রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৮

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৮
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“উনি উমাইর স্যার না?”
সন্দেহজনক কণ্ঠ স্বাগতার।তার বিচলিত প্রশ্নে তাহুরা বামে ফিরে।পেছন অবয়ব পর্যবেক্ষণ করে মেয়েটা চিনলো তার মনের রাজাকে।সুঠাম দেহী উমাইর অন্যদিকে মুড়ে আছে।লোকটার ঘাড়ের উপর ট্রিম করা চুল,পেছনের অবয়ব চিনতে ভুল করেনি তাহুরা।এমনকি স্বাগতাও ঠিক ধরেছে।কলেজের সুনামধন্য স্যার হওয়ায় যে কেউ তাকে চিনতে সক্ষম হবে।উমাইর তার পড়ানোর নিয়ম,ভালো ব্যবহার,আবার মেজাজের তিক্তকা,রাগী মনোভাব, সুদর্শনতা সবকিছু দিয়ে কলেজে বেশ ভালো জনপ্রিয় করেছে নিজেকে।
তাহুরা মাথার হিজাবে হাত রাখে।ভাবুক হয়ে উত্তর দেয়,

–“হ্যাঁ,উনি।কলেজের মাঝে কি করছেন?”
উৎসুক হয় তাহুরার মন।পরপর তার মনের প্রশ্নের উত্তর আঁখির সম্মুখে আসে।উমাইরের পাশে এসে দাঁড়ায় ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের আরো কিছু শিক্ষক শিক্ষিকা।মূলত তারা ছবি তুলতে দাঁড়িয়েছে।সকলে সারি বদ্ধ দাঁড়ালে পেছনে তাহুরা, স্বাগতাকে দেখা যায় ক্যামেরায়।ফলস্বরূপ ফটোগ্রাফার হালকা চিৎকারে বলে উঠে,
–“পিছন থেকে প্লিজ সরে দাঁড়ান।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

স্বাগতা,তাহুরার হাত ধরে টানে।মেয়েটার শক্ত কদম না চাওয়া সত্ত্বেও অগ্রসর হয়।ফটোগ্রাফারের ইশারায় একজন শিক্ষিকা এসে দাঁড়ায় উমাইরের নিকট।আর সেদিকে তাকায়নি তাহুরা।অদ্ভুত জ্বলন অনুভব করে অন্তরে।সেদিকে দ্বিতীয়বার তাকানোর মুরত নেই মেয়েটার। আঁখি ছলছল। উমাইরের পাশে অন্য মহিলাকে দাঁড়াতে দেখে তার এতটা কষ্ট হওয়ার কি কথা ছিলো?

অভিমানী ভাবনায় ছেয়ে পড়ে সরল মেয়েটার মন পিঞ্জিরা।পেছন ফিরে তাকালে হয়তো দেখতো,উমাইর সেই মেয়ে শিক্ষিকা হতে এক হাত দূরে অবস্থানরত।ক্যামেরাম্যান বলেও কাছাকাছি আনতে পারেনি।অবশেষে ছবি তুলে ক্যামেরাম্যান।নাছোড়বান্দা থাকে উমাইর।
তাহুরা,স্বাগতা কলেজের এক কিনারায় যায়।নিজে সামলে নেয় তাহুরা।লোকটা যার পাশে দাঁড়াবে দাঁড়াক।এই নিয়ে আর ভাববে না বোকা মেয়েটা।বুকে অন্যরকম পীড়া।অসহ্যকর যন্ত্রণা।দুই হাতের তালু ঘষে সে।নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায়।অনুষ্ঠানের জন্যে বিদ্যমান ছাউনী থেকে তারা বহু দূরে মূলত কলেজের বৃহৎ গাছটার নিচে।
স্বাগতা ঘড়ি দেখে হাতের।বিরক্ত হয় খানিকটা,

–“চৈতালি এখনো আসছে না।গরমটা অসহ্য লাগছে।”
–“কমন রুমে বসবি?”
ধীর সুর তাহুরার।
স্বাগতা ফিরে তাহুরার পানে।তার পাশেই বসে,

