রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২০

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২০
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“তাহুরাকে পছন্দ আমার।আমি উমাইর যা পছন্দ করি সেটা আমার করে দম ফেলি।বলতে পারেন,আমি তাহুরাকে ভালোবাসি।”
সম্মুখে মুন্সী।তার আঁখি জ্বলন্ত চেরাগের লাহান দপদপে। উমাইরের চালচলন সুবিধার না।সে চঞ্চল।তাহুরা মুখে হাত রেখে দাঁড়িয়ে।ঘটনা কোনদিন মোড় নিলো বুঝতে মেয়েটা হিমশিম।শরীরে অজানা ভার।কি হচ্ছে না হচ্ছে বুঝলো না।আয়ত্বের বাইরে যেনো সব।মুন্সীর অবস্থা বেগতিক।এখনই হুংকার ছাড়বে সে।জানে তাহুরা।তার বাবার ব্যবহার জানা আছে।এরপর কি করবে উমাইর?বাবাকে মারবে?কষ্টে কেমন অন্তরটা কেঁপে উঠে।তাহুরা উমাইরকে ইশারা দেয়,ছেলেটা দমলো না।উল্টো ভয়ংকর দৃষ্টিতে ভস্ম করে তাহুরাকে।

–“আমি মেয়ে দিবো না আপনাকে,উমাইর।”
মুন্সীর ক্ষিপ্ত সুর।তাহুরার প্রাণ নাশ হবে হবে ভাব।বাবা কেনো এমনটা বললো?উমাইর ছাড়া কোনো পুরুষের কথা মন ভাবেনি।সে ব্যতীত অন্য লোকের কিভাবে হবে তাহুরা?মাথা ঘুরে উঠে।চারপাশ আঁধার।
ঝাপসা নজরে দেখে উমাইর তার বাবার দিকে তেড়ে যাচ্ছে।তাকে থামানোর কেউ নেই।যেনো এক মরুভূমিতে তাদের তিনজনে লড়াইয়ের ব্যবস্থা করা হলো।তাহুরা চিৎকার দেয়, উমাইরের পা ধরে। ফুঁপিয়ে বলে,
–“আমার বাবাকে মারবেন না।আল্লাহ্ সহ্য করবে না,আমিও না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উমাইরের বলিষ্ঠ দেহ নিমিষে ঝুঁকে।বাহু টেনে উঠায় তাহুরাকে।তীব্র ব্যাথায় কুঁচকে যায় মেয়েটার স্নিগ্ধ মুখশ্রী।পরপর উমাইর চেপে ধরে তাহুরার কোমর।কি বিষাক্ত পীড়া!কোমরের হাড় ভাঙবে নিশ্চয়?
তাহুরার মৃদু আর্তনাদ শোনা যায়,
–“স্যার,ছাড়ুন আমাকে।ব্যথা লাগছে।”
–“তুই অন্য ছেলেকে বিয়ে করবি?তোর বাপ অন্যের সাথে তোকে সংসার করতে পাঠাবে?আর তুই?তুই সায় দিচ্ছিস?এই তুই জানিস না, আমার জীবনে তুই কি?”
কণ্ঠ বাজের শব্দের সমার্থক।তাহুরার কানে সেই ধ্বনি বিষ ঢাললো নিমিষে।মস্তিষ্ক স্থগিত।তাহুরা কম্পনরত হাত উমাইরের বুকে ঠেকায়,

–“আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না,উমাইর।”
নিজ হতে তাকে আলাদা করে উমাইর।
পরপর উমাইর কি বললো শুনলো না সে।আচমকা ভূমি কাঁপছে।তাহুরা বসে পড়ে দ্রুত।হঠাৎ কি বলো বুঝলো না।প্রচণ্ড ঝাঁকিতে সব ঝাপসা হয়।
ধীর ঝটকি অনুভব করে সে নিজের তনুতে।সাথে এক স্নেহ সমৃদ্ধ সুর,

–“তাহু,ঠিক আছো?চোখ খুলো মেয়ে?”
পিটপিট দৃষ্টি মেলে মেয়েটা।শরীর এখনো থেমে থেমে অস্থির হচ্ছে।নিজেকে আবিষ্কার করে বদ্ধ গাড়িতে।ঐযে পার্কিংয়ের আলোতে দেওয়াল দৃশ্যমান।তাহুরা নিজের শরীর উঠাতে চায়।পারে না।উদরে তার বাঁধা।পিঠ ঠেকে আছে কিসে?মাথায় যন্ত্রণা।পেটে ক্ষুধারা হট্টগোল করছে।
–“তাহুরা,কথা বলো?”

