রাজনীতির রংমহল পর্ব ৯

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৯
সিমরান মিমি

বিকেল পাচটা।সূর্যের তপ্ত হাওয়া কমে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে ধরনীতে।হোস্টেলের সামনের বাগানে আমতলায় হাটু মুড়িয়ে বসে ফোনের দিকে নিরব হয়ে তাকিয়ে আছে স্পর্শী। এই মুহুর্তে পৃথিবীর সমস্ত মন খারাপেরা তাকে ঝেকে বসে আছে।কারো সাথে কথা বলার জন্য ভেতরটা তুমুলভাবে ছটফট করছে।রাতে দেরি ঘুমানোর জন্য সকালে বেশ দেরী করে উঠেছে সে।তাড়াহুড়ো করে খেয়ে ভার্সিটি তে ছুটেছে।

সারাদিন ভার্সিটির ক্লাস,বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা,সেখান থেকে হোস্টেলে এসে গোসল করে খেয়ে-দেয়ে বেশ ব্যাস্ততম সময় পার করেছে।কিন্তু বাধ সাধলো বিকেলবেলাতে।অনন্দাও বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে।সারাদিন পর এই একাকী বিকেলে নেতামশাই নামক স্বল্প আলাপের ব্যাক্তিটা ভেতর’টা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।ইশশ এ কেমন অনুভূতি? কত মানুষকে ঘোল খাওয়ানো স্পর্শী কিনা শেষ পর্যন্ত কারো প্রেমে পিছলে পড়ে গেছে।আচ্ছা এই হঠাৎ অনুভূতি কি শুধু নেতামশাই য়ের সদ্য জন্ম নেওয়া অবহেলার জন্যই প্রকাশ পেয়েছে? ভাবতে পারলো না স্পর্শী।ফোন হাতে কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে কল দিয়েই বসলো।রিং হচ্ছে…

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পার্টি অফিসে মিটিং চলছে।গোল টেবিলে সমস্ত বড় বড় নেতারা বৈঠকে বসেছেন।পরশ শিকদার তাদের মধ্যমনি।বেশ মনযোগ সহকারে তার প্রতিটা কথা শ্রবণ করছে তারা।হঠাৎ ফোনের রিং বাজতেই বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো পাভেলে’র দিকে।অন্য সবাই ও মনযোগ কে সামান্য সময়ের জন্য নষ্ট করে পাভেলের দিকে চাইলো।কিন্তু পাভেল নিরব,নির্বাক হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।নাম্বার’টা “স্পর্শীয়া” লিখে সেভ করা।

এটা তো ভাইয়ের পার্সোনাল ফোন।এই নামের কোনো মেয়েকে সে চেনে বলে তো মনে হয় না তাও আবার ভাইয়ের ফোনে তার নাম্বার সেভ করা।আশেপাশে কয়েকবার তাকিয়ে ফোনের স্ক্রিন টা পরশের সামনে ধরলো।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ফোন বাজতে থাকা স্পর্শীর নাম্বারের দিকে।কাল এভাবে ইগনোর করার পর থেকেই পরশ নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় কাজে ব্যাস্ত থেকেছে।আর যাই হোক,কারো উপর নিজের অনুভূতিকে চাপিয়ে দেওয়ার মতো কাপুরুষ ও সে নয়।সেজন্যই এখন পর্যন্ত স্পর্শীকে ফোন তো দূর একটা মেসেজ ও করে নি সে। এই মুহুর্তে ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা কাজ করছে পরশের।স্পর্শী তাকে নি’জে থেকে ফোন করেছে।তাহলে কি সে তাকে মিস করছিলো।ভাবতেই ঠোটের মধ্যে সবার অগোচরে এক দূর্বোধ্য হাসির রেখা মিললো।

