সঞ্চারিণী পর্ব ১৩+১৪+১৫

সঞ্চারিণী পর্ব ১৩+১৪+১৫
আফনান লারা

মিটিংটা শেষ হয়েছে ঘন্টাখানেক হলো।কিন্তু শাওন এখনও স্লো মোশনে গাড়ী চালিয়ে বাসায় ফিরছে।দরকার হলে বাসায় পৌঁছাতে ভোররাত করে ফেলবে তাও তাড়াতাড়ি ফিরা যাবেনা।
এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে সে এই এক ঘন্টা ধরে।রশ্নির মেজাজ বিগড়ে শেষ সীমানা অতিক্রম করে ফেলেছে।এতক্ষণ বসে বসে শাওনের ইচ্ছে করে দেরি করা দেখছিলো সে।
এবার সহ্য করতে না পেরে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,’বুঝলাম তুমি বিয়ে করবেনা।এরকম ধীরে সুস্থে যাবার কি আছে?তৃনা আপুর হবু শ্বশুর বাড়ির লোকদের সাথে কথা না বলাটা অভদ্রতা।তাদের মেয়েকে বিয়ে করবে কি করবেনা সেটা পরে আসছে।বড়দের কমন সম্মানটুকু তো দিবা।শুনছো তুমি?’

শাওন মোড়ে গাড়ী ঢুকিয়ে বললো,’এমন তো নয় যে আর কখনও তারা আমার বাসায় আসবেনা।আরও অনেকবার আসবে।আমি ঠিক সময়ে ওখানে যাওয়া মানে কাবিন নামায় সাইন করে দেওয়া।তাই যত ধীরে সুস্থে ড্রাইভ করছি।তুমিও ধীরে সুস্থে বাহিরের পরিবেশটা দেখো।কি সুন্দর রাতের ঢাকা।শীতল মিষ্টি বাতাস।লোকজন নেই।পথ ফাঁকা,তুমি আর আমি।গান চলছে রোমান্টিক।টেক ইউর টাইম’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘আমার টাইম লাগবেনা।তুমি গাড়ীর স্পীড বাড়াও।নাহলে কথা বলবোনা একদম।’
শাওন কি আর করবে।রশ্নিকে ভালোমতন চেনে সে।সত্যি সত্যি কথা বলা বন্ধ করে দিতে পারে সে।
বাধ্য হয়েই গাড়ীর গতি বাড়িয়ে দিলো শাওন।বাসায় ফিরে কলিংবেল চাপতে হয়নি।দরজা খোলাই ছিল।ভেতরে মানুষে গিজগিজ করছে।এত মানুষ দেখতে ভালো লাগেনা শাওনের।যেটার ভয়ে শামুকের মতন আসছিল অবশেষে সেটার দেখা পেতেই হলো।সোফায় বসে আছেন তৃনা আপুর হবু শ্বশুর শাশুড়ি।তার সঙ্গে বাবাও আছেন।

-‘বাবা আমাকে দেখে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে ছিলেন তাও কিছুই বললেন না।দেরি হলো কেন এই টাইপের কোনো প্রশ্নই মুখে আনলেন না।রীতিমত সালাম দিয়ে কেটে পড়লাম আমি।সোজা নিজের রুমে।রুমে এসে দেখি এলাহি কান্ড।যত বাচ্চাবুচ্চা ছিল সব মনে হয় আমার রুমে বাসা পেতেছে।মেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে।আরিফার জন্য এমনটা হলো।সে নিজেও এই বাঁদর দলের প্রধান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।’

শাওনের এক ধমকে যে বাচ্চা যেখানে ছিল ওখানে থাকা অবস্থায় আটকে গেছে।এক বাচ্চা সেসময়ে বেডের কিণারায় ডিকবাজি দিয়ে গেছিলো, বেশি কিণারায় বলে দুম করে নিচেও পড়ে গেছে এখন।শাওন ভেতরে ঢুকে বললো,’আমার রুমে ঢুকার পারমিশন কে দিছে তোমাদের?আরিফা তোমায় এর শাস্তি পেতে হবে।বের হও ওদের নিয়ে।’
আরিফা মুখ বাঁকিয়ে পিঁপড়ার মতন হেঁটে চলে গেছে।কোনো সাড়া শব্দ না করে।শাওন তার বিছানার দিকে তাকিয়ে বললো,’আজ আমায় ফ্লোরে শুতে হবে।কি করেছে রুমের!!”

