রাজনীতির রংমহল পর্ব ১০

রাজনীতির রংমহল পর্ব ১০
সিমরান মিমি

থমথমে শিকদার মহল।বসার রুমে গোল হয়ে সবাই বসে আছে।মহীউদ্দীন শিকদার,তার পাশেই বসা ছোট ভাই আলতাফ শিকদার,অন্যপাশে প্রেমা এবং ফোন স্ক্রল করতে থাকা পাভেল’কে দেখা যাচ্ছে।সোফার পাশেই থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিয়াশা এবং রোমানা শিকদার।পরশ ত্রস্ত পায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলো।সবাইকে বসা থাকতে দেখে সাময়িক ভাবে দাড়িয়ে পড়লো।ঘটনা কতদুর গড়িয়েছে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত।দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেটে সিড়ির কাছে গেল। আলতাফ শিকদার মুখ খুলতেই পরশ বললো-

দশ টা মিনিট সময় দাও চাচ্চু। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।সব টা বলবো,একটু অপেক্ষা করো।
ঢুকরে মুখের উপর আচল দিয়ে কেদে উঠলেন পিয়াশা।সব টা বলবো মানে নিশ্চয়ই পাভেলের কথাই ঠিক।হায় আল্লাহ, কোন রাক্ষসীর কবলে পড়লো তার ছেলেটা?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মহীউদ্দীন শিকদার শান্ত চোখে পিয়াশার দিকে তাকালেন।তারপর চুপ করে বসার ইশারা দিলেন।পিয়াশা শুনলো না।ছোট বেলা থেকে মেয়েমানুষ থেকে দুরে থাকা তার রষকশহীন ছেলেটা কি না বিয়ে করেছে।কি করে সম্ভব এটা?
শান্ত ভঙ্গিতে সিড়ি দিয়ে নামলো পরশ।আসন্য বোম ব্লাস্ট হওয়া সম্পর্কে জ্ঞাত সে।তারপরেও কিছু না জানার ভান ধরে সোফায় বসে বললো-

এখন বলো?
টইটম্বুর হওয়া চোখ নিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন।ঝড়ের গতিতে বললেন-
মেয়েটা কে?কবে বিয়ে করছিস?এমপি হয়েছিস বলে কি আমাদের সামান্য একটুও মূল্য দিবি না।যা
খুশি তাই করবি?

কটমটে চোখে পাভেলের দিকে তাকালো পরশ।ফোন থেকে চোখ সরিয়ে নিজের পিঠে হাত বুলিয়ে দাত কেলিয়ে চাইলো পাভেল।উদ্দেশ্য তখন কার কিল মারাটা যে পরশের অনুচিত হয়েছে সেটাই বোঝাতে চেয়েছে।পরশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
সেরকম কিছু নয় মা।আশ্চর্য! আমি বিয়ে করতে চাইলে তোমাদের লুকিয়ে কেন,সামনে দাঁড়িয়ে করলেও কার ক্ষমতা আমাকে আটকানোর?

তাহলে পাভেল যে বললো স্পর্শীয়া নামে কোন মেয়েকে বিয়ে করেছিস?(পিয়াশা দ্রুতবেগে বললো)
পুনরায় পাভেলের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো পরশ।পাভেল নড়েচড়ে বসলো।পরশ মাকে বললো-
বিয়ের জন্য এতোদিন লাফাচ্ছিলে।সেই জন্যই মেয়ে দেখতে নেমেছি।তাই বলে তোমরা রোজ রোজ আমাকে কাঠগড়ায় বসাবে?ধুর,সব বাদ । আমার এমনিতেও কাজের অভাব নেই।তার উপর বাড়তি ঝামেলা।
খানিকটা নরম হলো পিয়াশা।বাদবাকি সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাদের কথা শুনছে।পরশের উদ্দেশ্যে বললো-
মেয়েটা কে বাবা?তোর ফোনে নাকি ফোন ও দেয়?