–“নাহ।চার তলায় উঠার শক্তি নেই। চৈতালিকে একটা শিক্ষা দিয়ে এরপর বাসায় দৌড়।”
–“দরকার কি বল?যেটা হয়েছে সেটার চ্যাপ্টার বন্ধ করলে তো হয়।আমি আসতে চাইনি,তুই জোর করে…”
তাহুরাকে বলতে দেয়নি স্বাগতা।কথার ফোড়ন কাটে,
–“তুই বেশি বুঝিস।সেদিন রেস্টুরেন্টে কেনো তোর সাথে এমনটা করলো চৈতালি?আমি কোনোদিন ব্যাপারটা মেনে নিবো না।কৈফিয়ত আমার লাগবে।”
তাদের কথার মাঝে উপস্থিত হয় চৈতালি।গেইট থেকে অবলোকন করলো সে দুই সইদের।চৈতালি আসলে ক্ষিপ্ত হয় স্বাগতা,

–“তোকে আমার ফ্রেন্ড মানতে ইচ্ছা করছে না।”
চৈতালি কান ধরে একহাতে, অপর হাতে জড়িয়ে ধরে তাহুরাকে,
–“সরি তো।সেদিনের ভুলটা আমি জীবনেও করবো না। মাফ করে দে প্লিজ।”
–“তুই জানিস,সেদিন ওর কিছু হলে আঙ্কেল কি করতো তো…”
–“আচ্ছা বাবা,হয়েছে স্বাগতা।আমি মাফ করলাম চৈতালিকে।”
তাহুরা হেসে উত্তর দেয়।কান ছেড়ে চৈতালি তাহুরাকে আগলে নেয় দুই হাতে,
–“তুই সবচেয়ে সেরা।”
স্বাগতা কোমরে হাত রাখে,

–“সেরা তো অবশ্যই।মেয়েটাকে যদি ফের এইসব লটভট কাজে নিয়ে যাস,তোর চুল ছিঁড়বো আমি।”
স্বাগতা নিজেও জড়িয়ে নেয় আদরের দুই বান্ধবিকে।
–“তোরা দিনদুপুরে কি শুরু করলি?কি বাজে দৃশ্য!”
নাক কুঁচকায় নিবরাস।তার সাথে দুইজন ক্লাসমেট।তাদের একজন ক্লাসের প্রথম সারির ছেলে।বাকি ছেলেটাও ভদ্র।নাহলে,নিবরাস উৎশৃঙ্খল ছেলের সাথে চললেও,মেয়ে বন্ধুদের মাঝে তাদের কখনো আসতে দেয়নি,বা আনেনি তাদের।
তাহুরা,চৈতালি অবাক হলো কিঞ্চিৎ।তবে,অবাক হয়নি স্বাগতা।যেনো সে পূর্ব হতে জানতো নিবরাস আসবে।

–“তুই কোথা থেকে আসলি?অনুষ্ঠানে এসেছিস?”
চৈতালি প্রশ্ন করে।
–“উম,কাজে এসেছি।অনেক রকম কাজ।”
দৃষ্টি তার স্বাগতার পানে।যেনো গ্রাস করবে এখনই।
তাহুরা মিটমিটিয়ে হাসে।স্পষ্ট বুঝে নিবরাস,স্বাগতার মাঝে রোমাঞ্চকর ব্যাপার চলছে।
–“সব মিটমাট হয়েছে,চল কলেজ ঘুরে দেখি।ব্যাপক আয়োজন হয়েছে অনুষ্ঠানে।”
স্বাগতা বলে।

–“উম, নাহ।আমি বাসায় যাবো।আব্বা বকবে দেরী হলে।”
তাহুরা বলে উঠে। দাঁড়ায় মেয়েটা। কাঁধে ব্যাগ চাপলে চৈতালি তার হাত ধরে,
–“বিশ মিনিট ঘুরে চলে যাবো।প্রমিজ।”
স্বাগতাও সায় দেয়।
–“কালকে আপুর হলুদের অনুষ্ঠান।অনেক কাজ বাকি।”
পুনরায় তাহুরা বললে স্বাগতা তার বাহু ধরে হাঁটতে আরম্ভ করে,
–“কালকে আর বিশ মিনিটের মাঝে বিরাট তফাৎ,বুঝলি?”

