শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৩

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৩
তানিয়া মাহি

” ডাক্তারসাহেব আপনি সিঙ্গেল?”
অভীককে কল দিয়েই শুভ্রতা কথাটা বলে। পাশে আবিরা বসে মুখ টিপে হাসছে। সে নিজের মানুষের প্রতি আস্থাশীল, মানুষটা তাকে অসম্ভব ভালোবাসে সেটা সে বোঝে। শুভ্রতা ওপাশের মানুষটার জবাব শোনার অপেক্ষায় আছে কিন্তু ওপাশ থেকে কোন জবাব আসছে না দেখে শুভ্রতা আবার বলে,

” ডাক্তারসাহেব!”
” জি বলুন, স্যরি আমার এক পিচ্চি পেশেন্ট ফোনটা নিয়ে নিয়েছিল। কে বলছেন?”
” আমি শুভ্রতা, ওই যে সেদিন গিয়েছিলাম আপনার কাছে চেকআপ করাতে। ”
” প্রতিদিন তো অনেকেই আসে কীভাবে মনে রাখি বলুন তো!”
” সেটাও কথা, আপনাকে একটা মেয়ে বলেছিল আপনি দেখতে শুভ্র মেঘের মতো সুন্দর সেটা কি মনে আছে?”
” হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে, আপনি তাহলে কল দিয়েছেন! কোন প্রয়োজন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” হ্যাঁ প্রয়োজন তো। আমার না আপনাকে অনেক ভালো লেগেছে, ভালো লাগা মানে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?”
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শোনা যায়। শুভ্রতা ভ্রু কুচকে আবিরার দিকে তাকায়। আবিরাও এতক্ষণ চুপচাপ কথা শুনছিল। অভীকের হাসির কারণ সেও বুঝতে পারছে না।
অভীকের হাসি থামলে শুভ্রতা বলে, ” আপনি এভাবে হাসলেন কেন? আমি কি হাসির কিছু বলেছি আপনাকে?”
অভীক বলে, ” আ’ম স্যরি, আমি সিঙ্গেল নই। ”

” বিয়ে করে নিয়েছেন?”
” না তবে খুব জলদি করব। যোগাযোগ থাকলে
দাওয়াত পাবেন।”
” যোগাযোগ রাখবেন বলছেন?”

” যোগাযোগ রাখতে চাইলে প্রতিদিন কথা বলতে হবে এমন ব্যাপার নাহ। এই যে আজ আমাদের কথা হলো আমি নম্বরটা রেখে দিলাম। বিয়ের সময় আমার হবু স্ত্রীকে দিয়ে আপনাকে দাওয়াত দেয়ালাম! জানেন তো বিয়েতে মেয়েপক্ষরা বেশি মজা করে?”

” হ্যাঁ বুঝেছি। সত্যিই আপনার কেউ আছে? তখন হাসলেন কেন?”
” আপনার মতো কেউ এভাবে জিজ্ঞেস করে নি তাই হাসলাম। হ্যাঁ আমার কেউ আছে সত্যিই কেউ আছে। আমি এখন টিনেজ বয়সে নেই যায় ভালোবাসার মানুষ থাকা সত্ত্বেও অন্যকাউকে হাতে রাখার জন্য বলব আমার পছন্দের মানুষ নেই। অনেক আগেই আমার বিয়ের বয়স হয়েছে, আমার বন্ধুদের বাচ্চাও হয়ে গিয়েছে। আমিও খুব জলদি বিয়ে করব, দাওয়াত কিন্তু পাচ্ছেন। ”

আরও কিছুক্ষণ কথা চলল দুজনের মধ্যে। শুভ্রতা কথা বলছে আর আবিরা শুনে মিটিমিটি হাসছে। একসময় শুভ্রতা কথা শেষ করে আবিরার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আপু আমি এখন আর কোনভাবেই এই প্রেমকে সাপোর্ট করি না। আমার তো মনে হলো উনি ভালো আর সেদিনও এরকমই মনে হয়েছিল। তুমি যদি সত্যিই পছন্দ করো তাহলে উনাকে বলো উনার বাবা-মাকে বলে যেন বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। এ বাড়িতে রাজি করানোর জন্য আমি আছি। উনি তোমাকে জানিয়েছে ভালোবাসার কথা আর তুমি সময় নিয়েছো এবার বলে দাও তুমি প্রেম না বিয়ে করবে।”

