লুকানো অনুরক্তি পর্ব ৫

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ৫
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

বাস ফিলিং স্টেশনে থামতেই মাহফুজ অবনিকে ডাকে।সাড়া না দিয়ে অবনি কয়েক সেকেন্ড মোচড়ামুচড়ি করে আবার গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল। ঘুমের মাঝেই দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে মাহফুজের কলার।শব্দহীন হাসে মাহফুজ। এলোমেলো, অবিন্যস্ত চুলগুলো কানের উল্টো পিঠে গুঁজে আবারও ডাকে।
‘অবনি?’

বার কয়েক ডাকতে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় অবনি।বুঝার চেষ্টা করলো ঠিক কোথায় আছে। মাথা ভার হয়ে আছে তার। অনুভব করল কিছু একটা খুব করে ধরে রেখেছে সে। আড়চোখে চোখ চাইলো সেদিকে। নজরে এলো দু’টো শার্টের বোতাম আর কলার। মস্তিষ্ক জানান দিলো কোনো এক পুরুষের বুকে লেপ্টে আছে সে। মানুষটাও তাকে সযত্নে আগলে রেখেছে। ব্যপারটা বোধগম্য হতে ছিটকে সরে এলো। রিনরিনে গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘স্যরি।’
জবাব দেয় না মাহফুজ। ক্ষণকাল নীরব থেকে বলে উঠলো,
‘ওয়াশরুমে যাবি? গেলে চল। হাত মুখেও পানির ঝাপটা দিবি। ভালো লাগবে।’
উঠে দাঁড়ায় অবনি।একটু ওয়াশরুমে গেলে শরীর হালকা হতো।
মোটামুটি অনেক যাত্রী নেমেছে বাস থেকে। অবনিও নামল। আর তার পিছু পিছু মাহফুজ।
অবনি আড়ষ্ট চোখে এক নজর মাহফুজকে দেখে নত স্বরে বলে,
‘তোমায় তো আমি একেবারে নোংরা করে ফেলেছি।’

নিজের হাতের দিকে তাকায় মাহফুজ। শার্টের হাতা ফোল্ড করে রাখলেও বমির দাগ স্পষ্ট। প্যান্টেও পড়েছে কিছুটা। অধর প্রশস্ত হয় তার। অবনিকে অপ্রস্তুত করার জন্য রগড় গলায় বলে,
‘ভবিষ্যতের জন্য প্রেকটিস করে নিচ্ছি। আল্লাহ চাইলে কোন এক সময় রাত বিরাতে আমার এসব পরিষ্কার করতে হবে। আগে থেকে দক্ষ হয়ে থাকা ভালো না?’
কথার ভাবার্থ বুঝলো না অবনি। সরু চোখে তাকিয়ে রইলো মাহফুজের দিকে। ক্ষনিক পরে কথাটার আসল উদ্দেশ্য মস্তিষ্ক বুঝতে পেরেই সে তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।

দশটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। রৌদ্রের প্রখরতা বাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। গন্তব্যে এসে বাস থামল। নিজ জেলায় এসে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে অবনি। চোখ বন্ধ করে নিলো মুহুর্তেই।
‘এখন কেমন লাগছে শরীর? বাকি পথটা যেতে পারবি? চল আগে কিছু খেয়ে নিবি?’
অবনি চট করে জবাব দেয়, ‘আমি সোজা বাড়ি যাবো। বাড়ি গিয়ে যা হবার হবে।’
আশেপাশে নজর বুলায় মাহফুজ। রাস্তার অপরপ্রান্তে কয়েকটা ফলের দোকান দেখে ছুটলো সেদিকে।
আধঘন্টার মাঝে ফিরে এলো কয়েক রকম ফল নিয়ে।

‘তুমি এসব কিনেছো কেন? এগুলো কে খাবে?’
অবনির প্রশ্নের জবাব দেয় না মাহফুজ। কদম বাড়ায় সিএনজি স্ট্যান্ডের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেখানেই অনড় রইলো অবনি।
মাহফুজ পিছু ফিরে তাকায়, ‘বাড়ি যাবি নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি?’
একছুটে মাহফুজের কাছে এসে দাঁড়ায়। দু’জন সমানতালে হাঁটতে লাগল। সিএনজি স্ট্যান্ডে এসে একটা খালি সিএনজিতে বসায় অবনিকে। ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে বলে,

‘চাচা সাবধানে যাবেন। এই এলাকার রাস্তাঘাটের যে হাল।’
অবনিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘বাড়ি গিয়ে আমায় একটা ফোন করবি।’
অবনি মাহফুজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি যাবে না।’
‘না।’

‘এতোখানি পথ এসে আবার ফিরে যাবে? তুমি গেলে বাবা মাও খুশী হতো।’
‘অফিস থেকে হাফ ডে ছুটি নিয়েছি। লাঞ্চের পর উপস্থিত থাকতে হবে।’
সিএনজি স্টার্ট দেয় ড্রাইভার। মাহফুজ তড়িঘড়ি করে বলে,
‘চাচা, চাচা পাঁচ মিনিট আমি এখনি আসছি।’
ফিরে এলো তাড়াতাড়ি। হাতে কতগুলো চকলেট। সেগুলো অবনির হাতে দিয়ে বলে,
‘এগুলো তোর ভাইয়ের।’
‘তুমি সহ চলো না।’
শুকনো হাসে মাহফুজ।
‘যাবো সময় হউক।’

