শেষ থেকে শুরু পর্ব ৯

শেষ থেকে শুরু পর্ব ৯
লাবণ্য ইয়াসমিন

হৈমন্তী আবিরের সামনে বসে আছে। মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আবিরের রাগ হচ্ছে মেয়েটার উপরে। ভাবলো মেয়েটা সব সময় এতো ভয় পেলে পৃথিবীতে টিকে থাকবে কি করে। টিকে থাকতে হলে লড়াই করতে হয়। মুখোশধারী মানুষের অভাব নেই আমাদের সমাজে। প্রিয়জন সেজে আমাদের আশেপাশে ঘাপটি পেতে বসে আছে। ওদের সামনে নিজেকে দুর্বল প্রকাশ করলেই তুমি মরেছো। তোমাকে ভেঙে টুকরো করে বিলীন করে দিতে সময় নেবে না। তাছাড়া দূরের শত্রুর থেকে কাছের প্রিয়জনের করা আঘাত গুলো সহ‍্য করা বেশ কঠিন। যত সুযোগ দেবে ওরা ততই সুযোগের সৎ ব‍্যবহার করবে। হৈমন্তীর কথায় আবিরের ধ‍্যান ভাঙলো। নিরবতা ভেঙে হৈমন্তী শুরু করলো,

আমি সবে নবম শ্রেণিতে উঠেছি। বাবা মা ভাইবোনদের কাছে আমি ছোট থেকেই খুব আদরের ছিলাম। আম্মা আর দাদি একটু বকাবকি করতেন কিন্তু তেমন পাত্তা দিতাম না। তাছাড়া আমি অন‍্যদের মতো এতোটা চনচল ও ছিলাম না কিন্তু আরেকজন ছিল আমার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমার খুব প্রিয় একজন বান্ধবী ছিল ডালিয়া। সবাই আমরা আদর করে ওকে ডলি বলে ডাকতাম। ওর বাসা আমাদের গ্রামেই ছিল। ডলির বাবা আবুল চাচা আমাদের বাড়িতে কাজকর্ম করতেন। সেই সুবাদে আমাদের বাড়ির সঙ্গে ওদের বাড়ি একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রাতদিন যাওয়া আসা চলতো। ডালিয়াদের বাড়ি উত্তর পাড়ায় আর আমাদের বাড়ি দক্ষিণে। আমাদের গ্রামের পশ্চিমে ধলেশ্বরী নদী।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নদীর গভীরতা খুব বেশি ছিল না। বর্ষাকালে পানি থাকলেও গ্রীষ্মকালে পানি শুকিয়ে যেতো। গ্রামের মানুষেরা নদীতে গোসল করতো। শীতের সময় নদীর ওপারে ছেলেরা দল ধরে বসে রোদ পোহাতো। মেয়েদের সঙ্গে অনেক সময় ঝগড়া ও করতো তবুও কেউ এসব পাত্তা দিত না। আম্মা আমাকে কখনও নদীতে যেতে দিতেন না। আমি অনেক রাগারাগি ও করতাম। কিন্তু সেদিন ডলি এলো আমাদের বাড়িতে। যেহেতু দুজনে এক সঙ্গে পড়াশোনা করতাম তাই প্রায় সময় আমরা এক সাথেই থাকতাম। কেউ কিছু বলতে পারতো না। আম্মার একটা গুণ ছিল উনি ডলি আর আমাকে আলাদা ভাবতেন না। আমার জন্য কোনো ড্রেস পছন্দ করে কিনলে ডলির জন‍্যও তাই কিনতেন। ডলি আম্মার খুব প্রিয় ছিল। তাছাড়া ডলি ভালো কাজকর্ম পারতো। আম্মার থেকে শিখতো আমি ওসব পাত্তা দিতাম না। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার ডলি আমাকে প্রস্তাব দিয়েছি,