আশে-পাশের সবাই উদগ্রীব হয়ে পরশের দিকে তাকিয়ে আছে।কিছুটা দোটানায় পড়লো সে। এই মুহুর্তে ফোন রিসিভড করে কথা বলাটা সংগত হবে না।পরক্ষণেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো-
যেই ঝাঝ লবঙ্গবতী তাকে ফোন দিয়েছে সে যে মারাত্নক রকমের ইগো ওয়ালী।সামান্য একটু অনুভূতির টের পেয়েই হয়তো ফোন দিয়েছে। এখন যদি রিসিভড না করে, না জানি সারাজীবনের জন্য সিম অফ করে ফেলে।
সবার মাঝখানে দাড়িয়েই ফোন রিসিভড করলো পরশ।স্পিকার মুখের সামনে এনে গম্ভীর কন্ঠে বললো-

মিটিংয়ে আছি,বিশ মিনিট পর কল করছি।সিম বন্ধ করার কথা মাথায় ও আনবে না।
বলেই কেটে দিল।অবাকের শেষ পর্যায়ে এসে বাকহারা হয়ে গেল পাভেল।কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পরশ চোখ রাঙানি দিয়ে চেয়ারে বসতে বললো । তারপর পুনরায় সবার মনযোগ আকর্ষন করে নিজের বক্তৃতা দিতে লাগলো।কিন্তু আর কতক্ষণ?পাচ মিনিট কষ্ট করা কথা বলতেই হাসফাস করে উঠলো।তার এই মুহুর্তে এই সব বোরিং কথাবার্তা বলতে ভালো লাগছে না।স্পর্শীর ত্যাড়া কথা শোনার খুব দরকার।পেটের মধ্যে কেমন কিলবিল কিলবিল করছে।যদি স্পর্শী রাগ করে ফোন বন্ধ করে দেয়। নাহ,এটা হওয়া উচিত নয়।তাড়াহুড়ো করে বিদায় দিল দলের সদস্যদের।পাভেল’কে বলে নাস্তা করানোর জন্য পাঠিয়ে দিল তাদের সাথে।তারপর আরাম করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।

ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসফাস করছে স্পর্শী।ইশশ,লোকটা মিটিংয়ে ছিলো। তার উচিত হয়নি ফোন দেওয়া।ধুর!কি ভাবলো?
ভাবতে ভাবতেই ওপাশ থেকে ফোন আসলো পরশের। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মিনিটের কাটার দিকে।সবেমাত্র আট মিনিট হয়েছে।সে তো বলেছে আরো বিশ মিনিট।ভাবতে ভাবতেই ফোন রিসিভড করলো।কানে নিতেই ওপাশ থেকে শান্ত কন্ঠে ভেসে আসলো-

তুমি যে কতটা ভয়ংকর মেয়ে, তা কি তুমি জানো?
অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে ফেললো স্পর্শী।সে ভয়ংকর।কেন?কি করেছে সে?
কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে পরশ বলে উঠলো-
তোমার জন্য মিটিং ফিটিং সব ক্যান্সেল করে বসে আছি।মনে হচ্ছিলো দলের সদস্যদের টেনে হিচড়ে বের করে দেই।জানো?পেটের মধ্যে কেমন খুশখুশ করছিলো তোমার সাথে কথা বলার জন্য।
হেসে দিয়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো স্পর্শী।সে কি লজ্জা পাচ্ছে।হ্যা,একটু হয়তো পাচ্ছে।তার সাথে কেউ কথা বলার জন্য এতটা উদগ্রীব ভাবতেই কেমন লাগছে।শান্ত কন্ঠে বললো-

নেতামশাই,ভালোবাসেন আমায়?
নির্বাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো পরশ।আজ এতোদিন পরেও স্পর্শী কি না তাকে ভালোবাসে কি না সেটা জিজ্ঞেস করছে।রাগ লাগছে পরশের।দাত কিড়মিড় করে বলে উঠলো-
কেন?এবার কি সাইনবোর্ডে লিখে গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে হবে?
দমে গেল স্পর্শী।কিছুটা লজ্জাও পেল নিজের এমন প্রশ্নে।কিন্তু তার তো শুনতে ইচ্ছে করছে নেতামশাইয়ের মুখ থেকে।কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবার বললো-