রেগে বালিশ নিয়ে ছুঁড়ে মারতে গিয়ে শাওন দেখলো বাবা এসেছে রুমে।বালিশটা আগের জায়গায় রেখে তাকিয়ে রইলো সে।বাবা মুখটা ফুলিয়ে বললেন,’ফ্রেশ হয়ে এসো জলদি’
শাওন মাথা নাড়ালো।রশ্নি ফিসফিস করে বললো,’যেটার ভয় পেয়েছো সেটা হতে যাচ্ছে।হেহে।আমি জিতলাম’

শাওন ফ্রেশ হয়ে বেগুনী টি -শার্ট একটা পরে বের হলো রুম থেকে।বের হতেই মুখোমুখি হলে তৃনার হবু ননদ রামিসার সঙ্গে।ক্রিম কালারের থ্রি পিস আর খোলা চুল।যে কেউ পছন্দ করবে এক দেখাতেই।তাছাড়া গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে।শিক্ষিত মেয়ে।সব কাজে দক্ষ।
একহাতে সংসার আর চাকরি দুটোই সামলাতে পারবে।এর আগে অনেক প্রস্তাব তারা ডিক্লাইন করে এসেছে।মনের মতন পাত্রের খোঁজে শাওনকে তাদের মনে ধরলো।

কিন্তু শাওনের চোখটা একবারের জন্যও আটকে গেলোনা।সে চোখ নামিয়ে চলে গেছে বাবার কাছে।রামিসা এক দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়া দেখলো।তার বাবা মা তাকে বলেছে শাওনের সঙ্গে বিয়ের কথা আজই বলা হবে।তাই তো তার সবচেয়ে প্রিয় রঙ পরে এসেছে।ইচ্ছে ছিল শাওনের প্রিয় রঙ পরে আসার।কিন্তু জানা হলোনা তার প্রিয় রঙটা কি।প্রথম যেদিন তৃনার সঙ্গে শাওনকে সে দেখেছিলো ঠিক সেদিনই ভালো লেগেছিলো ওকে।ভদ্র ছেলেদের প্রতি আলাদা আকর্ষণ থাকে।হয়ত সেই আকর্ষণ রামিসার মনেও সৃষ্টি হলো।লোভ লাগলো।শাওনের লোভ।
তার লোভের কথা জানালো মাকে।মা জানালো বাবাকে।এভাবেই আজ কথা এতদূর আসলো।

শাওন বাবার পাশে বসলো গিয়ে।মা এত রাতে নাস্তা তৈরি করছেন।ডিনার করাবেন বারোটায়।সবাইকেনদেখে মনে হয় সবেমাত্রই এসেছে।তার মানে বাবা আমাকে জলদি আনানোর জন্য মিথ্যে বলেছিল?
বাবার মুখে হাসি দেখেই বুঝে গেলো শাওন।নিজের কপালে নিজেরই চড় মারতে ইচ্ছে করছে এখন।রামিসাকে শাওনের সামনে বরাবর বসতে দিলো ওর মা।রামিসার বাবা বড়ই গম্ভীর স্বভাবের মানুষ।কথা বললে এক লাইন বলেন।পরের লাইন বলতে অনেক সময় লাগিয়ে দেন তিনি।তার পরেও আজ তার কি হলো কে জানে।

শাওন কেমন আছে,কাজ কেমন চলছে এরুপ করে প্রায় পাঁচ/ছটা প্রশ্ন তিনি করে ফেলেছেন।তার ছেলে রামিম তো অবাক।বাবা এত কথা বলতে জানে??অবশ্য তাকে বলা হয়নি তার বোনের সঙ্গে আজ শাওনের বিয়ের কথা হবে।জনাব এনামুল অবশেষে ছেড়ে কাশলেন।বলেই ফেললেন রামিসা আর শাওনকে একান্তে কথা বলা উচিত।বললেন না ঠিক কি কারণে।তার মতে সকলেই জানেন আজ তাদের বিয়ের কথা হবে।শাওন ও জানে।বাবার দিকে তাকালো সে।বাবা হেসে হেসে মনে হলো ধাক্কা মারলেন তার হাসি দিয়ে।বাধ্য হয়ে শাওন তার রুমে এসেছে তাও রামিসাকে সাথে নিয়ে।রুমের শেষ প্রান্তে গিয়ে বিন ব্যাগে ধপাস করে বসে গেলো সে।
রামিসা বিছানায় বসে কানের পেছনে অবাধ্য চুলগুলোকে গুজে দিয়েছে।সে কিছু বলতে যাবার আগেই শাওন বললো,’তোমার পছন্দের কেউ আছে?’

-‘নাহ’
-“তার মানে আমাকেও তোমার পছন্দ না?’
-“না সেটা নয়।’
-“তাহলে কি?আমি তো তোমায় আমার কথাই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি কি বুঝলে?আমাকে পছন্দ না করলে বিয়ে করলে তো সুখী হবেনা’
রামিসা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বললো,’আপনি ভুল ভাবছেন।আমি তো বলতে চেয়েছিলাম আমি অন্য কাউকে পছন্দ করিনা’
-‘তার মানে আমাকে ছাড়া তুমি আর কাউকে পছন্দ করোনা।তোমার মা বাবাকেও না।আমার বোনকেও না?তোমার ভাইয়াকেও না?’
-‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?অগ্রিম ভাবা ঠিক না’
-“আমি এভাবেই কথা বলি।আচ্ছা ছাড়ো ওসব।তোমার কি ভালো লাগে?’
-‘আমার ঘুমাতে ভালো লাগে’

-‘তোমাকে একটা ঘটনা শুনাই।মন দিয়ে শুনবে।প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো সবার শেষে।তো একবার কি হয়েছিলো!ঘটনাটা এক বছর আগের।ধানমন্ডিতে একটা পরিবার থাকতো।পরিবার বলতে একটা কাপল।স্বামী -স্ত্রী। স্বামীটা সারাদিন অফিসে থাকত।স্ত্রী কাজ করে সে ঘুমিয়ে পড়ত।সারাটা সময় ধরে শুধু ঘুমাতো।
কি আর করবে বলো।কাজ তো নেই।সেও তোমার মতোই ঘুমাতে ভালোবাসতো।তারপর একদিন কি হয়েছিলো জানো?সিলিন্ডার লিক হলো।গ্যাস ছড়িয়ে এট লাস্টে বুমমমমমমম।বলোতো কোন রুম?’