চতুর্থ শ্রেণির বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছেন ফাতেমা আমিন। রিডিং পড়াচ্ছেন। এক পলক বাইরের দিকে তাকিয়ে আবারও পড়ায় মনোযোগ দিলেন। সহসা উনার কপালে ভাঁজ পড়ে। মনে হলো কাউকে দেখেছেন। ঘাড় বাঁকিয়ে দরজায় মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন তিনি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। অবনি এক গাল হেসে বলে,

‘বিশ্বাস হচ্ছে না?’
টলমলে চোখে হাসলেন তিনিও।
‘এবার হচ্ছে।’
বইটা টেবিলের উপর রেখে পরম মমতায় আগলে নিলেন মেয়েকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো তাকিয়ে আছে সেদিকে।
‘বলে আসবি না। তাহলে আজ ছুটি নিতাম।’
‘তোমাকে চমকে দেওয়ার জন্য দিলাম না।’
‘তোর বাবাকে ফোন করছি। এসে তোকে নিয়ে যাবে।’

মামুনুর রশীদ হাঁক ছেড়ে ডাকেন বাড়িতে যে টুকটাক কাজে সাহায্য করে তাকে।
‘রাফিয়া বু কোথায় গেলে? দেখো কে এসেছে?’
রাফিয়া খাতুন বাটা থেকে পান বানাচ্ছিলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো ছোট্ট আবিদ। বাবার গলা শুনে অবিন্যস্ত পায়ে চলে গেল বাইরে। রাফিয়া খাতুন পান মুখে পুরে বলেন,

‘বাপ পাগল পোলা।’
ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনিও। অবনিকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠেন।
‘ও মাগো। তুমি আইবা আগে কইবা না। তোমার পছন্দের সব রাইন্ধা রাখতাম।’
রাফিয়া খাতুনকে জড়িয়ে ধরে অবনি।
‘ওসব পরে হবে। আগে বলো কেমন আছো?’

‘যার চাইর কূলে কেউ নাই। তার তোমগো ঘরে একটা ঠাঁই হইছে। হে কেমনে খারাপ থাকবো?’
‘ওহ্! তোমায় না বলেছি এসব বলবে না।’
মুখে আঙুল দিয়ে অবনিকে পর্যবেক্ষণ করছে আবিদ। তার কাছে আসছে না দেখে অভিমান করে বলে,
‘বাব্বা, অবন।’
ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকায় অবনি। হাত বাড়াতেই চলে এলো তার কোলে। তার নাকে মুখে হাত বুলিয়ে বলে,
‘অবন।’
ভাইয়ের গালে টুক করে চুমু এঁকে দিলো অবনি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘হ্যা অবন।’

খেয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অবনি। বাজতে থাকল তার মোবাইল। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে মাহফুজের নাম। রিসিভ করতে ওপাশ থেকে কাতর কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।
‘খেয়েছিস?’
অবনির ছোট্ট উত্তর, ‘হুম।’
‘সবাই ভালো তো।’
‘হুম।’
অতঃপর দুজনেই নীরব। শুষ্ক ওষ্ঠ ভিজিয়ে নিলো অবনি। শান্ত গলায় বলে,

‘তুমি খেয়েছো?’
‘না। খাবো।’
‘ওহ্।’
‘অবনি সত্যি করে একটা কথা বলবি?’
বুক কেঁপে উঠল অবনির। মাহফুজ ঠিক বলার কথা বলছে বুঝে গেল চট করে। এই ব্যপারটার মুখোমুখি আর হতে চায় না সে। তড়িৎ গতিতে বলল,
‘মা ডাকছে। পরে কথা হবে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কল কে’টে দিলো মাহফুজ।

শীতকাল না হওয়া সত্বেও ভাপা পিঠা বানানোর আয়োজন করেছেন ফাতেমা আমিন। চুলোর পাশে পিঁড়িতে গরম গরম পিঠা খাচ্ছে অবনি।
মামুনুর রশীদ হাত মুখ ধুয়ে এলেন। মেয়ের পাশে পিঁড়ি পেতে তিনিও বসে পড়লেন।
‘আবিদ উঠেনি বাবা?’
গরম গরম ভাপা পিঠা মুখে পুরে নিলেন মামুনুর রশীদ। মুখের পিঠা শেষ হতেই বললেন,

‘জমিদার সাহেব এতো তাড়াতাড়ি উঠেন না।’
কথার ধরনে হেসে ফেলে অবনি। রাফিয়া খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ফুফু পিঠা খাচ্ছো না কেন?’
‘পান মুখে দিছি এহন খামু না।’
বিরক্ত হয় অবনি।
‘ঘুম থেকে উঠে পান খাওয়ার স্বভাবটা তোমার গেল না।’
খাওয়া শেষ হতেই মামুনুর রশীদ বলেন,