আকুলতা ভর্তি মায়াময় সুর।তাহুরা বাঁক ফিরে ডানে।উমাইর! তার অবয়ব পরিষ্কার।কেমন ঘনিষ্ঠতার সাথে বসে দুইজন।
উমাইরের হাত তার উদরে লেপ্টে।তার পিঠ উমাইরের বক্ষদেশে।আঁখিদ্বয় ছানাবড়া মেয়েটার। খানিক আগের দৃশ্য কেবল দুঃস্বপ্ন ছিল!ব্যাপারখানা আয়ত্বে এলে দ্রুত সরতে চায় তাহুরা।
উমাইর নিজ হাত সরায় ধীরে।তাহুরার মাথায় হাত রাখে,
–“আস্তে উঠো।”

তাহুরা সিট হতে পা নামায়। দূর্বলতা ঘিরে ধরে।মাথাটা টলে।আতঙ্কিত সুরে আওড়ায়,
–“আমার কি হয়েছিলো?”
–“পাঁচ মিনিটের জন্যে সেন্সলেস ছিলে তুমি।ব্যাপার কি?”
উমাইর চিন্তিত।তাহুরা ফিরেনি তার দিকে।লজ্জায় মরমর সে।তখনই আবার পেটে মোচড় দেয়।খিদার আহ্বান জানায়।তাহুরা চুপ করে থাকে কয়েক সেকেন্ড।ফের বলে,
–“অনেক্ষণ কিছু না খাওয়ায়,প্রেসার লো হয়েছিল হয়তো।”
–“হোয়াট?”

হুংকার ছাড়ে উমাইর।নিজে গাড়ি থেকে বেরিয়ে তাহুরাকেও টেনে বের করে।আলোতে মেয়েটার ভীত মুখ অবলোকন করলেও,উমাইর তার কঠোর ভাব জারি রাখে,
–“নাটক করো না খেয়ে?তুমি নায়িকা?খাবে না
আর অজ্ঞান হলে নায়ক তোমাকে উঠিয়ে ডাক্তারের কাছে নিবে?আমি তোমাকে মাত্রই গাড়ি থেকে ফেলতে নিচ্ছিলাম!ভাগ্যিস উঠেছিলে।”
সমান্তরাল ভ্রু জোড়া বক্র হয় তাহুরার।সত্যি উমাইর তাকে ফেলে দিতো?কই?সে তো এমন কিছু অনুভব করেনি! বরং উমাইরকে,তার স্পর্শকে,চিন্তিত সুরকে অনুভব করেছে।তাহুরা ভীত কণ্ঠে শুধায়,

–“আপনি…আপনি সত্যি আমাকে গাড়ি থেকে ফেলে দিতেন?”
–“ফেলে দেখানো দরকার ছিলো!”
উমাইর বাঁকা হাসে।ছেলেটা তাহুরাকে জ্বালাতন করতে ব্যাপক ভালোবাসে।
–“উমাইর!কি হলো মেয়েটার?”
পেছনে মেঘলার আওয়াজ।মহিলা চিন্তিত।সাথে আছে রকি, রনি এবং বাপ্পী।
–“তাহুরার জ্ঞান এসেছে তবে?”
বাপ্পী জিজ্ঞাসা করে।

–“মা,ওকে নিয়ে যাও। খাবার না খেয়ে অজ্ঞান হয়েছে।আর কখনো এমন হলে এই মেয়েকে আমি!”
তাহুরা নিজেকে ছাড়িয়ে মেঘলার নিকট যায়। বাকি কথা শেষ করলো না উমাইর।ভীত সন্ত্রস্ত তাহুরাকে তার বক্ষ পিঞ্জিরায় লেপ্টে নিতে লোভ জাগে হঠাৎ।মেয়েটার হিজাব নষ্ট হয়েছে,কয়েকটা চুলও বেরিয়েছে।ডাগর ডাগর আঁখি জোড়া ভীত দৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে উমাইরকে পর্যবেক্ষণ করে তো আবার মেঘলার দিকে ফিরে।
–“একে নিয়ে খাওয়াও।দুই প্লেট অবশ্যই।নায়িকা সাজছে নায়িকা!”