-‘রান্নাঘর’
-‘রং!বেড রুম ব্লাস্ট হলো।’
-“সিলিন্ডার তো রান্নাঘরে থাকে’
-“ওটাই তো!সে ঘুমের ঘোরে ডেলিভারি ম্যান থেকে সিলিন্ডার নিয়ে বেড রুমে রেখে দিয়েছিলো যেটা কিনা অলরেডি লিক হওয়া ছিল।তারপর আর কি বুমমম হয়ে পুরো বেডরুম উড়ে গেলো সাথে ঐ স্ত্রীটাও উড়ে গেলো।আহারে!!ঐ কেসটা আমি নিজে দেখতে গিয়েছিলাম।ফ্লোর পর্যন্ত ফুটা হয়ে ছিলো।কতটা মারাত্মক! ভাবতে পারো।ঘুম ভালো জিনিস।তবে এটাকে কন্ট্রোল করে রাখতে হয়।এরকম নেশাদ্রব্যের মতন সেবন করলে এমনটাই হবে।’
রামিসার কপাল ঘেমে গেছে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।শাওন এমন ভাবে কথাগুলো বললো যেন জলন্ত উদাহরণ সে দিচ্ছে।এটা মিথ্যে হতে পারেনা।

রশ্নি কপাল চাপড়াচ্ছে।এমন করে শাওন প্রতিবার বিয়ে ভাঙ্গে।
শাওন পায়ের উপর পা তুলে বললো,’তাহলে ভাবো তোমায় বিয়ে করলে আমার আই মিন আমাদের কি হাল হবে।আমি তো মরবোনা।মরবে তুমি।কারণ আমি সকালে বেরুলে বাসায় ফিরি রাত দশটায়’
রামিসা কাঁপা গলায় বললো,’আমরা তো জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকবো তাইনা?আপনার বাবা,মা,আরিফার সঙ্গে একসাথে।’

-“না তো।কে বললো?আমার একবার এক জায়গায় ট্রান্সফার হয়।এরপর হয়ত খুলনা/বরিশাল/রাজশাহীতে হতে পারে।সাথে করে তো তোমায় নিয়ে যাব।আর যাই হোক তুমি তখন আমার স্ত্রী থাকবে’
-‘তাহলে এখন কি হবে?আই রিয়েলি লাইক ইউ।’
-‘আগামী পাঁচ/ ছয়দিন ধরে দিনরাত ২৪ঘন্টায় শুধু চার ঘন্টা ঘুমাবে।বাকি সময় চোখে টেপ মেরে বসে থাকবে। ঐ যে টম এন্ড জেরিতে টম টেপ লাগিয়েছিলো ঠিক সেরকম।
পারবে?’

রামিসা ভূত দেখেছে মনে হয়।নাকি অন্য কিছু।হয়তবা সে পরীক্ষায় ফেল হবার কথা জেনে গেছে ফলাফল প্রকাশের আগেই।ঠিকসেরকম মুখ করে বসে আছে।শাওন হাত নাড়িয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো পারবে কিনা।রামিসার কপাল এই মুছে তো এই ভিজে যায় ঘামে।হাতের উল্টো পিঠ ও ভেজে গেছে মুছতে মুছতে।শেষে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।আমতা আমতা করে শুধু বললো পারবে।তারপর ছুটে চলে গেলো রুম থেকে।ওর ছুটে যাওয়া দেখে শাওনের বেশ হাসি পেলো।হাসতে হাসতে রশ্নির দিকে তাকিয়ে বললো,’রেডি হও।তোমাকে খুব শীঘ্রই বিয়ে করবো আমি’
রশ্নি গম্ভীর গলায় বললো,’তা হয়না’

শাওন পাত্তা দিলো না।রশ্নি মারা যাবার পর থেকে ঠিক যতবার সে বিয়ের কথা বলেছে ততবারই রশ্নি এই একই কথা বলে আসছে।তা হয়না শাওন।তা হয়না।হতে চাইলে সব হয়।
শাওনের বাবা রেগে গেলেন রামিসা যখন ফিসফিস করে তার বাবা মাকে কিসব বললো তা দেখে।উনারা চোখ বড় করে শুধু শুনে গেলেন।কিছু বলছেন না দেখে তিনি নিজেই জিজ্ঞেস করলেন সমস্যা টা কি।
রামিসার বাবা উত্তরে বললেন,’ও কিছুনা।রামিসার সঙ্গে শাওন মজা করেছে।আমার মেয়ে বড়ই সহজ সরল তো এসব বুঝেনা।ভয় পেয়ে গেছে।তা শাওনকে ডাকুন।বিয়ের কথাও তো পাকা করতে হবে নাকি??’
শাওনের বাবা সোজা গেলেন শাওনকে নিয়ে আসতে।খুশি আর ধরেনা তার।রামিসা যখন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিলো তিনি তো একেবারে ভয়ে চুপসে গিয়েছিলেন

