শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৩

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৩
তানিয়া মাহি

” তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে আবিরা?”
অভীক এখনো হাঁপাচ্ছে, বলতে গেলে দৌঁড়ে এসেছে আবিরার কাছে। অভীকের কথা শুনে আবিরা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলে একে তো তাকে মিথ্যা বলেছে আবার এসে বিয়ের কথা বলছে!
” কি হলো কিছু বলবে না আবিরা?”

অভীকের কথায় সে আবার অভীকের দিকে ফিরে তাকায়। কি বলবে সেটাই ভাবছে। “না” তো বলতে পারবে না সে তো এটার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
” কোথায় ছিলেন আপনি?”
” বাসায় গিয়েছিলাম একটু, তোমাকে বাসায় নিয়ে যাব আজ। মা-বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব তাই মাকে জানাতে গিয়েছিলাম।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আপনার বাসায় যাব মানে? আগে তো বলেন নি?”
” আগে থেকে বলার কি আছে? এই যে এখন বললাম। ”
” কিন্তু প্রস্তুতির তো একটা ব্যাপার আছে তাই না?”
” কোন প্রস্তুতি লাগবে না। তুমি শুধু আমার সাথে যাবে, গিয়ে মা-বাবার সাথে দেখা করবে। আমি খুব শিঘ্রই মা-বাবাকে তোমাদের বাড়ি পাঠাবো। তোমার ছোট বোনেদের বিয়ে হয়ে গেল অথচ তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছো। আর অপেক্ষা করতে হবে না। খুব তাড়াতাড়ি আমরা বিয়ে করব আবিরা।”

” কিন্তু এখন…..”
” কোন কিন্তু না আবিরা। চলো আমার সাথে, আমরা বাসায় যাব এখন।”
” শুভ্রতা আর শাকিরা পরিক্ষা দিচ্ছে, ওদের পরিক্ষা হয়ে যাবে তো। আমি এখান থেকে কীভাবে তোমাদের ওখানে যাব বলো? শাকিরার বিয়েটা হয়ে গেলে আমি আবার একদিন এখানে আসব তখন তোমাদের বাসায় যাব কেমন?”
” ওদের পরিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই আমরা ফিরে আসব, তুমি চিন্তা করো না।”

” আসতে পারব তো? আমার খুব ভয় লাগছে অভীক। আপনার মা-বাবা আমাকে পছন্দ করবেন তো?”
” অপছন্দ করার কোন চান্স নেই। চলো তো। যত তাড়াতাড়ি যেতে পারব তত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব।”
অভীক আবিরাকে গাড়িতে তুলে নিজে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে ড্রাইভ করতে শুরু করে। আবিরার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা অভীকের মা-বাবা তাকে পছন্দ করবে তো!

অভীকের চেম্বার থেকে বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি না। দশ থেকে পনেরো মিনিটের পথ। এই দশ থেকে পনেরো মিনিট আবিরা কোন কথা বলল না। চোখ বন্ধ করে দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছিল। অভীক ড্রাইভ করছে আর আবিরাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। মেয়েটা এত বড় হয়ে গিয়েছে তবু বাচ্চামি ভাবটা এখনো যায় নি।

পরিক্ষা চলছে…
শুভ্রতা একমনে লিখে যাচ্ছে। গত দুইটা পরিক্ষা তার অসম্ভব ভালো হয়েছে। প্রশ্ন কমন পড়লে যে আনন্দ পাওয়া যায় সেই আনন্দটা খুব কম জিনিসে উপভোগ করা যায়। শুভ্রতা আর ফাউজিয়া একই রুমে পড়েছে কিন্তু দূরত্ব অনেক। পরিক্ষা চলাকালীন কোন বিষয়ে দুজনের কথা বলার কোন সুযোগ নেই।

প্রথম পরিক্ষার দিনে নিহান এসে তাকে দিয়ে গিয়েছিল। সারারাস্তা সে নিহানের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে এক হাত দিয়ে ধরে এসেছে। শুভ্রতা সেদিন নির্ভর করার মতো একটা কাধ পেয়েছিল। যেখানে সে নিশ্চিন্তে মাথা রাখতে পারে। নিহান হাতে একটু সময় নিয়ে বের হয়েছিল যেন বাইক আস্তে চালিয়ে যেতে পারে।
বাইক চালানোর পর যখন মাথাটা সোজা রাখতে না পেরে নিহানের পিঠের ওপরের দিকে রাখে নিহান তখন চমকে যায়।

” শুভ্রা!”
” হুম।”
” খারাপ লাগছে?”
” মাথা সোজা রাখতে পারছিলাম না।”
” এক হাত দিয়ে আমাকে ধরে বসতে পারিস। ধরে না বসলে পড়ে যাবি যখন তখন। বাম হাতটা দিয়ে ধরে পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাক। আমি আস্তে যাচ্ছি।”
” ঠিক আছে।”