অগ্নির দহনের ন্যায় তেজ উমাইরের কথায়।তাহুরা লোকটার দিকে দেখার সাহস সঞ্চার করেও ভেতরে সেই সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারলো না আর। পাঞ্জাবি পরিধেয় সুদর্শন লোকটার চোখের রং বদলাচ্ছে।
–“যাচ্ছি। বকবি না আর ওকে।”
মেঘলা জবাব দেয়।ভদ্র মহিলা তাহুরার কাঁধ চেপে সম্মুখে অগ্রসর হয়।
তাদের অবয়বে দৃষ্টি রাখে উমাইর। বিড়বিড় করে আপনমনে বলে,
–“বকা দিতে কে চাই?আমার বোকা রূপসীকে আদর করতে চাই আমি।হালাল আদর।”

তাহুরা মেঘলার হাত ধরে হাঁটে।দুই তলায় পৌঁছালে মেয়েটা মেঘলার হাত ধরে অনুরোধ করে,
–“আন্টি মাকে কিছু বলবেন না।মা রাগবে আমার উপর।”
মেঘলা আঙুল ঠেকায় তাহুরার চিবুকে,
–“বলবো না,মা।চিন্তা করো না।খাওয়া দাওয়ায় মন দিও।উমাইর যখন ডাকা পাঠালো আমাকে,আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।”

–“সরি আন্টি।আর হবে না এমন।”
তাহুরা মাথা ঝুঁকায়।
মেঘলা তাহুরার মাথায় অধর ছোঁয়ায়,মেয়েটার এলো চুল হিজাবের আড়াল করে,
–“খেয়ে এরপর হিজাব ঠিক করবে।”
তাহুরা আলগোছে মাথা নাড়ে।
সেদিনকার মতো অনুষ্ঠান শেষ হলো প্রায় রাত সাড়ে তিনটায়।তাহুরাদের বাসায় পৌঁছিয়ে দেয় উমাইর।

বিয়ের অনুষ্ঠানের দিনে তাহুরার বাবার শরীর একেবারে বিগড়েছে।খানিক্ষণ আগে তাহুরার দুই চাচার সাথে তর্কে জড়িয়ে উনি ব্যাপক অসুস্থ হোন।সুনেরা পার্লারে সাথে কিছু আত্মীয় যায় তার সাথে।তাহুরার আত্মীয় বড়ভাই কয়েকজন রান্নার ব্যবস্থা দেখছে ভেন্যুতে।মুন্সী বেরোবে সেথায় যেতে তখনই ভাইদের সাথে বিরোধ বাঁধে।বিরোধের কারণ অহেতুক।পূর্বের পারিবারিক সমস্যা টেনে এই ঘটনার আবির্ভাব হয়।
তাহুরা তাদের সামনে কিছু বলতে পারলো না।কেবল বাবার অপমানে চোখের পানি বিসর্জন দেয়।সেই মুহূর্তে আসে ইমনের বাবা এবং শিউলি।ভদ্রলোক এসে চিৎকার করে,

–“গাড়িতে উঠাও জলদি।কেনো বসে রাখলে এতক্ষণ?”
শিউলি নিজেকে সামলে নেয়।মহিলার মনোবল অনেক।স্বামীকে অপদস্ত করার সময় না থাকলেও ঘটনা দ্রুত শুনে নেয় বাকি আত্মীয় হতে।
তাহুরাকে জড়িয়ে নেয় নিজ বুকে।ঘটনা শুনে শিউলির ক্রোধ আকাশসম।তাহুরার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত সুরে মেয়েকে বুঝায়,