–মেয়েটাকে আগে আমি একটু বুঝি,চিনি।তারপরে তোমাদের জানাবো।ভালোলাগলে আগাবে নইলে ওখানেই শেষ। আশা করি আমাকে আর জ্বালাবে না।খিদে পেয়েছে।
দ্রুতবেগে মাথা দু দিকে নাড়িয়ে না বললো পিয়াশা।মুখে বললো-
আচ্ছা,আচ্ছা কিচ্ছু বলবো না।কিন্তু যা করবি একটু তাড়াতাড়ি করবি।
বলে রোমানাকে নিয়ে রান্নাঘরে গেল খাবার বাড়তে।মহীউদ্দীন ও সোফা থেকে উঠে রুমের দিকে হাটা ধরলো।পরশের চাচা একজন’ই।তবে তারা একসাথে নয় পাশাপাশি বাড়িতে থাকে।কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেই এক হয় তারা।
বাবা যেতেই পরশের দিকে তাকিয়ে দাত কেলালো পাভেল।বললো-

আমি কিন্তু বাড়িতে বলি নি যে তোর বাবুর আম্মুর বাবুও আছে।ওতোটাও পেট পাতলা ভাবিস না আমাকে।
পরশ ভাইয়ের দিকে তাকালো।তারপর বললো-
ভীষণ দয়াবান আপনি।দয়া করে একদম উদ্ধার করে ফেলেছেন আমায়।
রাতের খাবার শেষে গটগট পায়ে রুমে ঢুকতেই দ্রুতবেগে খাটে এসে বসলো পাভেল।মুখে তার রাজ্যের চিন্তাভার।রিষিয়ে রিষিয়ে পরশের উদ্দেশ্যে বললো-

ভাই,তুই কি সত্যিই বাবুর আম্মুকে বিয়ে করছিস।না মানে,আমি বলছিনা যে সে খারাপ।কিন্তু দেখ,যে মেয়ে সামান্য মেসেজ দিয়েই প্রেম করতে পারে।সে চেনা ছেলেদের কাছে আরো ক্লোজ।মানে আমি বলতে চাইছি,ওই মেয়ে আরো দশ বিশটা প্রেম করে।আমি নিশ্চিত।তুই এই ধরনের মেয়ের ফাদে পড়লি।

ভ্রু কুচকে পাভেলের দিকে তাকালো পরশ।পরবর্তীতেই চিন্তার রেখা তার কপালে ফুটে উঠলো।পাভেলে’র কথা একদম ফেলে দেওয়া যায় না।পরক্ষণেই মস্তিষ্কে এলো-“সে একজন এমপি সেটা জানার পরেও স্পর্শীকে কত কাটখড় পুড়িয়ে রাজি করেছে।তার মানে এই ধরনের লোভ তার মধ্যে নেই।আর যার মধ্যে লোভ নেই,সে এরকমভাবে ছেলেদের সাথে ফালতু সম্পর্কে জড়াতেই পারে না।মুখে বললো-

এরকম কিছুই না।ও এমন নয়।
তেতে উঠলো পাভেল।বললো-
এহহহ,মাত্র এ কটা দিনে তুই সব জেনে বসে আছিস নাকি।দাড়া,একটু ওয়েট কর।সিমটা ভরি,তারপরই তোর সব ভাবনা ধূলিসাৎ করে দিব।
ভ্রু কুচকে পরশ বললো-
কি করবি তুই?
বেশ আয়েশ করে বসলো পাভেল।বলল-

দেখ,আমি আনমোন নাম্বার থেকে তোর বাবুর আম্মুকে ফোন দিয়ে প্রেমিকের মতো কথা বলবো।ওর যদি তেমন কোনো প্রেমিক না থাকে তাহলে তো শুরুতেই আমায় রিফিউজ’ড করে দেবে।
–তোর কি মনে হয়,আদোও সফল হবি?(পরশ)
–অবিয়েসলি,সফল হবো না মানে।তুই খালি দেখ,তোর বাবুর আম্মুর সাথে তোর সামনেই ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেম করে যাব।নাম্বার টা দে।

পরশ নাম্বার দিলো।যতই বিশ্বাস করতে যাক না কেন মনের মধ্যে এক খচখচানি থেকেই যাচ্ছে।পাভেল সিম অন করে স্পর্শীর নাম্বারে কল দিল।পরশ মন প্রাণ দিয়ে চাইছে যাতে অচেনা নাম্বারের কল স্পর্শী না ধরুক।কিন্তু তাকে হতাশ করে প্রথমবার রিং পড়তেই রিসিভড হলো কল।সাময়িকভাবে বুকে ধাক্কা খেল পরশ।আর পাভেল,সে তো ভ্রু নাচিয়ে ভাইয়ের মজা উড়াচ্ছে।
ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে পাভেল মধুর কন্ঠে স্পর্শির উদ্দেশ্যে বললো-

