রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৯

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৯
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“লিসেন তুনাজ,সোজাসাপ্টা কথা হলো,তাহুরার দিকে তাকানো যাবে না।ওর ব্যাপারে কোনো কথা ভাবতেও পারবে না তুমি।”
দুই আঙ্গুল টেবিলে ঠেকিয়ে গড়গড় করে নিজ বক্তব্য পেশ করে উমাইর।ভাবভঙ্গি শক্ত,নির্দয় ভাব। অপর পাশে অবস্থানরত তুনাজ ঘাবড়িয়ে।দোটানায় ভুগে। এইভাবে সে উমাইরকে ভীতি করে চলে।তার উপর একাকীত্বে উমাইর তাকে ডেকেছে আবার তাহুরার বিষয়ে হুশিয়ারি দিচ্ছে।তুনাজের কপালের কিনারায় সূক্ষ্ম ঘামের আস্তরণ।তাহুরাকে পছন্দ করে বিরাট ভুল করেছে কি?

একদিকে তাহুরার প্রতি মায়া,ভালো লাগা অন্যদিকে উমাইরের কঠোর বক্তব্য।হরেক রকম চিন্তা শেষে তুনাজ মুখ খুলে,
–“আসলে,তাহুরাকে আমার ভালো লেগেছে।বাসায় মেয়ে দেখছিল আমার জন্যে।তাই….”
টেবিলে সজোরে থাবা দেয় উমাইর।তার কর্মকাণ্ডে রেস্তোরায় উপস্থিত তাদের নিকটবর্তী সকলে চিন্তিত নজরে অবলোকন করে।উমাইর ঘাড় ফেরায় চারিদিক।তার টগবগে দৃষ্টি সকলকে নিজ কাজে ফিরতে বাধ্য করে নিমিষে।তুনাজ শঙ্কিত।ভুল কথা বলেছে সে নিশ্চিত।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–“তাহুরা অনেক আগে থেকেই আমার।ওর উপর অন্য ছেলের দৃষ্টি আমি কখনো সহ্য করি না।নেহাত তুমি আত্মীয় তাই বোঝাতে এলাম।তোমার জায়গায় অন্য ছেলে হলে বোঝানোর দরকার পড়তো?তুমি জানো আমি কি করতাম তখন।মুখে না বলে আমার হাত দ্বারা আলোচনা করতাম।”
উমাইরের কণ্ঠ বড্ড গম্ভীর। দাঁতে দাঁত চেপে বলা প্রত্যেক বাক্যে যেনো হুমকি আর হুশিয়ারি।
তুনাজ ঘাবড়ে যায়। এসির মাঝেও সে ঘেমে কুলহীন সাথে উমাইরের ভয়ংকর নজর।সুদর্শন লোকটা রেগে গেলে আঁখিদ্বয় তার রক্তিম হয়,কপালের মধ্যেকার রগ হয় ভাসমান।তুনাজ স্পষ্ট বুঝে নেয়,উমাইর তাহুরাকে পছন্দ করে।উহু,পছন্দ না ভালোবাসে।
ভীত সুরে তুনাজ মুখ খুলে,

–“আপনি…আপনি তাহুরাকে পছন্দ করেন?বা ভালোবাসেন?”
–“যেটাই করি,সেই মেয়েটা শুধু আমার।নজর দেওয়া নিষিদ্ধ।তুমি পরিচিত তাই বসে আলোচনা করলাম।চ্যাপ্টারটা এইখানে ক্লোজ করছি।ফের যেনো তোমার বাড়ির কেউ বা তুমি তাহুরার কোনো বিষয়ে কথা না বাড়াও।”
আবারও এক রাশ গম্ভীর মনোভাব প্রকাশ করে উমাইর।পরক্ষণে চেয়ারে হেলান দেয় সে।অধর বাঁকা করে,
–“আত্মীয় বলে একবার আলোচনার সুযোগ পেয়েছো।দ্বিতীয়বার পাবে না।শেষ কথা হলো,আমাদের আলোচনা আমাদের ভেতরে থাকবে।মামী বা ফ্যামিলির কেউ যদি জানে,এর ফল তুমি ভোগ করবে।আমি চাই না,আমার তাহুরাকে কেউ কটু কথা শোনাক বা জ্বালাতন করুক।”

বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁয়ে দেয় উমাইর তার নিজ কপালে।
তুনাজ উঠে দাঁড়ায়।সে ভারসাম্যহীন।তাহুরার প্রতি উমাইরের চাহিদা আছে জানলে,মেয়েটার দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে দেখতো না।সামান্য ঝুঁকে তুনাজ।গড়গড় শব্দে আওড়ায়,
–“আজ থেকে আমি ভুলে যাবো তাহুরা নামের কাউকে আমি চিনতাম।”
–“দ্যাটস গুড।”
উমাইর নিজ বুকে দুহাত ভাঁজ করে হাসিমুখে।তবে চাহনি তার এখনো করুণ।
–“আমি যাই তবে।”

তুনাজ শার্টের হাতায় ঘাম মুছে।
–“অবশ্যই যাও।একাকী মিটিং পরের বার যেনো না হয়।তখন মিটিং রেস্টুরেন্টে না হয়ে,কই হবে সেটা তোমার জানা আছে।”
উমাইর রুঢ় হাসে।
–“জ্বী, উমাইর ভাই।”
তুনাজ পায়ের গতি বাড়ায়।হতদন্ত ভঙ্গিতে একপ্রকার ছুটে পালায়।

উমাইর রেস্তোরায় একা বসে।মেজাজ নিয়ন্ত্রণের জন্যে কফি অর্ডার দেয়।এরমাঝে তার মোবাইলে বিপ বিপ শব্দ আসে পরপর।স্ক্রিনে “মা ” ভাসমান।মেঘলা বেগম নিশ্চয় ব্যাপক চিন্তিত।উমাইর ফোন রিসিভ করে।পরিস্থিতির স্বাভাবিকতা সম্পর্কে জানায়।মেঘলার যেনো জান বাঁচলো।
মায়ের সাথে কথা শেষে উমাইর ঢু মারে তাহুরার চ্যাটে।মেয়েটা চারটা মেসেজ দিয়েছে চার সময়ে। উমাইরের কথা মনে পড়ছিলো বুঝি?
তাহুরার মেসেজের বিপরীতে উমাইর পাঠায়,

–“সমস্যা কি? এতো মেসেজ দিচ্ছো?”
মিনিট এক পরে তাহুরা উত্তর পাঠায়,
–“সরি।আসলে আপনি দুপুরে রেগে ছিলেন।তাই ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি,এখনো কি রেগে আছেন?”
–“না।”
উমাইর ছোট্ট অক্ষরে লিখে।
–“আচ্ছা।”
মেসেজ পাঠিয়ে তাহুরা আবারও প্রশ্ন করে,
–“উম,একটা প্রশ্ন হচ্ছে; আপনি আজ বললেন কালকে আপনি এমন কিছু করবেন যেনো আমি অজ্ঞান হবো।কি করবেন?”

উমাইর তাহুরার প্রশ্ন দেখে হাসে।সে জানতো মেয়েটা এই বিষয় নিয়ে দ্বিধায় ভুগবে শতভাগ।দ্বিধায় যখন ভুগছে তাহুরা,সেই তাড়নায় উমাইর তাকে আরো জ্বালাতন করার সিদ্ধান্ত নিলো,
–“করবো কিছু একটা।সহ্য হবে তোমার?”
–“কিজানি!”
তাহুরা অবাক হয় কিঞ্চিৎ।
–“কিজানি বলে লাভ নেই।আমি ভেবে নিয়েছি কি করবো।আর একটা কথা, কাল যেনো খোলা চুলে ঘুরতে না দেখি তোমাকে।দুই ফ্যামিলির একসাথে বিরাট প্রোগ্রাম।যতো ঢং করার আমার সামনে করবে,অন্যের সামনে না।”
মেসেজ পাঠিয়ে মোবাইল থেকে নজর সরায় উমাইর।ওয়েটার তার সম্মুখে কফি রাখে।
আবারো মোবাইল ভাইব্রেট করলে উমাইর দৃষ্টি দেয় মোবাইলে।
তাহুরা জবাব পাঠিয়েছে,