বলুন না।দেখুন আপনি একদম হেয়ালি করবেন না।এতোদিন যা ছিলো সব বাদ।এবার নতুন করে বলুন?প্রেম করবেন আমার সাথে?
পরশ নিঃশব্দে হাসলো।মেয়েরা পারেও বটে।ইচ্ছে করে বারবার কারো মুখ থেকে নিজের নামে ভালোবাসার কথা, প্রশংসার কথা শুনতে মরিয়া হয়ে থাকে। বললো-
উহুম,প্রেম করতে তো চাচ্ছি না।বিয়ে করতে চাচ্ছি।করবে আমায় বিয়ে?
সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ত্যাড়া কন্ঠে ভেসে আসলো-

এই আপনি এতো বিয়ে বিয়ে করে লাফাচ্ছেন কেন হ্যা?যাতে একসাথে ফাসাতে পারেন আমায়।এই এই আপনি এর আগে আবার দু-চারটা বিয়ে টিয়ে করে রাখেন নি তো।বউ ছেড়ে চলে গেছে বুঝি।এখন আমাকে ফাসিয়ে দুম করে বিয়ে করতে চাইছেন।কি ভেবেছেন বিয়ের পর জানলে তখন কিছু করার থাকবে না, তাই তো।শুনুন,স্পর্শী ওত্তো বোকা না।আগে আপনার সাথে কদিন প্রেম করবো,আপনার ফুল বায়োডেটা জানবো,দেন বিয়ে-টিয়ে।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল পরশ।এ মেয়ে কতদুর পর্যন্ত ভেবে নিয়েছি।মাই গড!অবাক হওয়া কন্ঠে বলে উঠলো-

আমাকে দেখে তোমার বিবাহিত ছেলেদের মতো মনে হয়?
চেচিয়ে উঠলো স্পর্শী।বললো-
এই আপনি আমার সম্পর্কে কি ভাবেন বলুন তো?আমি ওইসব মেয়ের মতো নাকি যে কোনো ছেলেকে দেখেই বলতে পারবো সে বিবাহিত কি না?

পুনরায় হতভম্ব হয়ে গেল পরশ।সে কি বলে আর এই মেয়ে কোথায় নিয়ে যায়।নিজেকে সং যত করে বললো-
স্পর্শীয়া,আমি বলতে চাইছিলাম প্রেম তো বিয়ের পরেও করা যায় তাই না।আমি একজন নেতা মানুষ, আমার কি সেই বয়স আছে নাকি।আর তুমিও তো ছোট নও।
–কেন?কেন?আমার প্রেম করার বয়স নেই,এখন আমাকে বুড়ি বুড়ি লাগছে।প্রেম করতে হলে তো কচি মেয়ে লাগবে?তো আমার কাছে আসছেন কেন?কচি মেয়ের কাছে যান।অভাব পড়বে না।আমাকে আর ফোন দিবেন না।

—-এইই এই স্পর্শীয়া,ফোন কাটবে না।আরে আমি তো সেটা বলিনি। তুমিই ভুল ভাবছো।আচ্ছা,আচ্ছা করবো প্রেম৷আগে প্রেম করবো তারপর বিয়ে।ওকে
বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো পরশ।স্পর্শী দাত কেলিয়ে হেসে দিলো।তারপর কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বললো-
দেখা করুন।

—কিইই?কবে?
–উমমম কাল করুন দেখা।
–এই না না প্লিজ।ঢাকা যেতে গেলে প্রায় পাচ-ছয় ঘন্টা লস হয়ে যাবে।আমি চার পাচ দিন পরে এমনিতেও আসবো।তখন দেখা করে নিব।এখন পার্টির কাজে খুব বিজি আছি।
–ওকেএএ,তাহলে আপনি ওটা নিয়েই থাকুন।এমনিতেও নেতা-ফেতার দ্বারা প্রেম হয় না।রাখছি।
-থাপড়ে গাল লাল করে দিব বেয়াদপ মেয়ে।আসছি কাল,বিকেলের দিকে আসলে চলবে?
দাত কিড়মিড় করে বললো পরশ।
স্পর্শী হেসে দিয়ে বললো-