হেই বেবি,কি করছো?
স্পর্শী চমকালো,থমকালো।ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নাম্বার’টা একবার দেখলো।বারকয়েক পলক ঝাপ্টা দিয়ে ভাবলো”এ আবার কোত্থেকে টপকালো?”
স্পর্শীর নিরবতা পেয়ে পুনরায় পাভেল বলল-

কি হলো,কথা বলছো না কেন বেবি?
চশমা’টা আঙুল দিয়ে ঠেলে ফোনটা কাধ দিয়ে চেপে ধরে পুনরায় এসাইনমেন্ট লিখতে শুরু করলো স্পর্শী।ফোনের আগন্তুকের উদ্দেশ্যে বললো-
জ্বী আব্বা,পড়তে বসছি।আপনার শরীর ভালো।
স্পর্শীর চিন্তায় চিন্তিত হয়ে সবে মাত্র পানি মুখে দিচ্ছিলো পরশ।ওপাশ থেকে এমন উত্তর শুনে কাশি উঠে গেল। গড়গড় করে সমস্ত পানি গিয়ে পড়লো পাভেলের গায়ের উপর।পাভেল সাময়িক ভাবে হতভম্ব হয় গেছে।পরশের দিকে তাকিয়ে পুনরায় জিভ ভিজিয়ে বললো-

এসব কি কথা বলছো বেবি?
—আব্বা আপনার কাশি কমছে?ওষুধ খাইছিলেন?
স্পর্শী এসাইনমেন্ট লিখতে লিখতে শান্ত স্বরে বললো।
পাভেল ঝটপট করে “সরি রং নাম্বার” বলে ফোন কেটে দিলো।সামনে তাকিয়ে দেখলো পরশ দম ফাটানো হাসিতে মেতে উঠেছে।ঠোট দুটোকে উচু করে আফসোসের সুরে পরশ পাভেল কে বললো-
আমার শশুর হওয়ার এত্তো শখ তোর?

পাভেল কিচ্ছু বললো না।থমথম করতে করতে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।পুনরায় দরজা ঠেলে ভিতরে উকি দিয়ে বললো-
একবারেই সব পরিক্ষা হয়ে যায় না।আবার করবো ফোন।আমি প্রমাণ করেই ছাড়বো,” বাবুর আম্মুর অনেক গুলো বাবুর বাপ আছে।তুই শুধু দেখতে থাক।
অনন্দা কান থেকে হেডফোন খুললো।প্রেম করছিলো সে,কিন্তু স্পর্শীর কথার আওয়াজে বিরক্তি নিয়ে হেডফোন খুলতে বাধ্য হলো।তারপর তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

এতো আব্বা আব্বা করছিস কেন?তোর আবার আব্বা জন্মালো কোত্থেকে?
স্পর্শী হতাশ দৃষ্টিতে অনন্দার দিকে তাকালো। বললো-
কে জানি, কোত্থেকে টুপ করে পড়লো। ফোন দিয়েই বেবি বেবি করছে।ভাবলাম এত্তো মধুর করে বেবি ডাকছে নিশ্চয়ই বেচারা বাচ্চাহীন বাজাখোজা পুরুষ। তাই ভাবলাম আব্বা ডেকে একটু মনটাকে শান্ত করি।তা ব্যাটা আব্বা ডাক শুনেই রংনম্বর বলে কেটে দিলো।
তুই পারিস ও বটে।আল্লাহ তোকে কি দিয়ে বানাইছে কে জানে?
অনন্দা পুনরায় হেডফোন কানে দিতে দিতে বললো।

রাত এগারোটা।ছাদের এক কার্ণিশে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে পাভেল।দৃষ্টি তার এলোমেলো। মন তার বিচ্ছিন্ন। এই যে সারাদিন আমোদ-প্রমোদ,হাসি-মজায় মেতে থাকা পাভেলের ও মন খারাপ হয়।তার ও মন কিছু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষিত হতে থাকে।কিন্তু সে নিরুপায়।যেগুলো পাওয়ার অধিকার তার নেই, সে গুলো নিয়ে ভাবা নিতান্তই বোকামি।ভুলে থাকতে চায় সেইসব।

