রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৯

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৯
সিমরান মিমি

অপরাহ্ণের প্রথম ভাগ।বিশালাকার ছাইরঙা অন্তরীক্ষের মধ্যিখানে অবস্থানরত দিনপতি তার প্রভা ছড়াচ্ছে ব্যস্ততার সাথে।তার প্রস্থানের যে সময় হয়ে এসেছে। নিজস্ব দীপ্তি’কে যতটা পারছে ততটা ছড়িয়ে দিচ্ছে অবনিতলে।এই মরুভুমির ন্যায় মস্ত দালানকোঠার মধ্যিখানে এগিয়ে যাওয়া প্রশস্ত ধুলোময় পথকে পারি দিয়ে বেশ দাপটের সাথে ডেইরি গেটে প্রবেশ করলো তিনখানা বিলাসবহুল গাড়ি।

হুট করে এই বিকেলের দিকে এমন আগমন কে মেনে নিতে পারলো না অনেকেই।ফলস্বরূপ কৌতূহলী দৃষ্টিতে অবাকের ন্যায় দৃষ্টি দিলো গতিশীল গাড়িগুলোর দিকে।হুশ-হুশ করে ইঞ্জিনচালিত গাড়িগুলো এগিয়ে গেলো ছেলেদের আবাসিক হলের দিকে।এবারে কেউ কেউ আন্দাজ করলো হুট করে চলে আসা এই অতিথি’কে।তাদের আন্দাজ করা দৃষ্টিগুলোকে সত্য প্রমাণিত করেই গাড়িগুলো থামলো ‘কাজী নজরুল আবাসিক হলে’র সামনে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মুহুর্তেই দুপাশের গাড়ি থেকে নেমে এলো কালো পোশাক ও বন্দুকধারী বডিগার্ড।ডোর খুলতেই মধ্যিখানে থাকা গাড়িটি থেকে দাপটের সাথে বেরিয়ে এলো পিরোজপুর ৩ এর নব নির্বাচিত সাংসদ পরশ শিকদার।তার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো পারসোনাল সেক্রেটারি রুপে থাকা মেঝ ভাই পাভেল শিকদার।দ্রুতপায়ে হেটে গেল রিসিভশনের দিকে।পাভেল বপডিগার্ডদের সেখানে থাকার আদেশ দিয়ে নিজেও ছুটলো ভাইয়ের পিছুপিছু।

রিসিপশনে থাকা লোকটা তাদেরকে চেনে।দেখতেই হাসি দিয়ে সালাম দিলো।বাম পাশে থাকা ফর্ম টা বের করে দিতেই ত্রস্ত হাতে সই করে দিলো পাভেল।পরশ এতোক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে।ফর্ম রেখে ভাইয়ের পিছনে জোরপায়ে ছুটতেই নাগাল পেলো।দাঁতে দাঁত চেপে করুন কন্ঠে বললো,
“এতো জোরে হাটছিস কেন?আমার তো তোকে ধরতে রীতিমতো দৌড়াতে হচ্ছে।ভাই,একটু তো এদের সামনে আমার প্রেস্টিজ টা রাখ।”

কোনোরুপ সাড়া পেল না পরশের থেকে।নিশ্চয়ই পিয়াস কে নিয়ে বেশ চিন্তিত।বুঝতে পারতেই নিজেও গম্ভীর হয়ে গেল পাভেল।গ্রাউন্ড ফ্লোরের শেষ প্রান্তের বামদিকে’ই লিফট।এর আগে পরশ এলেও পাভেল আসে নি।ফলস্বরূপ ভাইয়ের পিছু পিছু ছোট বাচ্চাদের মতো ছুটতে হচ্ছে।৩০২ নং রুমের সামনে গিয়ে দুবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় আদনান।উলটো ঘুরে পরশ কে দেখেই পিলে চমকে উঠলো পিয়াসের।দ্রুত খুলে রাখা শার্ট হাতে নিয়ে গায়ে জড়ানোর প্রয়াশ করতেই ধরে ফেললো পাভেল।