” বেশি খারাপ লাগলে বলিস কিন্তু।”
” আচ্ছা।”
” পরিক্ষা দিতে পারবি তো?”
” হ্যাঁ পারব।”
” ঠিক আছে।”
শুভ্রতা পরিক্ষা দিতে দিতে নিহানের কথা মনে পড়ে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ স্যার এসে বেঞ্চে শব্দ করতেই চমকে ওঠে সে। সামনে স্যারকে দেখে লেখা শুরু করে।
” কি হয়েছে শুভ্রতা? প্রশ্ন কমন পড়ে নি?”
” জি স্যার পড়েছে।”
” তাহলে লিখছো না কেন?”
” স্যরি স্যার লিখছি। ”

স্যার আর কোন কথা মা বলে সেখান থেকে চলে যায়। পিছনের দিকে ডানপাশের সারিতে তাকালে দেখে ফাউজিয়া তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, ” কিছু হয়েছে?” শুভ্রতা মাথা ঝাঁকিয়ে লেখায় মনে দিতে বলে নিজেও লেখা শুরু করে।

আবিরা আর অভীক বাসা থেকে মা-বাবার সাথে দেখা করে বের হয়েছে। আবিরা আঙুলের রিংটার দিকে তাকিয়ে আছে। অভীকের মা অসম্ভব ভালো মানুষ নইলে কি কেউ এত ভালো ব্যবহার করে! প্রথম দেখায় সোনার আংটিও পড়িয়ে দিলেন। আবিরা গাড়িতে ওঠার পর থেকে ওটা দেখেই যাচ্ছে। অভীক আবিরার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকায়। সে বলে,

” মা-বাবাকে কেমন লাগলো তোমার?”
” দারুণ!”
” হ্যাঁ? ”
” না মানে অসম্ভব ভালো লেগেছে।”
” খুব তো ভয় পাচ্ছিলে প্রথমে তারপর বাড়ি গিয়ে গল্প থামছিলই না।”
” সুন্দর করে কথা বলেন উনি।”
” আচ্ছা, শোনো এখন তোমাকে কোথায় নামিয়ে দেব বলো? ওদের কি পরিক্ষা শেষ হয়েছে?”
” সময় তো হাতে এখনো আধাঘণ্টা আছে।”
” আমার চেম্বারে বসবে?”

” না, আপনি আমাকে সামনের রাস্তায় নামিয়ে দিবেন। সময় যেহেতু আছে তাহলে কিছু কেনাকাটা করা যাবে।”
” আমি যাই সাথে?”
” না, আমার সাথে কেউ থাকলে আমি পছন্দ করে কিনতে পারি না। আপনি আপনার কাজে যান। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে।”
” সাবধানে থাকবে কিন্তু, কোন বিপদ মনে করলে আমাকে কল দিও।”
” আচ্ছা। ”
গাড়ি এসে মার্কেটের সামনের গোলিতে এসে থামে। আবিরা অভীকের থেকে বিদায় গোলিতে ঢুকে গেলে অভীকও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।

ফাউজিয়া খাতা জমা দেওয়ার জন্য দাঁড়াতেই শুভ্রতাও দাঁড়ায়। দুজন নিজ নিজ জায়গা থেকে বেরিয়ে খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে আসে। তারা দুজন বাহিরে এসে দাঁড়ায়। ফাইল থেকে প্রশ্নটা বের করতে করতে শুভ্রতা বলে,
” পরিক্ষা কেমন হয়েছে তোর?”
” আলহামদুলিল্লাহ, কিন্তু ‘ক’ বিভাগের দুইটা প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারি নি।”
” কোন দুইটা?”
ফাউজিয়া প্রশ্নপত্রটা হাতে নিয়ে খুঁজতে থাকে। পেয়ে গেলে বলে, ” তিন আর সাত নম্বর। তুই পেরেছিস?”
” হ্যাঁ লিখেছি কিন্তু হয়েছে কি না জানি না।”
” সব মিলিয়ে পরিক্ষা কেমন হয়েছে?”