ফোনের টোনের আওয়াজ পেতেই স্ক্রিনের দিকে তাকালো। কাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকেই কল টা এসেছে।পাভেল হাসলো।মেয়েটা এত্তো বোকা কেন?এতো অপমান করার পরেও পিছু ছাড়ছে না।অথচ তার সাথে কথা না বললেও দম বন্ধ হয়ে যায় পাভেলের। রিসিভড করে কানে তুললো ফোন।ওপাশ থেকে ভেসে আসলো আর্শির মিষ্টি আওয়াজ।
পাভেল ভাই,

–হুম।
–আপনি আমাকে একটু ফোন ও দিতে পারেন না।আমি কি এতোটাই ফেলনা।যখন নিজে থেকে দেই তখন ও ধরেন না।আর ধরলেও কথা বলেন না।
থেমে,
পাভেল ভাই, আমি কি দেখতে খুব খারাপ?

পাভেল হাসলো।সে জানে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর মেয়ে এটা।শ্যাম বরণ মুখ খানিতে অজস্র মায়া লেপ্টানো এই অষ্টাদশী যে আরো বছর খানের আগেই কাবু করে ফেলেছে তাকে।তার ওই পলক ঝাপ্টানো প্রতিটা কথাবার্তায় যে তার হৃদয়ে ফাল মেরে ওফাড়-ওফাড় করে ফেলে।মুখে বললো-

এতো রাতে এই সব ঢং করার জন্য ফোন দিছো। সামনে না পরিক্ষা,এমনিতেও তো ফেল্টুস।এরপরে এইচএসসি তে ফেল করলে তো বিয়েই করবে না কেউ।তখন সব দোষ আমার উপর পড়বে তাই তো।
নাক ছিটকালো আর্শি।সবকিছুতে পড়াশোনা টানে এই লোক।অথচ নিজেও যে খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলো তা না।নেহাত আর্শি তাকে ভালোবাসে তাই লেখাপড়া টেনে কথা বলে না।মুখে বললো-

তাহলে আপনি বিয়ে করবেন।
হাসলো পাভেল।কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বললো-
আর্শি,
হু
তুমি এতো অবুঝ কেন?দেখো,নিজের আবেগ টা কমাও।আমি জানি কষ্ট হবে,কিন্তু তাও চেষ্টা করো।দেখো,তুমি একবার বাস্তবতা নিয়ে ভাবো।কোনোদিন তোমার ভাই এই সম্পর্ক মানবে না।আর না তো আমি চাইবো আমার ভাইকে কষ্ট দিতে।আমি চাই না,ভাই জানুক তারই শত্রুর বোনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে।হয়তো মুখে কিছু বলবে না।কিন্তু কষ্ট পাবে।
থেমে,
তুমি আমাকে এরপরে আর কখনো ফোন দিবে না।
কেদে দিল আর্শি।বললো-

আমার নাম্বার তো ব্লকে রাখতে পারেন। রাখছেন না কেন?মুখে বারবার বলছেন কেন ফোন না দিতে?
পাভেল কেটে দিল ফোন । পাভেল তো পারবে না। সে মুখে যতই বলুক দিনশেষে ওই বোকা বোকা কন্ঠ না শুনলে তার ঘুম আসে না। বুক চিরে ভেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।

সকাল দশটা।পরশ তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে ঢুকলো।পার্টির যাবতীয় কাজ পাভেলকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে।সেই আজকে হ্যান্ডেল করবে সবকিছু।দ্রুতবেগে গোসল করতে ঢুকলো।গোসল করে সামান্য খেয়েই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।এই প্রথম কোনো কাজ ছাড়াই ঢাকায় আসছে সে তাও আবার কোনো মেয়ের কথায়।নিজের উপরেই মাঝে মধ্যে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে পরশ।কোনো মেয়ে কি না তাকে কন্ট্রোল করছে।