এক টানে শার্ট ধরে ছুড়ে ফেললো ফ্লোরে। বাম হাত ধরে টেনে ঘুরিয়ে দিলো উল্টোদিকে।পুনরায় পিঠের দিকে তাকাতেই চিবুক শক্ত হয়ে গেল।স্টিকের প্রতিটা আঘাত ফর্সা পিঠময় লাল’চে হয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে।পিঠে তরল তেল জাতীয় কিছু অনুভব হতেই খাটের দিকে চাইলো পরশ।পাশেই মলম রাখা।হয়তো মলম লাগাচ্ছিলো।দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো পিয়াস।রাগে ভেতর’টা ফেটে যাচ্ছে।কার এতোবড় সাহস তাকে না জানিয়ে ভাইকে খবর দিয়েছে।স্পর্শীর হাতে পড়েছিলো ফোন।তার মানে কি ওই করেছে।ওকে তো……ছিঁড়ে খাবে পিয়াস।

“এভাবে মার খেয়েছিস কেন?”
পরশের গম্ভীর প্রশ্নের মুখে তৎক্ষনাৎ ‘ই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো পিয়াস।আমতাআমতা করে বললো,
“তেমন কিছু না ভাই।ও আমি সামলে নেব।তুমি কেন আবার কষ্ট করে আসতে গেলে।”
ঠোঁট দুটো গোল করে বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ফেললো পাভেল।বললো,
“কেউ তো শুধু শুধু এমন বেধড়ম পেটাবে না।কি করেছিলি তুই?পড়তে এসেছিস ভালো কথা।কিন্তু এমন বারো মাসে বারোবার নালিশ আসবে কেন?আর আমাদের ই বা এমন ছুটতে হবে কেন বারবার?তুই জানিস না ভাই এখন কতটা ব্যস্ত থাকে।”

মাথা নিচু করে ফেললো পিয়াস।পরশের অগোচরে পাভেল কে চোখ রাঙালো।যার মানে এই “তুই কেন এসেছিস এখানে?আর ভাইকে কেন রাগিয়ে দিচ্ছিস আমার বিরুদ্ধে?”
ঠোঁট টিপে হাসলো পাভেল।তারপর পুনরায় গা-জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো,

“ছিঃ,মান-সম্মান তো পুরো ডুবিয়ে দিলি।কোন না কোন মেয়ের হাতে মার খেয়েছিস।আমি ভাবছি এই কথা কোনো ভাবে পিরোজপুরে ছড়ালে কি হবে?বিরোধী পক্ষের সবাই বলবে,” এমপি’র ভাই মেয়ে মানুষের হাতে মার খায়।ছিঃ,আমার তো লজ্জা করছে তোদের ভার্সিটিতে আসতেই।সবাই মুখ টিপে টিপে হাসছে আর বলছে,”ওই যে মেয়েদের হাতে মার খাওয়া পিয়াসের ভাইয়েরা এসেছে।”
“জাস্ট শাট আপ পাভেল।আমি এই মুহুর্তে ওই মেয়েটাকে দেখতে চাই।দশ মিনিটের মধ্যে হাজির করবি ওই মেয়েকে।”

রেগে চিৎকার করে বলে উঠলো পরশ।
থেমে আদনানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,”কি জন্য মেরেছে ওই মেয়ে?আর তোমরা কোথায় ছিলে?”
আদনান পিয়াসের দিকে তাকালো।পিয়াস না বলার জন্য বার বার মাথা নাড়িয়ে ইশারা দিলেও পরশের ধমকানির সাথে পেরে উঠতে পারলো না।নিচুমুখে বললো,
“ওই মেয়েটাও এই জাবির’ই স্টুডেন্ট।আমাদের জুনিয়র।ওর বোনকে পিয়াস ডিস্টার্ব করেছিলো সকালের দিকে।তাই জন্য হকস্টিক দিয়ে পিটিয়েছে।আর ভাইয়া,ওই মেয়ের ভার্সিটির সবার সাথে হাত মেলানো।ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে সাধারণ স্টুডেন্ট রাও ওই মেয়ের কথায় হ্যাঁ মেলায়।ওখানে আমরা যদি কিছু করতে যেতাম, তাহলে উলটো মার খেতাম।”

পরশ অবাক হয়ে শুনলো না।কপালের চাঁমড়ায় দু-ভাজ করে গেছে ইতোমধ্যে।পিয়াশের দিকে তাকিয়ে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করলো,
“মেয়েদের কে ডিস্টার্ব করছিলি?বাহ!মারামারি,যাবতীয় অকাম-কুকাম থেকে শুরু করে এখন মেয়েলি ঝামেলায় ও পড়েছিস।এই জন্য তোকে এখানে পাঠিয়েছিলাম আমি?”