–“আমি যাচ্ছি তোর চাচাদের কাছে।তুই মামার সাথে যা হাসপাতালে।বাবা তোকে দেখলে শান্তি পাবে।”
কান্নারত তাহুরা ওড়না দ্বারা চোখের জল মুছে।বাবার হাত ধরে মামার সাথে এগোয়। বোকা মেয়েটা বাবাকে সামলাচ্ছে।মুন্সী মেয়েকে পেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টায়।মেয়ের বিয়ের দিন ভাইদের এমন ব্যবহার সহ্যের বাহিরে।
বাবাকে নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে তাহুরা।মামাও সাথে এসেছে।মন খুব খারাপ তার।বিয়ে বাড়ীতে রঙিন আলো জ্বললেও,মন তাহুরার বিষন্ন।সারাদিন উমাইরের সাথেও কথা হয়নি।লোকটাকে সে কারণে অকারণে বারংবার মেসেজ দিতে ভালোবাসে।লোকটা মাঝে মাঝে রেসপন্স না করলেও তাহুরা নিজ হতে তাকে মেসেজ দেয়,জানান দেয়;তাহুরা সবসময় উমাইরের কথা ভাবে।আজ মোবাইল নেওয়ার ইচ্ছেটাও নেই তাহুরার।বিছানায় শুয়ে রয় সে নিরব।বাবার সাথে বাসায় থাকবে কি সে?থাকলে থাকবে।বাবার জন্যে মন কাঁদে।বাবা আজ মেয়ের বিয়েতে যাবে না।

তাহুরা নিজ কক্ষের চারিদিকে নজর বুলায়।আজ থেকে সে একা মায়ের সাথে থাকবে এই রুমে। বোন চলে যাচ্ছে পর ঘরে।বোনের সাথে কতো রাত আনন্দে কেটেছে!মাঝে মাঝে খুনসুটি হলেও বড় বোন সব ঠিক করেছে তাদের অভ্যন্তরে।এটা সেটা কতো কি কিনেছে তার জন্যে!তাহুরা এই ঋণ কখনো শোধ করতে পারবে না বোনের।
দরজায় খুট শব্দ হয়।আঁখি রক্তিম তাহুরার।মা প্রবেশ করে কক্ষে।মুখশ্রী গম্ভীর।তাহুরাকে শুয়ে থাকতে দেখে শিউলি মুখ খুলে,

–“উঠে রেডি হো।ক্লাবে যেতে হবে।”
–“আমি বাবার সাথে থাকবো?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।
–“কোনো দরকার নেই।রানু কাকী আছে তোর বাবার সাথে।আমিও যেতাম না।কিন্তু, সুনেরা যদি জানে তোর বাবার শরীর ফের খারাপ হয়েছে সে চিন্তা করবে।এছাড়া ঐ বাড়ির কাউকে জানানো হয়নি আজকের ঘটনা।”
শিউলি নিজ বাক্য শেষে বেরিয়ে আসে কক্ষ হতে।

তাহুরা উঠে ধীরে।আলমিরা হতে শাড়ির প্যাকেট বের করে।জলপাই রঙের সেই সুন্দর শাড়ি।মাকে ডেকে মায়ের সাহায্য নিয়ে শাড়ি জড়ায় সে কেবল।মুখে প্রসাধনীর আবরণ নেই।ইচ্ছে করছে না তার কিছুই।কেবল হিজাব বাঁধে সিলভার রঙের।অধরে লেপ্টে লিপ অয়েল।প্রাকৃতিক মোহে রূপে ষোলো আনা তাহুরা।রক্তিম নাক,গাল তার আরেকটু গাঢ় দেখাচ্ছে বাবার জন্যে বারংবার অশ্রুতে ছেয়ে যাচ্ছে বলে।
হাতের ছোট ব্যাগটা নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত ঘোষণা করে তাহুরা।

শিউলি মেয়ের সহজ সাজ দেখেও বললো না কিছু।মেয়েকে তার এইভাবে অপ্সরী মনে হয়।
বিয়ের ভেন্যুতে এলাহী কান্ড।তাহুরার এখন টনক নড়ে।হলুদের চেয়েও বিয়েতে ভারী মানুষ জনের আগমন।মেয়েদের সাজসজ্জা বিলাসিতায় ভরপুর। উমাইরদের এবং নিজেদের পক্ষের মেয়ে আত্মীয়রা বেশ পরিপাটি।সেখানে তাহুরা একেবারে সাধাসিধে রূপে।তাহুরা ঠিক করে আজ সে একদিকে বসে রবে।বোনের সাথে দেখাও তেমন করবে না।বোন হাজারটা প্রশ্ন করলে তাহুরা মিথ্যে বলতে পারবে না।
মানুষের ভিড় অসংখ্য।তাহুরার অস্বস্থি হচ্ছে।মেঘলা তাকে একা বসতে দিলো কই? হাসিখুশিতে উনি সকলের সাথে তাহুরার পরিচয় করাচ্ছে।