> হৈমি চল নদীতে যায়। নতুন পানি এসেছে গোসল করে আসি। তাছাড়া টিউবওয়েলে গোসল করতে সময় লাগবে শীত করবে। নদীতে গিয়ে ডুব দিলেই হয়ে যাবে।
> আম্মা রাগলে তখন?
> আমি বুঝিয়ে বলবো। কাকিমা আমার উপরে রাগ করতে পারবেন না।
আমি জানতাম ডলি আম্মাকে মানিয়ে নিবে তাই আর দ্বিমত করিনি। চলে গেলাম গোসল করতে। নদীর উপারে কয়েকজন ছেলে বসে ছিল আমাদের ঘাট বরাবর না কিছুটা দূরে। আমরা ভেবেছিলাম ওরা আমাদেরকে দেখবে না। হয়তো গল্পে জমে আছে। দুজনে গোসল করে ফিরে তো এলাম কিন্তু সেদিন থেকে শুরু হলো আরেক ঝামেলা। ওই ছেলেরা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। ডলি কাউকে ভয় পেতো না। কিন্তু আমি তো ভিতু। আড়াই কিলোমিটার হেটে স্কুলে যেতে হতো। মাঠের মধ্যে রাস্তা আর এই নির্জন রাস্তায় ওরা আমাদের একা পেয়ে আজেবাজে কথাবার্তা বলতো। বাড়িতে ভয়ে বলতে পারতাম না।। চুপচাপ হজম করতাম।ডলি নিষেধ করলো বাড়িতে বললে ঝগড়া ঝামেলা হতে পারে। এভাবে ঝামেলা নিয়ে এক মাস পার হলো। শীতের দিন শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলো প্রচণ্ড কুয়াশা চারপাশে অন্ধকারে ছেড়ে গেলো। সকালবেলায় আমি আর ডলি স্কুলে যাচ্ছিলাম। ওরা আমাদের রাস্তা আটকে ধরলো। ফর্সা লম্বাটে একটা ছেলে আমার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে খারাপ প্রস্তাব দিলো লজ্জায় আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। কিন্তু ডলি ওর কথা শেষ করতে দিল না থাপ্পড় লাগিয়ে দিল। পরপর দুটো থাপ্পড় দেওয়া শেষ ঠিক তখনই আমাদের গ্রামের কয়েকজন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। ওদের জন্য ছেলেগুলা চলে গেলো। তারপর আর ওদেরকে দেখিনি আমাদের রাস্তায়। হঠাৎ একদিন স্কুলে যাবার পথে ডলি বলল,

> জানিস ছেলেটা অতটাও মন্দ না বেশ ভালো।
আমি অবাক হয়ে জিঞ্জাসা করলাম,
> কোন ছেলে?
> আরে থাপ্পর দিলাম ওর কথা বলছি। ওর নাম রবিন নদীর উপারে মন্ডল বাড়ির ছেলে।
মন্ডলদের ওই গ্রামে বেশ দাপট আছে। বাবার থেকে গল্প শুনেছি ওরা ঝগড়া ঝামেলা করতে পছন্দ করে। আমি ডলিকে জিঞ্জাসা করলাম হঠাৎ ওর প্রশংসা করছে কেনো। ডলি যা বলল তাতে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। ওই ছেলেটার সঙ্গে ও রিলেশনে গেছে। প্রায়ই নদীতে দেখা করতে যায়। আমি ওর সঙ্গে খুব রাগারাগি করলাম বকলাম। মেয়েটা মন খারাপ করলো কিন্তু আমার কোনো কথায় শুনলো না। ততদিনে ওই ছেলের সঙ্গে ও বেশ পাকাপোক্ত সম্পর্ক তৈরী করে ফেলেছে। আজকে সন্ধ্যায় নাকি ছেলেটা ওকে ডেকেছে কিছু গিফট দেবার জন্য। আমি ওকে মানা করলাম সন্ধ্যায় না যেতে। গিফট দেবার হলে রাস্তায় দিক নয়তো কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিক সন্ধ্যায় কেনো ডাকছে?। সন্ধ্যা রাতে নদীর আশেপাশে মানুষ তেমন যাওয়া আসা করে না। ও আমার কথা শুনলো না বাড়িতে চলে গেলো। পরদিন সকালবেলায় নদীর তীরে ওর লাশ পাওয়া গেলো। এলোমেলো বিবস্ত্র কাপড়,মুখে থাপ্পড়ের অসংখ্য দাগ। ওকে দেখে আমি চমক উঠি, প্রথমবার অনুভব করি প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা। পুলিশ এলো যথারীতি ময়নাতদন্ত হলো। কিন্তু খুনীকে ধরা গেলো না। আমার জবানবন্দি নেওয়া হলো আর আমি সত্যিটা বলে দিলাম। পুলিশ ছেলেটাকে ধরলো তবে সেটা সন্দেহভাজন হিসেবে যেহেতু প্রামাণ ছিল না। ছেলেটার বন্ধুমহল রাস্তায় আমাকে হুমকি দিতে শুরু করলো। ডলির মতো আমার পরিণতি দেখতে না চাইলে যেনো জবানবন্দি বাদলে ফেলি।