” আমিও সেটাই ভাবছি রে। আমি এমন অনেক সংসার দেখেছি যারা কি না ভালোবেসে বিয়ে করেছে কিন্তু পরবর্তীতে ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে পারে নি। ”
” এই যে আমাকেই দেখো না!”
” আমি তোকে বলি নি বোন, তুই ছাড়াও অনেক আছে। তুই তো অল্প বয়সে একটা ভুল করেছিলি। দোয়া করি একটা সঠিক মানুষ এবার তোর জীবনে আসুক।”

” জীবনে যদি কখনো আর কাউকে প্রয়োজন হয় সেটা আমার বাবা ঠিক করবে, এসবের মাঝে আমি আর যাব না। আমার বাবা আমার জন্য যাকে সঠিক ভাববেন আমি তাকেই বিয়ে করব কিন্তু এখন আমার মেইন ফোকাস থাকবে পড়াশোনায়। কিছু কিছু মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমি পড়ে পড়ে মা’র খাওয়ার মেয়ে নই।”
” তুই অবশ্যই পারবি। আমাদের সব কাজিনদের মধ্যে তুই-ই একমাত্র যে কী-না পড়াশোনায় সিরিয়াস।”
” দোয়া কোরো আপু। আচ্ছা আপু আমি এখন যাই তবে।”
” আচ্ছা ঠিক আছে যা।”

শুভ্রতা আবিরার রুম থেকে বেরিয়ে হাটা শুরু করে। কিছুদূর এসেই হাতের বাম দিকে নিহানের রুম। রুমে লাইট অন, কিন্তু কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। শুভ্রতা একবার সেদিকে তাকিয়ে আবার রওয়ানা দেয় নিজের বাড়ির দিকে।

স্নিগ্ধা তখনও বাড়ি আসে নি। শুভ্রতা বাড়িতে ঢুকেই মায়ের রুমে চলে যায়৷ সেখানে তার মা আর শাকিরার মা আঞ্জুয়ারা বেগম কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। শুভ্রতা যেতেই আঞ্জুয়ারা বেগম মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন,
” এই যে শুভ্রতাও চলে এসেছে। শোন মা কাল শাকিরাকে দেখতে আসবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো কালই বিয়েটা হয়ে যাবে। তুই কিন্তু কালকে শাকিরাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবি।”

কথাটা শোনামাত্র রায়হানের কথা মনে পড়ে গেল তার। শাকিরা আর রায়হান দুজনই একে অপরকে পছন্দ করে সেটা তারা কাজিনরা সবাই জানে। ওরা দুজনই শুধু একে অপরকে বলে ওঠার সাহস পায় নি। শুভ্রতা কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বলে,
” শাকিরা কাউকে পছন্দ করে কি না সেটা জেনে নিয়েছেন? আমি হয়তো ভুল মানুষকে পছন্দ করেছিলাম আমার মতো সবাই ভুল কাউকে পছন্দ করবে এমনটা না। আপনি একবার ওর থেকে জেনে নিয়েন ও কাউকে পছন্দ করে কি না।”

আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ” সত্যি বলতে মা তোর ব্যাপারটার পর থেকে এইসব প্রেম ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে৷ ভালোবাসার ক’টা বিয়ে টিকে বল তো?”
” হতে পারে শাকিরা কারো সাথে হারাম সম্পর্কে নেই শুধুমাত্র একাই ভালোবাসে যা প্রকাশ করে নি কখনো।”
” তুই যেহেতু বলছিস তাহলে শুনে দেখব।”

” ওটাই ভালো হবে কাকি। আপনারা কথা বলেন আমি তাহলে রুমে যাই।”
” ঠিক আছে কালকে তাহলে আমাদের ওখানে শাকিরার সাথে সাথে থেকো কিন্তু।”
” ঠিক আছে, আপনি আগে শাকিরার সাথে কথা বলেন কাকি।”