তাহুরা নিরুপায়।দৃষ্টি ঝুঁকে চলতে থাকে।মনে আবারও হানা দেয় বিষাদ যন্ত্রণার। উমাইরের বলা কথা মনে আসে।সেদিন উমাইরের শার্ট মুছে দেওয়ার পর লোকটা এক অনুভূতিময় কথা বললো।এরপর!এরপর লোকটার মুখে আর এমন কথা শুনেনি।শুধু তাই নয়,উমাইর মেসেজও দেয় খুব কম।তাহুরার সাহস হয়নি জিজ্ঞাসা করার।শান্ত মেয়েটা হুট করে চঞ্চল হয় যখন উমাইর থেকে একটা মেসেজ আসে।লোকটা তার অভ্যাসে পরিণত।তার দেওয়া একটা মেসেজ তাহুরার নিকট অত্যধিক প্রিয়।যদিও বেশির ভাগ মেসেজে উমাইর তাহুরাকে খোটা দিয়ে কথা বলে।এই যেমন,

–“মাথার ঘোমটা ফেলে হাঁটলে নিজেকে নায়িকা মনে হয়?”
–“তুমি মাথামোটা,বুঝবা না।”
–“অন্য আত্মীয়দের সাথে এতো কিসের হাসি?নিজের সুন্দর হাসি জমিয়ে রাখতে শিখো।”
–“আমাকে উল্টা প্রশ্ন করলে তোমার কান টেনে ছিঁড়বো আমি।”
–“তোমার ঘোমটা আমার সামনে পড়া জায়েজ,বাকিদের সামনে না।”
–“জাফরানকে এতো আদর কিসের?কথায় কথায় ওকে কিস দাও কেনো?আমি কি তোমার জন্যে এখন জাফরান হবো?
–“খাওয়ার প্রতি উদাসীনতা দেখলে,প্লেট তোমার মাথায় ভাঙবো।”

আরো অনেক অনেক।তাহুরা একেকটা মেসেজের পর বিশাল সাফাই গেয়ে উত্তর লিখে।উমাইর পড়ে ঠিকই,কিন্তু জবাব দেয় না।ফলস্বরূপ,মেয়েটার দিন রাত মস্তিষ্কে কেবল উমাইর আর উমাইরের নাম ঘুরে।
ঘোমটা তো ইচ্ছা করে ফেলে না তাহুরা।কাজের ফাঁকে কখন মাথাটা ঘোমটা শূন্য হয় বুঝতে পারে না।উমাইর দু’বার এসেছিল তাদের বাড়িতে কাজের সূত্রে।লোকটা তো তার সামনেও আসেনি তেমন,তাও সব লক্ষ্য করে কিভাবে!লোকটার কি চার চোখ আছে?

–“তাহু,লাড্ডু খাবি? চুড়ি কিনবি না আজকে?”
সুবুদ্ধি লাভ করে তাহুরা চৈতালির প্রশ্নে।চুড়ি কেনার টাকা তাহুরার নেই।তাই অকপটে ভঙ্গিতে বলে,
–“লাড্ডু খাবো।”
–“কেনো কেনো? চুড়ি কিনবি না?তোর না অনেক পছন্দের!”
স্বাগতা জিজ্ঞাসা করে।
–“যাহ,আজকে তিন গরীবকে আমি চুড়ি কিনে দিবো।”
হেসে উত্তর দেয় নিবরাস।
–“লাগবে না।হুদাই কষ্ট করিস না তুই।”
তাহুরার নরম সুর।

–“তুই লাড্ডু খা,অসহায় আমাদের।”
তাহুরাকে পচিয়ে সে সহ বাকিরা হাসে।তাহুরা নিজেও হেসে উঠে।বহুদিন পর আগের সেই আড্ডার মহল ফিরে পেয়েছে।
কমলা রঙের লাড্ডু মিষ্টি তাহুরার হাতে। ক্ষণে ক্ষণে ছোট কামড় দিয়ে খাচ্ছে।গরমটা ভ্যাপসা।ইতিমধ্যে নাক,কপাল,গালের দুদিক রক্তিম হয়েছে তাহুরার।চারিদিকে অনুষ্ঠানের গানের শব্দ।মাইক লাগিয়েছে বলে কথা।হঠাৎ শব্দ বেড়ে যায় দুই গুণে।কাছাকাছি শব্দ শোনা যেনো দায়।