গ্রামে হৈচৈ পড়ে গেছে ডলির খুনের জন্য। মন্ডল বাড়ি থেকে বাবার কাছে লোকজন আসা শুরু হলো। আম্মা আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন। বহুকষ্টে ওরা ঘটনা ধামাচাপা দিল। ছেলেটা বেরিয়ে আসলো। আম্মা ওর ভয়ে আমার বিয়ের জন্য ভাইয়ের কাছে চাপাচাপি শুরু করলেন। শেষমেশ বিয়ে দিয়ে দিলেন। আপনি জানেন ওই ছেলেটা কে?
আবির চুপচাপ এতক্ষণ হৈমন্তীর কথাবার্তা শুনছিল। ও নীরবতা ভেঙে বলল,
> কে ছিল?
> রবিন হোসেন যে অরিণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করেছে ছবির ছেলেটা ওই। ওর সম্পর্কে আরও একটা কথা শুনবেন? ছেলেটা বিবাহিত একটা মেয়ে আছে। সেই ঘটনার এক বছরের মধ্যে ওর বিয়ে হয়। মন্ডলরা ছেলের চরিত্র ঠিক করতে ছেলেকে বিয়ে দিলেন। কিন্তু ছেলে বাচ্চা পেটে রেখে আমেরিকা পাড়ি জমালো। এতবছর পরে ফিরেছে। আর জানিনা ওর স্ত্রী সন্তান কোথায় আছে। আপনি বলুন ওই ছেলের সঙ্গে অরিণ কিভাবে ভালো থাকবে।?
আবিরের মেজাজ হুট করেই খারাপ হচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত করে বলল,
> আমার বোনের উপরে নজর দেওয়া ওর একদম ঠিক হয়নি। আমি ওকে খুন করবো।

হৈমন্তী ওকে শান্ত হতে বলল। তাছাড়া রাগান্বিত হয়ে কাজ করলে তা ভুল হয়। বুদ্ধি দিয়ে কিছু করতে হবে। বিয়ের দাওয়াত শুরু হয়েছে। সবথেকে বড়কথা অরিণকে কিভাবে বোঝাবে। আবির থতমত খেলো বোনের কথা ভেবে। হৈমন্তী চুপচাপ আছে কথাগুলো বলতে পেরে শান্তি পাচ্ছে। অরিণের ভালোর জন্য এই বিয়েটা ভাঙা জরুরি। ভালোবাসা একটা অভ‍্যাসের নাম। হয়তো কষ্ট পাবে তবে আহামরি কষ্ট হবে না। কিছু পুরুষ মানুষ ভাবে মেয়েরা শুধু ভোগের সমগ্রি। ঘরে বউ বাচ্চা থাকতে আরেকটা মেয়ের জীবন নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। শুধু থাপ্পড় না এদেরকে জনসম্মুখে ফাঁসি দেওয়া উচিৎ। হৈমন্তী কথাগুলো ভাবছিল এমন সময় আবির বলল,