–“আমি কেনো আপনার সামনে ঢং করবো?আমি এমন মেয়ে না।”
–“আমার সামনে ঢং করতে বাধ্য তুমি। গাঁধী একটা।”
উমাইর অধর চেপে হাসে।মেয়েটাকে হেনস্তা করা খুব সহজ আর মজাদার।তবে,তাহুরাকে হেনস্তা বা তার মজা নেওয়া কেবল উমাইর নিজের জন্যে বরাদ্দ রেখেছে।অন্য কারো সেথায় নাক গলানোর ভূমিকা উমাইর রাখেনি।
কফির কাপে চুমুক দেয় উমাইর।নজর এখনো স্ক্রিনে সীমাবদ্ধ।অনেক্ষণ তাহুরার নামের নিচে টাইপিং দেখাচ্ছে।মেয়েটা কি এতো লিখছে?মিনিট দুই পর তাহুরার উত্তর আসে,
–“আমি তাহুরা,গাঁধী না।”

অধর জোড়া প্রশস্ত হয় উমাইরের।বোকাটা এতক্ষণ চিন্তা করে এই মেসেজ পাঠিয়েছে!স্ক্রিনে আঙুল বোলায় উমাইর।মেসেজের জবাব না দিয়ে আপনমনে আওড়ায়,
–“আমার গাঁধী তুমি।আমার সুন্দরী গাঁধী।”
উমাইর কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রেস্তোরা হতে বেরোয়।বাইকের হেলমেট হাতে নিয়ে ভাইকে ফোন দেয়।জুবায়ের ফোন রিসিভ করে সহসা বলে,
–“কিরে তোর খেলানো শেষ?”
–“হুম।লেভেল ওয়ান ছিলো।খেলা কতদূর?”
উমাইর জবাব দেয়।

–“আরেক ম্যাচ স্টার্ট হবে।আসবি?”
–“আসছি। বিশ মিনিট।”
ফোন কাটে উমাইর।হেলমেট পড়ে। কালো কাঁচের আড়ালে কিছু দৃশ্যমান নেই।উমাইর মোবাইল পকেটে পুরে।ভারী মোটর বাইক নিমিষে নিজ আয়ত্বে আনে সে।অতঃপর সহজ রাস্তায় না গিয়ে,গাড়ি অন্য রাস্তায় নেয়।তাহুরাদের বাড়ির সম্মুখের রাস্তা নির্ধারণ করে সে।

গতি অনেকটা বেশি মোটর বাইকের।বড়, ছোট গাড়ির মধ্যখানে বেশ দক্ষতার সহিত মোটর বাইক এগিয়ে যাচ্ছে। আট মিনিটের মাথায় পৌঁছেও যায় তাহুরাদের বাড়ির গলিতে।গতি এখন মন্থর।তাহুরাদের গেইটের বরাবর আসলে ঘাড় ফেরায় ডানদিকে।তাদের প্রধান ফটক খোলা।ভেতরে একটা প্রাইভেট কার।হয়তো কোনো আত্মীয় আসলো।
কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখলো না।উমাইর ব্যথিত হয় না, কষ্টও পায় না।অধরে প্রশান্তির হাসি ঝুলিয়ে ভাবে,
–“তোমার বাড়ির সামনেও যেনো তোমার অস্তিত্বরা আমাকে গ্রাস করছে।”
ফের মোটর বাইকের বেগ বৃদ্ধি করে উমাইর। ম্যাচ শুরু হতে বেশি সময় বাকি নেই।

দুই পরিবারের আত্মীয়ের সংখ্যা অসংখ্য।বড় ছেলে,মেয়ের বিয়ে বলে কথা।কাউকে দাওয়াতে বাদ রাখেনি উভয় পরিবার।মুন্সী সমান টাকা ইনভেস্ট করেছে।যদিও একটু টানাপোড়ার জোগাড়,তাও থেমে নেই সে।ছেলেমেয়ের হলুদের অনুষ্ঠান একসাথে হবে বলে ক্লাবের ভাড়া অর্ধেক নিজ থেকে দেয় মুন্সী।মেয়ের জন্যে সব মেনে নিচ্ছে মানুষটা।তাহুরাদের পরিবার প্রথমে আসে কনভেনশন হলে।এরপর ধীরে ধীরে আত্মীয়ের সংখ্যা বাড়ে।ভেতরকার ডেকোরেশন দেখে মুন্সী সাথে তাহুরা এমনকি বাকি পরিবারবর্গ সমানে অবাক।নিশ্চয় ছেলে পক্ষ গোপনে টাকা খরচ করেছে এমন আয়োজনে।যেটা মুন্সীকে জানানো হয়নি।