কলেজের মাঠে স্টল একপাশে আর অনুষ্ঠান হচ্ছে কলেজের মাঠের মধ্যেখানে।কয়েকবার উকি ঝুঁকি দিলো মেয়েটা মনের রাজাকে দেখার আশায়।তবে,উন্নতি হয়নি।বিরাট মাঠে কিছু দেখা দুষ্কর।মানুষের মাথা ব্যতীত অন্যকিছু বুঝা মুশকিল।
হাতে বিদ্যমান মোবাইল কয়েকবার ভাইব্রেট হয়েছে বুঝলো তাহুরা।তবে, রোদের তেজে মোবাইল চেক করার দুই ফোঁটা আকাঙ্খা নেই তার।তারা বেরুতে নিলে আবারও ভাইব্রেট হওয়া শুরু করে তার মোবাইল।এইবার থেমে নেই।না দেখে আন্দাজ করে ফোন রিসিভ করে।

দু তিনবার “হ্যালো” বলেছে তবে ঐপাশে কি বললো শুনতে পায়নি সে।
ফোন কেটে দেয় অপর পক্ষ।পরপর তাহুরা অবলোকন করে,নিবরাস তার ফোন চেক করে চিল্লিয়ে তাহুরাকে বলে,
–“উমাইর ভাইয়া তোকে ওর কেবিনে যেতে বললো।ভাইয়ার নাকি তোকে কিছু দেওয়ার আছে তোর আপুর জন্যে।জুবায়ের ভাইয়া পাঠিয়েছে।সম্ভবত ভাইয়ার যাওয়ার কথা ছিল তোদের বাসায় আজ,কিন্তু তোকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিবে।”
তাহুরা বুঝেনি কথা।তিন চারবার করে বুঝিয়ে পাঠিয়েছে সে তাহুরাকে।বাকি দুই বান্ধবী ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সম্মুখে দাঁড়িয়ে।
বিল্ডিংয়ের মতো ভেতর যাচ্ছে তাহুরা মাইকের শব্দ কিছুটা কমে আসছে।

উমাইর তার কেবিনের দরজার আড়ালে।তাহুরাকে আসতে দেখে হাত টেনে আনে ভেতরে।দরজার সাথে ঠেকিয়ে দাঁড় করায়। কর্কশ গলায় প্রশ্ন করে ওঠে,
–“ছেলে নিয়ে ঘোরা হচ্ছে? নিবরাস ছাড়া বাকি দুই ছেলে কে?হেসে হেসে লাড্ডু খাও?লাড্ডু?এখন দিবো একটা কানের নিচে?”

তাহুরা ভীত,চমকিত।উমাইরের আঁখিতে দৃষ্টি মেলানো দায়।লোকটার দৃষ্টি হিংস্র।এখনই খুবলে খাবে এই দৃষ্টি।তাহুরার অন্তর কম্পিত। আঁখি জোড়া জ্বলে।তাহুরাকে কিভাবে দেখলো উমাইর?কই তাহুরা তো দেখেনি তাকে!ভাবনার মাঝে নিজ গালে আরো গভীর স্পর্শ টের পায় সে।

উমাইর দুই আঙ্গুলে তাহুরার গাল চেপে ধরে।তার বিশাল দেহের ছায়ায়ও স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে তাহুরার দু চোখ। নাহ মায়া লাগেনি, নেশা লেগেছে।মেয়েটাকে কে বলেছে রোদে এমন ছেলে নিয়ে ঘুরতে?ছেলেগুলো ওর দিকে সাথে অন্য মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছিল। মুর্দা কথা,তাদের দৃষ্টি তাহুরাতে কেনো পড়েছে এই নিয়ে উমাইরের যতো অভিমান।অথচ,তার মতো ম্যাচিউর পুরুষ এমন হালকা ব্যাপার না বোঝার কিছু নেই।তবে কি ভালোবাসা সত্যি মানুষকে বোধশূন্য করে?