অধরে হাসি ঝুলিয়ে চুপটি করে মাথা নাড়ায় সকলের সম্মুখে মেয়েটা।
বান্ধুবীরা এলে তাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় পার করে তাহুরা।তারাও অবশ্য দ্রুত প্রস্থান নেয়।তাহুরার যেখানে মন খারাপ,সেখানে অনুষ্ঠানে তারা জান খুঁজে পায়নি।বাদ বাকি তারা জানে,তাহুরার মন সম্পূর্ণ তার বাবার নিকট।
মেঘলা আবারও তাহুরাকে খুঁজে বের করে।তার হাত ধরে বলে,
–“আম্মা,তোমার আজ কি হয়েছে? এমন চুপচাপ কেনো তুমি?সুনেরা,জুবায়ের এর সাথে খেতে বসবে। আসো।”
সুনেরার কথা শুনে একটু বিচলিত হয় সে,

–“আন্টি,আপুর সাথে বিদায় বেলায় দেখা করবো।এখন না।এছাড়াও আমার খিদে নেই।”
–“মাইর পড়বে মেয়ে।আসো বলছি।হলুদে কি হলো ভুললে?উমাইর কিন্তু খুব বকবে।”
উমাইরের কথা শুনে দমে যায় তাহুরা।লোকটা কই?একটাবার দেখলো না।খোঁজ নিবে কি তার?মেঘলা উত্তর দিবে অবশ্যই।
–“উমাইর স্যার! মানে উনাকে আজ দেখলাম না।”
–“সে নিচ তলায়।তোমার আংকেলের সাথে নেতাদের সামলাচ্ছেন।বেশ বড় মাপের লোকেরা এসেছেন বলে কথা।ছেলেদের খাবারের ব্যবস্থা নিচে।”
তাহুরা নিজ ভাবনায় এমন মশগুল ছিলো ব্যাপারটা খেয়াল করেনি।চারিদিকে নজর বুলিয়ে জবাব দেয়,
–“ওহহ আচ্ছা।”

মেঘলার সাথে খাবার টেবিলে যায় তাহুরা।সুনেরা বোনকে পেয়ে প্রথমে বিরাট ক্ষেপে যায়।জুবায়ের সামলে নেয় তাকে।বোনের এমন সাধারণ মেকাপ দেখেও বিচলিত হয় সুনেরা।উত্তর জানতে চায়।তাহুরা বিপাকে পড়ে।সেই মুহূর্তে শিউলি এসে সামাল দেয়।জানায় তাহুরার শরীর ভালো না।সুনেরাও মেনে নেয়।অতঃপর বোনকে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলায়।অসংখ্য বার দুঃখ প্রকাশ করে জানায়,

–“সরি বাচ্চাটা।আগে বললে কি হতো?”
–“কিছু না।”
তাহুরা জবাব দেয়।
–“খেয়ে আপুর সাথে ছবি তুলবি।”
সুনেরা নির্দেশ দেয় বোনকে।
–“না।আমি তুলবো না।সবাই কতো সুন্দর করে সাজলো।আমাকে খুব সিম্পল লাগছে।”
তাহুরা মন খারাপ করে বলে।
–“সিম্পলেই আমার শালী অপরূপ।ভাইয়া কিন্তু খুব রাগ করবো ছবি না তুললে।”
জুবায়েরের অমায়িক আচরণে হাসে তাহুরা।মলিন কণ্ঠে বলে,
–“আচ্ছা ভাইয়া,তুলবো।”

–“বাহ,বউয়ের বোনকে সবাই পেম্পার করছে আর বরের ভাই কাজ করে হয়রান।”
তাহুরা স্তব্দ।তার সম্মুখে উমাইর।একদম ফিট।ধূসর রঙের স্যুট পড়েছে সে।অত্যধিক সুদর্শন তার অবয়ব।ছেলে হয়েও উমাইরকে যতটা পরিপাটি লাগছে তাহুরাকে ঠিক ততটাই সাধারণ লাগছে বলে মন খারাপ হয় তাহুরার নিমিষে।উমাইর নিশ্চয় আশে পাশের সুন্দরী মেয়েদের প্রতি মত্ত হবে!
ঠিকই তো। আশে পাশে পরিপাটি রমণী থাকলে কে বা সাধারণ মেয়েদের পানে চায়?
–“তুই আর আমার শালী দুজনই আমাদের সাথে ছবি তুলবি।তোদের আজ পাওয়া যাচ্ছে না।”