আলোর ফোয়ারা চারিদিকে।অত্যন্ত সুন্দর ডেকোরেশন।কৃত্রিম চেরি ব্লোসমের গাছের দেখা মিলল।সেথায় ঝুলছে গোলাপী আভা।কি মনোরম,কি আকর্ষণীয়!
তাহুরা বিস্ফোরিত নজরে চারিদিক দেখছে।অনুষ্ঠানে এমন আয়োজন হবে কস্মিককালে ভাবেনি। স্টেজ থেকে শুরু করে পুরো এলাকাজুড়ে কেবল কৃত্রিম আলো,গাছ,ফুল,কাঁচের সমাহার।তাহুরা নিজ হলুদ রঙের শাড়ির কুঁচি ধরে সাবধানে।আপুর সাথে ভারী সাজ দিয়েছে সে।মুখে একটু অস্বস্থি লাগলেও,ব্যাপক মানিয়েছে মেয়েটাকে।সোনালী রঙের হিজাবে তাহুরাকে আরো জীবন্ত লাগছে।অধরে লেপ্টে তার খয়েরী রঙ।আলাদা দ্যুতি জ্বলজ্বল করছে মেয়েটার সত্তা হতে।
মুন্সী মেয়ের সৌন্দর্য দেখে শুকরিয়া আদায় করে।পাশে দাঁড়ানো সহধর্মিণীকে বলে,

–“তাহুরাকে গিয়ে সূরা পড়ে ফুঁক দিয়ে আসো।আমার বাচ্চাটার উপর কারো কুনজর আল্লাহ্ না পড়ুক। সুনেরার জন্যেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করো।”
শিউলি মেয়েকে মন ভরে দেখে।বড় মেয়েকে হলুদের বৌ-রুপে দেখে আঁখিতে জল জমে।ধীরে হেঁটে ছোট মেয়ের কাছে যায় শিউলি।মাকে দেখে খুশি মনে তাহুরা বলে,

–“কি সুন্দর লাগছে চারিদিকে তাই না,মা?”
শিউলি দোয়া পড়ে ফুঁক দেয় মেয়ের সত্তায়,
–“হ্যাঁ।তোর সইরা আসবে না?”
–“আজকে আসবে না, মা।পরশু দিন বিয়েতে আসবে।”
তাহুরা জবাব দেয়।
–“আচ্ছা।সাবধানে থাকিস।আমি আত্মীয় সামলাই।”
মায়ের উত্তরে তাহুরা মাথা নাড়ায়।মা চলে গেলে আবারও তার স্নেহময় দৃষ্টিতে পারিপার্শ্বিক দিক অবলোকন করে মেয়েটা।

নিজ প্রাইভেট কার হতে উমাইর বেরোয়।সবার শেষে এসেছে সে।অনুষ্ঠানের জন্যে কেক আনতে সে দেরী করে। উমাইরের জন্যে এখনো বর,কনে স্টেজে উঠেনি আনুষ্ঠানিকভাবে।উমাইর গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজা খোলে।তার ধারে আজিম দাঁড়িয়ে।উনি মূলত কেক ভেতরে নিবেন।উমাইর দরজা খুললে প্রবীণ লোক কেকের বাক্স নিয়ে হলের দিকে এগোয়।

উমাইর নিজ পাঞ্জাবি সমান্তরাল করে।জেল সারা সেট করা চুলে আলতো হাত বুলায়। গালে চাপ দাড়ির নকশা নতুন। ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা।ফর্সা ত্বকে হালকা সবুজ রঙের পাঞ্জাবি বেশ আকর্ষিত করলো উমাইরের তনুকে।হাতের কব্জিতে সটান আটকে তার কালো ঘড়ি।বন্ধুদের একে একে ফোন দিয়ে খবরাখবর জানছে।কতটুক পৌঁছালো তারা!
সিঁড়ি ভেঙে মাত্র কনভেনশন হলের প্রাণে এসে দাঁড়িয়েছে উমাইর। তখনই তার ভেতরকার সত্তা নড়ে উঠে।চক্ষুদ্বয় স্থগিত হয়। বক্ষদেশের গতি অস্বাভাবিক।শরীরের ভেতর অদ্ভুত তাপ।তার শরীরটা কি জ্বলছে?