এখন কোনো ভয় নেই।শাওনের মুখ দিয়ে হ্যাঁ বের করতে হবে তাহলে শান্তি।
শাওন তার ফুলগাছগুলোর মধ্যে যেসব পোকামাকড় যুক্ত পাতা আছে সেগুলোকে কেচি দিয়ে কেটে কেটে নিচে ফেলছে।অবসরে তার এই ছোট্ট বাগান সে নিজেই সামলায়।রেদোয়ানের কেস শেষ হলে তার বাসার বিদেশী ফুল কটা নিয়ে আসা যাবে।তার তো একূল ওকূল দেখার কেউ নেই।শুধু শুধু ফুলগুলো পড়ে থেকে মরবে কেন?তার চেয়ে বরং আমি তাদের যত্ন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবো।ঠিক আমার রশ্নির মত করে।’

-‘শাওন!’
শাওন পেছনে তাকিয়ে বাবাকে দেখে মনে করলো উনারা চলে গেছেন।বাবা বুঝি এখন ঝাড়তে এসেছে।মুখে হাসি ফুটে এগিয়ে গেলো সে।মাথায় ছিল হলুদ রঙের ক্যাপ।সেটাকে বিছানায় ফেলে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাবা ওকে সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন,’আমি অনেক খুশি শাওন।উনারা বিয়েতে রাজি।এবার তুুই হ্যাঁ বলে দে তাহলে সব ওকে’
শাওনের মনে হলো কারেন্টের শক লেগেছে।এত ভালো করে ভয় দেখিয়ে কিনা বিয়েই পাকা হয়ে গেলো।বাবা ছলছল চোখে শাওনের মুখ থেকে হ্যাঁ শোনার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চেয়ে আছেন।শাওন ঢোক গিললো।তার আর বুঝতে বাকি নেই আজ সব কিছুর রফাদফা হয়ে তারপর শেষ হবে।

-“বুঝলাম তোর লজ্জা করছে বাবার সামনে বলতে।ঠিক আছে, তোর বোনকে তো বলতে পারবি?এই তৃনা এদিকে আয় তো মা’
-‘বাবা শুনো।আমি এই বিয়ে করতে পারবোনা’
বাবা শাওনের হাত ছেড়ে দিলেন।নিশ্চুপ হয়ে আছেন তিনি।শাওন পাশে তাকিয়ে রশ্নিকে দেখতে পেলো।ওর থেকে চোখ হটিয়ে বাবার হাত সে নিজেই ধরলো এবার।শান্ত গলায় বললো,’আমি রশ্নিকে অনুভব করি বাবা।আমার পক্ষে ওকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না।আর তুমি তো জানোই আমি রশ্নির ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস?’

-‘তোমার এসব ভীমরতি এবার বন্ধ করো।অনেক হয়েছে।ফার্মগেটের কাছে একটা হসপিটালে আমার বন্ধুর ছেলে আছে।ভালো ডাক্তার।হসপিটালটা তুমি চিনো হয়ত।কাল সকালেই তুমি সেখানে যাবে।তোমার মানসিক চিকিৎসা দরকার।মন থেকে তোমার ঐ মেয়েটাকে বের করতে হবে।ডাক্তার দেখিয়ে এসে আমাকে বাবা বলে সম্বোধন করবে।তার আগে আমাকে মুখ দেখাবেনা।যে মেয়ে মারা গেছে তাকে নিয়ে এত কেন??বুঝলাম তাকে তুমি দেখতে পাও কিন্তু তাই বলে সব কিছুতে তাকে টানবে কি জন্যে?তোমাকে বুঝতে হবে তাকে তুমি দেখতে পেলেও তার সাথে বাস্তবের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।আমরা তাকে দেখিনা।একটা সাধারণ মানুষ তাকে দেখেনা।আমি আর কিছু শুনতে চাইনা।যা বললাম তুমি করবে।শুভ রাত্রি ‘

বাবা চলে গেলেন।শাওন পাশে তাকিয়ে রশ্নিকে দেখতে পেলোনা।রাগ করে কই গেছে কে জানে।
-‘তবে বাবার কথায় তার রাগ হবার কথা নয়।তার রাগ হয়েছে আমি বিয়েতে মত দিলাম না সে জন্যে।কারণ সবার মতন সেও চায় আমি যেন এবার বিয়ে করে ফেলি।তা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।’

