শেষটা সুন্দর পর্ব ৬২

শেষটা সুন্দর পর্ব ৬২
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

রাবীর ছুটে গিয়ে মেহুলের হাত আঁকড়ে ধরে। সে ক্ষুব্ধ হয়ে চায়। হাত মুচড়িয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। রাবীর তাতে বাঁধন আরো শক্ত করে। চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘এমন করছেন কেন, মেহুল?’

মেহুল জবাব দেয় না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। নাকের পাল্লা ফুলিয়ে কান্না দমানোর চেষ্টা করলেও, পেরে উঠে না। রাবীর তার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলে,
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আযান দিবে। বাসায় চলুন, ইফতারের পর আপনার সব কথা শুনব।’
সে মেহুলের হাত চেপে ধরে তাকে গাড়িতে নিয়ে বসায়। মেহুল নিরব। ঠোঁট কামড়ে নাক টানছে কেবল। রাবীর ড্রাইভিং সিটে বসে মেহুলকে এক পলক দেখে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সবার সাথে ডাইনিং এ বসলেও, খুব বেশি কিছু মেহুলের গলা দিয়ে নামে না। কোনোরকমে দুটো খেজুর আর এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। তার শাশুড়ি মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন,
‘ওমা, কোথায় যাচ্ছো?’
মেহুল নিরুত্তাপ সুরে বলে,
‘নামাজ পড়তে যাচ্ছি, মা।’

রাবীর বসে বসে মেহুলের যাওয়া দেখল। তারপর বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে খাবারের দিকে চেয়ে রইল। ঠিক এই ভয়েই, এতদিন সে মেহুলকে কিছু বলেনি। মেয়েটাকে এত কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না সে। কিন্তু, আটকাতে পারল কই? ঠিকই তো মেহুল সব জানল। রাবীরও খুব বেশি কিছু খেতে পারল না। খালাকে ডেকে, খাবারগুলো ঢেকে রাখতে বলে, সে উপরে রুমে চলে যায়।

মেহুল নামাজ শেষ করে মোনাজাত ধরতেই যেন, ভুবন কাঁপিয়ে তার কান্না আসে। সে চাইছে শব্দ না করতে কিন্তু, পারছে না। কান্নার বেগ বাড়তেই, সে দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,
‘আল্লাহ, কেন এমন হলো? কেন? আমি কেন মা হতে পারব না? কী অন্যায় করেছি আমি, বলোনা। কোন দোষের শাস্তি দিচ্ছ আমায়? আমি কীভাবে সহ্য করব, আল্লাহ? আমার যে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।’
মেহুলের কান্না থামার নাম নেই। সে এসবের মাঝে খেয়াল করেনি, রাবীর যে তার পাশেই নামাজে দাঁড়িয়েছে। হুট করেই তার গলার স্বরে মেহুল সম্বিত হয়। রাবীরও মোনাজাত ধরেছে ততক্ষণে। সে হাত তুলে বলে,

‘আল্লাহ, আমি জানি তুমি যা করো ভালোর জন্য করো। তোমার থেকে নিশ্চয়ই তোমার বান্দাকে বেশি কেউ ভালোবাসে না। তুমি তো উত্তম পরিকল্পনাকারী। আমার বিশ্বাস আছে তোমার উপর। তোমার সব সিদ্ধান্তে, আমি সন্তুষ্ট। আমার কোনো অভিযোগ নেই। বাবা না হতে পারার কোনো আক্ষেপও নেই। আমি জানি, তুমি কিছু কেড়ে নিলে তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দাও। আর সেই ভরসা আর বিশ্বাস থেকেই বলছি, আমি তোমার সব সিদ্ধান্ত হাসি মুখে মেনে নিয়েছি। এবার তুমি কেবল, আমার স্ত্রীকে সেই বোঝ দাও। উনার মনোবল বাড়িয়ে দাও। উনার সব কষ্ট দূর করে দাও। তুমি সহায় হও আমার স্ত্রীর। উনাকে তুমি সর্বোচ্চ সুখ দাও, খোদা।’