উমাইর হতে কিছু ফুট দূরত্বে অবস্থানরত তাহুরা। শাড়িতে মোড়ানো।মার্জিত রূপ।চেহারার সৌন্দর্যের বিস্তৃত কোনো বৃত্তান্ত নেই।মেয়েটা অপরূপ,মোহনীয়।খুব করে হাসছে।ভারী মেকাপে গোলাপী আভার গাল জোড়া আরো গাঢ় দেখাচ্ছে।বুকের গতি এতটা অস্বাভাবিক হলো,উমাইর নিজ কানে তা শুনছে।
আটকে রইলো সম্পূর্ণ সে তার রূপসীতে।তার মোহে গ্রাস হলেও,অন্তঃস্থলে ঈর্ষায় মত্ত হয় মানব।মানা করেছিল এমন দুর্দান্ত ভাবে না হাসতে।উমাইর এমনটা ছিলো না কখনো।তবে,তবে,তবে…এই এক সরল মেয়েটার জন্যে নিজের অন্যান্য গুণের সাথে ঈর্ষার গুণ অর্জন করেছে।

–“বাবা,সবাই বুঝে যাবে তুমি তাহুরাতে মগ্ন।নজর ফেরাও।”
মায়ের দুষ্টুমি ভরা কণ্ঠ।উমাইর দৃষ্টি ফেরায় না।গরম ভাব বাড়ছে তার তনুয়,
–“ওকে আমি এমন খিলখিল হাসতে মানা করেছিলাম ভরা আসরে।ওর বাসায় হাসুক,আমার বাসায় হাসুক আমার সমস্যা নেই।কিন্তু…সবার সামনে কেনো হাসছে?প্রস্তাব আসার জন্যে?”
মেঘলা ছেলের ঈর্ষা দেখে অবাক না হয়ে পারে না। যেই ছেলের নম্র ব্যবহার,আবার জিদ, রাগ,মেয়েদের প্রতি সম্মানের গুণ দেখেছে;সেই ছেলের এমন ঈর্ষান্বিত রূপ আশা করাটা খুব অপাক্ষিক ছিলো।মেঘলা মুখে হাত দেয়।অবাক হয়ে বলে,

–“আব্বা তুমি জেলাস?”
–“জানিনা।ওকে এইভাবে সবার সামনে নিজের সুন্দর হাসি দিতে মানা করো।আমি মানা করলে না তোমার পছন্দ হবে না মেয়েটার।”
উমাইর ক্রোধে দগ্ধ আবার মেয়েটাকে মত্ত।অন্য পাশে যেতে যেতে তাহুরাকে ভস্ম করে উমাইর নিজ দৃষ্টি দ্বারা।
উমাইর আসার পর সকলে তাড়াহুড়ো করে কনে-বরের স্টেজে উঠার প্রক্রিয়ার জন্যে।ভাই বোনেরা মিলে পাশাপাশি দাঁড়ায় তাদের। তাহুরা তার বোনের নিকট,সাথে আয়মা। সেইদিকে দাঁড়িয়েছে তাহুরার চাচাতো ভাইয়েরা।খানিক নড়চড় হলে তাহুরার গায়ের সাথে ঘেষবে সহজে।উমাইর দাঁড়ায়নি প্রথমে।কিন্তু,এহেন দৃশ্য দেখে থামাতে পারলো না সে নিজেকে।

গটগট ভঙ্গিতে হেঁটে যায়।হুংকার ছাড়ে ভদ্রতা বজায় রেখে,
–“মেয়েরা ভাবীর পাশে দাঁড়ালে বেটার।”
তাহুরা সবে লক্ষ্য করলো উমাইরের অবয়ব।সুঠামদেহী এই মানবে গলে যায় তাহুরার নরম অন্তর।কি আকর্ষণীয় লোকটার আঁখি,অবয়ব।অস্থির হয়ে যায় মনের গহীন।ঘেমে উঠে তার নাক।লোকটা কবে এলো?তাহুরা উমাইরকে দেখতে ব্যস্ত হলেও, উমাইরের নির্দেশে সবাই নিজ অবস্থান ঠিক করছে।তাহুরা আলতো ভাষায় উমাইরকে বলে উঠে,
–“কখন এসেছেন আপনি?”