তার মনের পক্ষিকে পারছে না উমাইর এখন‌ই খাঁচায় বন্ধী করতে।
তাহুরা চুপ থাকলে গালে আরেকটু চাপ দেয় সে,
–“এই কথা বন্ধ কেনো?”
–“আম..আমি জানতাম না ওরা আসবে।আমি…
আমি…আমি ছেলে নিয়ে ঘুরি না।সত্যি কথা।”

হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তাহুরা।উমাইর চেয়ে চেয়ে মেয়েটার অশ্রুপাত দেখে।চোখ খিঁচে আবারও গাল খুলে শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা।গাল ছাড়েনি উমাইর তখনো।হালকা ঝুঁকে তাহুরার পানে,
–“কলেজে কাজ কি?আমাকে জানাওনি কেনো তুমি আজকে বের হবে বাসা থেকে?”
তাহুরার গলা শুকিয়ে আসে।লোকটা নিজে যোগাযোগ করে না,তাহুরা আবার যেঁচে কেনো জ্বালাবে লোকটাকে?মাঝে মাঝে বেশি মনে পড়লে তখন দু তিনবার মেসেজ দেয় সে উমাইরকে।তাও ফলাফল শূন্য ই থাকে।
–“পরের বার থেকে বলবো।”
নাক টানে তাহুরা।

উমাইর সোজা হয়।দু হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখের পানি পুছে দেয় প্রিয়তমার,
–“আচ্ছা।দেখি, কাঁদে না আর।”
তাহুরা নিজেকে সামলায়,কষ্ট করে দৃষ্টি দেয় লোকটার অবয়বে।
কলেজের জন্যে উমাইরের গেটআপ অন্যরকম।অতীব মোলায়েম দেখায় উমাইরকে।চেক ডিজাইনের ফুল হাতা শার্ট ইন করে পড়েছে সে।গালে খোঁচা দাড়ি।চুল একপাশ করে আঁচড়ানো।গালের চোয়াল অত্যন্ত ক্ষীণ।ভ্রু জোড়া সমান্তরাল।
উমাইর তার অফিস ব্যাগ হতে একটা খাম বের করে।তাহুরার হাতে দেয়,

–“ভাবীকে দিবা।ভাই দিয়েছে।আমার যাওয়ার কথা ছিল তোমাদের বাসায়,কিন্তু তোমার মাধ্যমে পাঠালাম।”
–“আপনি যাবেন না?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।
–“যাওয়ার আর দরকার কি!যেটা বেশি দরকার ছিল সেটা এইখানে পেয়েছি,শান্তনা দিয়েছি।আরেকটা কাজ করতে ইচ্ছা হয়েছে।সেটা কালকে করবো।”
উমাইর তির্যক হাসে।তাহুরা তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে কিছু আন্দাজ করতে পারেনি।সে সহসা প্রশ্ন করে,

–“বুঝলাম না!”
–“বুঝবে কালকে।যখন আমার কাজে তুমি অজ্ঞান হবে।”
উমাইর বুকে হাত গুটিয়ে দাঁড়ায়।
তাহুরা আবারও প্রশ্ন করতে নিলে উমাইর তার কান ধরে।টেনে বলে,
–“ক্লাসমেট হোক আর যে হোক,অন্য ছেলেকে তোমার পাশে ফের যদি দেখি আমি,বিনা কথায় গিয়ে হার্ট করবো।”
–“মারবেন আমাকে?”
একটু ভয় পেয়ে বলে তাহুরা।

উমাইর হাসে।এক হাতে নিজের চুল ঠিক করে।আঙুল দ্বারা তাহুরার মাথায় টোকা দেয়,
–“বোকা মেয়ে,তোমার পাশে যে ছেলে থাকবে তাকে। ইউ নো,এককালে আমার এক ঘুষিতে মানুষ সেন্সলেস হতো।”
দরজায় টোকা পড়ে।তাহুরার কানে এখনো উমাইরের কথা বাজছে।আজকের পর পরিবারের ছেলে ব্যতীত কোনো ছেলেকে নিজ ত্রিসীমানায় আসতে দিবে না তাহুরা।
–“স্যার,আপনি বিজি?”
মেয়েলি সুর।দরজা হালকা ধাক্কায় খুলে।তাহুরা একটু খেয়ালী হয়।সকালের ম্যাম এটা।এইখানে এসেছেন!কেনো?