তারপর সে দোয়া পড়ে মোনাজাত শেষ করে। মেহুলও তখন “আমিন” বলে তার মোনাজাত শেষ করে। মাথা নুইয়ে বসে থাকে। রাবীরের দিকেও ফিরে তাকায় না। কেঁদে কেটে নাক মুখ লাল করে ফেলেছে সে। এখন ভীষণ অস্বস্তিতে ঝিম মেরে বসে আছে। রাবীর একটু স্বাভাবিক হয়। মেহুলকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। মেহুলের মাথার সাথে তার মাথা ঠেকিয়ে ধীর গলায় বলে,

‘মেহুল, আপনি জানেন, আমার মায়ের পর আমার কাছে সবথেকে প্রিয় নারী আপনি। আপনাকে আমি ঠিক কতটা মহব্বত করি, সেটা আপনাকে কখনও বুঝিয়ে বলতে পারব না। শুধু এইটুকুই বলতে পারব, আপনার ভেজা চোখ আমার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে। আমার তো দরকার নেই। কোনো সন্তানের দরকার নেই। আমার কোনো আফসোসও নেই। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছে, যতটুকু দিয়েছে, আমি তাতেই সন্তুষ্ট।

আমার প্রয়োজনের বেশি কিছু চাইনা। আপনি আছেন, আমার তাতেই চলবে। সন্তানের জন্য আমি আপনাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারব না। প্লিজ, ভেঙে পড়বেন না। তারপরও যদি আপনার সন্তানের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা বাচ্চা দত্তক নিব। প্রয়োজন পড়লে, সারোগেসি পদ্ধতি অবলম্বন করব। তাও আপনি নিজেকে সামলে নিন, প্লিজ। এইভাবে আমি আপনাকে দেখতে পারব না।’

রাবীর থামে। মেহুল খুব মনোযোগের সহিত এসব শুনে। টু শব্দও করেনা। তার এই নিরবতা রাবীরকে যে আরো জ্বালাচ্ছে। সে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। মেহুলের দৃষ্টি এখনও জায়নামাজেই নিমজ্জিত। রাবীর মেহুলের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
‘কী হলো? কথা বলছেন না কেন, মেহুল?’

মেহুল ফোলা ফোলা চোখ দুটো নিয়ে এবার রাবীরের অস্থির সুশ্রী মুখটার দিকে তাকায়। নিমিষেই মন হালকা হয় তার। এই মুখটা দেখলেই, সব কষ্ট উবে যায় তার। বুক ভার লাগা কমে যায়। মনে স্বস্তি ফিরে। সে কম্পিত হাতে রাবীরের খোঁচা খোঁচা অমসৃণ দাঁড়িওয়ালা গালটাতে হাত রাখে। গলার স্বর কাঁপছে তার। কথাগুলো গলাতেই জমে আছে। বের হচ্ছে না। মেহুল খুব চেষ্টা করে একটা শুকনো ঢোক গিলে। মৃদু আওয়াজে শুধায়,

‘আপনি সব জেনেও, কেন আমাকে কিছু বলেননি?’
রাবীর মেহুলের সেই হাতটা ধরে তার ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমু খায়। পরে হতাশ সুরে বলে,
‘জানালে যে এইভাবে কষ্ট পেতেন, তাই জানাতে চাইনি।’
মেহুল বড়ো করে শ্বাস ফেলে। অস্থির চোখে মুখে এদিক ওদিক চেয়ে ফের জায়নামাজের দিকে তাকায়। মিনমিনিয়ে কম্পিত সুরে বলে,

‘আপনি আমাকে সান্ত্বনা দিতে এসব বলেছেন, তাই না?’
রাবীর কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
‘কোন সব?’
‘ঐ যে, আপনার বাচ্চা লাগবে না বললেন যে। এটা কি আদৌ সম্ভব? কোন ছেলে বাবা হতে চায় না, বলুন?’
রাবীর মেহুলের কাঁধ ধরে তাকে তার দিকে ঘুরায়। মেহুল দৃষ্টি তুলছে না। রাবীর মিহি সুরে বলে,
‘তাকান আমার দিকে।’

মেহুল তাকাতে চায় না। রাবীর পুনরায় বলে,
‘কী হলো, তাকান।’
মেহুল বাধ্য হয়ে চোখের পল্লব নাড়ায়। রাবীরের চোখে চোখ পড়তেই ভীষণ মন ভার হয় তার। এই মানুষটাকে যে সে কিছুই দিতে পারল না। এই আফসোসেই তো জীবন শেষ হয়ে যাবে তার। মেহুলের চোখ জল জমতেই, এবার রাবীর ধমকে উঠে,