নজর মিলে দুজনের।উমাইরের দৃষ্টিতে অন্য মাতোয়ারা স্পষ্ট।কি বুঝালো,তাহুরা বুঝলো না।তবে অবাক হলো,উমাইর তাকে জবাব দেয়নি বলে।মুহূর্তে চঞ্চলতা ছেয়ে যায় তাহুরার হৃদয়ে।লোকটা তার সাথে কথা বলবে না?কেনো? কি করেছে তাহুরা?
সবাই ঠিক হয়ে দাঁড়ালে ক্যামেরাম্যান নির্দেশনা দেয় সম্মুখে আগানোর।তাহুরা এখনো উমাইরের পানে চেয়ে।একটা বাক্যের অপেক্ষায়।সমাপ্তিতে উমাইর বেশ ব্যক্তিগত ভঙ্গিতে তাকে চিবিয়ে জবাব দেয়,

–“বেশি উড়লে সবার সামনে পাখা ভাঙবো।”
খানখান করে উঠে পুরো শরীর।কথা তো কথা নয়,যেনো তীর।সোজা এসে হানা করে তাহুরার বক্ষ মাঝারে। ভুল করে তাহুরা কিসে গরমিল করলো?
মনের ভাবনার সাথে পাল্লা দিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয় সে সকলের তালে।অন্যমনস্ক হওয়ায় শাড়ি পায়ের নিচে আসে খানিকটা।পড়তে নিলে নিজেকে সামলে নেয়।
তার দৃশ্য উমাইরের নজরে আটকালে মেজাজ চটে তার।ক্ষিপ্ত হয়ে আওড়ায়,
–“মাথামোটা।”

কথায় বলে নিজ পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিজের খাওয়ার সুযোগ হয় সবার শেষে।তাহুরার বেলায় একই।মেয়েটা জড়তার সাথে আত্মীয়দের সামলাচ্ছে। উমাইরের দিকের আত্মীয় তারা দেখছে।ক্ষুধা ভিড় করে তাহুরার উদরে।দুপুরের পর কিছু খাওয়া হয়নি।তার উপর এতো খাটনি। মানুষও বেড়েছে অনেক।
একজনকে দেখলে আরেকজনকে খুঁজে পাওয়ার দায়।বিশাল এরিয়া বলে কথা। উমাইরের দিকের আত্মীয়ের সংখ্যা বেশি।

ক্ষুধায় তার মাথা ঘোরার জোগাড়। বোনেরা খেতে আরো দেরী আছে,সবাইকে ফেলে খেতে বসতে মন সায় দিচ্ছে না মেয়েটার।তার উপর মন খারাপের পরিমাণ আকাশ ছুঁয়ে।উমাইর তাকে অবজ্ঞা করছে।কি দোষ করেছে সে,কথাটা জিজ্ঞাসা করতে দুইবার উমাইরের নিকট গেলে তাকে না দেখার ভান করে উমাইর।শেষবার তো উমাইরের বন্ধু রনি তাহুরার উপস্থিতিতে বলেছিলো,

–“উমাইর,তাহুরা হয়তো কিছু বলতে চায়।”
বিনিময়ে উমাইর জবাব দেয়,
–“তোকে ছাড়া কাউকে দেখছি না।”
কি অপমান!তাহুরাকে একেবারে গায়েব করে দিলো?
মন খারাপের পাল্লা ভারী অত্যন্ত।তাহুরা বাবাকে খুঁজে।মায়ের কাছে জানে,তার বাবাকে বাসায় পাঠিয়েছে উমাইর।বাবার শরীর এতো মানুষের ভিড়ে খারাপ হচ্ছে।
উমাইর তার পরিবারের জন্যে উজাড় করছে সবটা,আর সেই পরিবারের ছোট মেয়েকে করছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য।কান্না পায় তাহুরার।শরীর টলছে।মানুষ যাকে ভালোবাসে তার এক বিন্দু এড়িয়ে যাওয়াটা যেনো বিষের চেয়েও বিষাক্ত।
আবারো নজর হন্য হচ্ছে উমাইরকে খুঁজতে।তৎক্ষণাৎ বেজে উঠে মুঠোফোন।উমাইরের নাম, নাম্বার,ছবি দৃশ্যমান।তাহুরা কিছু বলার পূর্বে উমাইরের গম্ভীর স্বর শুনতে পায়,