হুট করে পরশের এমন চিৎকারে ভয় পেয়ে গেল পিয়াস।দ্রুত নিজের সাফাই গাইতে বললো,
“ভাই,আমার কোনো দোষ নেই।ওই মেয়েকে অনেক দিন ধরে পছন্দ করি আমি।এমনকি আমাদের অনেক বছরের রিলেশন।কিন্তু হুট করে ও কিছুদিন ধরে আমাকে ইগনোর করছিলো।অন্য আরেক’টা রিলেশনে জড়িয়েছে।আমি মানতে পারি নি।ব্যাস, রাগের বসেই ওর সাথে দেখা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে হাত ধরেছিলাম।আর জোড় করার জন্যই হয়তো ওর বোনকে বলে এমন একটা সিন ক্রিয়েট করেছে।তুমি বলো,কাউকে ভালো বাসা কি ভুল?”
কথাগুলো বলেই কাতর চাহনিতে তাকালো পিয়াস।ঘাড়ে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে পরশ বললো,

“এসব মেয়েদের পাল্লায় পড়তে নেই ভাই।এরা সাময়িক সময়ের জন্য এসে মায়া বাড়িয়ে অন্য পুরুষে মগ্ন হয়।আমি বুঝতে পারছি তোকে।”
এরইমধ্যে ফোন হাতে এগিয়ে এলো রতন।পরশের উদ্দেশ্যে বললো,
“ভাই,ওই মেয়েটা..যে পিয়াস কে মেরেছে।আপনি কথা বলে ডাকুন।আমাকে গালি দিচ্ছে।”

পরশ ফোন’টা ধরতেই টেনে নিয়ে গেল পাভেল।ভাইয়ের উদ্দেশ্যে নিচু কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো,”আমি কথা বলছি।তোর বলার দরকার নেই।এমপি মানুষ,যদি মেয়েটা গালি/টালি দিয়ে বসে তখন আর প্রেস্টিজ থাকবে না।”
সায় জানালো পরশ।ফোন’টাকে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে দাবাং মার্কা এক ধমক চলে এলো, ” ওই বিল’গে’টসে’র বা’চ্চা,টাকা কি ফোনে বেশি হয়ে গেছে। ফোন দিয়ে এমন চুপচাপ থাকার মানে কি?খুব বেশী হয়ে গেলে আমার নাম্বারে রিচার্জ করে দিস ভাই।এখন রাখ।”

হকচকিয়ে গেল পাভেল।ফোন কেটে দিবে এই আতংকে দ্রুত বললো,
“আমি পাভেল শিকদার বলছি।”
মুহুর্তেই ওপাশ থেকে ঘুমঘুম কন্ঠে ভেসে আসলো, “তো আমি কি করবো?জানতে চেয়েছি আপনার নাম?কি দরকারে ফোন দিয়েছেন সেটা বলুন।”
“পিয়াস শিকদার আমার ভাই হয়।আপনি যাকে আজকে ভার্সিটির সবার সামনে পিটিয়েছেন।আপনার সাথে কথা আছে দশ মিনিটের মধ্যে ক্যাম্পাসে আসবেন।”

নাক ছিটকালো স্পর্শী।দাম্ভিকতা’র সাথে বললো,
“গাড়ি পাঠিয়ে দিন সোসাইটি গেইটে।আসছি আমি।”
অবাক হয়ে গেল পাভেল।না বোঝার প্রয়াসে আবারো জিজ্ঞেস করলো,
“গাড়ি পাঠাবো মানে?”
সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ঝাড়ি এলো।তেঁ তেঁ স্পর্শী বললো,
“তো আমি কি বি এম ডাব্লিঊ তে চড়ে আসবো যে দশ মিনিটের মধ্যে হাজির হবো।লোকাল বাস ধরতে হবে ভাই।কয় ঘন্টা লাগবে জানি না।”

কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই পরশের ইশারায় আবার থেমে গেল।শান্ত কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা আসুন।অপরাজেয় বাংলা’র সামনে আসবেন।আমরা সেখানেই অপেক্ষা করছি।”
ফোন রেখে দিতেই পরশের উদ্দেশ্যে পাভেল বললো,