–“বলতে পারেন।”
–“সবাই লাঞ্চ করেছে। আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।”
ম্যামের কথায় অন্য সুর।তাহুরার মনটা নড়ে উঠে।
–“অপেক্ষা তাহলে করতেই থাকতে হবে।বিকজ,আমি লাঞ্চ এইখানে করবো না।বাসায় ফিরবো একটু পর।আজকে আমার লাঞ্চ বাসায়।”
উমাইরের কথায় তিক্ততা।

–“ওকে।হ্যাভ এ নাইস লাঞ্চ।”
ম্যাম যেইভাবে প্রফুল্লতায় এসেছে সেইভাবে বিষন্নতা নিয়ে ফিরলো।
তাহুরা মলিন কণ্ঠে বলে,
–“আমি তাহলে আসি।”
–“আসতে চাইলে আসো,আমি রেডি আছি।”
উমাইর ঠিক কতটা গভীর মনোভাবে কথাটা বললো তাহুরা বুঝেনি।উল্টো জবাব দেয়,
–“কই আসবো?আমি বাসায় যাচ্ছি।”
তাহুরা আর দাঁড়ায় না।দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।
তার যাওয়ার দিক লক্ষ্য করে উমাইর অধর চেপে হাসি আটকে রাখে।কপালে দুই আঙ্গুল ঠেকে বলে,
–“তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে ডিটেইলসে বুঝানোর অপেক্ষায় আছি রূপসী।তুমি যে কার হাতে পড়েছো বোকা মেয়ে!”
–“আমি যতটা উন্মাদ তোমার প্রতি,তুমি ঠিক ততটা নাজুক।তুমি আস্ত এক আদর,আমার ভালোবাসা।”

–“কিরে,এতক্ষণ লাগে নাকি?”
খানিক অবাক হয় স্বাগতা।
–“আরে,ওরা কি এখন আর স্যার,স্টুডেন্ট?ওদের মাঝে কতো ভাব হবে এখন।ওরা এখন আত্মীয়।হয়তো,কুশল বিনিময় করতে করতে সময় গেলো।”
হাহা করে হাসে চৈতালি।
তাহুরা অধরে হাত চাপে।কি লজ্জাকর পরিস্থিতি!
–“এমন কিছু না।”
লাজুক স্বর তাহুরার।
–“কেমন কিছু?”
স্বাগতা ফের প্রশ্ন করলে উত্তর আসে পেছন থেকে।উত্তর যেনো হাঁটছে,

–“জিনিস খুঁজতে দেরী করেছি আমি।”
আসলেই উত্তর হাঁটছে উমাইরের সাথে সাথে।তার বিশাল অবয়ব দেখতে পায় তিনজন।
স্বাগতা,চৈতালি জোরে সালাম দেয়।উমাইর না পেছন ফিরলো,না ডানে না বামে।কেবল হাত উঠিয়ে ইশারা করে।
তাহুরা দৃষ্টি ঘোরায়।উমাইর মিথ্যা বলেছে শুধু তাহুরাকে বাঁচানোর জন্যে? লাজ ভর করে তার শরীরে।
–“এটা বলতে তোর এতক্ষণ লাগে?”
স্বাগতা বলে।
–“আমি জানিনা কিছু।গেলাম আমি।বড্ড দেরী হয়েছে।”

ব্যাগ খুলে মোবাইল রাখে,সাথে চুড়ি জোড়া সামলিয়ে নেয়। নিবরাসের কিনে দেওয়া।অবশ্য উমাইর জানলে হয়তো চুড়িগুলো ভেঙেই ফেলবে।লোকটার আসলে সমস্যা কি?
স্বাগতা,চৈতালি তাহুরার সাথে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যায়।পরপর সকলে নিজ গন্তব্যে ছুটে।
বাসায় গিয়ে সর্বপ্রথম তাহুরা খাম দেয় বোনকে।সুনেরা অবাক হয়।জিজ্ঞেস করে,
–“এটা কি?”