–“পার্কিংয়ে আসো।ফাস্ট।”
উমাইর তাহুরার সাথে কথা বলেছে এটাই যেনো সৌভাগ্য তার।মাকে খুঁজেছে জানানোর জন্যে।পায়নি।তবে মেঘলা বেগম তাকে দেখে এগিয়ে আসে,
–“উমাইরের কাছে যাও।আমি তোমার মাকে সামলাবো।”
–“কাজ ছিলো আন্টি?”
তাহুরা জানতে চায় কেনো উমাইর ডাকছে তাকে!
–“উমাইর রেগেছে কেনো জানি।বলেনি আমাকে।এইদিকে আমি দেখছি, সামলাচ্ছি।”
মাথা নাড়ায় তাহুরা।মেয়ে পক্ষ কি ভুল করেছে এই নিয়ে তাহুরার শঙ্কা।নাহলে উমাইর রাগলো কেনো?হলের মুখে আসলে রনি তাকে এগিয়ে নেয়,

–“আসো ছোট আপু।”
বিনা কথায় তাহুরা তাকে ফলো করে। পার্কিংয়ে নিরবতা।বন্ধুরা পার্কিংয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে।সেখান হতে উমাইর তার হাত ধরে।টেনে নিয়ে যায় সারির পর সারির পিছে উমাইরের গাড়ির দিকে।তাহুরা তার লম্বা কদমের সাথে পাল্লা দিতে হিমশিম।তাও এগিয়ে যাচ্ছে।হাফ ছুটে প্রশ্ন করে,
–“আপনি রেগেছেন কেনো?”

উমাইর গাড়ির পেছনের দরজা খুলে।তাহুরাকে বসায়।ফের তাহুরাকে আরো সরিয়ে নিজে বসে।শেষ প্রশ্বাস ঘন।বুকের উঠানামা দ্রুত।ভয়ে আড়ষ্ট তাহুরা।পার্কিংয়ের লাইটে গাড়ির ভেতরকার দৃশ্য আবছা হলেও স্পষ্ট।তবে বাহির থেকে দেখার জো নেই।গাড়ির কাঁচ কালো।
তাহুরা অধর ভেজায় জিহ্বার সাহায্যে।কি হয়েছে?
শাড়ি খাঁমচে ধরে সে।মাথা নিচু করে প্রশ্ন করে,

–“এই যে,আপনি এমন করছেন কেনো?আমরা কোনো ভুল করেছি?সরি ভুল করলে।”
উমাইর চোখ খুলে।ঘুরে বসে তাহুরার নিকট।দৃষ্টি তার এলোমেলো।তাহুরা বুঝছে?বুঝছে না।
তাহুরা ছলছল দৃষ্টিতে মাথা উচুঁ করে তাকালে উমাইর আরো নিকটে যায়।ফলস্বরূপ আরেকটু পেছালো তাহুরা,
–“এই যে,কি হয়েছে?”
–“একদম এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাবে না।ম”রে যাবো আমি।”
উমাইরের কণ্ঠে মাদকতা।নিজেকে হারানোর মাতোয়ারা।

তাহুরা দৃষ্টি নামিয়ে ফের তাকায়।উমাইরের নজরটা তাহুরাকে ভেঙে ছুঁড়ে ছারখার করছে।মাথাটাও বড্ড ঘোরাচ্ছে।প্রেসার লো হচ্ছে মেয়েটার।
–” বললাম না তাকাতে আমার দিকে।”
তাহুরা উমাইরের কথা শুনে মাথা ঘোরালে,উমাইর তার হিজাব টানে,
–“শেষ করেছো আমাকে তুমি।জাস্ট শেষ।”
তাহুরা হিজাবের টানে তাকায় উমাইরের পানে।লোকটার সুঠাম দেহ তার অনেকাংশ জুড়ে ঝুঁকে।

–“তোমার বোনের বিয়ে,অবশ্যই তুমি সুন্দরভাবে সাজবে,সব করবে।কিন্তু, আমার সহ্য হচ্ছে না।বুকের জ্বালায় দম বন্ধ হচ্ছে।আমি আগে কখনো এমন ছিলাম না।তুমি আমাকে এমনটা হতে বাধ্য করেছো।”
খানিকটা অগ্রসর হয় উমাইর।ততক্ষণে তাহুরা গাড়ির দরজায় লেপ্টে হিজাব সরে।উমাইর দৃষ্টি সংযত করেও লাভ হয়নি।মেয়েটার আকর্ষণীয় বক্ষাংশ আঁখিতে বন্ধী।মাথায় হাত রেখে আফসোস করে,
–“আহ, শিট!”