বিকাল তিনটা।জাবির ক্যাম্পাস কখনো শূন্য থাকে না।অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর আনাগোনা থাকে তার মধ্যে।পরশ গাড়ি নিয়ে গেটের ভেতর ঢুকলো। আজকে একটা গাড়ি’ই এনেছে।গাড়িতে সামনে দুজন বডিগার্ড ছাড়া আর কাউকেই আনে নি।এদেরকেও আনতে চাইছিলো না কিন্তু পাভেলের জোরের কারনে বাধ্য হয়ে নিয়ে এসেছে।কি কপাল তার?বডিগার্ড নিয়ে এসেছে প্রেম করতে।নিজের উপর’ই হাসলো পরশ।গাড়ি থেকে নেমে হাটতে হাটতে গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগের সামনের বড় রাস্তায় গেল।বডিগার্ড দের গাড়ির ভেতরে থাকারই হুকুম দিয়েছে সে।পকেট থেকে ফোন বের করে স্পর্শীর নাম্বারে ফোন দিলো।একবার,দুইবার,তিনবার………….এমন করে প্রায় চৌদ্দবার ফোন দিল পরশ।রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না।বিরক্তিতে মুখমন্ডল কুচকে ফেললো।

এই স্পর্শী,ওঠ।এই,আরে তোর নেতামশাই ফোন দিয়েছে।এই ওঠ,
আড়মোড়া ভেঙে উঠলো স্পর্শী। পরক্ষণেই আবার শুয়ে পড়ল।বললো-
এখন কথা বলতে পারবো না।ঘুম পাচ্ছে আমার।
—আরে এই নিয়ে পনেরোবার ফোন করছে।নিশ্চয়ই আর্জেন্ট।ফোন টা ধর।
নাক মুখ কুচকে উঠলো।ফোন হাতে রিসিভড করে ঝাঝালো কন্ঠে বললো-
এই আপনার কি কমন সেন্স নেই কোনো।দেখছেন ফোন ধরছি না,তার মানে তো বিজি আছি নাকি।পরে কথা বলবো,ঘুমোচ্ছি আমি।

—থাপড়ে গাল লাল করে দেব বেয়াদপ মেয়ে।সারাটা দিন জার্নি করে এসেছি আর এখন এসব বলছো।তোমার ঘুম ছুটিয়ে দিব আমি।দশ মিনিটের মধ্যে শহীদ মিনারের সামনে এসো।আমি অপেক্ষা করছি।
নেতামশাই এখানে ভাবতেই হতভম্ব হয়ে গেল স্পর্শী। পরক্ষণেই মনে পড়লো সেই কালকে আসতে বলেছে।ইশ মাথা থেকে একদম বের হয়ে গেছিলো।

নেতামশাই তার এক কথায় দেখা করতে এসেছে ভাবতেই মন আনন্দে নেচে উঠলো।তার কথাকে প্রায়োরিটি দিয়ে একজন সংসদ সদস্য নাকানিচুবানি খেতে খেতে জাবির ক্যাম্পাসে এসেছে ভাবতেই অনন্দাকে ধরে ঘুরে নাচতে লাগলো।পুনরায় কানের কাছে ফোন টা নিয়ে বললো-
নেতামশাই,মাত্র পনেরো মিনিট দিন।দশ মিনিটে রেডি হবো,পাচ মিনিটে চলে আসবো। ওকে
পরশ কতক্ষন গম্ভীর থেকে উত্তর দিলো।
আসো।

একা একা পুরো ক্যাম্পাসে হাটছিলো পরশ।হাটতে হাটতেই শহীদ মিনারের সামনে এলো।প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে।চারদিকে লোকজনের আনাগোনা ধীরে ধীরে বাড়ছে।কতক্ষণ পরপর বিরক্তি নিয়ে ঘড়ি দেখছে পরশ।আজকে কালো জিন্সের সাথে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে।বরাবরই পরশ জিন্স পড়ে।পাঞ্জাবির সাথে আজ অবধি কখনো পায়জামা পড়েনি।পায়জামা শব্দটা মাথায় এলেই কেমন মেয়ে মেয়ে লাগে পরশের।ভীষণ অসস্তি হয়।

বিরক্তি নিয়ে আবারো ঘড়ি দেখলো।কপাল কুচকে সামনে তাকাতেই হা হয়ে গেল।ধীরে ধীরে কুচকানো কপাল সোজা হয়ে মুগ্ধতায় ছেয়ে যেতে লাগলো।সামনেই স্পর্শী দাঁড়ানো।নীল র ঙের শাড়ি পড়ে আছে সে।ঠোটে হালকা খয়েরী রঙের লিপস্টিক,আর চোখে কাজল।ব্যাস,আর কোনো সাজ নেই।পরশ মুগ্ধতা নিয়ে আরেকটু সামনে আগালো।খেয়াল করে দেখলো স্পর্শীর হাতেও নীল রঙের চুরী।স্পর্শী এবার অসস্তিতে পড়লো।