‘চল মা পুকুরে যাই। তোর জন্য মাছ ধরবো।’
খুশিতে চকচক করে উঠে অবনির চোখ। মুখের পিঠা শেষ করে বলে,
‘তাড়াতাড়ি চলো বাবা।’
‘আগে খেয়ে নে।’
‘আমার খাওয়া শেষ।’

আজকের রাতটাই বাড়িতে থাকবে অবনি। আগামীকাল এই সময় আবার ঢাকায়। ফিরবে ট্রেনে। ট্রেনের টিকেটও কাটা শেষ। আর যাবে না কখনো বাসে। এইবারে আক্কেল হয়েছে।
মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ফাতেমা আমিন। রাতটা পেরোলে আবার মেয়ে দূরে চলে যাবে। বুকটা কেমন জ্বলছে। দুইদিন বাড়িটা কেমন ভরা ছিলো। মা মা করে বাড়ি মাথায় তুলেছে মেয়েটা। কালকের পর নীরব হয়ে যাবে।

চোখ টলমল করছে অবনির। দুটো দিন চোখের পলকে চলে গেল।
‘তোর ফুফুকে তোকে আদর করে তো?’
কিছুক্ষণ চুপ থাকে অবনি। মায়ের হাতটা বুকে জড়িয়ে বলে,
‘ওই মানুষটা তোমার মতো স্নেহ না করলে হয়তো আমি ওখানে থাকতে পারতাম না মা। ফুফুর কাছে নিজের দুই ছেলেমেয়ে যেমন আমিও তেমন। আমি যে তার মামাতো ভাইয়ের মেয়ে। কখনো সেই চোখে দেখেনি। সর্বদা সন্তান স্নেহ করে।’

আবারও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন তিনি।
‘অবনি?’
‘হুম?’
তপ্ত শ্বাস ফেলে তিনি বলেন,
‘না কিছু না।’
ফিচেল হাসে অবনি। মা কি জানার জন্য ইতস্তত করছে বুঝল।
‘ভয় পেয়ো না মা। তোমাদের অসম্মান হয় এমন কোনো কাজ করবো না।’

ঢাকায় ফিরেছে অবনি। ফাতেমা আমিন অনেক রকমের পিঠা বানিয়ে দিয়েছেন।
নাস্তায় ফাতেমা আমিনের বানানো নকশি পিঠা খাচ্ছে সবাই।
খাওয়া শেষ হতেই নাদিয়া রুমে গেল। আফসানা খানম গেলেন রুমে।
টেবিলে শুধু অবনি আর মাহফুজ। মাহফুজের মোবাইল রিং হতেই রিসিভ করে সে। লাউডে দিয়ে মোবাইল টেবিলের উপর রাখল।

‘শা*লা কই তুই। একটু পরেই মিটিং শুরু হবে।’
খাওয়া থামিয়ে মাহফুজের দিকে তাকিয়ে রইলো অবনি। কথার শুরুতে কেউ এসব কথা বলে?
চোখে চোখ পড়ে দু’জনের। দৃষ্টি নামিয়ে নেয় অবনি। তবে মাহফুজ দৃষ্টি সরালো না।
‘নাস্তা করছি।’
‘কতক্ষণ লাগে নাস্তা করতে?’

‘হবু শ্বাশুড়ি তার জামাইর জন্য পিঠা বানিয়ে পাঠিয়েছে। একটু সময় নিয়ে খাবো না। কত যত্ন করে বানিয়েছে এগুলো।’
হতভম্ব হয়ে গেলো অবনি। ভ্রু কুঁচকে তাকায় মাহফুজের। ব্যপারটা অন্যকারো সাথে শেয়ার করেছে ভেবে রাগ বাড়ল তার। রাগে ধীরে ধীরে লাল হয় নাকের ডগা।
‘পিঠা তো নয় যেন অমৃত।’
রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে চলে গেল সে।

লাঞ্চ আওয়ারের পর মাহফুজ কে কল করে অবনি।
হঠাৎ করে অবনির কল আসায় অবাক হয় মাহফুজ। কল কে’টে ব্যাক করে সে।
‘আজ সূর্য কোনদিকে উঠলো?’
অবনি কিছু না বলে হিস হিস হিস করছে।
‘রেগে আছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে?’ আসবো আমি?’
অবনি কঠিন গলায় বলল,
‘তুমি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছো না?’
আহাম্মক হয়ে গেল মাহফুজ।
‘আমি আবার কি করলাম?’

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ৪

‘তোমার এসব কথাবার্তা যে আমার অস্বস্তি বাড়ায় বুঝো না?’
‘এটা সামনাসামনি না বলে মোবাইলে বলছিস কেন? নাকি সামনাসামনি বলার সাহস নেই।’
‘ না নেই। আমি ঢাকা শহরে তোমার সাথে প্রেম করতে আসিনি। পড়াশোনা করতে এসেছি।’
‘তো আমায় ভালোবাসলে আমি কি তোর বইখাতা ছিঁড়ে ফেলবো?’

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ৬