–“উমাইর স্যার দিয়েছে কলেজে।জুবায়ের ভাইয়া নাকি তোমার জন্যে পাঠিয়েছিল।আমাকে কলেজে দেখে স্যার তাই আমাকে দিয়ে পাঠায় উনি।”
তাহুরা জবাব দিয়ে বোরকা খুলে। সুনেরা খাম খুলে অবাক।তার মনের দখলদার তাকে শেষ চিঠি লিখেছে প্রেমিক হিসেবে। সুনেরা মুচকি হেসে চিঠি পড়তে আরম্ভ করে।
মুখ ধুয়ে এসে তাহুরা বোনের হাসিমুখ দেখে।নিশ্চয় তার দুলাভাই আপুর মন খুশি করতে কিছু লিখেছে।তার বোন সত্যি ভাগ্যবতী।

উমাইর দুপুরের খাবার খায় মায়ের সাথে।তখন অনেকটা বিকাল। সন্ধ্যায় তাদের ফুটবল খেলার পরিকল্পনা আছে।জুবায়েরের কালকে হলুদের অনুষ্ঠান, তাও সে আজ খেলতে যাবে।ফুটবল খেলাটা তাদের অন্যরকম আকর্ষণ।মূলত ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করছে উমাইর।নিবরাস ইতিমধ্যে তাদের ক্লাবে।
উমাইর তার কক্ষের বারান্দায়।গাছের পরিচর্যা করলো হালকা।গোলাপের গাছ আবারও মৃত।যে চার-পাঁচটা ফুল হয়েছিল সেগুলো সব শুকিয়ে এরপর উমাইর তার বইয়ের ভাঁজে রেখেছে।আগের গাছের ফুলগুলোও আছে।
মৃত গোলাপ গাছ সাইডে রাখে সে।কোমরের পিছে দুই হাত রাখে,

–“ফুল গাছের মালকিনকে কবে আমার ঘরে আনবো?মন ভরে দেখবো?”
–“ধৈর্য উমাইর,ধৈর্য।”
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে উমাইরের।ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।এইভাবে লাইটিংয়ের কাজটা পরখ করা দরকার।যেই ভাবা সেই কাজ।টুকটাক আত্মীয় বাসায়।উমাইর মোবাইলে মনোনিবেশ করে হাঁটতে থাকে।পা থামে তার পেছন থেকে মায়ের ডাকে।মায়ের পাশে জাফরান।

–“বলো,মা।”
উমাইর মোবাইল পকেটে পুরে।
–“আসলে আব্বা..কথাটা কিভাবে বলবো!”
উমাইর কোলে তুলে জাফরানকে।বিনা দ্বিধায় বলে,
–“রিল্যাক্সে বলো মা।”
–“আমি কি নম্রতাকে বলবো,তুমি তাহুরাকে পছন্দ করো সেটা?”
মেঘলা খানিকটা দমে যাচ্ছে।

–“কাহিনী কি?”
উমাইর গাল টানে জাফরানের।মেঘলা ভয় পাচ্ছে,অথচ উমাইর কেমন শান্ত।
–“তুনাজ কিছুতে মানছে না।সে কালকে আবারও তার বাবার সাথে মিলে তাহুরার বাবাকে…”
–“ওহহ।মামীকে কিছু বলার দরকার নেই।যেটা করবো আমি দেখছি।”
উমাইর মাকে থামিয়ে উত্তর দেয়।
–“আব্বা,তুমি মারপিট করবে নাকি?আত্মীয় স্বজন মানুষ!”
মেঘলা ছেলের হাত ধরে আকুতি করে।

–“প্রথমে বুঝাবো,এক বোঝানোতে রাজি হলে ভালো।তাহুরার সাথে রিলেটেড কোনো কিছু আমি হালকায় নিচ্ছি না।”
জাফরানকে কোল থেকে নামায় উমাইর।পকেট থেকে ফোন বের করে ফের।তবে মোবাইল চালুর পূর্বে মাকে বলে,
–“টেনশন করো না,আগের মতো সরাসরি উমাইর কারো গায়ে হাত তুলে না।স্যার মানুষ আমি,কিন্তু গায়ে জ্বালা সৃষ্টির মতো কথা আমি বলতে জানি।সব কেস আজকে মিটিয়ে দিবো।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৭

–“আব্বা,তুমি বেশি ভেজাল করো না।”
–“তুনাজ ভেজাল করলে,আমি না করে কিভাবে থাকি?বিষয়টা আমার ঐ বোকাকে নিয়ে,যে বোকাটা একান্ত আমার।”
পরপর উমাইর মোবাইল কানে লাগায়।গম্ভীর,থমথমে সুরে বলে উঠে,
–“ভাই,আমি খেলবো না।অন্যকে খেলাতে বেরুচ্ছি।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ১৯