পরেরদিন সকাল সকাল তৈরি হয়ে দ্রুত গতিতে পায়ে হেঁটে মেধা হাজির হসপিটালে।হাতের প্লাস্টার চেঞ্জ করবে তাই।ডাক্তার নাফিস তার হাতের প্লাস্টারটা চেঞ্জ করবেন।এটা একজন নার্স ও পারবে।কিন্তু তিনি নিজেই করছেন কারণ তার মেয়ে আর মেধা ক্লাসমেট ছিল।একসাথে অনেক জায়গায় যাওয়া হয়েছে দুই পরিবারের।বাসাও কাছে।
চেনা অনেক দিনের।কাছের মানুষদের নিজের হাতে সেবা করার আনন্দ অন্য দিকে।শাওন ও এসেছিলো একই হসপিটালে।বাবা যে ডাক্তার দেখাতে বলেছে সে আজ সকালেই সুইজারল্যান্ড চলে গেছে।তাই বাবার কথা রাখতে অন্য একটা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো তাকে।এই ডাক্তারের নাম তৌকিরউল্লাহ।তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট(Psychiatrist)

শাওনকে এক দেখাতেই চিনে ফেললেন।কদিন পরেই ওকে টিভিতে দেখা যায় এটাও বললেন।শাওন চুপ করে তার কথা শুনে যাচ্ছে।শাওনকে চেনেন এটার ব্যাখা শেষ করে অবশেষে তিনি বললেন,’তো বলো তোমার কি সমস্যা? সহজ ভাষায় বলবে’
-‘আমার সমস্যা নেই।আমি রশ্নিকে দেখতে পাই এটা বাকিরা সমস্যা মনে করে’
-“ওহ,রশ্নি।সে কে?’
-‘সে আমার গার্লফ্রেন্ড’
-‘ছিল?নাকি এখনও আছে’
-‘মারা গেছে।তবে আমি তাকে দেখতে পাই।এমন কি সে এখন আপনার এই রুমের জানালার ধারের ফুলদানিটা ছুঁয়ে দেখছে’

তৌকিরউল্লাহ নড়েচড়ে বসলেন।তারপর টাই ঠিক করে বললেন,’কবে থেকে তাকে দেখতে পাও?’
-“যেদিন সে মারা গেছে সেই রাতেই ওকে আমি আমার রুমে দেখতে পেয়েছি।তারপর থেকে সবসময় দেখি।’
-‘তুমি ওকে টাচ করতে পারো?’
-“হ্যাঁ’
-“কিরকম টাচ করতে পারো?’
শাওন চোখ তুলে তাকালো তৌকির উল্লাহর দিকে।তৌকির উল্লাহ বললেন,’ঠিক বুঝেছো।আমি ওসব টাচের কথাই জিজ্ঞেস করছি’
শাওন হালকা কেশে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো রশ্নি নেই।লজ্জা পেয়েছে।তৌকির উল্লাহ এখনও তাকিয়ে আছেন দেখে শাওন ঠিক হয়ে বসে বললো,’নাহ আসলে আমি ওকে এখনও সেরকম করে টাচ করিনি’

-“করিনি বলতে করতে চাও নি?’
-‘চেয়েছি।কিন্তু পারিনি।’
-“সে রাজি না?’
-“না আসলে সেটা নয়।আমি ওকে টাচ করতে গেলেই ও চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে যায়।’
-‘তারপর কখন আসে?’
-“যখন আমি ওকে টাচ করার সব ভাবনা মাথা থেকে ছাড়িয়ে ফেলি ঠিক তখনই ওকে পাশে দেখতে পাই’
-‘বুঝলাম।কঠিন প্যাঁচ!আচ্ছা তুমি ছাড়া আর কেউ রশ্নিকে দেখতে পেয়েছে?মানে ধরো ওর ছায়া অথবা ও কিছু ধরলো সেটাকে শূন্যে দেখতে পাওয়া??’
-‘আমি দেখেছি স্যার।আমি আমি!’

শাওন মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেধা দাঁড়িয়ে আছে।শাওনকে এই কেবিনে ঢুকতে দেখে মিনিট দশেক পর কান পেতে ছিল শুনবে বলে।আগের কিছুই শোনেনি শুধু লাস্টের লাইনটা সে শুনতে পেলো।শাওন চোখ বড় করে বললো,’তুমি এখানে কি করো?আমার ব্যাক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবেনা একদম।’
তৌকিরউল্লাহ মেধাকে বসতে বললেন।মেধাকে কাল টিভিতে দেখেছিলেন সেটাও বললেন তারপর উপহাস করে বললেন,’আজ দেখি সব সেলিব্রেটি আমার দরজায়।আচ্ছা ওসব পরে হবে।তুমি বলো কি দেখেছিলে?’
-‘স্যার ওর কথায় পাত্তা দিবেননা।ও ভুলভাল কথা বলে।ওর কথার কোনো লজিক নাই।’

-‘আমি দেখেছিলাম উনার শার্টের বোতাম আপনা আপনি লেগে যাচ্ছে’
তৌকির উল্লাহ চোখ বড় করে ফেললেন।শাওন নিজেও থেমে গেলো মেধার কথা শুনে।
-‘আসলেই কি তাই?মেধা কি করে রশ্নিকে….’
-‘কি বলছো।আমি তো ভাবলাম শাওনের হয়ত রোগ তাই দেখছে।কিন্তু তুমি কেন দেখলে তা তো বুঝলাম না।তুমি কি কোনোভাবে রশ্নিকে চেনো?’
-‘আমি এই নাম সবার আগে উনার মুখে শুনেছিলাম তাছাড়া আমার জীবনে এই নামের কারোর সাথে পরিচিত হইনি’
-‘বিষয়টা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে আসছে।আমি বুঝছিনা ঠিক কি চিকিৎসা দরকার।যাই হোক শাওন, তুমি রশ্নিকে এখন ডাকতে পারবে?আমি কিছু দেখতে চাই’