যতটা সাহস নিয়ে শাড়ি পড়েছিলো ঠিক ততটাই লজ্জা লাগছে তার।জীবনে কখনো কোনো ছেলের সামনে নিজেকে আবেদনময়ী সাজানোর চেষ্টা করে নি।লজ্জায় ঘুরে অন্যদিকে তাকালো।সাথে সাথে পরবর্তী ঝটকা টা খেল পরশ।স্পর্শীর চুল অনেক লম্বা।এতোদিন কাকড়া দিয়ে বাধা চুলগুলো,তার উপর মাথায় রাখা ওড়নার জন্য খেয়াল না হলেও আজ শাড়ির সাথে খোলা চুলগুলো যেন এক পশলা বৃষ্টি নামিয়ে দিল পরশের হৃদয়ে।হাটু ছুইছুই চুলগুলো।আরেকটু খেয়াল করতেই মেজাজ বিগড়ে গেল পরশের।চুলগুলো কি সুন্দর কালো।অথচ নিচের দিকে প্রায় আঙুল পাচে’ক বাদামী রঙ করা।

কি দরকার ছিলো এমন ঘোড়ার লেজের মতোন করার?কিন্তু তারপরেও পরশ মনে মনে সিদ্ধান্ত আটলো।বিয়ের পরে অজস্র চুল কালো করার অরনামেণ্টস মাখাবে।তাতেও কাজ না হলে ওই চুলটুকু কেটে ফেলবে।পরবর্তীতে আবার লম্বা হবে।
কোথায় হারালেন?নেতামশাই
হুশ ফিরলো পরশের।কিন্তু ধরা দিল না।বলল-
কোথাও না,চলো হাটি।

হাটতে লাগলো দুজন।বলতে লাগলো কথা।রাস্তার দু ধারে অজস্র খোলা খাবারের দোকান বসেছে।ফুচকার দোকান চোখে পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়লো স্পর্শী।পরশের দিকে তাকিয়ে দাত কেলালো। পরশ হতভম্ব হয়ে গেল।মাঝে মধ্যে এই মেয়ের হাসি দেখে ভীষণ ভয় লাগে তার।যেন মনে হয় সে এক অবলা নারী,আর স্পর্শী কোনো বখাটে ছেলে।ভাবনা টা কাল্পনিক হলেও বাস্তবেও স্পর্শী মাঝে মধ্যে বখাটে দের মতো করে হাসে পরশের সামনে।
নেতামশাই,প্রেম করতে এসেছেন ভালো কথা।পকেট আছে তো?

পরশ প্রথমে না বুঝলেও পরক্ষণেই স্পর্শীর কথার প্যাচ বুঝে ফেললো।বলল-
তুমি কি কিছু খাবে?
–এটা আবার বলা লাগে নাকি।চলুন,ফুচকা খাবো।
পরশ পাশের দোকান টার দিকে চাইলো।পরক্ষণেই নাক ছিটকালো। বলল-
ইয়াক স্পর্শীয়া।তুমি এসব খাবার খাও।এর থেকে কোনো রেস্টুরেন্টে চলো, এসব আনহেলদি খাবার খাওয়ার দরকার নেই।

ভ্রু কুচকালো স্পর্শী।পরশের থেকে খানিকটা দূরে সরে দাড়ালো। বললো-
আপনি না খাওয়ালে খাওয়াবেন না।তাই বলে বাজে কথা বলছেন কেন?আর শুনুন,তিন বেলার দুই বেলাই আমি এইসব আনহেলদি, রাস্তার খাবার খাই।আপনি এসব টলারেট করতে পারলে করবেন নইলে আগেভাগেই ভাগুন।
স্তব্ধ হয়ে গেল পরশ।এ কেমন মেয়ে,সামান্য ফুচকার জন্য ব্রেক আপ করার হুমকি দিচ্ছে।মুখে বললো-
না না তুমি খাও।চলো,বাট আমাকে জোর করবে না। আমি এইসব জীবনেও খাবো না।
স্পর্শী নাক কুচকে এগিয়ে গেল ফুচকাওয়ালার দিকে।বললো-