পরপর উমাইর তাহুরার পিঠের নিচে হাত রেখে নিজের নিকট টানে।কপালে কপাল ঠেকায়।আতঙ্কিত তাহুরা, উমাইরের গরম নিঃশ্বাসে দিগ্বিদিক হারায়। স্বপ্ন দেখছে কি সে?উমাইরের মাতোয়ারা শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠও ভেসে আসে তার কানে,
–“প্লিজ,অন্যের সামনে তুমি প্রাণখুলে হাসবে না রূপসী।আমার…আমার জাস্ট দম বন্ধ লাগে তখন।”
তাহুরা শুনছে কি শুনলো না নিজের আন্দাজে নেই।তার শরীর লাগামহীন বদ্ধ গাড়িতে,উমাইর কাছাকাছি।তাহুরার দুইহাত উমাইর নিজ বক্ষে ঠেকিয়ে রাখলো।
–“আচ্চ…আচ্ছা।কিন্তু,এখন আমি উপরে যাবো।খারাপ লাগছে।”
আকুতি ভরা কণ্ঠ।

উমাইর চেয়েছিলো ভালোবাসাময় শাস্তি দিতে তাহুরাকে।অতঃপর লক্ষ্য করে মেয়েটা নেতিয়ে যাচ্ছে অন্য কারণে।
উমাইর তার সুন্দরীর হাত ধরে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। মেয়েটাকে ভালোবাসার একটা স্পর্শ দিবে ভাবলেও,সামলে নেয় উমাইর নিজেকে।তাহুরার আঁখিতে ভয় স্পষ্ট।গাড়ি থেকে বেরুলে উমাইর লক্ষ্য করে তাহুরা নিজ হতে উমাইরের প্রশস্ত বাহুতে হাত রাখে।মাথা ঝুঁকিয়ে উমাইর লক্ষ্য করে তাহুরার পদক্ষেপ ধীর।তার হাতের উপর হাত বুলায় উমাইর।ঐযে দেখা যাচ্ছে রকি,রনিকে।

–“যা বলেছি মনে রাখবে।নাহলে আমি রাগ করবো আবারও।বাহিরের কারো সাথে বা কারো সামনে বেশি হাসবে না,ভাব করবে না। নাহলে,আমি এমন রাগ করবো তুমি সহ্য করতে পারবে না।মেজাজ বিগড়াবে না আমার।”
উমাইর হুশিয়ারি দেয় ফের।
তাহুরার সবকিছু এলোমেলো লাগে,মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে সে স্বপ্ন দেখছে।অথচ তার প্রেসার ফল করেছে খাবারের ঘাটতি আর ক্লান্তিতে।
–“স…সরি…”

বলতে বলতে তাহুরা নিজ ভারসাম্য হারায়।উমাইরের বাহুতে রাখা হাত ঢলে পড়তে নিলে উমাইর তার কোমর জড়িয়ে নেয়।বিচলিত হয় মুহূর্তে।গলা উঁচু করে রনিকে বলে,
–“রনি পানি আন।”

পরক্ষণে উমাইর কোলে তুলে তাহুরাকে।মেয়েটা তার বুকে লেপ্টে যায়।অজ্ঞান হ‌ওয়ার কারণ নিশ্চয় উমাইর নয়।বরংচ উমাইর তাহুরার নিস্তেজ ভাব লক্ষ্য করে, গাড়িতে তার গালে আলতো স্পর্শ করতে গিয়ে ফিরে আসে। পুনরায় তাহুরাকে গাড়ির দিকে নেয় উমাইর।চোখমুখ শক্ত হয় তার।গাড়ির পিছের সিটে শোয়ানো অবস্থায় আপন সুরে সে বলে উঠে,
–“আমি ছাড়া অন্য কেউ বা অন্যকিছু যদি জ্ঞান হারানোর কারণ হয় তাহু,আমি শুধু তাণ্ডব চালাবো।”
পরপর তাহুরার শুকনো মুখে হাত বুলায় উমাইর।রনি,রকি পানি নিয়ে আসছে।তাহুরার কপালে তাদের অনুপস্থিতে অধর স্পর্শ করে উমাইর,

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৮

–“তোমার ভালো,খারাপ,সুখ,দুঃখ সবকিছুর কারণ শুধু উমাইর।আমি ব্যতিত বাকি সবাইকে তোমার জন্যে বিষাক্ত ঘোষণা করলাম,জান।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ২০