শাওন রশ্নিকে ডাকলো।মিনিট দুয়েক পর রশ্নি শাওনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।মেধা রুমের কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’আমাকে কাছে আসতে বলবেন না।উনার সঙ্গে ভূত আছে।আমি দূর থেকেই যা বলার বলবো’
তৌকির উল্লাহ হাত ভাঁজ করে বললেন,’শাওন তুমি রশ্নিকে বলো এই কলমটার মুখ খুলতে’
রশ্নি কলমটা হাতে নিলো তারপর মুখ খুললো।তিনি বললেন,’কি হলো?কিছু দেখলে মেধা?’
-‘মেধা তোতলাতে তোতলাতে বললো,’শ্যাওলা স্যার থুক্কু আই মিন শাওন স্যারের ভূতুড়ে প্রেমিকা কলমের মুখ খুলে আবার লাগিয়ে রেখে দিয়েছে।যা দেখলাম সব শূন্যের উপরে।’
শাওন মাথা তুলে বললো,’সি ইজ রাইট’

তৌকির উল্লাহ গ্লাস থেকে ঢাকনা সরিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নিলেন।মেধার ও গলা শুকিয়ে গেছে।তার মনে হচ্ছে সে মরে যাবে আর নয়ত কঠিন রোগ হয়েছে তার। শাওনের মতন।
ভূতটাকে সে দেখতে পায়, শাওন দেখতে পায় আর কেউ দেখেনা তার মানে সেও একদিন পাগল হয়ে যাবে শাওনের মতন।
তৌকির উল্লাহ টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু এই নিয়ে ছ’টা বের করে কপাল মুছলেন।শেষেরটা হাতে নিয়ে মেধাকে ডাকলেন শাওনের পাশে এসে বসতে।

মেধা এক পা এক পা করে এসে হাজির হয়েছে।কোনো মতে চেয়ার টেনে বসেও পড়েছে সে।তৌকির উল্লাহ বললেন,’তো বলো শাওন তুমি রশ্নিকে কিরকম দেখো?মানে তাকে কি একজন মৃত ব্যাক্তি মনে হয় নাকি স্বাভাবিক মানুষ?সাদা সাদা,অথবা অতিমাত্রায় কালো।হলদে ভাব ইত্যাদি।যেটা দেখতে অস্বাভাবিক মনে হয় আর কি।’
-‘একদমই না।তাকে আমি আগের রশ্নির মতনই দেখি।কোনো খুঁত নেই তাতে’
মেধা ঢোক গিলে বললো,’অবজেকশান মাই লর্ড থুক্কু শাওন স্যারের ডাক্তার!আমার একটা কথা আছে,আমি তো উনার ভূতুড়ে প্রেমিকাকে দেখি না।শুধু সে যা যা করে সেগুলো দেখি।কলম ধরলে শূন্যের উপর কলম দেখি।তার হাত তো দেখিনা’

তৌকিরউল্লাহ নড়েচড়ে বসলেন।কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন এটা কেন হয়।
শাওন ও চিন্তায় পড়লো।রশ্নি কি করে না করে সেসব মেধা দেখে কিন্তু রশ্নিকেই সে দেখেনা।অনেক কঠিন হয়ে গেলো প্যাঁচটা।তৌকির উল্লাহ রহস্যর সমাধান করতে পারলেন না।প্রতিউত্তরে বললেন তিনি একজন ডাক্তার।সিআইডি নন।ঔষুধ লিখে দিলেন।কড়া ডোজের।শুধু ঘুমাতে হবে তার প্রথম শর্ত।শাওন মনে মনে অনেক হাসলো।সে সারাদিন কাজ করে ঘুমানের সময়টুকু বের করতে পারেনা আর এই ডাক্তার বলে কিনা কাজ ফেলে ঘুমাতে।এমন করলে তার চাকরিটা করবে কে?
মেধা বেরিয়ে দেখলো শাওন রশ্নির সাথে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে।দৃশ্যটা ওর মাথার উপর দিয়ে গেলো।কিছুই বুঝলোনা সে।

-‘এই ছেলেটা কি পাগল?তাহলে তো ঔষুধে কাজ হবার কথা না।এই যা দুপুর হয়ে গেলো!আমাকে তো রেডি হতে হবে’
মেধা ছুটে গেলো অফিসের দিকে।সেখানে এসে দেখলো সামিয়া ফিটফাট। একেবারে তন্নির ডুপ্লিকেট সেজে বসে আছে সে।মেধার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে এমনটা দেখে।সে চেয়েছিলো তন্নি সাজবে, তা আর হলো কই।
-‘এখন শেষ রক্ষা হলেই হয়।কিন্তু সামিয়ার উপর এত বড় দায়িত্ব মোটেও মানাচ্ছেনা।ওর জন্য আজকে প্রাণহানি ঘটে যেতে পারে।শাওন স্যার আমাকে পছন্দ করেননা বলে ওর মতন দূর্বল একজনকে দায়িত্বটা দিলো।এটা করে উনি নিজেরই ক্ষতি ডেকে এনেছেন।’