জুবায়ের হেসে কথাখানা বললে উমাইর তার থমথমে সুর বজায় রেখে উত্তর দেয় ভাইয়াকে,
–“বাবার কিছু প্রিমিয়াম গেস্ট এসেছিলো,উনাদের হ্যান্ডেল করছিলাম।”
অতঃপর খাবার টেবিলে চালাকির সাহায্যে উমাইর বসে তাহুরার পাশের চেয়ারে।
খাবার নিয়ে ব্যস্ত সকলে।উমাইর নিজ চেয়ার তাহুরার নিকট আরো এগিয়ে নেয়।অনেকটা ছুঁইছুঁই হয়ে বসে,
–“আজ সিম্পল মুখ দেখিয়ে সবাইকে নিজের সৌন্দর্য দেখাচ্ছো?মেকাপ ছাড়াও তুমি অপরূপ,এটা বুঝাচ্ছো?”
তাহুরা প্লেট শক্ত হাতে চেপে ধরে।উমাইর!আবারও উমাইর!লোকটার একেকটা কথায় উথাল পাথাল হয় মেয়েটার অন্তর।তবে,সারাজীবন লোকটা তাকে ভুল বুঝে।তাহুরা ধীর কণ্ঠে বলে,

–“নাহ।”
–“আমাকে শিখাও?আমি তোমার মতো বোকা?”
উমাইর ইচ্ছে করে তাহুরাকে চেতানোর চেষ্টায়।
–“এই যে বিশ্বাস করুন।আমি এমন মেয়ে না।আমি সত্যি কিছু করিনি ইচ্ছা করে।”
তাহুরা অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়ে।মেয়েটার এমন চঞ্চলতা অবলোকন করে থামে উমাইর।মেয়েটা চিন্তিত কিছু নিয়ে।তাহুরার কণ্ঠে স্পষ্ট সেই সুর।উমাইর জানতে চায় সেই বিষয়ে।
তাই একপ্রকার হুমকি দেয় সে তাহুরাকে,
–“খাবার শেষে আমার সাথে দেখা করবে।কি হয়েছে তোমার,সবটা বলবে।তোমার বোনকে তোমার মা মিথ্যে বললেও আমি খুব চালাক।”

তাহুরা নজর উঠিয়ে দেখে উমাইরকে।লোকটা সব বুঝে যায় কিভাবে?পরক্ষণে সে আলেয়ার দিকে ফিরে।আলেয়া এক ধ্যানে তাদের পর্যবেক্ষণ করছে তো বাকিরা নিজ খাবারে ব্যস্ত।উমাইর তাহুরার দৃষ্টি অনুসরণ করে আলেয়ার পানে তাকালে আলেয়া দ্রুত নজর সরায়।উমাইর আলেয়াকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে।এমনকি তাহুরার নামে উল্টোপাল্টা কিছু রটালে তার খারাপটা ভুগবে আলেয়া সেটা উমাইর সোজা জানিয়েছে তাকে।এই কারণেই আলেয়া সব জেনেও চুপ, উমাইরের মামীকেও বললো না কিছু।
উমাইরের ভাবভঙ্গি কঠোর হয়। খাবার এগিয়ে দেয় তাহুরার প্লেটে। সেই সময় তাহুরা মিনমিন কণ্ঠে বলে,
–“আমি ঠিক আছি।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৯

উমাইরের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টায় সে।মেয়েটা ইচ্ছাকৃত ঘটনা এড়াতে চাইছে বুঝলো।কিন্তু,উমাইর নাছোড়বান্দা।তার মাথামোটা কিছু নিয়ে চিন্তিত,মনে মনে জর্জরিত আর সে ব্যাপারটা জানবে না?মেয়েটার সকল শান্তির কারণ হতে চায় উমাইর।
বেশ ধিম গলায় উমাইর তার প্রেয়সীকে বলে,
–“তোমার প্রত্যেকটা নিঃশ্বাসের ভাষা আমি বুঝি,মাথামোটা।আর মুখের ভাষা বুঝবো না?

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২১