“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?রাতে মিটিং আছে।এই মেয়ের আসতে ক ঘন্টা লাগবে কে জানে?ততক্ষণ বসে থাকবো?আর সব কিছু বাদ দিলাম।কথা বলে যা বুঝলাম মেয়েটা ভীষণ ডেঞ্জারাস। যদি কিছু করে বসে সে সময় মান -সম্মান থাকবে তোর। এমনিতেই যা বুঝলাম তাতে এর হাত চলে কথার আগে।যদি দু-চারটা থাপ্পড় দিয়ে বসে।তারপর একে মেরে ফেললেও তোর সম্মান আসবে?আমার ভয় লাগছে ভাই।”

চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকালো পরশ।পিয়াস কে নিয়ে রুম থেকে বের হতে হতে বললো,
“যত রাত’ই হোক না কেন আমি থাকবো।আমি দেখতে চাই এমন হিম্মত কার যে কি না আমার ভাইয়ের গায়ে হাত তোলে তাও তার বোনের নষ্টামির জন্য।”
হার মানলো পাভেল।নিজেও পিছু পিছু আসতে লাগলো।পিয়াস চোরা কন্ঠে আস্তে করে বললো,
“ওর বাড়ি কাছেই।খুব বেশী হলে পনের মিনিট লাগবে।আর রেডিও কলোনী থেকে জাহাঙ্গীর নগর আসতে কোনো জ্যাম বাধেঁ না।”

ত্রস্ত পায়ে গেইটের ভেতরে ঢুকলো স্পর্শী।গায়ে কালো রঙের ঢোলা স্যালোয়ার-কামিজ।গায়ের ওড়না’টা মাথায় জড়ালেও বাতাসের দাপটে তা পড়ে যাচ্ছে বারবার।দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো অপারেজয় বাংলা’র দিকে।দশ মিনিট হাট’তেই দেখলো পিয়াসের মুখ।ওদিকে দাঁড়িয়ে সামনে থাকা মানুষ গুলোর সাথে কথা বলছে।পাশেই পার্ক করা তিন তিন’টা গাড়ি।বেশ চেনা লাগলো গাড়ি গুলো।এতোগুলো বডিগার্ড, পিয়াসের বন্ধুবান্ধব দেখে সামান্য ভড়কালো স্পর্শী।কি ব্যাপার?তাকে মারবে না কি এখন?মুহুর্তেই হাসি পেল তার ভাবনাতে।ত্রস্ত পায়ে সামনে এগিয়ে যেতেই পিয়াস ক্ষুদ্ধ চোখে তাকালো।

“আমাকে ডেকেছো কেন?”-বলতেই পিছু ফিড়ে তাকালো পরশ।সামনে সেদিনের অভদ্র মেয়েটা’কে দেখতেই অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। স্পর্শী নিজের কথা খৈ হারিয়ে ফেললো।এমন টান টান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে চেঁচিয়ে উঠলো পাভেল।বললো,
” একি!এটাতো সেই দু’শো টাকা ভাই।এই, তুমি মেরেছো আমার ভাইকে?”

ঢোক গিললো স্পর্শী।সামনে অবাক হয়ে দাঁড়ানো পরশের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মুহুর্তেই।দাঁত চিবিয়ে বললো,
তোমার সাহস কি করে হলো আমার ভাইকে মারার? হাহ!আমার শুরুতেই বোঝা উচিত ছিলো এমন ডাকাত,আধপাগলী,বখাটে,সন্ত্রাস মেয়ে ছাড়া কোনো ছেলেকে পেটানোর মতো কাজ আর কার দ্বারা হতে পারে?”
আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্পর্শী।তারপর চেঁচিয়ে উঠে বললো,

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৮

“আরে বাহ!আমি কি করে ভুলে গেলাম চোর-ছ্যাঁচোরের কম্বিনেশন।ভীষন বড় ভুল।আরে আমার বোঝা উচিত ছিলো, এই পবিত্র চরিত্রের ছেলেটার ভাই কতটা চরিত্রবান হতে পারে। একটা তো ডাকাত,আর অন্যটা চরিত্রহীন।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১০