শাওন আজ অফিসে এসেছে বিকেলে।আসতেই মিডিয়ার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে তাকে।তারা সবাই স্বচক্ষে দেখতে চান তন্নি কি কি বলে সব কিছুর উত্তরে।
শাওন রাজি হলো।ডাকা হলো তন্নির সাজে সামিয়াকে।পরনে সাদা থ্রি পিস।লম্বা চুল।হাঁটু অবধি।মাথায় বড় ঘোমটা টানানো।হাতে এক ডজন চুড়ি।
সেখানে সামনে বিশ ত্রিশ জন সাংবাদিক বসে আছেন।শাওন একটা সোফায় আর তার সামনের সোফায় সামিয়া বসেছে তন্নি সেজে।শাওন বার তাকাচ্ছে ওর দিকে।কেন যেন সামিয়া মনে হচ্ছেনা।অনেকটা মেধার মতন লাগছে নাকটা একেবারে বলে দিচ্ছে এটা মেধা।

কিন্তু সে হবে কেন।সামিয়া তো হাল ছেড়ে দেবার মতন মেয়ে না।আর মেধা এত সাহস করবেনা।
নুহাশ ইশারা করলে প্রশ্ন করার জন্য।ইশারা করেই সে চলে গেলো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে।কে আসলো আর কে গেলো দেখতে হবে।
শাওন ঘুরে বসে বললো,’আপনি আশার বান্ধুবী?’
-‘জ্বী’
-‘আপনার আর আশার বন্ধুত্ব্ব কত দিনের?’
-‘পনেরো বছর’
-‘তাহলে তো খুব ভালো করে চেনেন।কখনও কি এখানে আসা হয়েছিলো?আই মিন আশার বাসায়।’
-‘না’
-‘ আশার বিয়েতেও আসেননি?মানে বৌভাত তো ছেলেদের বাসায় হয়’
-‘না আসিনি’

আজকে শাওনদের টিমের সবার পোশাক সাদা ছিলো।এমনকি তন্নি সেজে যে বসে আছে সেও সাদা পোশাকে।
দূর থেকে সাদা পোশাকে একজন এগিয়ে আসছে শাওনের দিকে।হাত পকেটে ঢুকিয়ে কিছু একটা বের করতে যাচ্ছে।
তন্নি সেজে আজ সামিয়া নয় বরং মেধা এসেছে।সামিয়াকে ওয়াশরুমে আটকে সঠিক সময়ে সাজ বদলে এসে পড়েছে।
সে দেখে ফেললো সাদা পোশাকের একজন হনহনিয়ে ভীড়ের মাঝ থেকে ঠিক এদিকেই আসছে।মেধা তার কোমড়ে হাত দিলো গান বের করবে বলে ঠিক সেসময়ে লোকটা অতর্কিত ভাবে শুট করে বসলো।একেবারে শাওনের দিকে।
শাওন ছিঁটকে সরে গেলো সোফা থেকে।হাতের পাশ দিয়ে গুলি লেগেছে তার।মেধা উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার পা বরাবর শুট করে দিলো ততক্ষণে।হইচই লেগে গেছে সেখানে।সব সাংবাদিক ছোটাছুটি করছে।মেধা মাথা থেকে লম্বা নকল চুল খুলে ফেলে শাওনের কাছে এসে নিচে বসে বললো,’স্যার আপনি ঠিক আছেন?’

-‘তুমি!!তোমাকে এখানে আসতে মানা করছিলাম না আমি?’
শাওন ব্যাথায় হাত নাড়াচ্ছে অনবরত।রায়হান ছুটে এসে ওকে সোফায় উঠিয়ে বসালো।মেধা সামনে তাকিয়ে আরও পাঁচ ছয়জনকে দেখতে পেলো যারা এদিকেই আসছে।সব সেট করে তারা আজ হামলা করতে এসেছে বোঝাই যাচ্ছে।তাদের টার্গেট সব অফিসারকে আজ শেষ করে দেওয়া।
মেধাকে বাদে বাকি সবার উপর এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষন শুরু করে দিয়েছে তারা।শাওন আর রায়হান গান বের করে পিলারের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।আশ্চর্য হয়ে গেছে শাওন।কারণ লোকগুলো বাকি সবাইকে শুট করলেও মেধাকে ভুলেও শুট করছেনা।

মেধা গান ধরে এক এক করে গুলি করে যাচ্ছে তাও কেউ পাল্টা ওকে শুট করতে আসছেনা।শাওন তার হাতের গান নামিয়ে মেধার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।মেধা সবাইকে শুট করে তারপর থামলো।তার মনে পড়ে গেলো কেউ তাকে শুট করেনি অথচ বাকিদের করেছে এটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ফিরে শাওনের দিকে তাকালো সে।শাওন এভাবে তাকিয়ে আছে দেখে ওখান থেকে সরে গেলো মেধা।শাওনের হাত ধরে রায়হান ঐ জায়গা থেকে সরিয়ে আনলো। ডাক্তার নার্স মিলে শাওনকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।শাওন আর হাত নাড়ছেনা।তার মাথায় ঘুরছে কেন ওরা মেধাকে রেখে বাকিদের শুট করলো।নিতুকেও শুট করেছে।তাহলে মেধার সঙ্গে তাদের কিসের মিত্রতা??’