‘খবরদার, যদি আর এক ফোটা পানিও গাল বেয়ে পড়েছে। বলেছি না, আমার কিছু লাগবে না। কোনো বাচ্চা লাগবে না। আমার আপনাকে হলেই চলবে। আর আপনাকে নিজের করে রাখতে যদি পুরো দুনিয়াও এক দিক করে ফেলতে হয়, আমি তাই করব। বাট স্টিল, আই উইল নেভার লিভ ইউ।’

কথাটা শেষ করেই সে মেহুলকে আষ্টেপৃষ্ঠে বুকে জড়িয়ে নিল। যেন, ছাড়লেই সে পালাবে। মেহুল আর কিছু ভাবতে পারে না। এক মুহুর্তের জন্য সব কষ্ট ভুলে যায় সে। সেও রাবীরকে সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
‘আমিও আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না, নেতা সাহেব।’

গড়গড়িয়ে সব বমি করে, তবেই ক্ষান্ত হলো রিতা। কোনোরকমে শ্বাস টেনে সামনে তাকাতেই দেখল, বেচারা সাদরাজের গলা থেকে কোমর অবধি সব ভরে শেষ। সাদরাজ হতভম্বের মতো চেয়ে আছে তার দিকে। এমন কিছু যে হবে সে বুঝতে পারেনি। রিতা ততক্ষণে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে, অসহায় সুরে বলে,

‘স্যরি।’
সাদরাজ স্বাভাবিক গলায় বলে,
‘ইট’স ওকে। আমি পরিষ্কার হয়ে আসছি।’
রিতার মুখ মুছিয়ে রাবীর খাবার নিয়ে রান্নাঘরে রেখে এল। তারপর সে একটা তোয়ালে আর টাউজার নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে, ফ্রেশ হতে। রিতা ঐদিকে বসে বসে অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে। সে এটা কী করল? কোন আক্কলে সে সাদরাজের গায়ের উপর বমি করল? ইশ, কী একটা বিশ্রী অবস্থা। নিজের উপর’ই ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। সাদরাজ তাকে নিয়ে কী ভাবছে কে জানে?

সাদরাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চুল মুছতে মুছতে রিতার সামনে বসে। রিতা মুখ কালো করে কাচুমাচু করে বলে,
‘স্যরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি।’
সাদরাজ মৃদু হাসে। বলে,
‘আর কতবার স্যরি বলবে? বললাম তো, ঠিক আছে। এই সময় বমি হওয়াটা স্বাভাবিক।’
‘কিন্তু, আমি তো বমি করে আপনাকে নোংরা করেছি। আপনার নিশ্চয়ই ভীষণ বিরক্ত লাগছে?’
রিতা মাথা নুইয়ে কথাটা শেষ করে। সাদরাজ কথার পিঠে নরম গলায় বলে,

‘যেখানে আমার মতো এই জঘন্য মানুষটাকে তুমি একটু সুখী করতে এত কষ্ট করছো, সেখানে এই ছোট খাটো ব্যাপারগুলো আমার জন্য কিছুই না।’
রিতার চোখ ছলছল করে উঠে। সে এগিয়ে এসে সাদরাজের উদোম বুকে মাথা ঠেকায়। মিহি সুরে বলে,
‘আমি আমার সন্তানের বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি, সাদরাজ।’
সাদরাজ আগলে নেয় রিতাকে। ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,

শেষটা সুন্দর পর্ব ৬১

‘আর আমাকে বাবা হওয়ার সুখ দেওয়া, সেই নারীকে আমিও ভীষণ ভালোবাসি।’
রিতা সাদরাজের খোলা বুকে নাক ঘষে। মিষ্টি এক ঘ্রাণে, শরীর কেঁপে উঠে তার। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে মনে মনে ভাবে,
‘এই ঘ্রাণটা পাওয়ার জন্য হলেও, আজীবন তাকে এই বুকেই মুখ লুকাতে হবে।’

শেষটা সুন্দর পর্ব ৬৩