শুভ্রতা রুম থেকে চলে যায়। আয়েশা বেগম মেয়ের কথায় কিছু সন্দেহ করে৷ শাকিরার ব্যাপারে কি শুভ্রতা কিছু জানে! আঞ্জুয়ারা বেগম চলে গেলে তিনি শুভ্রতার রুমে যান। শুভ্রতা তখন পড়ছিল। তিনি গিয়ে বিছানায় বসেন। হাতের কাছে থাকা গোলকটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলেন,

” শাকিরা কাউকে পছন্দ করে? তুই কিছু জানিস?”
” হ্যাঁ মা, রায়হান ভাইয়াকে পছন্দ করে। রায়হান ভাইয়াও শাকিরাকে পছন্দ করে কিন্তু কেউ কাউকে বলে উঠতে পারে নি। ”
” কি বলিস! রায়হান পছন্দ করে শাকিরাকে! মেয়েটার ভাগ্য হয়তো ভালো। ওর মতো ছেলে পাওয়া মুশকিল। আঞ্জুয়ারাকে বলা উচিৎ ছিল, ওরা কোনভাবেই রায়হানকে অপছন্দ করবে না।”
” হ্যাঁ মা আমিও তাই ভাবছি। দেখি কাল কি হয়! এখন যাও আমি পড়ছি, পড়া শেষ করতে হবে তাড়াতাড়ি। ”
” ঠিক আছে দশটার দিকে খেতে আয়।”
” আচ্ছা মা যাও এখন।”
আয়েশা বেগম চলে গেলে শুভ্রতা পড়ায় মনোযোগ দেয়। ফাউজিয়া আর শুভ্রতা দুজন ঠিক করে নিয়েছে প্রতিদিন কতটুকু করে পড়বে। প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন কমপ্লিট করতে হবে৷ সে আর কোনকিছুতে সময় ব্যয় না করে পড়তে থাকে।

রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় বসে ফোন ঘাটাঘাটি করছে শুভ্রতা। ঘুমঘুম ও লাগছে তবুও সে ঘুমোচ্ছে না কারণ একটু পরেই তার বাবা এসে ডাকবে দুই রাকাত নফল এবং দুই রাকাত শোকরানা নামাজের জন্য। শুভ্রতার প্রতি জন্মদিনেই তার বাবা এমন কাজ করেন। তাদের বাড়িতে জন্মদিন পালন করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ।

শাহাদাত সাহেব প্রতিবছর এই দিনে মেয়েকে নিয়ে নামাজ আদায় করে সৃষ্টিকর্তাকে শুকরিয়া জানান আরো একটা বছর মেয়েকে তার সাথে রাখার জন্য।
অতীতের দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমে চোখ লেগে যায় শুভ্রতার। দরজায় নক করার শব্দে আচমকা ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত বারোটা দশ বাজে। শুভ্রতা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে শাহাদাত সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে যায় শুভ্রতার।

” বাবা!”
শুভ্রতা গিয়ে শাহাদাত সাহেবকে জড়িয়ে ধরে। শাহাদাত সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। হঠাৎ তিনি বুঝতে পারেন শুভ্রতা কান্না করছে। তিনি শুভ্রতাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে মুখ উঁচু করে দেখেন তিনি সত্যিই বুঝেছেন, শুভ্রতা কান্না করছে।

” কি হয়েছে মা? কান্না করছিস কেন?”
” বাবা মৃ*ত্যুর দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গেলাম তাই না?”
” সে তো প্রতি সেকেন্ডেই আমরা মৃ*ত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি মা। জীবনে শুধু মাত্র ওটাই আসল সত্য। আমাদের উচিৎ যেকোন সময় মৃ*ত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা। চিন্তা করে দেখতে হবে আমাদের থলিতে কি আছে ক*বরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সবসময় নিজেকে পাপ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবি মা। এখন চল নামাজ পড়বি না?”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১২

” হ্যাঁ বাবা তুমি বোসো একটু আমি আসছি।”
” ঠিক আছে যা। ”
শুভ্রতা বাবাকে বসিয়ে রেখে ওযু করতে চলে যায়। বাবার সাথে নামাজ আদায় করার অনুভূতি বেশ অন্যরকম। শুভ্রতা চিন্তা করে সবগুলো দিন যদি এভাবে বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা যেত!

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৪