মামা,আপনি ফুচকা বানাতে থাকেন, আমি খেতে থাকি।যতক্ষন আমার মুখ না থামে ততক্ষণে যেন আপনার হাত ও না থামে।ক্লিয়ার।আর হ্যা,প্রচুউউউউর ঝাল দিবেন।
স্পর্শী খাচ্ছে।এ যাবৎ দশ প্লেট খাওয়া শেষ তার।আরো খেতে ইচ্ছে করছে তার।কিন্তু ব্যাটা ভীষণ ঝাল দিয়েছে।চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি গড়িয়ে পড়ছে।শেষে বাধ্য হয়ে বারন করলো আর না বানাতে।পরশ স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে স্পর্শীর দিকে।ভাগ্যিস মনে করে পাঞ্জাবির পকেটে ওয়ালেট টা এনেছিলো।নইলে তো মান সম্মান এই জাবির ক্যাম্পাসেই লেপটে যেত।বারকয়েক আশেপাশে তাকালো।দুরেই গাড়ি দেখা যাচ্ছে।বডিগার্ড দুজন এদিকে তাকিয়ে ছিলো। পরশকে তাকাতে দেখেই অন্যদিকে ফিরে তাকালো।

অসস্তিতে পরলো পরশ।কি ভাবছে তারা।তাদের স্যারকে সামান্য একটা মেয়ে কতটা নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে।
স্পর্শী হা করে দুহাত দিয়ে মুখে বাতাস করছে।ঠোট দুটো নিজেদের লিপস্টিক হারিয়ে ঝালের চোটে লাল হয়ে যাচ্ছে।বারকয়েক মুখের ঝাল হওয়া লালা থুথু আকারে ফেললো।বারবার ঠোট ভিজিয়ে ঝাল থেকে বাচতে চাইলো স্পর্শী। পরশ ঢোক গিললো।আশে-পাশে তাকিয়ে নিজেকে সংযত করলো।

হঠাৎ ই মাথার মধ্যে দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো স্পর্শীর।আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো কোনো আইস্ক্রিমের দোকান খোলে নি।তারপরেও পরশকে উত্তেজিত করে জ্বালানোর জন্য জোরে বলতে লাগলো-
আইসক্রিম,আইসক্রিম খাবো আমি।আইসক্রিম আনুন।এক্ষুনি,ওমাগো মরে গেলাম।
পরশ চকিতে আশে-পাশে তাকালো। কোথাও কোনো আইস্ক্রিমের স্টল নেই।থাকলেও সেটা একদম জয়বাংলা গেটের পাশে।স্পর্শীর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-

খুন বেশী ঝাল লাগছে?
দ্রুত মাথা নাড়ালো স্পর্শি।বললো-
হ্যা,হ্যা,যেখান থেকে পারুন আমায় আইসক্রিম এনে দিন।নেতামশাই,খুব ঝাল, খুব ঝাল।ঠান্ডা কিছু লাগবে।
বলেই পরশের অসহায় মুখের দিকে তাকালো সে।পেট ফেটে হাসি বেরিয়ে আসতে চাইলো।স্পর্শী প্রচুর ঝাল খায়।এটা নয় যে এখন ঝাল লাগছে না।যতই ঝাল লাগুক, সেটা সহ্যের মধ্যে।কিন্তু পরশ কে জালানোর জন্যই এমন ছটফট করছে সে।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো পরশ। সে স্পর্শীর শয়তানি হাসিটা দেখতে পেয়েছে।তাকে যে জ্বালানোর জন্যই এমনটা করছে সেটা স্পষ্ট। নিজেও ঠোট কামড়ে হেসে দিলো।তারপর স্পর্শীর কাছে গিয়ে বললো-
দেখো,এই মুহুর্তে আমি তোমায় আইসক্রিম খাওয়াতে পারবো না।তবে সেম কোয়ালিটির তবে ঠান্ডা অন্য কিছু খাওয়াতে পারি।যা খেলে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিউর তোমার ঝাল কমে যাবে।
তড়িৎ গতিতে স্পর্শী বললো-