শুধু চলবে না নেতামশাই,দৌড়োবে।রাখছি,বায়।
তারপর ওপাশের কোনো কথা না শুনেই ফোন কেটে দিল স্পর্শী।দাত দিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে হেসে দিলো।তারপর মুখে বললো-
নেতামশাই,খুব শখ না স্পর্শীর সাথে প্রেম করার।তোমার প্রেমের পিন্ডি চটকিয়ে দিব।এমন জ্বালান জ্বালাবো না,নেতাগিরি ছুটিয়ে দিব।

দলের অন্যান্য সদস্যদের কোনোমতে খাইয়ে বিদায় করেই পুনরায় অফিসের দিকে ছুটলো পাভেল। তার মনের ভেতর তো এখন স্পর্শীয়া নামটা দাবানলের মধ্যে দাউদাউ করছে।কে এই মেয়ে?যার নাম্বার কি না তার ভাইয়ের পারসোনাল ফোনে ঠাই পেয়েছে।দরজার সামনে আসতেই পরশকে ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে দেখেই পেটে মোচড় মারলো পাভেলের।নির্ঘাত তার ভাই প্রেমে পড়েছে।অথচ সে জানেই না।মুখটাকে ইনোসেন্ট ভাবে শো করে পরশের সামনের চেয়ার টাতে বসলো।বললো-

এই স্পর্শিয়া কে ভাই?
পরশ চমকালো না।পাভেল যে তাকে আজ এই ব্যাপারে সারাক্ষণ জ্বালাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলো। মুখটাকে গম্ভীর করে বলল-
একটা মেয়ে।
সাময়িক সময়ের জন্য পেট উগড়ে একটা বিচ্ছিরি কথা বের হতে চাইলো।কিন্তু নেতারুপি বড় ভাইয়ের সামনে কথাটা গিলে নিল।স্পর্শিয়া যে কোনো মেয়ের নাম সেটা সে তার জন্মের আগে জানে।মুখ থমথমে করে বললো-
মেয়েটা কে?তুই কি প্রেম করছিস?

–নাহ,আপাতত বিয়ে করতে চাইছি।সফল হলে জানাবো।খবরদার বাড়ির কেউ যেন টু শব্দটাও না জানে। জানলে কিন্তু খুব পস্তাবি।সময় হলে আমি নিজেই জানাবো।
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠলো।
পাভেল ছুটে গিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে বসলো। বললো-
আচ্ছা বলবো না।অন্তত ছবি টা দেখাও।একটু চোখ জোড়া একটু শান্ত করি।
পরশ ভ্রু কুচকে তাকালো।বললো-

আমার কাছে কোনো ছবি নেই।এখন সর এখান থেকে।আর ছবি দেখার কোনো প্রয়োজন ও নেই। ওকে তুই চিনিস।
লাফিয়ে উঠলো পাভেল।উত্তেজনাকে চাপিয়ে রেখে কোনোমতে বললো-
কে?কে?আমি দেখেছি?দেখতে কেমন?
বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারন করলো পরশ। বললো-

ওই বাবুর আম্মু।নির্বাচনের দিন যে মেসেজ দিয়েছিলো। যাকে নবীনগরের সামনে বসে থাপ্পড় মেরেছিলাম।
দুম করে চেয়ারের উপর বসে পড়লো পাভেল।মাথায় হাত দিয়ে পরশের দিকে তাকিয়ে বললো-
তারমানে ওই মেসেজ ভুল ছিলো না।আগে থেকেই তোর সাথে রিলেশন ছিলো ওই মেয়ের।এমনকি তোদের বাচ্চাও হবে।কি করে পারলি আমাদের ঠকাতে?
থেমে,

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৮

জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বলল-
ভাই কি করে সামলাস ওকে?
সাথে সাথেই দুম করে পিঠের উপর কিল বসিয়ে দিল পরশ।পাভেল ছুটে অফিসের বাইরে যেতে যেতে বললো-
আজকে বাসায় আসিস?তোর জন্য বিরাট জনসভা বসাচ্ছি।প্রতারক!

রাজনীতির রংমহল পর্ব ১০