শাওনকে রেখে রায়হান,সাজিদ,মিলন আবারও আগের জায়গায় এসেছে সব দেখতে।সবাইকে মেধা হাতে আর পায়ে গুলি করেছে।মেধা এখন অফিসের দোতলায় এসেছে তন্নির সাজটা বদলাতে।গলা থেকে সিলভারের লকেটটা খুলে নিজের চুলগুলোকে পিঠে ছেড়ে দিলো সে।মেকআপ বক্স থেকে মেকআপ রিমোভাল ওয়াইপস্ নিতে গিয়েই দেখলো ঐ টিস্যুতে লেখা আছে,’আমার গোল্ডের ডিম পাড়া হাঁসকে কি করে মারার নির্দেশ দিই?আমার পক্ষে তা একেবারেই সম্ভব না’

মেধা টিস্যুটা ছুঁড়ে মারতে গিয়ে শাওনকে দেখতে পেলো দরজার কাছে।হাতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে এসেছে।
শাওন ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ফেললো।মেধা বেশ ভালো মতন বুঝে গেছে শাওন এখানে কেন এসেছে।ও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শাওন তেড়ে এসে বললো,’আমি জানতে চাই ওরা তোমাকে বাদ দিয়ে বাকি সবার উপর কেন আক্রমণ করেছে?তোমাকে একবারের জন্যও গুলি করেনি কেন?অথচ তুমি তাদের শুট করেছো তাও তারা ভুলবশতও তোমার দিকে গুলি ছোড়েনি।এর মানে বোঝাও আমাকে’

সঞ্চারিণী পর্ব ১০+১১+১২

মেধা দাঁত কেলিয়ে টেবিলের দঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’যদি বলি আমিও খুনির দলের একজন সদস্য।’
শাওন মেধার যে হাতটা এতদিন প্লাস্টারে বাঁধা ছিল সেটা চেপে ধরে বললো,’আমি মজা করার মুডে নেই মিস মেধা’
মেধা চোখ মুখ খিঁচিয়ে নড়ে উঠলো।তন্নি সাজতে গিয়ে ডাক্তারের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে তাকে প্লাস্টার খুলতে হয়েছিলো যাতে কেউ চিনতে না পারে।ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠেছে সে।শাওন খুব শক্ত করে ধরেছে ওর হাতটা।
শেষে ব্যাথার সঙ্গে না পেরে হেসে দিয়ে মেধা বললো,’আপনার যেটা মনে হয় আমি ঠিক সেটা।’
-‘শোনো!!কথা ঘুরাবেনা।আমাকে সোজা উত্তর দাও।একজন অফিসার হয়ে আমাকে বাধ্য করবা না তোমাকে আরও টর্চার করতে।তুমি আসামি নও যে আমি এখন তোমাকে টর্চার করে সত্যিটা বের করবো’
-‘প্রশ্নর উত্তর আমার জানা নেই।ওরা কেউই মারা যায়নি।আপনি চাইলে তাদের জিজ্ঞেস করতে পারেন।অবশ্য আমিও জিজ্ঞেস করবো আমি তাদের এত প্রিয় কেন’

-‘জিজ্ঞেস তো করবোই।ওসব পরে হবে।কিন্তু মাথায় একটা কথা ঢুকাতে পারছিনা কিছুতেই।
যে মেয়ে হাতে গান নিয়ে থরথর করে কাঁপছিল কদিন আগে। সে মেয়েটা কিনা আজ দুহাতে শুট করে সবাইকে সেভ করেছে একা দাঁড়িয়ে থেকে?আমি চোখের পলক ফেলতে পারছিলাম না।তাছাড়া সামিয়াকে ওয়াশরুমে আটকে তুমি নিজে এসেছো পরিস্থিতি সামাল দিতে।মানে তোমার বিশ্বাস ছিল তুমি একা হাতে সব করতে পারবে।তাহলে সেদিন ভীতু হবার নাটক কেন?শুধু সেদিননা।তুমি প্রথমদিন থেকেই একই নাটক করে এসেছো।

তুমি কি আসলেই ভীতু নাকি অন্য কিছু আছে এর পেছনে?
তখন যে দ্রুত গতির কাজ করা একটা মেয়েকে দেখলাম সে কি আদৌ মেধা ছিল নাকি অন্য কেউ?আচ্ছা! তোমার মধ্যে এত রহস্য কেন?’
মেধা মুখ এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বললো,’ঐ রহস্যটাকে আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে’

সঞ্চারিণী পর্ব ১৬+১৭+১৮