” সবমিলিয়ে ভালো হয়েছে। তোর কেমন হয়েছে?”
” আমারও ভালো হয়েছে। এখানে দাঁড়াবি নাকি সামনে গিয়ে কিছু খাবি?”
শুভ্রতা প্রশ্নপত্র থেকে চোখ তুলে ফাউজিয়ার দিকে তাকায়। অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে,” এই তুই রোজা না?”
” ইশ, ভুলে গেছিলাম। কি যে একটা অবস্থা! চল এগোই তাহলে।”
” শাকিরা বের হোক।”
” আমি ভাবছি আগামীকাল ও পরিক্ষা দিবে কীভাবে! বিয়ের দিনে পরিক্ষা!”
” কি আর করার! যেতে যেতেই ইফতারের সময় হয়ে যায়। বিয়ে রাতে হবে ইফতার পর। রায়হান ভাইয়া হয়তো থেকে যাবে, পরিক্ষা শেষ হলে ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ”

” নিহান ভাইয়ার কি খবর? ”
” সে ভালো আছে।”
” না মানে আমি জানতে চাইছিলাম তোরা বিয়ে কবে করছিস? ”
” অনেক দেরি।”
” দেখ মানুষটা কিন্তু অনেক ভালো, দেরি করিস না। তাড়াতাড়ি নিজের করে নে।”
” হ্যাঁ, আসলেই উনি খুব ভালো মানুষ। ”

ফাউজিয়া আর শুভ্রতা কথা বলতে থাকে এমন সময় শাকিরা বেরিয়ে আসে। শাকিরা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় শুভ্রতা আর ফাউজিয়াকে দেখে এগিয়ে আসে। শুভ্রতা শাকিরাকে দেখেই হেসে বলে, ” আরে বিয়ের কনে যে!”
” হ্যাঁ, বিয়ের মধ্যে যে প্যারা দিচ্ছে পরিক্ষা! চল, যাবি না? আবিরা আপুর কি খবর, কোথায় সে? কল দিয়েছিলি?”
” না, আমি ফোন নিয়ে আসি নি। তুই কল দে।”
” আচ্ছা।”

শাকিরা একটু দূরে গিয়ে আবিরাকে কল দিয়ে জেনে নেয় সে কোথায় আছে। আবিরা তাদের দুজনকে মেইন গেইটের সামনে যেতে বলেছে। আবিরার সাথে কথা শেষ করে শাকিরা আবার শুভ্রতার কাছে যায়। ফাউজিয়াকে বলে,
” তুই আজকেই আমাদের সাথে চল, খুব মজা হবে।”
ফাউজিয়া হেসে বলে, ” খুব মজা কি হবে? গিয়েই তো ইফতার পর পড়তে বসতে হবে। পরিক্ষার সময় মাঝে একটাদিন ছুটি নেই। তুই বিয়েটা তিনদিন পর করলেই পারতি তাহলে যাওয়া যেত। ”

” বিয়ের তারিখ আগেই ঠিক করা হয়েছে যে। কি আর করার, অন্যরকম ভাগ্য আমার। তুই কি তাহলে কালকে যাবি?”
” না রে আমার মা অসুস্থ। বিয়ে কর, ভাইয়াকে নিয়ে একদিন বাড়িতে আসবি।”
” এটা কোন কথা! আমি তো কালকে আগে আগে বের হয়ে যাব। পাশমার্ক উঠলেই বেরিয়ে যাব।”
” কার সাথে বাসায় যাবি পার্লার থেকে?”

” নিহান ভাইয়া আসবে। শুভ্রতার তো কাল একা একা যেতে হবে। কি রে শুভ্রতা যেতে পারবি একা?
শুভ্রতা নিচে গাছের দিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। এতক্ষণ কেউ তার দিকে তাকিয়ে ছিল মনে হচ্ছিল তার। সে তাকাতেই সেখান থেকে কেউ গাছের আড়ালে চলে যায়। অনেকক্ষণ ধরেই কেউ তাকে দেখছিল।
শাকিরা কোন জবাব না পেয়ে শুভ্রতার হাত ঝাঁকাতেই শুভ্র‍তা চমকে ওঠে।
” ক কি হয়েছে?”
” তোর কি হয়েছে? ওদিকে কি দেখছিস? আমার কথার কোন জবাব নেই কেন?”
” কোন কথা?”

ফাউজিয়া এবার শুভ্রতার মুখ দেখে বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে তার। বাহিরে কিছু একটা দেখছিল, শাকিরা ডাকতেই সে চমকে উঠলো। ফাউজিয়া একটু বারান্দার গ্রিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাহিরে তাকালো কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই দেখল না। ফাউজিয়া স্বাভাবিক হয়েই বলল, ” আচ্ছা বাদ দে এবার সবকিছু। চল বের হই নইলে দেরি হয়ে যাবে। মা বাসায় একা আছে। আর আজ তোদের বাড়ি ফিরতে এমনিতেও অনেকটা দেরি হবে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যা।”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২২

ফাউজিয়ার কথায় শাকিরা তাল মিলিয়ে বের হওয়াতে রাজি হয় কারণ এখানে যত দেরি হবে বাড়ি ফিরতেও তর দেরি হবে। তার চেয়ে ভালো এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়া। তিনজন হাটা শুরু করে কিন্তু শুভ্রতা বারবার পিছনে সেই গাছটার দিকে তাকাচ্ছে। তিনজন চলে গেলে মুখে কালো মাস্ক আর কালো শার্টে কেউ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৪