কি?
–চুমু।খাবে নাকি?
স্পর্শী চমকালো,থমকালো।কথাটা মস্তিষ্কে হানা দিতেই লজ্জা,অসস্তি, হানা দিল তীব্রভাবে।লজ্জায় মুখটা নীল হয়ে গেল।অন্যদিকে তাকিয়ে হাসফাস করতে লাগলো। পরশ ঠোট কামড়ে হাসছে।স্পর্শী নিজের উপরই ধিক্কার জানাচ্ছে।এই চুমু টুমু নিয়ে কত্ত মজা করেছে সে।অথচ আজকে এতো লজ্জা লাগছে কেন?লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না স্পর্শী।
এরইমধ্যে ধুলো উড়িয়ে শো শো করতে করতে তিন তিনটা মাইক্রো থামলো স্পর্শী ও পরশের সামনে।সাময়িক ভাবে পরিচিত গাড়ি দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো পরশ।প্রথম গাড়ি থেকে নেমে আসছে সোভাম সরদার,সাথে তার অন্যান্য চাচাত ভাইয়েরা ও আছে।বিরোধী দলের নেতা সোভাম সরদারকে দেখা মাত্রই রাইফেল হাতে ছুটে এলেন বডিগার্ড দুজন।পরশের সামনে ঢাল হয়ে দাড়িয়ে বন্দুক তাক করলেন সোভাম সরদারদের দিকে।

সোভাম সরদার ক্রুদ্ধ চোখে এগিয়ে এসে স্পর্শীর হাত ধরলো।টেনে নিয়ে গাড়িতে বসালো।পরশ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।সোভাম যাওয়ার আগে পুনরায় পরশের সামনে এলো।ক্রুদ্ধ চোখে দাতে দাত পিষে বললো-
শত্রুতা রাজনৈতিকভাবে।কিন্তু খবরদার! আমার বোনের দিকে নজর দিলেও তোর চোখ আমি গেলে দেব।সাবধান!স্পর্শীর আশেপাশেও যেন তোকে না দেখি।

পরক্ষণেই শো শো করে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল গাড়ি তিনটি।
স্তব্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল পরশ।স্পর্শিয়া সোভাম সরদারের বোন।উফফস,বুকের ভেতরটা কিছু হারানোর আশঙ্কায় ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

–এমপিসাহেব,খাইবেন না।সময় তো প্রায় শেষ হইয়া গেল।এরপর তো আর খাবার পাইবেন না।
হাবিলদারের কন্ঠের রেশ কানে যেতেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো পরশ শিকদার।চোখটা ঝাপসা হয়ে গেছে।বাম হাত দিয়ে মুছে নিল চোখ টা।তারপর তাকালো হাবিলদারের দিকে।বললো-
হ্যা,যাচ্ছি।

পাশ ফিরে স্টিলের থালাটা হাতে নিল।তারপর ছোট্ট দরজাটা দিয়ে নুয়ে বেরিয়ে গেল জেলের বাইরে।লাইনের মানুষ কমে এসেছে অনেক।তার সিরিয়াল আসতেই থালা পাতলো।গরম ভাতের উপর গরম ঝোল পড়তেই তড়তড় করে গরম হয়ে উঠলো স্টিলের থালাটি।হাত প্রায় পুরো আসছে।তড়িঘড়ি করে আবারো নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কুঠুরিতে এলো।ফ্লোরের উপর থালাটা রেখে বারকয়েক হাত ঝারা দিল।

আবারো নতুন করে ফোস্কা পড়ে গেছে।পাতের দিকে চাইতেই পুনরায় বিতৃষ্ণা এলো।পল্ট্রির মুরগীর মধ্যে মুগ ডাল আর আলু দিয়ে ঝোল করে রান্না করেছে জেলের কর্মচারীরা।সপ্তাহে দুদিন মাংস খাওয়ায়।এই হলো সেই মাংস।উপর মহলে খবর যায় আসামীদের সপ্তাহে দুদিন মাংস,ডাল আর সবজি খাওয়ায়।পাতের ছোট্ট মাংসের টুকরোটার দিলে পরশ তাকালো। সাদা থকথকে টুকরোর দিকে তাকাতেই বিতৃষ্ণা এলো।কিন্তু গ্রাহ্য করলো না।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৯

গত চার বছরে এরকম খাবার খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে।
বুক চিরে হাহাকার বেরিয়ে এলো।কিছু বিশ্বাস ঘাতক, কিছু স্বার্থপর আর বিষাক্ত মানুষের জন্য জীবন আজ চার বছর ধরে জেলের ঘানি টানছে।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ১১