> ভয় পেলে ভয় তোমার উপরে জেকে বসবে। নিজের মেরুদণ্ড শক্ত না করলে ভাঙার মানুষের অভাব হবে না। অরিণকে আমি সামলে নিবো তুমি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করো। এতো ভীতু কেনো তুমি? ভাইয়েরা যদি না থাকতো তোমার অস্তিত্ব এতদিন বিলীন হয়ে যেতো। শক্ত হয়ে ময়দানে নেমে পড়ো জায়গা নিজ থেকে তৈরী হয়ে যাবে। আমি আসছি
আবির চুপচাপ উঠে চলে গেলো। বাগানের আড্ডা থেমে গেছে। কিছু কিছু আবার ছাদে গিয়ে যোগ দিয়েছে। রোহান আবিরের রুমে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। আবিরকে রেগে থাকতে দেখে রোহান বলল,

> হৈমন্তী ডেকেছিল কেনো?কোনো অসুবিধা হচ্ছে? আপাকে আসতে বলবো?
আবির নিজেকে শান্ত রেখে উত্তর করলো,
> বিষয়টা গোপনীয় এই মূহুর্তে বলা যাচ্ছে না। ওর কিছু হয়নি হয়েছে আমার।
আবির আনমনে কথাগুলো বলে বাথরুমে চলে গেলো। রোহানের আবারও রাগ হচ্ছে। এতো দিনের বন্ধুত্ব সামান্য একটা মেয়ের জন্য পর হয়ে গেলো। হৈমন্তী আবিরকে বশ করে নিচ্ছে। নেকা সেজে থাকে। ওর সঙ্গে যা হয়েছে বেশ হয়েছে বলে ওর মনে হলো। রোহান হাবিজাবি আরও অনেক কিছুই ভাবলো। শেষপর্যন্ত হৈমন্তীর উপরে রেগে থাকতে পারলো না। ও রাগের উৎস খুজে পাচ্ছে না। হুদাই আজেবাজে চিন্তাভাবনা মস্তিষ্কে জমা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিলো এই বাড়িতে ও থাকবে না সকালবেলায় চলে যাবে।

সারারাত জেগে পার করলো হৈমন্তী। অরিণ মাঝরাতে আড্ডা শেষ করে রুমে ফিরেছে। রবিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেদিন রাত হৈমন্তী বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কাটালো। ঘুম থেকে উঠে আরাফাতকে ফোন দিলো ওকে রেখে গিয়ে নিখোঁজ হবার কারণ কি জানতে চাইলো। আরাফাত শুধু মৃদু হাসলো। সেদিন ভোরবেলায় আবির কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। খাবার টেবিলে ওকে নিয়ে গুঞ্জন হলো কিন্তু সঠিকভাবে কেউ কিছু বলতে পারলো না। ফোন বন্ধ আসছে। হৈমন্তীর টেনশন হচ্ছে যদি বিয়েটা হয়ে যায় তখন। আরিণকে সবটা বলতে ইচ্ছা করলো কিন্তু কিভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। টেনশনে টেনশন সারাদিন কেঁটে গেলো। আবির দুপুরেকে টেক্সট করেছে অরিণকে কিছু না বলতে। ও বাড়িতে ফিরে অরিণকে জানিয়ে দিবে। আরাফাত আসবো বলেও আসতে পারলো না। বিষণ্নতায় দিন পার হলো।

শেষ থেকে শুরু পর্ব ৮

সন্ধ্যায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে এলো আবির। হৈমন্তী তখন অরিণের সঙ্গে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল।। অরিণ ভাইয়ের উপরে বিরক্ত। দুদিন পরে ওর বিয়ে কিন্তু আবিরের সেদিকে নজর নেই। একমাত্র বোন তবুও কেনো এই অবহেলা? মানতে কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া বিয়ের পরে ও বরের সঙ্গে আমেরিকার ফিরে যাবে। আবির চুপচাপ অরিণকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। হৈমন্তী শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। দুঘন্টা ধরে ভাই বোন ঘর বন্ধ করে কি গোপন আলাপ করছে কেউ বুঝতে পারলো না। হঠাৎ রুমের দরজা খুলে গেলো। অরিণ মাথা নিচু করে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। আবির মাথা নিচু করে বসে আছে। বোনকে ও চিনে। শুধু মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। তার জন্য উপযুক্ত প্রমাণের জন্য বেরিয়েছিল। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতে চাইলো না। বিয়ে যেমন চলছিল চলবে।

শেষ থেকে শুরু পর্ব ১০