে হাজতে নিয়ে যাবে।

আচমকা দূর থেকে চারজন পুলিশের মাঝখানে হ্যান্ডকাফ বাধা পরশ কে দেখেই ছুটলো সেদিকে। মাত্র তিনদিনের মধ্যে একদম শুকিয়ে ম্লান হয়ে গেছে মুখটা।গায়ে আসামীদের সাদা কালো ডোরাকাটা পোশাক। পুলিশের সামনে যেতেই স্পর্শী গম্ভীর কন্ঠে বললো-
আমি ওনার স্ত্রী।মাত্র পাচ মিনিট কথা বলবো। প্লিজ।
ইনস্পেকটর মাথা নাড়িয়ে একটু সাইডে গেলেন।তবে ওনাদের কঠোর দৃষ্টি আসামীর দিকে।যতই সম্মানীয় হোক না কেন সে,যদি পালিয়ে যায়।

পরশ স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো।মনে মনে এই মুখ টা দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো তার। আদালতে ঢুকতেই সমস্ত পাবলিকের মধ্যে চোখ জোড়া চাতক পাখির ন্যায় এই তোতা পাখি টাকে খুজছিলো।কিন্তু আফসোস!পায় নি।
–কেন করলেন এমন নেতামশাই?কি দরকার ছিলো ওদের এভাবে খুন করার?পুলিশের কাছে বলতেন।ওরা সাজা দিতো।
মুহুর্তেই হাস্যজ্জ্বল মুখটিতে বিষাদ ছেয়ে গেল।চোয়াল শক্ত করে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলল-

রক্তে টান লাগছে?আমার’ও লেগেছিলো।
থেমে করুন কন্ঠে,
এতোটা স্বার্থপর হো’স না বউ।সইতে পারবো না।
স্পর্শী থমকালো।সে কি সত্যিই স্বার্থপর।পরক্ষণেই ছলছল চোখে পরশের দিকে তাকিয়ে বললো-
আপনি বুজতে পারছেন না নেতামশাই।পাভেল নেই,আম্মু-আব্বু ভীষণ ভেঙে পড়েছে,প্রেমা অসুস্থ, আপনিও নেই।কি ভাবে বাচবে এই পরিবার টা।

আর আমি?আমি আপনাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবো এতটা বছর।এক নয়,দুই নয় পুরো বাইশ টা বছর।
চোয়াল শক্ত করে ফেললো পরশ।দুহাত দিয়ে স্পর্শীর গাল আকড়ে ধরে কঠিন কন্ঠে বললো-
শুধু বাইশ বছর কেন পাখি?প্রয়োজনে আজীবন অপেক্ষা করবে আমার জন্য।যদি কখনো শুনেছি ও না আমার অনুপস্থিতিতে অন্যকারো কারো সাথে জড়িয়েছো।খোদার কসম,আমার হাতের চতুর্থ খুন টা তুমি হবে।

বাক হারা হয়ে গেল স্পর্শী । নেতামশাই কি তাকে অবিশ্বাস করছে?মুহুর্তেই ভালোলাগায় ছেয়ে গেল হৃদয়।সে তো চেয়েইছিলো কেউ একজন এতটা কঠোর ভাবে তার উপর অধিকার ফলাক।তাকে শাসন করুক। লোকজন,পুলিশ সবাইকে অগ্রাহ্য করে পরশের বুকের উপর হামলে পড়লো স্পর্শী।কান্নারত কন্ঠে বলতে লাগলো-

আপনি একদম কোনো চিন্তা করবেন না নেতামশাই।আমি আছি তো।কিচ্ছু হবে না আপনার।প্রয়োজনে আমি হাইকোর্টে আপিল করবো।তাও আপনাকে এতো কষ্ট পেতে দেব না।আর বাড়ি?বাড়ির সবাই কে নিয়ে একদম কোনো চিন্তা করবেন না।প্রেমা এখন অনেকটা সুস্থ।আমি আছি তো।সব সামলে নেব।
এরইমধ্যে ইনস্পেকটর তাড়া দিয়ে নিয়ে গেল পরশ কে।হেচকি তুলে সে দিকে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।আচমকা বসে পড়লো সেখানেই।শরীর যে আর মানছে না।এতটা মানসিক চাপ,যন্ত্রনা,এতটা পথ জার্নি করে আসা -যাওয়া,শরীর টা যে আর মানছে না।

এরই মধ্যে হাতের ফোন টা বেজে উঠলো।অনন্দা ফোন দিয়েছি।রিসিভড করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে তড়িঘড়ি করে বললো-

স্পর্শী,তুই কি আর ভার্সিটি তে আসবি না।এদিকে এক্সামের নোটিশ দিয়ে দিয়েছে।তুই প্রায় তেরো দিন ধরে ক্লাস করিস না।এতটা অনিয়মিত হলে তোর উপর তো চাপ পড়বে।
দেয়ালে মাথা হেলিয়ে দিলো স্পর্শী।অস্পষ্ট কন্ঠে ওকেও বললো-

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩৩

আমি সামলে নেব অনু।আমি সব টা সামলে নেব।
বলেই ফোন কেটে দিলো।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩৫